সদ্গতি

(প্রথম পর্ব)

পরপর দুই রাত ঘুমের মধ্যে আব্বাকে দেখে কেঁদে উঠলাম।
প্রথম স্বপ্নটা ছিল আমার খুব পরিচিত—এই স্বপ্নটা কিশোর বয়সে বা এমনকি বিশ-পেরোনো সময়টাতেও অনেকবার দেখেছি। প্রতিবারই দেখতে গিয়ে নতুন করে বুকে ব্যথা লাগে; সেই কষ্টটাও বুঝি পরিচিত। দেখলাম, আব্বা আমাকে না নিয়ে বাজারে চলে গেছে। একটু আগেই বুয়া থলি বের করছিল, আম্মা বাজারের ফর্দ লিখছিল, আমি তাড়াতাড়ি করে হাফহাতা শার্টের বোতাম লাগাচ্ছিলাম। বাইরে রোদ চড়ছিল। আর দেরি হলে মাছ পাওয়া যাবে না—কেউ বলছিল। দেরি করা যাবে না। দেরি করলে যদি আব্বা আমার কথা ভুলে যায়! বুক ধুকপুক। ডান পায়ের চপ্পল বাঁ পায়ে, আর বাঁ পায়েরটা ডান পায়ে। আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। ভোঁ-দৌড়। যদি আব্বা আমাকে না নিয়েই চলে যায়! দৌড়ে দরজার কাছ পর্যন্ত গেলাম। তারপর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। এমনকি কেউ বলল না পর্যন্ত যে আব্বা আমাকে রেখেই চলে গেছে। বাসার বন্ধ সদর দরজার সামনে একটা ছোট মানুষ হয়ে নিজেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বপ্নের মধ্যেই আমার বুকের ভেতর থেকে কান্না উথলে উঠল।

তারপর দ্বিতীয় রাত। দ্বিতীয় রাতের আমি স্বপ্নের মধ্যে অনেক বড় হয়ে গেছি; আব্বা বুড়ো হয়ে গেছে। আব্বার মনে বুঝি মৃত্যুভয় ঢুকেছে। হুজুর দিয়ে পবিত্র কোরআন খতম দেওয়ানোর প্ল্যান করেছে আব্বা। আমাদের কলোনি বাসার ড্রয়িংরুমে ময়লাটে সাদা পাজামা আর তার চেয়ে খানিকটা ফরসা পাঞ্জাবি পরা শীর্ণকায় এক হুজুরকে দেখলাম সোফায় বসে সেন্টার টেবিলের ওপর ধীরেসুস্থে গিলাফ খুলতে। হুজুরের সামনে চা, মিষ্টি আর পিরিচ দিয়ে ঢেকে রাখা পানির গেলাস। মুন্নিকে দেখলাম কৌতূহলী চোখ করে ড্রয়িংরুমের আশপাশে ঘুরঘুর করতে। আশ্চর্য, আমি বড় আর আব্বা বুড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু মুন্নি বড় হয়নি। সাইজে বড় একটা ঢলঢলে সবুজ ফ্রক পরে মুন্নি দেখি ড্রয়িংরুমের পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে—প্রায় ঝুলছে। আমাকে বলল, ভাইয়া, ওই হুজুরটা ক্যান আসছে? আব্বা কি মরে গেছে? মুন্নির কথা শুনে আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুমে ঢুকলাম, আর ওই নিমীলিত নয়নে কোরআন শরিফ পাঠরত হুজুর ভদ্রলোকের ওপর খেঁকিয়ে উঠলাম। উনাকে বললাম, এখানে কী চাই? বললাম, আর আসতে হবে না। স্বপ্নের মধ্যে শুনলাম কোথায় যেন সন্তর্পণে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। মনে হলো গেস্টরুমের সাদা চাদরঢাকা জাজিমের ওপর বসে আব্বা টিভি দেখছে; টিভি দেখতে দেখতে ঝিমাচ্ছে। আমরা হইহই করে প্যাসেজ পেরিয়ে আব্বার মৃত্যুসংবাদ নিয়ে গেস্টরুমের দরজা পর্যন্ত দৌড়ে গেলাম, তারপর আব্বাকে দেখে থেমে গেলাম। আব্বা ডান চোখ কচলে নিয়ে আমাদের একটু দেখে নিল—বিরক্তি নয়, বরং একটা স্মিতহাস্যই বুঝি দেখলাম আব্বার মুখে। বলল, কিরে? তোরা ঘুমাস না? তারপর আবার টিভিতে মন দিল। ওখানে একঘেয়ে সুরে কিছু একটা বাজছিল। পুরোনো ছবির গান বুঝি। মালা সিনহা? হবেও-বা।

পরপর দুই রাত এ রকম।
তৃতীয় দিন আব্বার মৃত্যুসংবাদ পেলাম।
তখন বেকারিতে সন্ধ্যার শিফট মাত্র শুরু হচ্ছিল। বেকিং সেকশনের পাঞ্জাবি ছেলেগুলো কাজ শেষ করেনি তখনো। এটা আমার সেকেন্ড জব ছিল—অফিসের কাজ শেষ করে সপ্তাহে তিন দিন এখানে কামলা দিতাম। সেই দিন জগৎ আর আমানদীপ কাজ থুয়ে গেঁজাচ্ছিল; দুজনে মিলে বুঝি কেটারিং সার্ভিস খুলবে। কত প্ল্যান-প্রোগ্রাম! আমার খুব বিরক্ত লাগছিল; প্রতি শুক্রবার রাতে ওদের ঢিলামি আমাকে ভোগায়। ওদের কাজ শেষ না হলে আমার কাজ শুরু হয় না। আহারে, ভাগ্যিস তখন হাত খালি ছিল। নইলে মুন্নিটা আমাকে ফোনে পেতই না রাত ১১টা ৫৫, অর্থাৎ মিডনাইট ব্রেকের আগে। পাবে কীভাবে? ব্রেকটাইম ছাড়া ফ্লোরে ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। ম্যানেজার সন্দীপ কুমারের কড়া বারণ।

মুন্নি নিষ্কম্প গলায় বলল, আব্বা স্কয়ার হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে। দুপুরে মুন্নিরা আব্বা-আম্মাকে নিয়ে সাইয়্যেদেনা কমিউনিটি সেন্টারে যাচ্ছিল—ওখানে মুন্নির চাচাতো ননদের এনগেজমেন্ট ছিল বুঝি। ড্রাইভ করছিল মুন্নির বর আলতাফ ভাই। গাড়িতেই আব্বার অ্যাটাকটা হয়। ফেরার সম্ভাবনা খুবই কম। আমি আর মিশু যেন খারাপ খবরের জন্য রেডি থাকি। ‘আর ভাইয়া, দোয়া পইড়ো। হ্যাঁ?’
আমি সব শুনলাম। ফোন হাতে নিয়ে বেকারির পিছের গাড়িবারান্দার বাউন্ডারিদেয়ালটা ঘেঁষে বসে পড়লাম। দেয়ালের সীমানা উপচে একটা ফুলের গাছ প্রায় আমার ব্রহ্মতালু পর্যন্ত নেমে এল। আমাকে বেকারিতে নামিয়ে দিতে এসে মিশু একদিন বলেছিল, এটা নাকি মাদাগাস্কার জ্যাসমিন। সেই দিনটা মনে আছে আমাদের। অফিসের কাজটা পাওয়ার আগে বেকারির কাজটা জুটেছিল আমার—সে আরও তিন বছর আগের কথা। আমি আর মিশু আমাদের জীবন-জীবিকার কাছে তত দিনে প্রায়-পরাস্ত। যত যা-ই হোক, ‘অড জব’ করব না—সেই পণ ভেঙে কল সেন্টারের কর্মচারী, ইলেকট্রনিকস দোকানের সেলসম্যান, ক্যাফের ওয়েটার, এমনকি হোটেলের ক্লিনার হওয়ার জন্য পর্যন্ত সিভি দাখিল করা শুরু করেছিলাম। মিশু তখন সপ্তাহে মাত্র বিশ ঘণ্টা কাজ করতে পারত। অ্যাকাউন্টিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী আমার বউ, শপিং মলের হেয়ার ড্রায়ার সেকশনে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকত; আর সম্ভাব্য খদ্দের পাকড়াও করে হাসিমুখে বলত, ‘দিস মাদার’স ডে, হাউ অ্যাবাউট আ সুপারসনিক ড্রায়ার ফর ইওর ওয়াইফ?’

তো তিন বছর আগে বেকারির চাকরির সেই প্রথম দিনে—মিশু শখের পোষা প্রাণীদের মতন ফুর্তিতে বাগবাগ হয়ে নিজে ড্রাইভ করে আমাকে ঠিক এই জ্যাসমিনগাছটার পাশে নামিয়ে দিয়েছিল। গাছটা তখন ফুলে ভর্তি। এত সুন্দর! আহা…নলের মুখে পাঁচটা পাপড়ি। সাদা ধবধবে। গন্ধে আমার মাথা ধরে যাচ্ছিল আর শ্বাসনালি প্রায় বুঁজে আসছিল। অ্যাজমা আমার পুরোনো ব্যারাম। মিশু সেদিকে খেয়াল না করেই বকবক করে যাচ্ছিল। কোনকালে পাড়ার বানিংসে টবের গাছ পাওয়া যাচ্ছিল বুঝি দশ ডলারে তিনটা করে—সেখানে গিয়ে সে অস্ট্রেলীয় দ্বীপের আদিম গুল্মলতা থেকে শুরু করে গাছের বেয়ে ওঠার সহায়ক নকল বাঁশের ধাড়া পর্যন্ত দেখে এসেছে। আমি বলেছিলাম, মিশু, গাড়িটা আরেকটু সামনে নিয়ে রাখলে হয় না? আমার তো অ্যাজমার টান উঠতেছে। মিশু অপরাধী চেহারা করেছিল বটে, পরক্ষণেই ঝিলিমিলি হেসে বলেছিল, অ্যাজমার অ্যাকটিং করতেছ না তো? মিশুকে আগে বহুবার এই গল্প বলেছি, একবার অ্যাজমার টান উঠেছিল যখন আমি অনেক ছোট। বছর পাঁচেক হবে তখন আমার বয়স। দিলীপ কাকা—আব্বার বন্ধু, পরে বিজনেস পার্টনার-ওনার ফ্যামিলিসহ আমাদের বাসায় এসেছিলেন, আর ততক্ষণে চলেও যাচ্ছিলেন। ওনার ছেলে রঙ্কুর সঙ্গে উঠানের শুকনা ঘাসের ওপর বেশ হুটাপাটি হয়েছিল সেদিন। তখনো মুন্নির জন্ম হয়নি। আমার প্রায়-একলা জীবনে একটা বিকেলের জন্য রঙ্কুর আসা যেন সারা মাসের দুরন্তপনা উশুল করার অজুহাত ছিল। মেহমান বিদায় নিচ্ছিল যখন, তখন হঠাৎ আমাকে হাঁপানিতে পেয়ে বসে। সে-ই প্রথম। আব্বা খেয়ালও করেনি। আম্মা ভেবেছিল আমি বুঝি মিথ্যামিথ্যি অভিনয় করছি; ভেবেছিল মুখ হাঁ করে মাটিতে লেপটে বসে পড়ে আদতে আমি রঙ্কুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। আহারে! আজকে যখন আব্বার হার্ট আজন্মের মতো অকেজো হয়ে যাওয়ার সংকেত দিল ধীরলয়ে ধুকধুক করে, আব্বা কীভাবে তড়পাল? কেউ কি বুঝল আব্বার কষ্ট, নাকি ভাবল যে আব্বা বুঝি আলতাফ ভাইয়ের আলগোছে বলা কোনো হাসির কথায় রিঅ্যাক্ট করে রোগীর মতো মিথ্যামিথ্যি, অ্যাবসার্ড, হাস্যকর মুখভঙ্গি করছে? পানচিনির দাওয়াত খেতে যাচ্ছিল আমার যে সুবেশ, সুসজ্জিত পরিবার, যে পরিবারের ছবির মতো সুন্দর একটা জুম্মাবারের শরিক আব্বা—কিংবা আমি—আর কখনো হব না, সেই পরিবার কি আজকের দিনটার কথা কোনো দিন ভুলতে পারবে? আমি যে কখনোই আব্বার হার্টের সমস্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখিনি, এমনকি ভালো বউমার মতন মিশুও যে কখনো আব্বার ওষুধ গুনে-গেঁথে-গুছিয়ে দেওয়ার রীতিবদ্ধ নাটক করেনি কিংবা অধিকার নিয়ে বলেনি ‘আব্বা, রেড মিট খাওয়া কিন্তু আপনার নিষেধ’—এসব অপরাধ, এসব দগদগে, অনপনেয় দাগ আমরা কি কখনো মুছতে পারব?

সন্দীপকে বলে আজ কাজের সময় ফোনটা চালু রাখলাম। ঘণ্টা দুয়েক পর মুন্নি আবার ফোন করল। সব শেষ? আমি কাঁদতে পারলাম না। ফোন কানে লাগিয়ে আবার বেকারির গাড়িবারান্দা পর্যন্ত গেলাম। ‘আম্মা…আম্মারে ফোনটা দে প্লিজ’। মাদাগাস্কার জ্যাসমিনগাছটাতে আজকে কোনো ফুল—এমনকি কুঁড়িও—নেই। এমনই নিরুপদ্রবভাবে আমার আব্বা আমাকে ছেড়ে গেলেন। ‘মুন্নি, তোর ভাবিকে তুইই ফোন দে। আমি এখন পারতেছি না রে’। আরও অর্ধেক শিফট বাকি।

জানি অন্য কেউ হলে এই অবস্থায় আর কাজ করত না। বাড়ি চলে যেত। অনির্দিষ্টকাল ছুটিতে থাকত। আমি বেকারির কাউকে কিছু তো বললামই না, এমনকি মিশুকেও কয়েকটা টেক্সট মেসেজের বেশি কিছু করতে পারলাম না। মিশু অস্থির হয়ে বারকতক ফোন করল। আমি ধরলাম না। পরের রবিবার সবুজদের বাসায় যাওয়ার প্ল্যান ছিল আমার আর মিশুর। সবুজের মেয়েটার জন্মদিন। সবুজকে লিখলাম যে আমাদের যাওয়া হবে না। আমার খুলির ভেতর মগজটা বুঝি ঠান্ডা হয়ে চুপসে গেছিল। অস্বাভাবিক শান্তভাবে আমি বেকিং ফ্লোর পরিষ্কার করলাম। ভূতগ্রস্তের মতো একা একা চব্বিশ-পঁচিশটা ধাতব বেকিং র‍্যাক সরালাম—সব কয়টার ওপর স্পিনাচ আর চিজ রোল থরে থরে ফুলে–ফেঁপে আছে—প্যাকিং ফ্লোরের ছেলেরা বাকিটা দেখবে। মেঝে ভ্যাকুয়াম করার পর ক্লিনিং লিকুইড দিয়ে ঘষে ঘষে বেঞ্চের তলা মুছলাম। কাজ করতে করতে হাত দিয়ে নিজের গাল-কপাল ছুঁয়ে দেখলাম—দরদর করে ঘামছি; কাঁদছি না। ম্যানেজার সন্দীপ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল। কাঁধে হাত রাখল আমার। ‘ইওর ওয়াইফ কল্ড। প্লিজ গো হোম। সো সরি ফর ইওর লস।’

ভাগ্যিস আমাদের গাড়িটা আমার সঙ্গে ছিল, নইলে মিশু হয়তো আমাকে খুঁজতে নিজেই ড্রাইভ করে চলে আসত। সেটা মোটেও ভালো হতো না। গাড়িটা বের করলাম; ড্রাইভ করে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেলাম। মেলবোর্নে শুক্রবার রাতের রাস্তা কেন সোমবার রাতের মতো সুনসান? এমন তো দেখিনি কখনো! টার্মিনালের কাছে গাড়ি পার্ক করে ঢুকলাম ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জে। বসে থাকলাম সারি সারি চেক-ইন কাউন্টারের সামনের বেঞ্চিগুলির একটাতে—এখানে দিনরাত গ্রীষ্ম-বর্ষা সকলই সমান শীত। জ্যাকেটটা গাড়িতে রেখে এসেছি। চারদিকে নম্বর লেখা সাইনবোর্ড আর ডিজিটাল স্ক্রিন। লম্বা করিডরের ওপর দিয়ে শত শত চাকাওয়ালা ব্যাগ যাচ্ছে, ব্যাগসহ ট্রলি যাচ্ছে, মানুষও—যেন পা নেই, আছে চাকা। এমিরেটসের টিপটপ এয়ারহোস্টেস মেয়েগুলোকে দেখে কেউ কেউ সসম্মানে লাইন ছেড়ে দাঁড়াল। একটা ধাতব শৈত্য অনুভব করলাম। জ্যাকেটটা মিস করছিলাম।

চাইলে ম্যাকডনাল্ডস থেকে চিপস কিনে খেতে পারতাম—খিদে না থাকলেও পেট খালি—কিংবা পাশের আইরিশ পাব থেকে এক বোতল বিয়ার। অতটুকুই। মাটির ওপরে দেগে রাখা হলুদ লাইন পার হওয়া যাবে না। আব্বাকে মাটি দেওয়ার আগে দেখা হবে না।

*
এয়ারপোর্টের বেঞ্চে বসে থাকার কথায় মনে পড়ল—আব্বা মরার সাত দিনের মাথায় অফিস-আওয়ারে আমাকে মুনি পন্ডস জংশনের লোহার বেঞ্চে বসে থাকতে দেখে মিশু। আমি দুই হাতের তিনটা-তিনটা ছয়টা আঙুল দিয়ে একমনে সিগারেট রোল করছিলাম—রেডিমেড সিগারেটের ওপর ট্যাক্স বাড়ার পর থেকে ওটা বাদ দিয়েছি, খোলা তামাকপাতা আর ফিল্টার কিনে হাতে পাকিয়ে খাই—আর মিশু ফিরছিল সুপারমার্কেট থেকে, মাংস কিনে।

লোহার বেঞ্চটা বহমান ট্রামলাইনের দিকে মুখ করা। এই দিকটায় লোকে বসে না, তা না, তবে প্রতি দশ মিনিট অন্তর ট্রাম এসে যখন উপবিষ্ট জনতাকে প্রায় সেচে উঠিয়ে নিয়ে যায়, তখন কয়েক মিনিটের জন্য বেঞ্চগুলো নির্জন পড়ে থাকে। দিনের এই সময়টা এমনিতেও খুব ব্যস্ত নয়; বড়জোর স্কুলগামী বাচ্চাসহ গৃহিণী কিংবা বেকার অভিবাসী কিংবা নির্বিষ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সময় এইটা। চাকরিটা যাওয়ায় পর এত লোকের চোখ বাঁচিয়ে চলা শিখেছি, এত ক্যাজুয়াল সতর্কতা কায়েম করেছি—নাটক-সিনেমাতেও তো কম দেখিনি জনারণ্যে লুকিয়ে পড়া সদ্য-বেকার পুরুষলোকের ধরা খাওয়ার গল্প—কিন্তু মিশুর কাছে ধরা খেয়ে যাব, আশা করিনি। এই পথ দিয়ে মিশু আসা-যাওয়া করতে পারে, তাও আবার বাজারের ব্যাগ নিয়ে হেঁটে এবং পথে আমাকে দেখে ফেলতেও পারে—এই সম্ভাবনা থিওরেটিক্যালি নাকচ না করা গেলেও বাস্তবে দেখা হয়ে গেলে কী হবে, এসবের অগ্রপশ্চাৎ আমি খুব একটা ভাবিনি।

ভাবলে কোনো একটা নিরাপদ জায়গাতেই বসতাম। এত বড় শহরে এত অল্পসংখ্যক পরিচিত মানুষের চোখ এড়িয়ে দিন পার করে দেওয়া আর এমনকি কঠিন কাজ? এই রকমের কয়েক হাজার স্পট আমি চিনি তো। যেকোনো অচেনা সাবার্বের লাইব্রেরি, ট্রেনস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-শহর ছাড়িয়ে পুব দিকের লাইনে যেদিকে বাঙালি কম থাকে, এমনকি কয়েক শ শিশুবান্ধব পার্কের যেকোনো একটা। একবার তো সেমেটারিতেও গিয়ে বসে ছিলাম, অগুনতি অচেনা লোকের কবরের দিকে মুখ করে। চাইলে সিটিতে গিয়েও অনায়াসে বসে থাকা যেত—অফিসপাড়ার ভেতর বড় বড় বিল্ডিংয়ের নিচতলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রিসেপশন এরিয়ার মধ্যে এন্তার জায়গা আছে; জুতমতো একটা কোনা খুঁজে নিয়ে ভুসভুসে গভীর একটা সোফার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে বসে মোবাইল ফোনেই দিব্যি সময় পার করে দেওয়া যেত। আসলেই...সিটিই সবচেয়ে ভালো আর নৈর্ব্যক্তিক বিকল্প হতে পারত। তা না করে কোন দুঃখে আমি মুনি পন্ডস জংশনে বসলাম!

মিশুর বাঁ হাতে লম্বালম্বি ভাঁজ করে রাখা ওভারকোট। ডান হাতে সবুজ ব্যাগে বাজারসদাই—ভেতর থেকে ধনেপাতা আর পেঁয়াজকলির ডাঁটি বের হয়ে আছে। পুরোনো ব্রণ, গত কয়েক রাতের কম ঘুম আর আব্বা মারা যাওয়া-পরবর্তী একটা অনির্দিষ্ট অপরাধবোধ প্রায়-স্থায়ী দাগ রেখে গেছে ওর মেকআপবিহীন মুখে-গালে-চোখে। তেলা চুল তালু আর কপালের সঙ্গে লেপটে আছে। জানি, নিজের যত্ন নেওয়ার সময়ও পায় না মিশু। গত কয়েক মাসে স্পষ্টতই ওর ওজন বেড়েছে-ও তো আগে এমন ঘাড়ে-গর্দানে ছিল না। মাথা-মুখ-গলা-শুধু এতটুকু পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকলে ওকে যদিও তন্বী বলে ভুল হতে পারে।

একপাশে ওভারকোট আর একপাশে বাজারের ব্যাগ থুয়ে মিশু আমার পাশে বসল। আমার ঝুরা তামাকের ছোট্ট পুঁটলিটা লোহার বেঞ্চের ফাঁক গলে মাটিতে গড়াতে লাগল, আর বাতাসের ধাক্কায় প্রায় উড়ে যেতে লাগল মিশু যেদিক থেকে হেঁটে এসেছিল, সেদিক বরাবর।
মাহফুজ, চলো বাসায় যাই।
বাসায় গিয়ে কী হবে?
তোমার ঘুমানো দরকার। সকাল থেকে কিছু খাইছো?
আমি কিছু বললাম না।
আসলেই আজকে অফিস বাদ দিছ? ছুটি নিছ?
না, ছুটি নেই নাই।
কাল রাতে আম্মা আর মুন্নির সঙ্গে আরেকটুক্ষণ কথা বলতা না হয়। ঢাকা যেতে যখন পারতেছি না...আচ্ছা, এখন ফোন লাগায়া দিব?

এক সপ্তাহে চল্লিশতমবারের মতো এই কথাটা বলল মিশু—যেন আম্মার সঙ্গে, মুন্নির সঙ্গে কথা বললে আমি ভুলে যেতে পারব যে মরা বাপের মুখ দেখাটাও আমার কপালে জোটেনি। শেষ দম বের হওয়ার আগে আব্বার হাতটা একটু না-ধরতে পারার, নিজের হাতে আব্বাকে মাটি না-দিতে পারার অনুশোচনা যেন ঢাকার সঙ্গে আমার হোয়াটসঅ্যাপ কলের অন্তঃস্থিত ইথারতরঙ্গময় চিকন নালায় হাপিশ হয়ে যাবে। এতই সহজ সেটা, যেন আমি সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলছি আর ঘাম-ক্লেদ-জীবাণু সব জলের সঙ্গে মিশে গিয়ে বাথরুমের পাইপ গলে নেমে যাচ্ছে। তোমার-আমার দুজনের মাথাপিছু দুই শ-দুই শ চার শ-মাত্র দুই শ-দুই শ চার শ ডলার বাঁচানোর জন্য—মিশু, আমরা বছরখানেক আগে আমাদের ভিসাটা রিনিউ না-করানোর মতো চূড়ান্ত অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম—বলো, তখনই কি আমরা স্বীকার করে নিই নাই যে রাজার মতো আত্মার দরজা-জানালা-ফটক খুলে বাঁচার দিন আমাদের শেষ? আমার মরা বাপের আত্মার হায় তার মৃত্যুর বহু আগেই ছেলের গায়ে লাগেনি কি? এই যে আমরা ঢাকা যেতে পারলাম না, কারণ একবার অস্ট্রেলিয়ার বর্ডার পার হয়ে গেলে আর কখনো আমরা বৈধ পথে এই সোনায় মোড়ানো শ্মশান দেশে ফেরত আসতে পারব না—এই অন্যায়ের জন্য কে আমার কাছে মাফ চাইবে? হোম অ্যাফেয়ার্স অধিদপ্তর? নাকি তুমি চাইবে? হাহ্…

এসব মিশুকে আর বললাম না—যদিও এই বক্তব্যের নানান ভার্সন নানান কায়দায় মিশুকে গত এক সপ্তাহে ঘ্যানঘ্যান করে শোনানো শেষ হয়েছে। মিশুর সহ্যেরও তো একটা সীমা আছে। আব্বার কাছে আমি নয় একটা বাচ্চা ছেলেই ছিলাম আজীবন—মিশুর কাছে তো আমি তা নই। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের আত্মবিশ্বাস নিয়ে, সাংসারিক কর্তৃপক্ষ সেজে, যে পাঁচ পয়সা বাঁচানোর সিদ্ধান্ত আমি হরদম নিয়ে থাকি, যেই কারণে স্যালভেশন আর্মির সেকেন্ডহ্যান্ড শীতবস্ত্রের দোকান থেকে বেছে বেছে কম ছেঁড়া-ফাটা, কম সুতার-বুজকুড়ি ওঠা ওভারকোট কিনতে বাধ্য হয় মিশু, ত্বকে সয়ে যায় দেখে দামি ফেসওয়াশের বদলে সস্তা ড্রাগস্টোর ব্র্যান্ডের টিউব ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়, সারা দিন বাইরে খাটুনির পরে মসলা পিষতে আর পেঁয়াজ কাটতে নামে, দোকানের বা টেক-অ্যাওয়ে খাবারের কিংবা অবকাশযাপনের কিংবা বিদেশভ্রমণের লোভ রেখেঢেকে চলে, জুলাইয়ের শূল বেঁধানো শীতেও হিটার না ছেড়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে—সেই সবের দায়িত্ব আমার না তো কার?
যথারীতি আমার চোখ বিতৃষ্ণ। পারলে নিজের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতাম।

জোরে বাতাস দিল। ট্রামলাইনের ওপর দিয়ে শুকনা পাতা কেউ যেন তীব্রবেগে ঝাঁটা দিয়ে হেঁচড়ে নিয়ে গেল। আমি মিশুর বারণ উপেক্ষা করে লাইটার দিয়ে একটু আগেই পাকানো সিগারেটটা ধরাতে চেষ্টা করলাম। বারকয়েক চেষ্টা করতে হলো—হাতের পাতা দিয়ে আগুন ঢাকছিলাম, তবু বারবার বাতাস এসে নিভিয়ে দিচ্ছিল। আমার জুলফির পাশে বাড়তে থাকা চুল আমার ডান কানের পেছনে গুঁজে দিল মিশু—ও এখনো সহ্যের সীমারেখার ভিতরে বসবাস করতে চায়। আমি কখনোই আত্মহত্যার কথা চিন্তা করিনি। মিশু করত, যখন ওর বয়স কম ছিল। ওর বাঁ বাহুর ট্রাইসেপ বরাবর অনেকগুলো কাটা দাগ ছিল। কিশোরী বয়সে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া করে ব্লেড দিয়ে খানবিশেক পোঁচ দিয়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল নাকি। এই রকম কোনো অপকর্মের রেকর্ড আমার নেই। চাচাতো বড় ভাইয়ের বায়োলজি প্র্যাকটিক্যালের ডাইসেকশন সেটের ভেতর থেকে কাটারির মতো দেখতে কী যেন একটা বের করে খেলতে গিয়ে একবার হাত কেটে ফেলেছিলাম—তারপর আব্বার এক চড় খেয়ে বাকি জীবনে আর সজ্ঞানে নিজের শরীরের ওপর কোনো ক্ষতি করার চিন্তা মাথায় আনিনি। কিন্তু ওই মুহূর্তে মিশুর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল আমাকে বুঝি আত্মহত্যার হাত থেকে একচুলের জন্য বাঁচিয়েছে ও। ঠান্ডা হাত দিয়ে আমার হাত ধরছিল, কেমন যেন খাবলে-খাবলে থাবা প্রসারিত করে, যেন নিশ্চিত মৃত্যুর নদীর ভেতর থেকে আমার দেহ টেনেহিঁচড়ে তুলে এনেছে, আর ডরাচ্ছে পাছে আমি আবার পাড় ভেঙে পিছলে না যাই!
শোনো মিশু, আমি ঠিক আছি। থেরাপি সেশন মিস করিনি। দুই সপ্তাহ আগ পর্যন্ত প্রতিদিন অফিসেও গিয়েছিলাম।
তুমি তো বলছ তুমি এই কয় দিন রোজই অফিসে গেছ। আজকে সকালেও বলছ অফিস যাইতেছ।

ঘণ্টি বাজিয়ে আমাদের প্রায়-গা-ঘেঁষে উনষাট নম্বর ট্রাম এসে থামল। দুপুর বারোটা কি একটা মতন বাজে তখন। যথারীতি ট্রামে বেশি লোক ছিল না। চার-পাঁচজন নেমে গেল। আশি পেরোনো এক বয়স্ক স্থূলাঙ্গি নারী গোলাপি ফ্রিল-দেওয়া ফুল-ফুল জামা আর মেরুনরঙা জাম্পার পরে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে অবিশ্বাস্য ধীরে হেঁটে গেল আমাদের সামনে দিয়ে। সম্ভবত গ্রিক কি ইতালিয়ান হবে। আমাকে ওই জায়গায় সিগারেট খেতে দেখে ওই নারী কপাল কুঁচকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে আমাদের দুজনের দিকে তাকাল। কোথাও তো লেখা নেই ‘নো স্মোকিং’। আমাদের দেখতে নিশ্চয়ই বিবর্ণ, দীপ্তিহীন, লাগাতার-মার-খেয়ে-পরাজিত এক যুগলের মতো লাগছিল—আমাদের মতো ত্রিশোর্ধ্ব, সংসারী, নয়া-প্রবাসীদের দেখলেই চেনা যায়; আমাদের বাকি সব প্রবৃত্তি ধুয়েমুছে গিয়ে হরে-দরে-গাণিতিক গড়ে একটা জিনিস দাঁড়িয়েছে—সেইটাই আমাদের স্পিরিট। নির্জীব, দুর্বল, স্টেরাইল। এসব ভেবে একটু জেদ হলো। মহিলার দৃষ্টির জবাবে আমিও একটা প্রতিরোধী, পূর্ণ দৃষ্টি দিলাম। মহিলা বুঝল কিনা কে জানে। মহিলার পিছে হাঁটছিল সদ্য ট্রাম থেকে নামা বাকি সওয়ারিরা। হাঁটার পথটা অপরিসর, তার ওপর আবার বেঞ্চি পাতা। মহিলার কারণে দেরি হয়ে যাচ্ছিল বাকিদের, তবুও ওরা ধৈর্য ধরে মাটির দিকে চোখ রেখে আস্তে আস্তে সার বেঁধে হাঁটছিল। ওরা কেউ আমাদের দেখল না। সেই মানুষগুলোর মধ্যে একটা সবুজ রঙের পানির বোতল হাতে একটা বাচ্চাও ছিল—সকলের মধ্যে সে-ই দেখলাম একমাত্র অস্থির—বাঁ হাতে মায়ের হাত ধরে রেখে ডান হাতে বোতলটা সে সজোরে ঝাঁকাচ্ছিল, কিন্তু বাচ্চাটারও মুখের ভাব খুব সিরিয়াস, এমনকি হয়তো গভীর কোনো চিন্তায় নিবিষ্ট। মিশুর কোমল, সস্নেহ দৃষ্টি বাচ্চাটার ওপর নিবদ্ধ-মিশুরও বাচ্চা চাই। রাস্তার উল্টোদিকে তারকাঁটার বেড়া বসানো। কালো হুডি পরা একটা কমবয়সী ছেলে মাত্রই এসে থামা ট্রামটা ধরার জন্য তারকাঁটার বেড়ার অপর পাশের ফুটপাত থেকে পড়িমরি করে দৌড় লাগাল—একপর্যায়ে হাতের মোবাইল ফোনটাকে অনায়াসে মুখে কামড়ে ধরে দুই হাতে ভর দিয়ে তারকাঁটার বেড়া ডিঙিয়ে ওই পাশের ট্রাইমলাইন পার হয়ে আলোর বেগে ছেলেটা এই পাশের ট্রামের সামনে এসে পড়ল। কিন্তু ওর কপাল মন্দ। ট্রামের স্বয়ংক্রিয় দরজা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলেটার রাগী, হতাশ চোখের সামনে দিয়ে ট্রামটা আবার ঘণ্টি বাজিয়ে টান দিয়ে চলে গেল। হুডি-পরা ছেলেটা গমনোদ্যত ট্রামটার গায়ে জোরে এক থাবড়া দিল। বলল, ফাক। বুড়িটা তখনো আস্তেধীরে হেঁটে যাচ্ছে লাঠিতে ভর দিয়ে—ছেলেটার দিকে একবার পেছন ফিরে তাকাল বুড়ি। তারপর লাঠিটা মাটি থেকে তিরিশ ডিগ্রি উঁচিয়ে কী যেন একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর নিজে একাই বিড়বিড় করতে করতে পথচারী পারাপারের সিগন্যালে গিয়ে দাঁড়াল।

মিশু, গত মাসের লাস্ট সোমবার ওরা আমাকে ফায়ার করছে। আমার চাকরিটা আর নাই।
মিশু বিষাদিত চোখ বড় করে একবার আমার দিকে, আরেকবার ওর ব্যাগে ঠাসা বাজারসদাইয়ের দিকে, তাকাল। ওর একটা আস্থার জায়গা যেন বহুদিন ধরেই অল্প-অল্প করে খসছিল, ওই মুহূর্তে যেন শেষমেশ ভেঙেই গেল—যেন বোকার মতোই বিশ্বাস করেছিল ও আমার ওপর, আর বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমার টাকা বিয়ানোর কি টাকা বাঁচানোর ক্ষমতার ওপর। আশ্চর্য, মিশু তবু কাঁদল না। আমি কেঁদে ফেললাম। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এই আমি তখন জাতের চাকরি হারিয়ে ভরসায় আছি যে বেকারির গ্রেইভইয়ার্ড শিফটের কামলা-খাটার কাজটা ওরা আমাকে সপ্তাহে ছয় দিন করতে দেবে। মিশু কি করে আশা করে যে এই মুখ নিয়ে আমি আম্মা আর মুন্নির সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলব?

রাস্তার উল্টোদিকের বিখ্যাত হোয়াইট সেডার গাছটা পাতা ঝরে প্রায়-ন্যাড়া হয়ে গেছে—ডালে ডালে তার কয়েকশ পাখির বাস। আরেক দফা বাতাস দিল; তাতে পাখিদের সমবেত আত্মা চিৎকার করে উঠল। বছরের এই সময়টা ঘণ্টায় সত্তর কিলোমিটার বেগে বাতাস বয়। ডালগুলো ভয়ংকরভাবে নড়ে উঠছিল-শীতের হাওয়ায় যেন পাখিগুলো গাছের পাতার মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়বে। পাখিদের আর্তনাদে মনে হচ্ছিল কান পাতা যাবে না। এতে আমার কান্না আপনিতেই থেমে গেল। মিশু অনিচ্ছায় আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে নিজের চুল সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

*
জ্যানেট স্মিথ নামের কটা লাল লিপস্টিক-লাগানো মহিলাটা কোনোমতেই ফোন ছাড়ছিল না। ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা সম্ভবত মহিলার কথা ভালো শুনতে পাচ্ছিল না, কিংবা এমনিতেই কানে কম শোনে—হয়তো বয়স্ক কেউই হবে। বারবার একটা ফোন নম্বর আবৃত্তি করছিল জ্যানেট; সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে শুনতে আমারই প্রায় মুখস্থ হয়ে গেল। জ্যানেটের বুকের কাছে চেলসি লার্নিং সেন্টারের আইডি কার্ড—গলা থেকে একটা লাল রঙের ফিতায় ঝুলছে সেটা। ওর পোশাক সম্পূর্ণটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওপরের অংশটা নির্দ্বিধায় টকটকা লাল। লার্নিং সেন্টারের অভ্যর্থনা লাউঞ্জে নয়া অভিবাসীসুলভ কিন্তু, কিন্তু দেহভঙ্গিসমেত কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। জ্যানেট মাত্র ওর ডেস্কের ওই প্রান্ত থেকে আমাকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করেছিল। ওর সঙ্গে বাক্যবিনিময় শুরু হয়েছে কি হয়নি, এমন সময় ওর ফোনটা বেজে উঠেছিল। ও বুঝি আমাকে জিজ্ঞেস করছিল আমি ওখানকার কোনো স্টাফের কাছে এসেছি কি না। তখনই ফোন বাজল আর আমাকে আধা-সুরাহা-হওয়া প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো অনির্দিষ্ট সময়; এসব অপেক্ষা দারুণ অস্বস্তির। অনেকে এ রকম মুহূর্তে ইতস্তত করতে থাকে আর দুটো হাত কোথায় রাখবে বুঝে পায় না—আমার উল্টো মনে হতে থাকে আমি এখনই চাপড়া-বাঁধা ধুলার মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ব আর বাতাস এসে আমার ভস্মাবশেষ উড়িয়ে নিয়ে যাবে। জ্যানেট স্মিথ দেখলাম ধৈর্য ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বারবার ফোনের অপর প্রান্তের সেই মানুষটাকে বলে যাচ্ছে, ‘তোমার সোফা আর চেয়ারের ফুল সেট আজকেই পৌঁছে যাবে। তুমিই কিন্তু নীল রঙের আপহোলস্ট্রি চেয়েছিলে! হ্যাঁ। নীল। নীল। নীল তো খুবই সুন্দর রং। ব্লু ইজ গুড। ব্লু ইজ রিয়েলি গুড’। আশ্চর্য! আপাদমস্তক লালে আবৃত একজন মানুষ—লাল লিপস্টিক, লাল জামা, লাল রিবনে সজ্জিত হয়ে সমানে নীলের স্তুতি করে যাচ্ছে। জ্যানেটের গলা চড়ছিল। আমার অস্থির লাগতে থাকল।

আজকে আমাদের মাসিক অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার সাপোর্ট গ্রুপের প্রথম অধিবেশন। আমি এদের কাউকেই চিনি না। অনলাইনে রেজিস্টার করে চলে এসেছি। প্রতি মাসেই নাকি চেলসি লার্নিং সেন্টারের একটা রুম বিনা মূল্যে ভাড়া করে দুই ঘণ্টার সেশন চলে। ক্রনিক উদ্বিগ্নতা কিংবা বিষণ্নতায় ভোগা একদল মানুষ—তাদের মধ্যে একজন থাকে সঞ্চালক—গোল হয়ে বসে থাকে আর বসে মন খুলে নিজেদের কথা বলে। শুধু কথা বলতে চাওয়া ছাড়া আর কোনো উচ্চাশা কিংবা আবেদন নিয়ে এরা আসে না। এরা বেশির ভাগই আশপাশের সাবার্বের মানুষ—চেলসি, ফ্র্যাংকস্টন বা বন্বিচে এদের বাড়ি। যদিও এদের মধ্যে সাদা মানুষের সংখ্যাই বেশি (জনসংখ্যার বিচারে তেমনই হওয়ার কথা), এদের মধ্যে এ ছাড়া রয়েছে একাধিক মিল—এরা প্রত্যেকেই মনোজাগতিক সংকটের কাছে হেরে গেছে। কারও চাকরি চলে গেছে, কেউ বৃদ্ধ বা অশক্ত, কারও–বা ড্রাগ অ্যাবিউজের রেকর্ড আছে, কেউ বহিরঙ্গে খুব ফিটফাট, কিন্তু আদতে সমাজবিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ—মোটকথা সিস্টেমের মোটাজালির ফাঁক গলে এরা প্রত্যেকেই ঝরে পড়েছে। এদের সঙ্গে নিজেকে আবিষ্কার করার লজ্জা কাটাতে আমার অনেক সময় লেগে যাবে, আমি জানতাম। টেম্পটেশন বেকারির ড্রাইভার মঞ্জিত ব্রার আমাকে বলছিল এদের কথা। টেম্পটেশন হচ্ছে সেই বেকারি, যাদের ফ্যাক্টরিতে আমি শ্রমিকের কাজ করি, কিন্তু ঢাকায় কেউ আমার এই কাজের কথা জানে না। অফিসের চাকরিটা যাওয়ার পর সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করার আবেদন মেনে নিয়েছে সন্দীপ। এটাই এখন আমার মূল কাজ।

রিসেপশন ডেস্কে জ্যানেট স্মিথ মহিলাটার সামনে যখন আমি দাঁড়িয়েছিলাম, তখন দেখলাম পুরু মেকআপ করা এবং গালের হনু প্রায়-অস্বাভাবিক রকমের স্পষ্ট করে তোলা মুখটা হাসি হাসি করে একটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা আমার সামনে এসে খুব সুর করে জিজ্ঞেস করল, আমার কাছে কনফার্মেশন ইমেইল আছে কি না। মেয়েটার বয়স ত্রিশের কিছু কম—চোখের ওপরের পাতায় ঘন করে আলগা পাপড়ি বসানো; দেখে মনে হচ্ছিল চোখ মেলে তাকাতেও বুঝি ওর শারীরিক পরিশ্রম হচ্ছে। ওর ঠোঁটে হাসিটা একটা অনতিক্রম্য রেখার মতো জেগে ছিল—শুধু ওই পর্যন্ত গিয়েই থেমে যেতে হবে—এর বেশি যাওয়া যাবে না। প্রেমে পড়া বা প্রেমভাব প্রকাশ করা তো দূরের কথা।

আমাকে ও বলল ওর পিছে পিছে যেতে। আমি হাঁটা শুরু করলাম। পুরু কার্পেটে মোড়ানো মেঝে—আমি চেষ্টা করলাম মিশুর উপদেশমতো পা-হেঁচড়ে না-হাঁটতে, এতে নাকি জুতার সোল দ্রুত ক্ষয়ে যায়। প্যাসেজে লেমনগ্রাসের গন্ধ (এয়ার-ফ্রেশনার)। মেয়েটা হাঁটতে হাঁটতে পেছন না ফিরেই দস্তুরমাফিক জানতে চাইল লার্নিং সেন্টার খুঁজে পেতে আমার কোনো অসুবিধা হয়েছে কি? বলল, আমি নিশ্চয়ই আশপাশের কোনো এলাকাতেই থাকি। আমি ওকে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলাম, না, তবে আমার অফিস খুব কাছে। খুব চিকন একটা করিডর পার হয়ে একটা দরজার দিকে হেঁটে যাচ্ছিল মেয়েটা—যদিও ও সামনে থাকায় দরজাটা তখন দেখতে পাচ্ছিলাম না। যেমন ছোটবেলায় আমি টিভি দেখতে বসলে মুন্নি টিভির ঠিক সামনে এসে পুরো পর্দা আড়াল করে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকত।

দরজা খুলে ধরে মেয়েটা আমাকে যে রুমে নিয়ে গেল, সেখানে ঢুকে আমি দেখলাম সবাই কথা থামিয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। ওদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যে তখনো ওরা মূলত শ্রোতার ভূমিকায়—হয়তো ওদের মধ্যে যে সঞ্চালক, শুধু সে’ই বলছিল—কিন্তু সাদা ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে গোল হয়ে বসে থাকা সকলকে দেখে আমি টের পেলাম ওদের মধ্যে একটা পুরোনো বোঝাপড়া আছে। ওদের নীরব পারস্পরিক আদবের মধ্যে তেমন একটা ব্যাপার ছিল। হয়তো বেশিক্ষণ আগে না—মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই ওরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। একে-একে বলেছে নিজেদের নামধাম, পেশা, বাড়িতে কুকুর পালে কি না, কিংবা শেষ কবে বেড়াতে গিয়েছিল বালি বা প্যাসিফিক আইল্যান্ডস। রিসেপশন ডেস্কের সামনে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সেশনের শুরুর দিককার কিছুটা অংশ আমার মিস হয়ে গেছে, বুঝলাম।

সঞ্চালক মহিলাটা সকলকে বলল, ‘এবার আমরা জোড়সংখ্যক মানুষ হয়েছি। চমৎকার!’ তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি কাইলি’, আর তারপর পাশে বসে থাকা বয়স্ক মহিলার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করল। বয়স্ক মহিলাটা হাসল—মুখে একটা দাঁতও নেই, আর মাড়িগুলো কালচে; আর কী অদ্ভুতভাবে হাতে গার্ডেনিং গ্লাভস পরা, যেন মাত্রই সেন্টারের পিছের বাগানে আলু তুলছিল—তারপর নরম গলায় আমাকে তার নাম বলল। তারপর একে-একে বাকিরাও। প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিয়ে আমি দুই কদম পিছিয়ে গেলাম, তারপর নিজের নাম বললাম। ছোট্ট করে নিজের অনুভূতিও বললাম, এখানে এসে খুব ভালো লাগছে, হ্যান ত্যান। পাবলিক স্পিকিংয়ের যেসব টিপস আমরা শুনে থাকি, যেমন উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে থেকে শুধু একজনকে বেছে নিয়ে তার চোখে চোখ রেখে সকলের উদ্দেশে কথা বলা, সেসব মনে পড়ল হঠাৎ। আমার চোখ গেল তামজিদ ছেলেটার দিকে। ওর চেহারা ভারতীয় উপমহাদেশীয়, কিংবা সেই দলে আমি ছাড়া বাদামি চামড়া একমাত্র ওর দেখেই কিনা কে জানে? আমার ওকে পূর্বপরিচিত, প্রায়-আত্মীয় বলে মনে হচ্ছিল। আরও একটা কারণ হতে পারে যে এই গ্রুপে যেহেতু অনেকেরই সোশ্যাল অ্যাংজাইটির সমস্যা আছে, বাকিরা হয়তো তাই চোখ লুকিয়ে রাখছিল আমার থেকে। সঞ্চালক কাইলি মহিলাটা ঘরের কোনা থেকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এসে ওদের বৃত্তের পরিধিটা একটু বড় করে দিয়ে হাততালি দেওয়ার মতো করে হাতের ধুলা ঝেড়ে আমাকে বলল, ‘বসে পড়ো।’

ছয়টা সাদা চেয়ার, আর মাঝের একটা গোল টেবিল—আর ঘরের পশ্চিম কোণে একটা চাকাওয়ালা কাঠের দেরাজ, তাও অন্যদিকে মুখ করে রাখা। দেরাজটায় চৌকো-চৌকো কাঠের ইন-লে করা ডিজাইন, দেখে মনে হচ্ছিল একটা রুবিক্স কিউব আমাদের অধিবেশনে যোগ দিয়েছে, আর রাগ করে দূরে গিয়ে পাছা ঘুরিয়ে বসেছে। একটা দেয়ালে টানা নোটিশ-বোর্ড, আর তাতে জরুরিই হবে এমন কিছু কাগজ সাঁটানো। আরেক পাশে কাচের দেয়াল; এন্তার আলো আসছে। ঘরটায় আর কোনো আসবাব নেই।

এবারে কাইলি একতাড়া কাগজ নিয়ে বসল। আমাদের বুঝিয়ে বলা হলো সেশনের মুখ্য উদ্দেশ্য। আমরা কথা বলব—প্রথমে অল্প কথায় বুঝিয়ে বলব আমরা এখানে কেন এসেছি, কী কারণে বা কোন ঘটনা ঘটার পর আমাদের মনে হয়েছে এখানে আসা দরকার। তারপর আমরা জোড়ায় জোড়ায় কথা বলব। একজন সাথি বেছে নিয়ে পালাক্রমে বলব আমাদের উদ্বেগ, ভয়, আশঙ্কা, ট্রমা (যদি থাকে) ইত্যাদির কথা। সাথিকে প্রশ্ন করব, সাথিকে জাজ করব না, সাথির প্রয়োজনে তার হাত ধরব বা সমমর্মিতা দেখাব, সাথির জন্য কথা বলা সহজ করে দেব। সেই সঙ্গে এটাও মনে রাখব যে সাথি কিছু বলতে না চাইলে তার ইচ্ছাকে সম্মান করতে হবে। অবশ্যই এই সেশন তো কোনোভাবেই ওষুধ, কাউন্সেলিং বা ডাক্তারি সেবার বিকল্প নয়। আমরা কি বুঝতে পারছি? আমাদের কি কোনো প্রশ্ন আছে? না থাকলে প্রথমে এই কাগজে সই করতে হবে—আমরা প্রত্যয়ন করছি যে সর্বাবস্থায় এই সেশনের সমস্ত কথোপকথন গোপন রাখব—কোনোভাবেই এই চার দেয়ালের বাইরে যেতে দেব না।

(আগামীকাল সমাপ্য)