শেষ মোগলের খোঁজে

বাহদুর শাহ জাফরেরর এই আলোকচিত্রটি তাঁর বিচারচলাকালে তোলা, ১৮৫৮
বাহদুর শাহ জাফরেরর এই আলোকচিত্রটি তাঁর বিচারচলাকালে তোলা, ১৮৫৮

ইয়াঙ্গুন শহরে একটা নির্জন একটেরে গলি আছে, যাতে আছে একটা সাদামাটা দরগা, আর সেখানেই লুকিয়ে আছে ভারতের ইতিহাস। রাস্তাটার নাম জি ওয়াকাওয়া স্ট্রিট। গাড়িঘোড়া, পথচারীর সে রকম ভিড় থাকে না। দরগার সামনে একচিলতে ফাঁকা মাঠ। তার পাশ দিয়ে কয়েক মিনিট ড্রাইভ করে গেলেই ইয়াঙ্গুন শহরের অন্যতম গৌরব: শোয়ে ড্রাগন প্যাগোডা। সোনায় তৈরি তার রত্নখচিত চূড়া রাতের আকাশে ঝলমল করে।

সেই দরগায় কোনো ধনাঢ্য আভিজাত্য নেই। এক পাশে রয়েছে কেয়ারটেকারের বিবর্ণ সবুজ ঘর। মূল দরজা পেরিয়ে শ্বেতপাথরে তৈরি কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেই মাজার। সেখানে পাশাপাশি দুটি কবরে চাদর চড়ানো। একটি কবর তাঁর, সেই সুফিসাধকের। পাশেরটি তাঁর স্ত্রী জিনাতমহলের। দেয়ালে দুজনের সাদা–কালো ছবি। পাশাপাশি ফ্রেমে উর্দু ভাষায় বাঁধিয়ে রাখা সুফি কবির কয়েকটি শায়ের, নিচে ইংরেজি অনুবাদ।
‘কিতনা হ্যায় বদনসিব জাফর
দফনকে লিয়ে দো গজ জমিনভি মিল নহি সকি।’
জাফর, তুমি এতই দুর্ভাগা, ভালোবাসার দেশে তোমার কবরের জন্য দুগজ মাটিও জুটল না।

লাল, সবুজ সাইকোডেলিক আলোর নিচে ব্লোআপ করা ফ্রেমবন্দী ছবি থেকে কবির চোখ দুটো দর্শকদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছবির পাশেই ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় লেখা রয়েছে তাঁর পরিচিতি: হজরত মহম্মদ সিরাজুদ্দিন বাহাদুর শাহ জাফর (১৭৭২-১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দ)। দিল্লির লালকেল্লা থেকে বহুদূরে, সেখানেই মারা যান শেষ মোগল সম্রাট।

কিন্তু এটি আসল কবর নয়। আসল কবর দেখতে সিঁড়ি বেয়ে দরগার বেসমেন্টে নেমে যেতে হবে। সেখানে দেখা যাবে সামনে রেলিং-ঘেরা সবুজ চাদর বিছানো আর একটি সমাধি। ১৯৯১ সালে এই সমাধি চত্বরের নালা খোঁড়াখুঁড়ির সময় বার্মিজ শ্রমিকেরা মাটির নিচে একটি ইটের কবরখানা দেখেন। দেখা গিয়েছিল, কফিনের ভেতরে কঙ্কালও আছে। অচিরেই জানা যায়, এই কবর ও কফিন কার!

গোলাপশোভিত জাফরের সমাধি
গোলাপশোভিত জাফরের সমাধি

ওপর-নিচে এভাবে দুই সমাধির কারণ? ইংরেজ প্রথম থেকেই জানাতে চায়নি, কোথায় তাঁকে গোর দেওয়া হলো। ৮৭ বছরের বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ তাদের কাছে শেষ মোগল সম্রাট নন, ছিলেন বিদ্রোহী সিপাহিদের প্রেরণা।

১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর ভোর পাঁচটায় তাই এই বৃদ্ধ মারা যাওয়ার পরই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করেনি। দুই দিন আগে থেকেই কিছু খেতে পারছিলেন না, চামচে করে স্যুপ গেলানো হচ্ছিল। তাঁর মৃত্যু তখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র ছিল!

বিকেল চারটা নাগাদ প্রহরীদের ডেরার পেছন দিকে গর্ত খুঁড়ে তাঁকে কবর দেওয়া হয়। একটু দূরে বানানো হয় বেতের বেড়া। জেলার নেলসন ডেভিস লন্ডনে জানিয়েছিলেন, ‘কয়েদির মৃত্যু নিয়ে এখানে কেউ ভাবিত নয়। মেরেকেটে শখানেক লোক, বেশির ভাগই রেসকোর্সে বাজি ধরতে যাচ্ছিল। বেড়া আস্তে আস্তে পচে যাবে, নতুন ঘাস গজাবে, কয়েদিকে কোথায় কবর দেওয়া হলো কেউ জানতেও পারবে না।’ তাঁর চিঠিজুড়ে ছিল কয়েদি বা প্রিজনার শব্দের ছড়াছড়ি।

এর ঠিক বছর দুয়েক আগে ডেভিস কলকাতায় তাঁর কর্তাদের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি জানিয়েছিলেন, সাবেক সম্রাটের দুই ছেলে মির্জা জওয়ান বখ্ত ও শাহ আব্বাস ইংরেজি শিখতে চান। বাহাদুর শাহ ও বেগম জিনাতমহলও এ বিষয়ে আগ্রহী। কর্তারা উচ্চবাচ্য করলেন না, উপরন্তু গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং জানালেন, ‘ভবিষ্যতে এই সব সাবেক সম্রাট, মোগল রাজা গোছের শব্দ ব্যবহার করবেন না। স্টেট প্রিজনার লিখবেন।’ তাঁর সম্বন্ধে সম্রাট শব্দটা বারবার মুছে ফেলতে চেয়েছে ইংরেজ।

জিনাতমহল
জিনাতমহল

এই পরিকল্পনা বেশ কাজে দিয়েছিল। স্বামীর মৃত্যুর ২০ বছর বাদে জিনাতমহল যখন ইয়াঙ্গুনের একচিলতে ঘরে হতদরিদ্র অবস্থায় আফিমের নেশা করতে করতে মারা গেলেন, তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছিল কাছাকাছি এক জায়গায়। তাঁর স্বামীর কবর ঠিক কোথায়, তত দিনে লোকের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে গেছে। ইংরেজরা অওধের শেষ নবাব ওয়াজেদ আলী শাহকে মেটিয়াবুরুজে নির্বাসন দিয়েছিল, সেন্ট হেলেনায় নির্বাসিত নেপোলিয়নকে স্লো পয়জনিং করেছিল। কিন্তু প্রশাসনিক মেশিনারি কাজে লাগিয়ে এ রকম কবর-পলিটিক্স কোথাও করেনি!

পরের শতকেই অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হলো। ভারতজুড়ে শুরু হলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ইয়াঙ্গুন বা তৎকালীন রেঙ্গুনও এর বাইরে ছিল না। ১৯০৭ সালে তাই ছোট্ট এক পাথরের ফলক বসেছিল, ‘দিল্লির সাবেক রাজা বাহাদুর শাহ এখানে মারা গিয়েছিলেন, সন্নিকটে তাঁর সমাধি।’ পরে সেই পাথুরে ফলকের কাছেই তৈরি হয়েছিল টিনের চালার ছোট্ট মাজার। যা ছিল এই শ্বেতমর্মরশোভিত সমাধির পূর্বপুরুষ।

দেয়ালের গায়ে শায়রিতে লেখা আছে,
‘এই বাগানে শীত যায়, বসন্ত আসে
তবু প্রতিটি সকাল এক লাগে
খাঁচার ভেতরে কে–ইবা বোঝে শীত, বসন্ত আসে?’

এই মাজারের প্রথম কেয়ারটেকার কামালউদ্দিন, যাঁর রেঙ্গুনেই জন্ম, পিতামহ থাকতেন চেন্নাইয়ে, সাম্প্রতিক অতীতে এক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন, ‘এই জায়গায় ভারত-পাকিস্তান বিরোধ নেই। আপনাদের রাজীব গান্ধী, মনমোহন সিংহ এসেছেন, বেনজীর ভুট্টোও, ’। আজও স্থানীয় মুসলমানরাও আসেন নামাজ পড়তে, কাওয়ালি গাইতে। এই বাহাদুর শাহ জাফর নিছক সম্রাট নন, সুফিসাধক।

দুই রাজকুমার
দুই রাজকুমার

সম্রাট থেকে সাধকে উত্তরণ তাঁর জীবনে নতুন নয়। ৬২ বছরে সিংহাসনে বসলেন জাফর, তাঁকে ঘিরে থাকতেন সুফি পীর ও হিন্দু জ্যোতিষীদের দল। সন্ধ্যাবেলায় লালকেল্লায় মির্জা গালিব, জকের মতো কবিদের ডেকে শায়রি শুনতেন, কখনো রামলীলা দেখতেন। হিন্দু ও মুসলিম প্রজার মধ্যে ভেদাভেদ করতেন না।

‘তত দিনে বাংলা-বিহার-ওডিশা থেকে পাঞ্জাব, মহীশূর—সব ইংরেজের দখলে, মোগল সাম্রাজ্য বলতে স্রেফ দিল্লির যমুনাপাড়। ওই একচিলতে জায়গাতেও বাহাদুর শাহ তাঁর পূর্বসূরি আকবরের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির নীতি থেকে এক বিন্দু সরেননি।

ট্রাজেডির শুরু হলো ১৮৫৮ সালের ১১ মে। মিরাঠ, কানপুর থেকে আসা সিপাহি বিদ্রোহের সৈনিকেরা ততক্ষণে দিল্লি শহরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে দিয়েছেন, সবাইকে কচুকাটা করছেন। জাফরের প্রহরীরাও ভয়ে পালিয়ে গেছেন। বেলা তিনটা নাগাদ লালকেল্লায় বিদ্রোহী সিপাহিরা ঢুকে চেঁচামেচি শুরু করেন, ‘আমাদের কার্তুজ ও অস্ত্রশস্ত্র লাগবে। সম্রাট আমাদের আশীর্বাদ করুন।’ জাফর নারাজ, ‘আপনারা ওপরওয়ালা অফিসারদের খুন করে পালিয়ে এসেছেন।’ কিন্তু সিপাহিরা তাঁকে ঘিরে ধরেন, যেতে দেন না। এক সভাসদকে বিষণ্ণ স্বরে সম্রাট সেদিন বলেছিলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সে এটাই আমার প্রাপ্য?’ প্রায় বাধ্য হয়ে তিনি সিংহাসনে বসলেন, সবাই এসে তাঁকে সালাম করে আশীর্বাদ চাইলেন।

বাহদুর শাহ জাফর
বাহদুর শাহ জাফর

এই ঘটনাই পরবর্তীকালে তাঁকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়। দিল্লিকে তখন কেউ ছাড়েনি। একদিকে বিদ্রোহী সিপাহিদের লুটপাট, অন্যদিকে ইংরেজরাও পরে যুদ্ধে জিতে নৃশংস প্রতিশোধ নিতে আরম্ভ করে। এক ‘কুচা চালান’ এলাকায় শিশু–বৃদ্ধনির্বিশেষে হাজারজনকে কতল করা হয়। বিচার না করেই রাস্তায় ফাঁসির কাঠ তৈরি করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় মানুষকে। ধ্বংস করা হয় মসজিদ থেকে মোগল বাগিচাসহ অনেক কিছু। ব্রিটিশ পরিকল্পনা, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে দিল্লি শহরকে। এতটুকু অস্তিত্ব যেন না থাকে তার!

এ পরিস্থিতিতে ১৭ সেপ্টেম্বর ভোরে লালকেল্লা ছেড়ে জাফর আশ্রয় নিয়েছিলেন নিজামুদ্দিনের দরগায়। পীরের কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘বিদ্রোহীরা যে দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে, জানতাম। মোগল প্রদীপের আলো আর কয়েক ঘণ্টা পরই শেষ হয়ে যাবে।’ তারপর আর কেল্লায় ফিরলেন না, চলে গেলেন পূর্বপুরুষ হুমায়ুনের কবরে। কয়েক ঘণ্টা পর সেখানে এলেন বেগম জিনাতমহলও। লালকেল্লায় ততক্ষণে আছড়ে পড়ছে ইংরেজ সৈন্যদের কামানের গোলা। জয় সমাপ্ত। শাহজাহানের দিওয়ান-ই-খাসে এবার বিজয়ী সৈন্যদের ডিনার, হুইস্কির গ্লাসে সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার স্বাস্থ্যপান, ‘গড সেভ দ্য কুইন’।

হুমায়ুনের কবরে লুকিয়ে থাকা সম্রাটকে এই দৃশ্য দেখতে হয়নি। তার দুই দিন বাদে ২০ তারিখ ইংরেজ সেনাপতি হডসন তাঁকে ধরে নিয়ে এলেন লালকেল্লায়। প্রহরায় ছিলেন কেন্ডাল কোগিল নামের এক ইংরেজ সেনা। ‘হিন্দুস্তানের রাজা এখন আমার বন্দী। সেন্ট্রিদের বলেছি, জানোয়ারটা মুখ তুলে তাকালেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে,’ বাড়িতে চিঠিতে লিখেছিলেন কোগিল।

সেদিন তিনি আর সম্রাট ছিলেন না। পূর্বপুরুষের তৈরি কেল্লার দুটো ছোট্ট খুপরিতে বন্দী থাকতেন, খাটিয়ায় পাতা থাকত শতচ্ছিন্ন রজাই। রোজকার খাওয়াদাওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিল দুই আনা। আগে অনুমতি ছাড়া উজির থেকে আমির কেউ আসতে পারতেন না তাঁর সামনে। আর তখন তিনিই উঠতে–বসতে ইংরেজ প্রহরীদের সালাম ঠুকতেন। ধোবি, ক্ষৌরকার থেকে হাকিম কাউকে আসতে দেওয়া হতো না তাঁর কাছে। ‘রাজপরিবারের কেউ বিন্দুমাত্র সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নয়। সামান্য সমবেদনা জানানোও ভুল,’ নির্দেশ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ স্যার জন লরেন্স।

বাহদুর শাহ জাফরকে গ্রেপ্তারের দৃশ্য।
বাহদুর শাহ জাফরকে গ্রেপ্তারের দৃশ্য।

১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হলো রাজদ্রোহের অভিযোগে তাঁর বিচার। শীতের সকালে, অশক্ত বৃদ্ধ মাঝেমধ্যে দিওয়ান-ই-খাসের বিচারালয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন, কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন। বোধ হয় ভাবতেন, তাঁর পূর্বপুরুষ সম্রাট জাহাঙ্গীর একদিন এই ইংরেজ বণিকদের এ দেশে ব্যবসার অধিকার দিয়েছিলেন। তারাই আজ বিচারক!

মার্চ মাসে সাজা ঘোষণা হলো: নির্বাসন। আন্দামান, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনি...গভর্নর জেনারেল যেখানে ভালো বুঝবেন!

কিন্তু মোগল সম্রাটকে কোথায় পাঠানো যায়? লোক জানাজানি হলে আবার প্রজাবিদ্রোহ! ৭ অক্টোবর ভোররাত তিনটায় জেলার ওমনি সাহেব বৃদ্ধকে ডেকে তুললেন, ‘চলুন, যেতে হবে।’ বউ, দুই ছেলে, ভৃত্য—সব মিলিয়ে ৩১ জনকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল পালকি ও মোষের গাড়ি। পাহারায় ছিল কোম্পানির ৯ নম্বর ল্যান্সার বাহিনী। একদা পানিপথের যুদ্ধে জিতে তাঁর পূর্বপুরুষ বাবর তৈরি করেছিলেন মোগল সাম্রাজ্য। ৩৩২ বছর পর সেই ইতিহাস ছেড়ে ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে।

এলাহাবাদে পৌঁছানোর পর ওমনিকে বড়লাট ক্যানিং জানিয়েছিলেন, বন্দীদের নিয়ে যেতে হবে রেঙ্গুন! পুরো ব্যাপারে গোপনীয়তা এতটাই ছিল! তত দিনে দিল্লি থেকে বেরোনো ৩১ জনের অনেকেই খসে পড়েছেন, শেষ পর্যন্ত এলাহাবাদ থেকে ‘টেমস’ নামের স্টিমারে উঠলেন বাদশাহসহ ১৫ জন। ৪ ডিসেম্বর স্টিমার পৌঁছাল কলকাতার কাছে—ডায়মন্ড হারবার।

সিপাহী বিদ্রোহ
সিপাহী বিদ্রোহ

স্টিমার বদলে বন্দীদের তোলা হলো ‘এইচ এম এস মগারা’ জাহাজে। সঙ্গী দুই শাহজাদা জওয়ান বখ্ত ও শাহ আব্বাস জাহাজের ডেকে উঠেই চুরুট চাইলেন, সম্রাট চলে গেলেন নিচে। সেখানে তাঁর বিছানা, তাকিয়া পেতে দেওয়া হলো। জানালা দিয়ে নদীতে তাকিয়ে থাকতেন তিনি। দিল্লি থেকে আসার পথে কানপুরে প্রথম রেলগাড়ি দেখেছিলেন। জেলার ওমনি সাহেবকে সেদিন বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, সমুদ্রে জাহাজ কীভাবে যায়? আমার খুব জাহাজে চড়তে ইচ্ছা করে।’

জাহাজেই এবার রেঙ্গুন পৌঁছালেন। বরাদ্দ হলো ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ছোট ছোট চারটি ঘর। একটায় সম্রাট, অন্যটিতে বেগম জিনাতমহল, আর বাকি দুটোয় সস্ত্রীক দুই ছেলে। পাহারায় দিনের বেলায় মাস্কেট হাতে দুজন পাহারাদার, রাতে তিনজন। জাফরকে কাগজ-কলম দেওয়াও নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর বড় ছেলে জওয়ান বখ্ত মাতাল ছিলেন, মদের টাকার জন্য মাকেও মাঝেমধ্যে মারধর করতেন। বিষণ্ণ বৃদ্ধ গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে শুয়ে থাকতেন, রেঙ্গুন নদ বেয়ে ছুটে আসত হাওয়া।

এখন যদিও নদী মাজার থেকে দেখা যায় না। সামনে অনেক বহুতল, নতুন রাস্তা। সবই কি কফিনবন্দী শরীরের মতো একদিন ধুলায় মিশে যাবে? বন্দিদশাতেই তো লিখেছিলেন তিনি,
‘এই জীবনে আর আলোর রেখা নেই
কারও হৃদয়ে শান্তি হয়ে ঝরব না
ধুলা থেকে এবার ফের মিশে যাব ধুলায়।’

সবই ধুলা? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে মিয়ানমার যখন জাপানি সেনার অধিকারে, ওই মাঠেই তাঁবু ফেলেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের মেয়েদের ‘ঝাঁসির রানি’ ব্রিগেড। শেষ মোগল সম্রাটকে নিজে এসে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ সরকার ও ফৌজের সর্বাধিনায়ক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। সম্ভবত তিনিই প্রথম ভারতীয়, যিনি নির্বাসিত বিস্মৃত শেষ মোগলকে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যেচে উপস্থিত হয়েছিলেন।
এত কিছুর স্মৃতি নিয়েও তাঁর সমাধি আজও অটুট। তিনি কিন্তু ধুলা থেকে ধুলায় মিশে যাননি, প্রতিবেশী দেশে শেষ মোগল সম্রাট আজ সুফিসাধকে রূপান্তরিত।

তথ্যসূত্র:
১-The Last Mughal, William Dalrymple, Penguin India (২০০৭)।
২-The Last Mughal: The Fall of a Dynasty: Delhi, 1857; William Dalrymple, Vintage (২০০৮)।
৩-The Trial of Bahadur Shah Zafar, Pramod K. Nayar, Orient BlackSwan (২০০৭)।)