আলেয়া বিবির জীবনকাহিনি

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে মিশে আছে নানা মানুষের আত্মোৎসর্গ। স্বাধীনতা দিবসের আগে জানা যাক এক বীরাঙ্গনার জীবনের সত্য গল্প
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘বীরাঙ্গনা শব্দের অর্থ কী, তা আমি জানি না। শুধু জানি, লোকে আমাকে বীরাঙ্গনা বলে। আমার জীবন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না, জানতেও চায় না।’ বেশ কয়েক বছর আগে এ কথাগুলো বলছিলেন আলেয়া বিবি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আলেয়া বিবি ধরা পড়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। এখন তাঁর বয়স ৬৫ বা ৭০ বছর। কিন্তু যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ১৪–১৫ বছরের কিশোরী। যুদ্ধের অনেক বছর পরে ২০১৪ সালের জুন মাসে তাঁর সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, সে সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্বামী মো. ইউনুছ মিয়াও। না, যুদ্ধের সময় আলেয়া বিবাহিত ছিলেন না, তাঁর বিয়ে হয়েছে আরও পরে। আলেয়া বিবির মুখ থেকে আমরা সেদিন শুনেছিলাম যুদ্ধ, ১৯৭১ তাঁকে কীভাবে ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে সেই বৃত্তান্ত। শুনেছিলাম ইউনুছ মিয়ার কথাও।

আলেয়া বিবির চোখে তখন ভর করেছে গাঢ় বেদনার ছায়া। যুদ্ধদিনের কথা বলে চলেছেন তিনি:

‘১৯৭১–এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। একসময় সেই যুদ্ধের শিকার হলাম আমি নিজেই। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের কুমিল্লা জেলায়, তারপর গ্রামেও তা ছড়িয়ে পড়ল। চারিদিকে ভীতিকর অবস্থা। কতক্ষণ আর ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকা যায়? কোথায় গিয়ে পালাব? গ্রামের আনাচকানাচে মিলিটারি আর মিলিটারি।

‘যুদ্ধের শেষের দিকের কথা। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল বড় রাস্তা। একদিন কয়েকজন বান্ধবী মিলে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখি, মিলিটারিরা আসছে। তাদের দেখে খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। কে কোন দিকে দৌড়েছি, এখন আর বলতে পারব না। দৌড়ে আমি সোজা বাড়ি চলে এলাম। তবে আমি যে দৌড়ে এসেছি, তা দেখে ফেলল মিলিটারিরা। তারাও পিছু নিল আমার। আমি যখন ঘরের ভেতর ঢুকছি, তখন পেছন থেকে তারা আমার চুলের মুঠি টেনে ধরল। তারপর ওখানে—বাড়ির উঠানেই আমাকে নির্যাতন করতে শুরু করল একজনের পর একজন। একসময় আর সহ্য করতে না পেরে জোরে চিৎকার দিলাম আমি। আমার চিৎকার শুনে দৌড়ে এলেন আমার দাদা আর চাচি। মিলিটারিদের কাছ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলেন তাঁরা। এ সময় এক মিলিটারি গুলি ছুড়ল দাদা ও চাচির ওপর। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তাঁরা। মারা গেলেন। আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায়ও সেই গুলির ছিটা লেগেছিল। তখনো ওরা আমার ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। একদিকে আমাকে নির্যাতন করছে, অন্যদিকে চোখের সামনে আমার দাদা–চাচিকে মারছে। ওই সময়টা আমার কেমন যে লেগেছিল, তা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। আর সহ্য করতে পারছিলাম না। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও থামেনি ওই পিশাচ মিলিটারিরা—একে একে আমার দেহকে খুবলে দিচ্ছিল তারা। এমতাবস্থায় আরও বেশি দিশেহারা হয়ে পড়লাম। যে মিলিটারি আমাকে তখন নির্যাতন করছিল, গায়ের জোরে তাকে মারলাম একটা থাপ্পড়। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল গুলির আওয়াজ। মনে হলো, আমার বাম হাতটা আমার কাছ থেকে কেউ নিয়ে গিয়েছে। তারপর আর কিছু বলতে পারব না। 

‘দু–তিনদিন পর যখন আমার হুঁশ ফিরে এল, দেখলাম আমি ভারতের আগরতলা হাসপাতালের ৩ নম্বর বেডে শুয়ে আছি। প্রথমে তেমন কিছুই বুঝতে পারিনি। কেউ আমাকে কিছু বলেনি। কিছুক্ষণ পর চোখ দুটি এদিক–ওদিক ঘোরাচ্ছি। আসলে তখন পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি আমার কী হয়েছে। এদিক–সেদিক চোখ ঘোরানোর পর দেখি আমার বেড়ের এক কোনে দাঁড়িয়ে আছেন আমার মা-বাবা। চুপচাপ। তবে কেমন যেন অপরিচিত লাগছিল তাঁদের। খুব ব্যাকুল হয়ে তাঁদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম আমি, কিন্তু নড়াচড়াই তো করতে পারছিলাম না! ওদিকে মা-বাবাও এগিয়ে আসছিলেন না আমার কাছে। শেষে “মা মা” বলে ডাকতে শুরু করলাম। তখনো আমার মা-বাবা নির্বাক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

‘একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আমার মা। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, আমার কী হয়েছে? মা কিছুই বলছেন না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। অনেকক্ষণ জিজ্ঞাসার পর হঠাৎ মা হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বাবা আস্তে করে বললেন, কিছুই হয়নি।

‘এরপর মা আমাকে কান্নাভরা কণ্ঠে বললেন, “মা, তোর সব শেষ হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় যে সম্পদ মান-ইজ্জত, তা আর নেই তোর। মিলিটারিরা নষ্ট করে দিয়েছে।”এসব বলে মা খুব কান্নাকাটি করছেন। আর আমি তখন শোয়া থেকে উঠে বসার জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই পারছি না। তখন বাবা বললেন, “তুই এখন উঠে বসতে পারবি না। তোর হাতসহ সারা শরীরে গুলি লেগেছে, একটা হাত পঙ্গু হয়ে গিয়েছে।” তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কীভাবে? বাবা বললেন, “মিলিটারিরা গুলি করেছিল। জানে বেঁচে গিয়েছিস। কিন্তু পঙ্গু হয়ে গিয়েছে একটা হাত।” বাবা যখন এসব কথা বলছেন, আমার আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে শুরু করল। কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। কেবলই মনে হলো, কলঙ্কিনী, আমি তো কলঙ্কিনী!

‘দেশ স্বাধীন হলো। এর বেশ কয়েক দিন বাদে আগরতলার ডাক্তাররা আমাদের জানালেন, আমরা এখন দেশে ফিরতে পারব। আমার মা–বাবাকে তাঁরা বললেন, “তোমাদের মেয়ে এখন অনেকটা ভালো। এখন তোমরা তাকে নিয়ে যাও। ওখানকার হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ো।”

‘আগরতলা হাসপাতাল থেকে সরাসরি কুমিল্লা সদর হাসপাতালে চলে এলাম। বাড়ি যাইনি। কুমিল্লা হাসপাতালেও দীর্ঘদিন থাকতে হয়েছিল। আমার বাঁ হাতটা তখন একেবারেই পঙ্গু। হাড়ের মাঝখান দিয়ে গুলি চলে যাওয়ায় অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে। চিকিৎসায়ও ফল হয়নি।

‘অতঃপর বাড়ি ফিরে এলাম, আমার নিজ গ্রামে। শত দুঃখের মধ্যেও এটুকু আনন্দ যে দেশ এখন স্বাধীন। ভাবি, নিজের মান গিয়েছে, হাত গিয়েছে, শরীরজুড়ে ক্ষতবিক্ষত, তাতে কী, দেশ তো স্বাধীন। আমিও স্বাধীন। আর দশজনের মতন করে আমিও থাকব। কিন্তু না, আমার জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। কারণ, আমি যে কলঙ্কিনী! আমার নামের আগে এখন আরও একটা শব্দ যোগ করা হয়েছে, বীরাঙ্গনা। আর এই বীরাঙ্গনা নাম হওয়াতে সবাই আমাকে ঘৃণা ও নিন্দা করতে শুরু করল। বাড়ির চারপাশের লোকেরা থুতু ছিটাতে থাকল। এমনকি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে অনেকেই আজেবাজে কথা বলত। 

‘বিয়ে বা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে আমার বাড়ির লোকদের দাওয়াত দেওয়া হলে তাদের আগে থেকে বলে দেওয়া হতো আমাকে যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ, শুভ কাজে আমাকে নিলে সব অশুভ হয়ে যাবে। মোট কথা স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজের চোখে তখন আমি “খারাপ”।

‘গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বি মা–বাবাকে বললেন, মেয়েকে বিয়ে দাও। কিন্তু আমাকে যে কেউ বিয়ে করতে আসে না। দূর থেকে যেসব বিয়ের প্রস্তাব আসে, আমাকে দেখে মোটামুটি পছন্দ হয়। কিন্তু গ্রামের লোকজন যখন আমার অতীত ঘটনা বলে, তখন পাত্রপক্ষ ফিরে যায়। বিয়ে করতে রাজি হয় না কেউই। 

‘যুদ্ধের সাত বছর পর ১৯৭৮ সালে একটা বিয়ের প্রস্তাব এল। এবার আমার বাড়ির লোকজন বললেন, মেয়ের সব ঘটনা ছেলেকে জানানোর পর ছেলে যদি রাজি হয়, তখন দেখাশোনা হবে। তো, এখন যিনি আমার স্বামী, তাঁকে সবকিছু খুলে বলা হলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সব শুনে তিনি বললেন, আমি যে বীরাঙ্গনা, এ জন্যই তিনি আমাকে বিয়ে করতে চান। সব জেনেশুনেই তিনি আমাকে বিয়ে করেছেন।

‘বিয়ে হওয়ার পর আমি ও আমার মা-বাবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছি। আমার একটা ঘর–সংসার হয়েছে। নিরাপদ সম্মানজনক আশ্রয় হয়েছে। মানুষ এখন আমাকে বলে অমুকের বউ, হ্যাঁ, এই জীবনই আমি চেয়েছিলাম।’

এতক্ষণ আলেয়া বিবির পাশে বসে স্ত্রীর কথা শুনছিলেন মো. ইউনুছ মিয়া। আলেয়া যখন যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা বলছিলেন আর তাঁর মুখে ছায়া পড়ছিল সেই বেদনার, সেই সময় তাঁর দিকে মমতাভরা চোখে তাকিয়ে ছিলেন ইউনুছ মিয়া। আমরা কথা বললাম ইউনুছ মিয়ার সঙ্গেও। জানতে চাইলাম, কেন সেদিন সব জেনেশুনে আলেয়া বিবিকে বিয়ে করেছিলেন তিনি? 

খুব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন ইউনুছ মিয়া: 

‘মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টা ১৯৭১ সালে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তাই আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি। এ জন্য আমার মনের ভেতরে একটা অপরাধবোধ ছিল। আমি কেন যুদ্ধে যেতে পারিনি—নিজেই নিজেকে বহুবার এ প্রশ্ন করেছি। আর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যতই ভেবেছি, ততই মনের ভেতরে একটা অশান্তি, একটা অপরাধবোধ কাজ করেছে। ভাবতে থাকি, কী করে এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে একসময় মনে হলো, আমি একজন বীরাঙ্গনাকে বিয়ে করব।

‘যখন আলেয়ার কথা জানতে পারি, তখনই মনে মনে ঠিক করি, তাঁকে আমি বিয়ে করব। যখন আলেয়া আর আমার বিয়ের কথাবার্তা শুরু হয়েছে, সে সময় থেকেই আমার গ্রামের লোক, বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই ওকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছে। বলেছে যে আলেয়া মিলিটারি দ্বারা নির্যাতনের শিকার। তার ওপর সে পঙ্গু, একটা হাত নেই। সংসারের সব কাজ করতে পারবে না। এসব কথা শুনে আমি তাদের বলেছি যে সে তো আর নিজের ইচ্ছায় ইজ্জত নষ্ট করেনি। জোর করে তাকে নষ্ট করা হয়েছে। জোর করে যদি কেউ কাউকে নষ্ট করে, তাতে সে নষ্ট হয় না।

‘সব জেনেই আমি আলেয়াকে বিয়ে করি। আমি জানি, সে আর দশজনের মতন সুস্থ–সবল নয়। তাই সংসারে নানাভাবে কমবেশি কিছু সমস্যা তো হয়ই। তবে সে মন–প্রাণ দিয়ে সংসার করে। আসলে কথা হলো, আমি যে মুক্তিযুদ্ধ করিনি, এই দায় থেকে আমি কিছুটা হলেও মুক্ত হতে পেরেছি আলেয়াকে বিয়ে করে। পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা অবদান তো রাখতে পেরেছি, এটাই এখন আমার বড় সান্ত্বনা।’

কুমিল্লার এক প্রত্যন্ত গ্রামের বীরাঙ্গনা আলেয়া বিবি ও তাঁর স্বামী ইউনুছ মিয়ার জীবনের সত্য গল্প শুনতে শুনতে আমাদের মনের মধ্যে বিষণ্নতা আর আনন্দ একসঙ্গে খেলা করে। এই দম্পতির গল্প আমাদের অন্তরও ছুঁয়ে যায়।