মধুময় সম্পর্কের ব্যঙ্গচিত্র

শিল্পী: শেখ আফজাল
শিল্পী: শেখ আফজাল

সামাজ, সাংসার, রাজনীতিবিষয়ক কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র দেখতে আমরা অভ্যস্ত হলেও আপনজনদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ রংতামাশার কার্টুনচিত্র খুব একটা দেখা যায় না। কলাকেন্দ্রে ‘স্বজনঘাতী রেখা’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে দেখা মিলল চারুশিল্পীদের নিয়ে রঙ্গ-ব্যঙ্গের কার্টুনচিত্র। এখানে কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী ও শিশির ভট্টাচার্য্য কার্টুন হয়ে ধরা পড়েছেন শেখ আফজালের রেখাচিত্রে। আসলে চারুকলায় আফজালের শিক্ষার্থী, সহকর্মী এবং একান্ত কাছের ব্যক্তিরাই এ প্রদর্শনীতে অতিরঞ্জিত, হাস্যকর হয়ে রেখাবন্দী হয়েছেন। অর্থাৎ শিল্পী ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে আনন্দের খেলাই খেলেছেন।

কাজগুলো প্রতিকৃতিপ্রধান। রফিকুন নবী, হামিদুজ্জামান খান, শহীদ কবীর, আবুল বারক আলভী, শিশির ভট্টাচার্য্য, ফরিদা জামান, জামাল আহমেদ, নাসরিন বেগম, নিসার হোসেন, মোস্তাফিজুল হক, সৈয়দ ইকবাল, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, আনিসুজ্জামান প্রমুখ শিল্পীর মুদ্রাদোষ, ব্যক্তিত্ব, ছেলেমানুষি, মান-অভিমান, অপমান, আন্তচরিত্র, প্রেম, বিরহ, ঈর্ষা, রাগ, ক্ষোভ, ভয়, দুর্বলতা প্রভৃতি অতিরঞ্জন করে উপস্থাপন করেছেন শেখ আফজাল। কখনোবা ব্যক্তিত্বের বিপরীতধর্মী চরিত্র দিয়ে তাঁদের খলনায়ক হিসেবেও উপস্থাপন করেছেন। এ ক্ষেত্রে শিল্পীর বন্ধু শামসুদ্দোহার চরিত্রই এসেছে বেশি। এমন একটি ছবিতে দেখা যায়, রাগান্বিত হয়ে শামসুদ্দোহা শাসাচ্ছেন আফজালকে আর আফজাল বিনয়ের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে গোবেচারা হয়ে আছেন। অন্য একটি রেখাচিত্রে আফজাল নিসার হোসেনকে দিয়ে শামসুদ্দোহাকে শাসিয়ে নিচ্ছেন। এ রকম বিভিন্ন শিল্পীর নানামুখী অভিব্যক্তির চিত্র প্রদর্শনীকে রসময় করে তুলেছে বটে, কিন্তু যাঁরা ওই ব্যক্তিচরিত্রকে জানেন না, তাঁদের অবশ্য রস উপলব্ধি করতে একটু অসুবিধা হতে পারে।

২০০০ সাল থেকে আঁকা এই কার্টুনচিত্রগুলোর বেশির ভাগ বিভিন্ন টুকরো কাগজে এবং বলপয়েন্ট কলমে আঁকা, যা স্বনামধন্য কার্টুনিস্ট রফিকুন নবী, শিশির ভট্টাচার্য্যের থেকে আলাদা। রফিকুন নবীর টোকাইয়ে আছে স্কেচের আবহ ও শিশুসুলভ সারল্য, শিশির ভট্টাচার্য্যের কার্টুনে রয়েছে ভারতীয় চিত্রকলার মাধুর্য, পক্ষান্তরে আফজালের এসব কার্টুনসদৃশ রেখাচিত্রে বিশিষ্ট হয়েছে খামখেয়ালিপূর্ণ রেখার চলন এবং সংযমী রেখার আকার-ইঙ্গিতে। আফজাল প্রতিকৃতি আঁকতে পারদর্শী, ফলে প্রতিকৃতি ঠিক রেখে তিনি এখানে একই ফ্রেমে একাধিক মানুষের চরিত্রায়ণ করেছেন​। প্রায় প্রতিটি কাজই রয়েছে শিল্পীর নিজের উপস্থিতি ও আত্মবিশ্লেষণ। বিশেষত এখানে বিষয় হয়ে ওঠা অন্য শিল্পীদের শিশু ও বৃদ্ধকালের আচরণ ও অভিব্যক্তিকে দারুণ ক্যারিকেচারপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন আফজাল। এতে তাঁর ড্রয়িংয়ের পারদর্শিতা আরও উজ্জ্বলরূপে প্রতিভাত হয়েছে।

এ ছাড়া ব্যক্তিচরিত্রে আফজাল যে মান-অভিমান, ক্ষোভ যুক্ত করেছেন, তা সমাজ, সংসার, রাজনীনৈতিক কার্টুনের মতো বিব্রত করে না। বরং একেবারেই নিজেকে নিয়ে, স্বজনকে নিয়ে রসাত্মক হাস্যকৌতুক উদ্​যাপন করতে চান। ফলে একে বলতে পারি এটা মধুময় সম্পর্কের ব্যঙ্গচিত্র। ব্যক্তিচরিত্রের গোপনীয় বা লুকানো অভিব্যক্তি​র কল্পিত উপস্থাপন।

তবে শেষে একটি কথা বলতে চাই, প্রদর্শনীতে যেহেতু ঘুরেফিরে অল্প কয়েকজন মানুষের চরিত্রই রেখাচিত্রে স্থান পেয়েছে, সেহেতু গ্যালারির দেয়ালজুড়ে একই ধরনের একাধিক কার্টুন উপস্থাপন না করে নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরেকটু পরিমিতি রাখলে প্রদর্শনীটি আরও উপভোগ্য হতো। ১৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হয়েছে ১৭ মার্চ।