দ্য আইস অব ডার্কনেস রহস্যজনক এক বই

দ্য আইস অব ডার্কনেস নামের উপন্যাসে কি করোনাভাইরাসের পূর্বাভাষ ছিল? সম্প্রতি দারুণভাবে আলোচিত হয়েছে মার্কিন ঔপন্যাসিক ডন কুন্টজের এ বই
ডন কুন্টজ
ডন কুন্টজ

হঠাৎ করেই একদিন নিখোঁজ হয়ে যায় ড্যানি। খুঁজে খুঁজে হয়রান তার মা ক্রিশ্চিয়া ইভানস। জানেন না ছেলে বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে। অনেক পরে জানা যায়, ছেলে দুর্ঘটনাবশত মানুষের তৈরি বিষাক্ত এক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আটকা পড়ে আছে চীনের এক সামরিক গবেষণাগারে। এমন একটি প্লট নিয়ে গত শতকের ১৯৮১ সালে একটি থ্রিলার উপন্যাস লিখেছিলেন মার্কিন ঔপন্যাসিক ডন কুন্টজ। সেই উপন্যাস সম্প্রতি নতুন করে উঠে এসেছে আলোচনায়। ফলে হু হু করে বেড়ে গেছে এর বিক্রি। বই বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম আমাজন ডটকমের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় বইটি এখন রয়েছে ৩ নম্বরে।

এ বইয়ের নাম দ্য আইস অব ডার্কনেস।

আর ভাইরাসটির নাম? উহান-৪০০!

উহান! শুধু এই একটি শব্দই যথেষ্ট বইটি সম্পর্কে যে কাউকে আগ্রহী করে তুলতে। কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে উহান নামটি খুবই আলোচিত। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী মহামারিরূপে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস এই উহান শহর থেকেই প্রথম ছড়িয়ে পড়েছিল। সুতরাং উহান সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল তো থাকবেই। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু বিষয় রয়েছে এই উপন্যাসে, যা মানুষকে করে তুলেছে আরও কৌতূহলী। সবার মনে একটাই প্রশ্ন—করোনাভাইরাসের পূর্বাভাস কি তবে ’৮১ সালের এই বইয়েই ছিল? পড়ে দেখা যাক তবে।

উপন্যাসে দেখা যায়, চীনের একটি সামরিক গবেষণাগারে একদল গবেষক একটি ভাইরাস তৈরি করেছেন। উদ্দেশ্য, কোনো একটি শহর বা দেশকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া। তারা বলছে, কোনো একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য এটিই হচ্ছে ‘পারফেক্ট ওয়েপন’! কারণ এটি শুধু মানুষকে সংক্রমিত করতে পারে। অন্য কোনো জীবিত প্রাণী এ ভাইরাস বহন করতে পারে না। এ ছাড়া উহান-৪০০ মানবশরীরের বাইরে এক মিনিটের বেশি সময় টিকে থাকতে পারে না। উপন্যাসের একটি চরিত্র জানায়, তারা ওই ভাইরাসটিকে ‘উহান-৪০০’ নাম দিয়েছিল, কারণ এটি উহান শহরের বাইরে তাদের আরডিএনএ ল্যাব বা গবেষণাগারে তৈরি হয়।

উপন্যাসের অপর একটি চরিত্রের মুখ থেকে জানা যায়, উহান-৪০০ মানুষের মস্তিষ্কে সংক্রমণ ঘটায়। এটি মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর একটি টক্সিন ক্ষরণ করে, যা কিনা প্রকৃত অর্থেই আমাদের মস্তিষ্কের টিস্যুগুলো খেয়ে ফেলে। এটা মস্তিষ্কের ওই অংশকে নষ্ট করে দেয়, যা আমাদের শরীরের স্বতঃস্ফূর্ত কাজগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর উহান-৪০০ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে? না। ডট কুন্টজের সেই কাল্পনিক ভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ হতে সময় লাগত চার ঘণ্টা।

এসব তথ্যের সঙ্গে করোনাভাইরাসের মিল আসলে কতটুকু? চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্যমতে, করোনাভাইরাস সংক্রমিত করে মানুষের শ্বাসতন্ত্রে তথা ফুসফুসে, মস্তিষ্কে নয়। বলা হচ্ছে, উহান-৪০০ মানবশরীরের বাইরে এক মিনিটও বাঁচতে পারে না। অপর দিকে করোনাভাইরাস মানবশরীরের বাইরে দিনের পর দিন টিকে থাকছে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার ২ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তু দ্য আইস অব ডার্কনেস-এ বর্ণিত উহান-৪০০ ছড়িয়ে পড়ার ১২ ঘণ্টার মধ্যে মহামারি আকার ধারণ করেছিল।

যেভাবে আলোচনায় এল ‘দ্য আইস অব ডার্কনেস’
গত মাসে লেখক নিক হিনটন তাঁর টুইটারে দ্য আইস অব ডার্কনেস উপন্যাসের একটি পাতা পোস্ট করলে তা মুহূর্তেই ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই পৃষ্ঠাতেই মূলত রয়েছে ‘উহান-৪০০’ ভাইরাসের কথা। টুইটারে উপন্যাসের যে ছবিটি প্রকাশিত হয়েছে, তার কিছু অংশ লাল কালিতে চিহ্নিত করা। তাতে বলা হচ্ছে, ‘তারা (চীনা সামরিক বাহিনী) এটিকে উহান-৪০০ বলে, কারণ উহান শহরের ঠিক অদূরে তাদের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি গবেষণাগারে এটি তৈরি করা হয়েছিল। গবেষণাগারটিতে এটি ছিল মানুষের তৈরি অনুজীবের ৪০০তম সংস্করণ।’

অতএব দ্য আইস অব ডার্কনেস–এ করোনাভাইরাসের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নেই। উহান-৪০০ নামে যে ভাইরাসের কথা বলা হয়েছে, তা শুধুই কাকতালমাত্র। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে ডন কুন্টজের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ব্রিটিশ পত্রিকা ডেইলি মেইল। কিন্তু ডনের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। ডন এখনো নিশ্চুপ।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৮১ সালে প্রকাশিত দ্য আইস অব ডার্কনেস–এ প্রথমে ভাইরাসটির নাম উহান-৪০০ ছিল না। তখন তার নাম ছিল ‘গোর্কি-৪০০’। এটি রাশিয়ার একটি শহরের নাম। পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে বইটির নতুন সংস্করণে কুন্টজ চীনকে একটি খলরাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং ভাইরাসের নাম চীনের উহান শহরের নাম অনুসারে ‘উহান-৪০০’ রাখেন।

কেন নবতর সংস্করণে কুন্টজ এমন পরিবর্তন আনলেন? সে ব্যাপারেও মুখ খুলছেন না এই মার্কিন ঔপন্যাসিক। 

এদিকে সিএনএনের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা সত্য যে করোনাভাইরাসও উহান শহর থেকে ছড়িয়েছে। তবে ভাইরাসটি যে কোনো একটি গবেষণাগার থেকে দুর্ঘটনাক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে, এ ধারণা অমূলক। এটাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গুজব হিসেবে ধরা হচ্ছে এবং বিজ্ঞানীরা এই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা ভাইরাসটির প্রকৃত উৎস সন্ধানের চেষ্টা করছেন। গবেষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, বাদুড়জাতীয় কোনো প্রাণী থেকে এর উৎপত্তি হতে পারে। পরে তা বাহকের শরীর সংক্রমিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, করোনাভাইরাস শুধু বৃদ্ধ এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, তাদের জন্য জীবনের সংশয় সৃষ্টি করছে। কুন্টজের বর্ণিত উহান-৪০০ ভাইরাস এমনটি নয়। তাই বলা যায়, ডিন কুন্টজ একজন লেখক, আধ্যাত্মিক গুরু বা জ্যোতিষী—কেউ নন।

 

সূত্র: ডেইলি মেইল, সিএনএন, এএপি, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

গত মাসে লেখক নিক হিনটন তাঁর টুইটারে দ্য আইস অব ডার্কনেস উপন্যাসের একটি পাতা পোস্ট করলে তা মুহূর্তেই ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই পৃষ্ঠাতেই মূলত রয়েছে ‘উহান-৪০০’ ভাইরাসের কথা। টুইটারে উপন্যাসের যে ছবিটি প্রকাশিত হয়েছে, তার কিছু অংশ লাল কালিতে চিহ্নিত করা। তাতে বলা হচ্ছে, ‘তারা (চীনা সামরিক বাহিনী) এটিকে উহান-৪০০ বলে, কারণ উহান শহরের ঠিক অদূরে তাদের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি গবেষণাগারে এটি তৈরি করা হয়েছিল। গবেষণাগারটিতে এটি ছিল মানুষের তৈরি অনুজীবের ৪০০তম সংস্করণ।’