ঢাকাইয়া ভাষায় আর কবিতা লেখেননি শামসুর রাহমান!

কবি শামসুর রাহমান
কবি শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমান তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ লেখেন ১৯৮৪ সালে। ‘এক ফোঁটা কেমন অনল’ বইয়ের এই কবিতাটি বহুল-আবৃত্ত বাংলা কবিতার একটি। এই কবিতা লেখার আগে শামসুর রাহমান ঢাকাইয়া ভাষায় আর কোনো কবিতা লেখেননি, পরেও সম্ভবত না।
ঢাকাইয়া ভাষায় রাহমানের পরিবারের কেউ কথা বলতেন না, পারতেনও না; যদিও রাহমানের জন্ম ঢাকায়, বড়ও হয়েছেন এই শহরেই।
এক মধ্যরাতের ঘটনা। বন্ধুদের সঙ্গে একটু বেশি মাত্রায়ই ‘উন্নত মানের মদির পানীয়’ পানের পর বাসার উদ্দেশে রওনা হন শামসুর রাহমান। মোটরকার থেকে নামতেই ঠিক গেটের সামনে মহল্লার এক মাতাল যুবক এসে কবিকে কদমবুসি করেন। সস্তা মদের গন্ধ আসছে ভুরভুর করে। ঢাকাইয়া ভাষায় শ্রদ্ধামিশ্রিত কী সব বলে হুট করে গলির মাথায় গিয়ে মিলিয়ে যায় সেই যুবক। রাহমানও বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে রাহমানের মনে পড়ে যায় সেই দৃশ্য। তখনই মাথায় আসে কবিতা লেখার কথা। বিদ্যুল্লতার মতো সিদ্ধান্ত নেন, এই বিশেষ কবিতা তিনি প্রচলিত ভাষায় লিখবেন না। এই কবিতার প্রতিটি শব্দ, বাক্য—প্রথম পঙ্‌ক্তি থেকে শেষ পঙ্‌ক্তি পর্যন্তই ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা দাবি করে।
মূলত মাতাল সেই যুবকের সরল ঢাকাইয়া ভাষাই কবিকে পরিচালিত করেছিল ওই বিশেষ ভাষায় ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ লিখতে। কিন্তু রাহমান তো ঢাকাইয়া ভাষা পারেন না। কী করবেন? এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন তিনি। এই চ্যালেঞ্জে তাঁকে জয়ী হতেই হবে।
তারপর এক দিনের মধ্যেই লিখে ফেলেন ‘এই মাতোয়ালা রাইত’—খাস ঢাকাইয়া ভাষায় লেখা প্রথম কবিতা। অক্ষরবৃত্তে লেখা কবিতাটি ছিল আদ্যোপান্ত এক মদ্যপের স্বগতোক্তি। কবিতাটি লিখতে দু-তিনটি ‘খাস’ ঢাকাইয়া শব্দ তাঁকে সরবরাহ করেছিলেন ‘দৈনিক বাংলা’র তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার মরহুম তওফিক আজিজ খান।
সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ প্রকাশের পরপর পাঠক লুফে নেন কবিতাটি। কবিদের মুখে মুখে, আড্ডার টেবিলে তখন এই কবিতার আলোচনা। অনেক আবৃত্তিশিল্পী কবিতাটি আবৃত্তি করেন নানা অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন জায়গা থেকে সাধুবাদ পেতে থাকেন কবি।
এত জনপ্রিয়তার পরও ঢাকাইয়া ভাষায় দ্বিতীয় কোনো কবিতা লেখেননি রাহমান। এর পেছনেও আছে আরেক যুবকের গল্প।
এক সন্ধ্যারাতে ঢাকা ক্লাবের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে আছেন শামসুর রাহমান। ঠিক তখন এক প্রতিষ্ঠিত ঢাকাইয়া যুবক এসে দাঁড়ান রাহমানের সামনে। সালাম দিয়ে রাহমানকে তিনি বলেন ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ লেখা একদম উচিত হয়নি তাঁর। এ কবিতায় ঢাকার খাস বাসিন্দাদের হেয় করা হয়েছে। যুবকের সেই কথা রাহমানকে বিব্রত করেছিল, মর্মাহত করেছিল দারুণ।
ইচ্ছা সত্ত্বেও আর কখনো ঢাকাইয়া ভাষায় কবিতা লেখেননি শামসুর রাহমান।
পাঠকের জন্য কবিতাটি দেওয়া হলো:


এই মাতোয়ালা রাইত

হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও।
আবে, কোন্ মামদির পো সামনে খাড়ায়? যা কিনার,
দেহস না হপায় রাস্তায় আমি নামছি, লৌড় দে;
না অইলে হোগায় লাথ্থি খাবি, খাবি চটকানা গালে।
গতরের বিটায় চেরাগ জ্বলতাছে বেশুমার।
আমারে হগলে কয় মইফার পোলা, জুম্মনের
বাপ, হুস্না বানুর খসম, কয় সুবরাতি মিস্ত্রি।
বেহায়া গলির চাম্পা চুমাচাট্টী দিয়া কয়, ‘তুমি
ব্যাপারী মনের মানু আমার, দিলের হকদার।’
আমার গলায় কার গীত হুনি ঠান্ডা আঁসুভরা?
আসলে কেউগা আমি? কোন্হানতে আইছি হালায়
দাগাবাজ দুনিয়ায়? কৈবা যামু আখেরে ওস্তাদ?
চুড়িহাট্টা, চান খাঁর পুল, চকবাজার; আশক
জমাদার লেইন; বংশাল; যেহানেই মকানের
ঠিকানা থাউক, আমি হেই একই মানু, গোলগাল
মাথায় বাবরি; থুতনিতে ফুদ্দি দাড়ি, গালে দাগ,
যেমুন আধলি একখান খুব দূর জামানার।
আমার হাতের তালু জবর বেগানা লাগে আর
আমার কইলজাখান, মনে অয়, আরেক মানুর
গতরের বিতরে ফাল পাড়ে; একটুকু চৈন নাই
মনে, দিল জিঞ্জিরার জংলা, বিরান দালান। জানে
হায়বৎ জহরিলা কেঁকড়ার মতন হাঁটা-ফিরা
করে আর আইতে এমুনবি অয় নিজেরেও বড়
ডর লাগে, মনে অয় যেমুন আমিবি জমিনের
তলা থন উইঠা আইছি বহুত জমানা বাদ।
এ-কার মৈয়ত যায় আন্ধার রাইতে? কোন ব্যাটা
বিবি-বাচ্চা ফালাইয়া বেহুদা চিত্তর অইয়া আছে
একলা কাঠের খাটে বেফিকির, নোওয়াব যেমুন।
বুঝছোনি হউরের পো, এলা আজরাইল আইলে
আমিবি হান্দামু হ্যাষে আন্ধার কব্বরে। তয় মিয়া
আমার জেবের বিতরের লোটের মতই হাচা মৌত।
এহনবি জিন্দা আছি, এহননি এই নাকে আহে
গোলাব ফুলের বাস, মাঠার মতন চান্নি দিলে
নিরালা ঝিলিক মারে। খোওয়াবের খুব খোবসুরৎ
মাইয়া, গহীন সমুন্দর, হুন্দর পিনিস আর
আসমানী হুরীর বারাত; খিড়কির রৈদ, ঝুম
কাওয়ালীর তান, পৈখ সুনসান বানায় ইয়াদ।
এহনবি জিন্দা আছি, মৌতের হোগায় লাথ্থি দিয়া
মৌত তক সহিসালামত জিন্দা থাকবার চাই।
তামাম দালানকোঠা, রাস্তার কিনার, মজিদের
মিনার, কলের মুখ, বেগানা মৈয়ত, ফজরের
পৈখের আওয়াজ, আন্ধা ফকিরের লাঠির জিকির—
হগলই খোওয়াব লাগে আর এই বান্দাবি খোওয়াব?


সূত্র: শামসুর রাহমানের আত্মজীবনী ‘কালের ধুলোয় লেখা’ থেকে