ধীরে চলা

>

‘স্লোনেস’ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদ এবং দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের শুরুর খানিকটা আগের কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। ‘স্লোনেস’–এর বাংলা আমি করতে পারতাম, ধীরতা, মন্থরতা, কুঁড়েমি, মন্দগতি। কিন্তু করেছি ‘ধীরে চলা’। বুঝতেই পারছেন, মুখের ভাষার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছি।

এই উপন্যাসের শুরুতে গল্পের কথক একটা গাড়িতে চলেছে। তার পাশে তার স্ত্রী ভেরা। প্যারিস থেকে গ্রামের পথে যাচ্ছে তারা। কিন্তু আমরা জানি না কথকের নাম কী। সে দেখতে কেমন। গাড়িটা কী গাড়ি। লোকটা কী পরেছে। তার স্ত্রীই–বা কী পরেছে। পেট্রলের গন্ধ কি নাকে এসে লাগছে। শুধু পেছনে একটা গাড়ি ওভারটেক করার জন্য ছটফট করছে। সেই ছটফটানি সহ্য নয় কথকের; মানে মিলান কুন্ডেরার। তাই শুরু হলো গতি, স্থিরতা, ধীরতা নিয়ে তার তত্ত্ব কপচানো। ভিভাঁ দেনোঁ তাঁর উপন্যাসে কী লিখেছেন, সেই উপন্যাসের কাহিনি নিজের উপন্যাসে বলছেন মিলান কুন্ডেরা। আপাতত এতুটুকুনই আমরা খেয়াল করব। খেয়াল করব যে দ্বিতীয় চ্যাপ্টার শুরুর আগে থেকেই গল্পের মূল নায়ক-নায়িকা হারিয়ে গেছে। অন্য গল্প চলছে। মিলান কুন্ডেরার ‘স্লোনেস’ উপন্যাস অনুবাদ করেছেন আনিসুল হক

তিন–ক্যানভাসে আঁকা একটা ছবির মতো রাত, তিন পর্বে সাজানো একটা ভ্রমণের মতো রাত, এক. তারা পার্কে হাঁটে, তারপর তারা একটা ছাউনিঘরে সংগম করে, আর শেষে তারা প্রাসাদের এক গোপন ঘরে সংগম চালিয়েই যায়।

দিনের প্রথম আলো ফোটার সময় তারা আলাদা হয়। করিডরের গোলকধাঁধায় শেভালিয়ের হারিয়ে যায়। নিজের ঘর খুঁজে না পেয়ে সে চলে আসে পার্কে। সেখানে, কী আশ্চর্য, তার সাক্ষাৎ ঘটে মার্কিসের সঙ্গে। এই মার্কিসই তো মাদাম দে টির প্রেমিক বলে সে জানে। মার্কিস কেবল এলেন এই প্রাসাদে। তিনি শেভালিয়েকে অভিবাদন জানালেন হাসিমুখে। বললেন, কেন মাদাম শেভালিয়েকে এই রহস্যময় অভিসারে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কারণ, মাদামের একটা আড়াল দরকার ছিল, যাতে তার স্বামী মার্কিসকে সন্দেহ না করে। এই ফন্দি কাজে লেগেছে, তাই মার্কিস খুব খুশি। তিনি শেভালিয়েকে নকল প্রেমিকের মিশনটা পালন করার জন্য খানিকটা খোঁচা মারেন। আগের রাতের প্রেমলীলায় ক্লান্ত যুবক কৃতজ্ঞ মার্কিসের দেওয়া গাড়িতে করে প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেন।

এই উপন্যাসিকার নাম ছিল ‘কোনো আগামীকাল নেই’। ১৭৭৭ সালে উপন্যাসিকাটি প্রথম বেরিয়েছিল। লেখকের নামটা আড়াল করা হয়েছিল ছয়টা রহস্যময় অক্ষর দিয়ে—ম. দে. রা. জ. অ. ভ.। যার মানে করা যায়, মসিয়ে দেনো, রাজার জন্য অপেক্ষমাণ ভদ্রলোক। ১৭৭৯ সালে বইটি আবার বের হয়, এবারও লেখকের নাম ছাড়া এবং খুবই অল্প ছাপা। পরের বছর বইটা বের করা হয় আরেকজন লেখকের নামে। আরও সংস্করণ বের হয় ১৮০২ সালে। ১৮১২ সালে লেখকের আসল নাম ছাড়া এটাকে আবার প্রকাশ করা হয়। অর্ধশতকের উপেক্ষা শেষে বইটি ফের বের হয় ১৮৬৬ সালে। এরপর থেকে এই বইটার লেখক হিসেবে ভিভা দেনোঁ স্বীকৃতি পান।

ওই শতকের বাকি সময়টা এই বইয়ের সুনাম বাড়তেই থাকে। আজকের দিনে এই বইটি আঠারো শতকের শিল্প এবং চেতনার একটা শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।


হেডোনিজম, সুখপরায়ণবাদ বা ইন্দ্রিয়পরায়ণতা, প্রত্যেক ভাষাতেই অনৈতিক ইন্দ্রিয় সুখের জীবনের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। যদিও সরাসরি ব্যাপারটাকে পাপ বলে নির্দেশ করা হয় না। এটা ভুল, অবশ্যই: আনন্দ বিষয়ে প্রথম মহান তাত্ত্বিক এপিকিউরাস, সুখী জীবন সম্পর্কে খুব একটা পলায়নবাদী ধারণা পোষণ করতেন; তিনি মনে করতেন, আনন্দ হচ্ছে দুর্ভোগের অবসান। তা হলে দাঁড়ায়, দুর্ভোগ হেডোনিজমের মৌলিক একটা চিহ্ন। একজন ততটুক পরিমাণেই সুখী, যতটুক পর্যন্ত সে দুর্ভোগ এড়াতে পারে। যেহেতু আনন্দ প্রায়ই সুখহীনতা ডেকে আনে, সুখের চেয়েও বেশি করে আনে অ-সুখ, সুতরাং এপিকিউরাস সেই সুখকেই অনুমোদন করেন, যা ভবিষ্যতের কথা ভাবে, যা পরিমিত। এপিকিউরীয় জ্ঞানের পেছনে আছে বিষাদের একটা পর্দা: দুনিয়ার দুঃখ–কষ্টের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে মানুষ একটাই পরিষ্কার এবং নির্ভরযোগ্য মূল্যবোধ দেখতে পায়, তা হলো সুখ, অতি তুচ্ছ পরিমাণে সুখ, যা সে তার নিজের জন্য অনুভব করতে পারে: একটুখানি শীতল জল পান, একটুখানি আকাশের দিকে তাকানো (খোদার জানালার দিকে), একটুখানি আদর।

যে ব্যক্তি পায়, আনন্দ শুধু তার, পরিমিত কিংবা অপরিমিত, সুতরাং একজন দার্শনিক ন্যায্যভাবেই হেডোনিজমের সমালোচনা করতে পারেন, কারণ তা কেবল নিজেতেই নিহিত। তা সত্ত্বেও আমি দেখি এভাবে, হেডোনিজমের দুর্বল জায়গা, একিলিসের গোড়ালিটা, এটা নয় যে তা আত্মকেন্দ্রিক, বরং তা তা ইউটোপিয়ান (আহা, আমার ধারণা যদি ভুল হতো!)। আসলে আমার সন্দেহ হয় যে আসলেই আদর্শ হেডোনিজম কোনো দিনও অর্জন করা সম্ভব। আমার আশঙ্কা, যে ধরনের জীবনের সুপারিশ তা করে, সেটা কোনো দিনও মানবস্বভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে না!

আঠারো শতকের আর্ট নৈতিকতার নিষেধাজ্ঞা-কুয়াশা থেকে আনন্দকে আলাদা করেছিল। এটা মনের সেই কাঠামোটাকে আনতে পেরেছিল, যাকে আমরা বলি লিবারটাইন, অবদমনমুক্ত মানুষ। ফ্রাগোনার্দ এবং ওয়াতোর চিত্রকলা, দে সাদে, জুনিয়র ক্রেবিয়ঁ বা শার্ল দুকলোর পৃষ্ঠা থেকে যার রশ্মি বিকীর্ণ হয়েছে। এই কারণেই আমার তরুণতর বন্ধু ভিনসেন্ট আঠারো শতকের প্রশংসা করে। যদি পারত, সে তার বুকে মার্কিস দে সাদের নামফলক বহন করত। আমি তার এই মুগ্ধতা শেয়ার করি। কিন্তু তার সঙ্গে আমি এটাও যোগ করতে চাই, আর্টের সত্যিকারের মহত্ত্ব হেডোনিজমের প্রোপাগান্ডা বা অন্য কিছুর ওপরে নির্ভর করে না, বরং নির্ভর করে এটার ব্যাখ্যার ওপরে (কিন্তু আমার এই কথা কেউ শোনে না)। এই কারণেই আমি Pierre Choderlos de Laclos-র লেখা ‘লে লিয়াজোঁ দঁজারেজোঁ’-কে (ডেঞ্জারাস লিয়াজোঁ) সর্বকালের সেরা উপন্যাসের একটা বলে গণ্য করি।

এর চরিত্রগুলো কেবল প্রমোদকে জয় করে নেওয়া নিয়ে চিন্তিত নয়; একটু একটু করে পাঠকেরা বুঝতে পারেন, তাঁরা আসলে আকৃষ্ট হচ্ছেন প্রমোদ দিয়ে নয়, বরং জয়ের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে। প্রমোদের জন্য কামনা নয়, বরং বিজয়ের আকাঙ্ক্ষাই এই বইয়ের মূল সুর। এটা প্রথম দেখা যায় তখন, যখন একটা প্রমোদপূর্ণ খেলা চুপিসারে আর অনিবার্যভাবে জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে পরিণত হয়। কিন্তু সংগ্রামের সঙ্গে হেডোনিজমের সম্পর্ক কী? এপিকিউরাস লিখেছেন, ‘কোনো জ্ঞানী ব্যক্তিই সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত কাজের সন্ধান করেন না।’ (চলবে)