করোনার দিনে কেন 'দ্য প্লেগ' পড়বেন

দ্য প্লেগ আলবেয়ার ক্যামু
দ্য প্লেগ আলবেয়ার ক্যামু

করোনাভাইরাস মহামারির এই দিনে আলবেয়ার ক্যামু রচিত ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি কেন পড়বেন একজন গল্পকার বা ঔপন্যাসিক অথবা কবি? কী সাদৃশ্য আছে এই ‘দ্য প্লেগ’ বইটি এবং ২০২০ সালে ছড়িয়ে পড়া মহামারি কোভিড-১৯–এর মধ্যে?

আলবেয়ার ক্যামু বনাম বাংলাদেশের একজন স্বপ্নবাজ গল্পকার?
-কামুর প্লেগ আইডিয়া
-গল্পের রাজনীতি বা রাজনৈতিক গল্প
-প্রতিকী উপন্যাস
-ফ্রান্সে দখলদার নাৎসি বাহিনী কতৃক অবরোধ, আলজেরিয়ার নির্যাতিত নিপীড়িত আরব গোষ্ঠী।
-২০২০ সালের দক্ষিণ এশিয়া। বাংলাদেশ-ভারত-চীন-পাকিস্তান। মধ্যপ্রাচ্য-দূরপ্রাচ্য। উন্নত ও অনুন্নত বিশ্ব এবং জীবাণুযুদ্ধ।
-বাকস্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার ও ধর্মীয় অধিকারের পক্ষে বিরোধপূর্ণ লড়াই, দিনের পর দিন সড়ক দখল করে আন্দোলন, বিবিধ স্তরের শাসক ও কর্তৃপক্ষ এবং জনসাধারণের কাণ্ডজ্ঞান ও সচেতনতার চর্চা।
-অথবা একটি নির্দিষ্ট শহরের ভয়ভীতি, সংকট ও দ্বন্দ্বের চিত্র। একজন চিকিৎসকের অসম সাহসী সংগ্রাম। সেই শহরের জনগোষ্ঠীর অভ্যাসগুলো, স্বভাবসমূহ ও জীবনাচার।
আলবেয়ার ক্যামু কে ছিলেন?
অনেক ধরনের পেশাজীবিতা, এর মধ্যে ফুটবলার পরিচয়ও ছিল। আলজেরিয়ায় জন্ম, ফ্রান্সে বাস। সাহিত্যিক। সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও দখলদার জার্মান হামলার প্রতিবাদকারী। নিষিদ্ধ পত্রিকা ‘কোঁবা’–এর সম্পাদক, বুদ্ধিজীবিতা ও সাংবাদিকতা। ১৯১৩ সালে আলজেরিয়ায় জন্ম, ১৯৫৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ।
আলজেরিয়ার মন্দোভিদে জন্মগ্রহণ করা দার্শনিক ও সাহিত্যিক ক্যামু ১৯৬০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

করোনার দিনে ‘দ্য প্লেগ’ পড়বেন একজন গল্পকার বা সচেতন মানুষ, কিন্তু কেন? কী কী টুকে নেবেন এই বইটি থেকে?

দ্য প্লেগ
দ্য প্লেগ

ক্যামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি বইটি পড়া থাকলে এ আলোচনা সহজতর হবে পাঠকের জন্য। আর না পড়ে থাকলে পড়বেন বলে সংগ্রহ করেছেন, আগ্রহ আছে, অথবা পড়া শুরু করেছেন, তাঁরাও আশা করি পাঠ–আনন্দ পাবেন।
ক্যামু ছিলেন আলজেরিয় দার্শনিক, লেখক ও সাংবাদিক। সাহিত্যে দ্বিতীয় কনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী। তাঁর শৈশব কেটেছে দরিদ্রতার মাঝে। পড়াশোনা করেছেন দর্শন নিয়ে আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একজন টগবগে যুবক, তরুণ লেখক। ‘কোঁবা’ নামে একটি নিষিদ্ধ পত্রিকার সম্পাদনা করতেন, ‘কোঁবা’র জন্য লেখা আর্টিকেল জোগাড়-যন্তের দায়িত্বে ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিরা যখন ফ্রান্স দখল করে নেয়, ক্যামু সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে একসময়ে ক্যামু ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগদান করেন।
ক্যামুর বিষয়ে এতটুকু তথ্য থেকে তাঁর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলোর মাঝে তিনটি চরিত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য আমরা দেখি।
১. চিকিৎসক বার্নার্ড রিও: তাঁর শৈশব কাটে দারিদ্র্যের মাঝে। পাশাপাশি রিওর দার্শনিকতা ও নিরপেক্ষ চরিত্র, জীবন-মৃত্যু নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, যা ক্যামুর মতোই।
২. জাঁ তারিউ: তারিউ মহাপুরুষ হতে চান। সক্রিয় কর্মী ছিলেন কিছু রাজনৈতিক আন্দোলনে। পর্যবেক্ষক ও নিয়মিত ডায়েরি লেখার অভ্যাস থেকে বিবিধ ঘটনা টুকে রাখেন।
৩. র‍্যঁ বেয়া: বড় শহরে সাংবাদিকতা করেন। তথ্য সংগ্রহ করতে এসে ওরাওয়ের মতো ছোট্ট শহরে আটকা পড়েন এবং সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন এবং সুযোগ পেয়েও সিদ্ধান্ত পাল্টে ওরাও শহরের স্বেচ্ছাসেবীদের দলে যোগদান করেন। কিন্তু র‍্যঁ বেয়ার মন পড়ে থাকে অন্য শহরে, তাঁর প্রেমিকার কাছে। ঠিক ক্যামু যেমন তাঁর সব লেখাতেই আলজেরিয়াকে রেখেছেন, ফ্রান্সে বাস করেও তাঁর মন সারাক্ষণ আলজেরিয়াতেই ছিল যেন।
এই তিনজনের সবকিছু, সব অভিজ্ঞতা ঘুরেফিরে আলবেয়ার ক্যামুর বাস্তব জীবনের ঘটনা যেন।
ক্যামুর রাজনৈতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকলাপ কিছুটা অভিনবই ছিল সেই সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে।
ক্যামুর সময়ের বিদ্যমান স্বৈরতন্ত্র ছিল এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা এমন একধরনের সরকার, যারা বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে। ব্যক্তিগত বিরোধিতাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি জনজীবনে প্রচণ্ড ও সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন করছে। এ সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রগুলোর স্বৈরশাসকদের হাতে গণমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, এ সময়ে আমরা সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। বিশ্বের অনেক দেশেই তা বিরাজমান।
গণমাধ্যমগুলো সারাক্ষণ সরকারি প্রপাগান্ডায় ব্যস্ত থাকে—এ চিত্র ক্যামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসের পরতে পরতে আমরা খুঁজে পাই। একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে, উপন্যাসের শুরুতেই, একটি ঘটনা ঘটে, যেখানে চিকিৎসক রিও এবং সাংবাদিক র‍্যঁ বেয়া প্রথমবার একটি সাক্ষাৎকারের জন্য মুখোমুখি হয়েছেন। সাংবাদিক নিপীড়নের শিকার আলজেরীয় আরবদের অবস্থা নিয়ে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলে, ডাক্তার রিও সুকৌশলে তা এড়িয়ে যান। এড়িয়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হলো, স্বৈরতন্ত্র এবং তার খড়গ হস্তের ভয়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে স্বৈরশাসকের অন্যায় কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কোনো প্রচার বা সংবাদ পরিবেশন করলে অত্যাচারিত হওয়ার ভীতি। সাংবাদিক র‍্যঁ বেয়া বুদ্ধিমান লোক, তিনিও আর চাপাচাপিতে যান না। সাক্ষাৎকার চলতে থাকে।
কিন্তু গোটা উপন্যান পাঠে, সর্বগ্রাসী শাসনব্যবস্থাগুলো কতটা বিস্তৃত, রাজনৈতিক দমন, গণতন্ত্রের অভাব, কাল্টিজম বা ব্যক্তিবিশেষ অন্ধভক্তি, পরম ভক্তিশীলতার সংস্কৃতিবাদ (এ সময়ে সরকারের প্রশংসা এবং ধর্মীয় অনুশীলন সমান্তরালভাবেও বাড়বাড়ন্ত। বলাবাহুল্য হবে না, সরকার ও ঈশ্বরের ভূয়সী বন্দনার ধরনসমূহ সেই যুগে এবং এই যুগেও একই রকম)। উপন্যাসে অর্থনীতির ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ, বাকস্বাধীনতাহীনতা, গণনজরদারি এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক ব্যবহারও পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।
সর্বগ্রাসী শাসনের চেহারাটি আমরা বিভিন্ন দেশীয় সংস্কৃতি অনুশীলনে দেখেছি, দেখছি, দেখব-কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলো (প্লেগ উপন্যাসের পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে), বাকস্বাধীনতা ও অধিকারসহ বিবিধ বিষয়ে দমনকারী গোপন পুলিশ বাহিনী, ধর্মীয় নিপীড়ন, স্টেটস-এথিজম বা রাষ্ট্রের দুষ্টতা, মৃত্যুদণ্ড বা গুম–খুনের অবাধ অনুশীলন, প্রতারণামূলক নির্বাচন (যদি তারা অনুষ্ঠিত হয়) এবং সম্ভাব্য রাষ্ট্র কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতা গণহত্যা ও জেনোসাইডগুলো স্পষ্ট।

ক্যামু রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বগ্রাসী স্বৈরতন্ত্রের বিরোধীদের দলে ছিলেন। তিনি পুরোদস্তুরই লেফটিস্ট বা বামপন্থী ছিলেন।
বামপন্থী রাজনীতি প্রায়ই বিবিধ সামাজিক উঁচু–নিচু শ্রেণির ধারণার বিপক্ষে সমানাধিকার ও সাম্যবাদের সমর্থন করে। বামপন্থা রাজনীতি মূলত সুবিধাবঞ্চিতদের সমানাধিকার নিয়ে কথা বলে। আওয়াজ তোলে এমন সবকিছুর বিলুপ্তি সাধনের প্রয়োজনে, যেখানে বিচারবহির্ভূত বৈষম্যের ঘটনাগুলো ঘটেছে বা দৃষ্টান্ত রয়েছে।
ফরাসি বিপ্লব (১৭৯৯) চলাকালীন এই ‘বাম’ ও ‘ডান’ অর্থাৎ ‘লেফট’ ও ‘রাইট’ পলিটিক্যাল টার্মসগুলোর ব্যবহার শুরু হয়, এটি মূলত ফরাসি এস্টেট জেনারেলদের বসার ব্যবস্থাটির কথা উল্লেখ করে। অর্থাৎ যাঁরা বাঁ দিকে বসেছিলেন, তাঁরা রাজতন্ত্রের বিরোধিতা করেছিলেন এবং বিপ্লবের সমর্থন করেছিলেন, সঙ্গে চেয়েছিলেন একটি গণপ্রজাতন্ত্রী ও সেক্যুলার রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করতে। অন্যদিকে রাইট উইং বা ডান দিকে যাঁরা বসেছিলেন, অথবা ডানপন্থীরা ওল্ড রেজিম বা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের সমর্থক ছিলেন। সাধারণত যাদের মধ্যে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্ব নিয়ে কোনো গোঁড়ামি ছিল না, তাঁদেরই বামপন্থী হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।
ক্যামু একজন মোরালিস্ট বা নীতিবাদী ছিলেন। নৈতিকতাবাদ এমন একটি দর্শন, যার উত্থান ঘটে উনিশ শতকের সামাজিকভাবে কিছু নৈতিকতার অনুশীলনের ধারণা নিয়ে। যেমন ন্যায়বিচারের স্বাধীনতা, সাম্যের অনুশীলন, সামাজিক পরিমণ্ডলে আত্মসংযম ও সহনশীলতার চর্চা ইত্যাদি। ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসে এই রকম কিছু চিত্র আমরা দেখতে পাই। সেখানে জাঁ তারিউ এবং চিকিৎসক রিও উভয়ের মধ্যেই নীতিবাদী–চরিত্রগত বেশ কিছু ব্যাপার পরিলক্ষিত হয় বারবার বিভিন্ন ধরনের আলাপচারিতা ও ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে।

আলবেয়ার ক্যামু
আলবেয়ার ক্যামু

ক্যামু নীতিবাদী দর্শনের পাশাপাশি নৈরাজ্যবাদী শ্রমিক আন্দোলনের প্রতি ঝুঁকেছিলেন। প্লেগ যখন চূড়ান্তভাবে ওরাও শহরে আক্রমণ করছিল, সামাজিক আচরণ ও শাসকের আচরণেও অনেক কিছু সেখানে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। খাদ্যসংকট, বেকারত্ব ও অন্য বৈষম্যগুলো ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছিল। এ ব্যাপারটি নিয়ে বিভিন্ন উৎসবের উদযাপনে ধনী-গরিবের আচরণ ও বাজারব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক চিত্র বেশ ভালোভাবেই ক্যামু ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ‘প্লেগ’ উপন্যাসে।
আলজেরিয়ার যুদ্ধের সময়ে তিনি একটি নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে বহু সংস্কৃতি ও বহুত্ববাদী আলজেরিয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁর এমন অবস্থান, যা সে সময়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। ক্যামু ইউরোপীয় একত্রীকরণ ধারণাপন্থী সংগঠনগুলোরও সমর্থক ছিলেন। সেই সময়ে বেশির ভাগ পক্ষই তাঁর বহু সংস্কৃতি ও বহুত্ববাদী আলজেরিয়ার পক্ষের প্রস্তাবটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল।
দার্শনিক দিক থেকে লক্ষ করলে, আলবেয়ার ক্যামু এবসার্ডিজম বা নিরর্থকতাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। ক্যামুর কাছে পৃথিবীতে ঘটা সবকিছুকে যৌক্তিক বলে মনে হয় না। তাঁর সৃষ্টিকর্মগুলোর জন্য তাঁকে একজন অস্তিত্ববাদী হিসেবেও বিবেচনা করা হয়, যদিও এই আখ্যাটি তিনি সারা জীবন প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন।
ক্যামুর ‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটি লেখার ভাবনাটি প্রথমবার মনে মনে ভাবতে শুরু করেছিলেন ১৯৩৯ সালের শুরুর দিকে। কিন্তু ফ্রান্স পরাজিত হওয়ার পরও, যত দিন না জার্মানরা তাদের দখলদার সৈন্যদের সরিয়ে নিয়েছিল, তত দিন বাস্তবিকই লেখার কাজে হাত দেননি তিনি। কিন্তু এই বছরগুলোতে ক্যামু একগুচ্ছ নোটবুক বা ডায়েরিতে ছোট ছোট ঘটনাপঞ্জি আকারে অনেক তথ্যই টুকে রাখছিলেন। যার অনেক কিছুই এই উপন্যাসের প্লট তৈরির ধারণাগুলোতে পরে কাজে লেগেছিল এবং বইটি সম্পূর্ণভাবে সমাপ্ত করতে বেশ সহায়ক হয়েছিল।
প্রথম দিকে ক্যামু ‘প্লেগ’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে সতর্ক ছিলেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে এসেও উপন্যাসের নামকরণ হিসেবে ‘প্লেগ’ শব্দটি ব্যবহার করতে ইচ্ছুক ছিলেন না তিনি। এর পরিবর্তে ‘দ্য প্রিজনার’ শব্দটি বিবেচনা করেন এবং পরবর্তী সময়ে বেশ ঘন ঘন এই বন্দী ধারণাটিকে ব্যবহার করা শুরু করেন লেখা কাহিনিগুলোতে, জার্নালে, ডায়েরিতে। বিশেষ করে পৃথককরণ বা কোয়ারেন্টিন বা সেপারেশন থিমটিকে প্রতিপাদ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন বারবার। এবং আমরা দেখতে পাই—বিভিন্ন ধরনের বিচ্ছেদ উপন্যাসের প্রথম অংশের কিছু পর্বগুলোতে ইতিমধ্যেই প্রতীয়মান। প্লটলাইনের মধ্যে, অনেকগুলো চরিত্র তাদের স্বল্প সময়ের লোভ, তাদের কাছের মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসার অভাব এবং তাদের বিবিধ ব্যাপারে উদাসীনতার মাধ্যমে একে অপরের থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি ওরাও শহরে প্লেগের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে জীবিত ও মৃতদের বিচ্ছেদও রয়েছে। অসুস্থ ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন শিবিরে রাখা হয়েছে। আত্মীয় ও পরিবার থেকে পৃথক হয়ে গেছে। প্লেগের সেই ভয়াবহ দিনগুলোর বর্ণনায় এখনকার ২০২০ সালের নভেল করোনাভাইরাসের সময়কাল যেন তাকালেই ফিরে ফিরে আসে।
এই উপন্যাসের দার্শনিক পর্যালোচনায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার হলো—প্রকৃতি এবং ওরাও শহরবাসীর বিচ্ছেদ। এককথায় উপন্যাসের পরিবেশ নির্বাচন ও চিত্রনটি অনন্য। ‘সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী একটি শহর। মহামারির অসুস্থ কলুষিত দিনগুলোতেও প্রকৃতি ভীষণ উজ্জ্বল, মানুষের দুর্দশার কোনো অস্তিত্ব নেই বলেই মনে হয়। এটাই হচ্ছে “দ্য প্লেগ” উপন্যাসের মূল ধারণা বা ব্যাপার।’
মানুষ চায় এবং ঐকান্তিকভাবে প্রার্থনা করে স্বর্গীয় কোনো শক্তির কাছে, যা তার নিজের থেকেও বিশাল, তার চেয়েও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কেউ, তিনি ঈশ্বর। কিন্তু মানুষের ডাকে সাড়া দেন না তিনি, তার প্রতিক্রয়া ক্যামু দেখাচ্ছেন কেবল সুন্দর সূর্য-উত্তপ্ত নীরবতা দিয়ে। মানুষ আর তার মহাবিশ্বের মাঝে কেবল বিচ্ছেদই বড় সত্য।
সবচেয়ে বিড়ম্বনার ব্যাপার হলো, প্লেগ উপন্যাসে মানুষকে এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে এবং এই বিচ্ছিন্নতার সময়কাল যেন অসম্ভব দীর্ঘ ও প্রতিকূল, যা ফুরোয় না কখনো। প্লেগের দিনগুলোতে মৃত্যু ছাড়া কিছুই নিশ্চিত নয়। সবাই বিচ্ছিন্ন। একা।
এবং এটাই ধ্রুব সত্যের মতো ক্যামু বিশ্বাস করেছিলেন। উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন, ওরাও শহর বাহ্যিক জগতের সঙ্গে ফটক বন্ধের মাধ্যমে পুরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এবং মহামারি প্লেগ দ্বারা বন্দী হয়ে থাকছে লম্বা একটা সময়। ওরাও শহরের এই চরম প্রতিকূল বৈরী পরিস্থিতিতে ক্যামু এমন কিছু চরিত্র তৈরি করেছেন, যারা শহরের সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবতে, সময়োচিত বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করতে এবং স্বচ্ছন্দ জীবনধারণের দায়িত্ব নিজ নিজ কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়।
ওরাওবাসীদের অনেকেই প্রথমবারের মতো এ রকম মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে, সে আলোকে প্লেগ মহামারির সব বিভীষিকা সামনাসামনি মোকাবিলা করে ২০২০ সালে বিশ্ববাসী ভয়াবহ এ করোনা ভাইরাস কীভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে, তা অনুধাবন করা যায়।
ক্যামুর উপন্যাসের প্লেগ অবশ্যই ওরাও শহেরর সমস্যা বা বিপর্যয়ের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তা অনেক বেমি প্রতীকী। মহামারি প্লেগের প্রতীকী ইঁদুরের লক্ষণগুলো দিয়ে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে বিভ্রান্তিকর সময় ওরাওবাসী পার করছে, তা মিলে যাচ্ছে আমাদের এ সময়ের সঙ্গে। প্লেগ সব মন্দ ও দুর্ভাগ্যের জন্য যথার্থ প্রতীক।
‘দ্য প্লেগ’ উপন্যাসটির রূপক ভাবটি ত্যাগ করে আমরা যদি বাস্তবিক চোখে লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাই, ক্যামু যখন প্লেগ লেখা শুরু করেছিলেন, যে সময়ে তাঁর দেশ জার্মানদের দখলে ছিল, একটি সম্পূর্ণ পরাধীন দেশে তিনি বাস করছিলেন। যেভাবে প্লেগের আবির্ভাবে ওরাও শহরের সীমানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই তাঁর দেশকে পুরোপুরি কারাবরণ করিয়ে রাখা হয়েছিল যেন। পুরো দেশ এবং স্থানীয় নাগরিকদের জীবনে ধ্বংস, মৃত্যু এবং অপরিমেয় দুর্ভোগে নিপতিত ছিল। সেই নিষ্ঠুর সহিংসতা প্লেগের নিষ্ঠুরতার মতোই প্রকট ও অন্যায়।
পরাধীন ফ্রান্সে প্লেগের লক্ষণ সম্পর্কে অন্য দেশগুলোও জানত, কিন্তু সতর্ক হয়নি কেউ। দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল প্লেগ দেশ থেকে দেশান্তরে। এখনো কি তা–ই ঘটছে না? তাই এ সময়কে বোঝার জন্য নতুন করে পড়ুন ‘দ্য প্লেগ’ আরেকবার, মিলিয়ে নিন।