মঞ্জরি, স্মৃতিমঞ্জরি

আবুল হাসনাত এর অব্যবহিত আগে লিখেছেন প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য নামের খণ্ডস্মৃতির মনোহর বই, এবার আত্মজৈবনিক মুক্তগদ্যের বই হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে। ধরাবাঁধা ধ্যানধারণা, প্রচল সমাজ ও সংস্কারের বিরুদ্ধে এবং সমতাবাদী, উদার-মানবিক আগামীর স্বপ্নে গত শতকের ষাটের দশকে যে প্রজন্ম রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক লড়াই করেছেন, তাঁদেরই একজন আবুল হাসনাত। তাঁর আত্মজীবনী যে বিধিগত ধারাক্রম মেনে চলবে না, এ-ই স্বাভাবিক।

প্রাবন্ধিক-চিত্রসমালোচক বা সম্পাদক আবুল হাসনাত যে ‘মাহমুদ আল জামান’ নামে কবিতা লিখে থাকেন, তা এই বইয়ের পাঠককে না বলে দিলেও চলে। কারণ, তিন শতাধিক পৃষ্ঠার এ স্মৃতিমঞ্জরির গুণী গদ্যের গহনে পাঠক কবিতার নাছোড় লাবণ্য টের পাবেন, যদিও তা অযথা ভাবালুতা থেকে নিরাপদ দূরে।

এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর প্রাক্কালে যে বই প্রকাশিত হলো, তা শুরুই হয়েছে ১৯৭১ থেকে যখন লেখকের বয়স আটাশ বছরের। ‘৭১’ তাঁর কাছে সংখ্যামাত্র নয়, বরং বেঁচে থাকার অবিকল্প জল ও আগুন। পরিপার্শ্বের সবকিছুতে বিলগ্ন এক বালকের অবতারণা দেখি বইয়ের সূচনাভাগে, যে বালক জীবনের আটাশ বসন্ত পেরিয়ে দেখেন, মা ছাড়া তাঁকে যথার্থ অনুধাবনের মতো আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। অবশ্য ছিল একজন; জননী জন্মভূমি বাংলা:

মা সমগ্র জীবন কৃচ্ছ্রসাধনকে মেনে চলেছেন এবং নিরাভরণ জীবন যাপন করেছেন। আমি যখন মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ১৯৭১ সালে ২৯ মার্চ চলে যাচ্ছি বন্ধু ডা. ওয়াজেদুল ইসলামের সঙ্গে নিরুদ্দেশে, তখনো তিনি আমাদের বাড়ি ৯২ যুগিনগরের দোতলার রেলিংয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যতক্ষণ আমাকে দেখা যায়, ততক্ষণই তিনি নির্নিমেষ চেয়ে ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ‘খুব শিগগির ফিরব’ বলে আমি চলে যাচ্ছি—এই বাড়ি ফেরা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। (পৃষ্ঠা ৯-১০)।

যুদ্ধজয়ী সন্তানের ঘরে ফেরার পাশাপাশি এই বইয়ে বারবার এসেছে বদরুদ্দীন উমরের বয়ানে বাঙালি মুসলমানের বাঙালি হয়ে ‘ঘরে ফেরা’র কথা। আপাত রাজনৈতিক, মূলত সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় আবিষ্কারের সৃজনকল্পনামুখর বিশ্বস্ত বিবরণী হয়ে ওঠে এই বই।

এই বইয়ের সর্বত্রই সমষ্টিচেতনার এমন টিপছাপ লক্ষ করব আমরা, যেখানে বৃহৎ মানুষের তরে একটি অনিন্দ্য প্রভাতের জন্য নিদারুণ নিশি পার হয়ে আসতে হয়েছে লেখক ও তাঁর সতীর্থদের। খণ্ড খণ্ড পর্ববিভাজনে বাঙালি জীবনের মোড় ফেরানো ঘটনা, পত্রপত্রিকা, সংগঠন ও ব্যক্তির প্রসঙ্গ এসেছে ফিরে ফিরে; আবার সবে মিলে এক অখণ্ড বোধিচিত্র অঙ্কিত হয়ে চলে পাঠকের পটে। একাত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারির উত্তাপ, পঁচিশে মার্চের কালরাত, ওয়ারী-যুগিনগর-বনগ্রাম লেনের ধূলিবালি, ক্রিকেটের মাঠ থেকে ছাত্র-আন্দোলনের রাজপথ, সংস্কৃতি সংসদের দিনরাত, একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু জীবন ও বুদ্ধিজীবী সহায়ক সমিতির ভূমিকা, কালীরঞ্জন শীল ও জগন্নাথ হলে পাকবর্বরতা, লায়লা সামাদ ও নারী সাংবাদিকতা, রুশ বিপ্লবের পঞ্চাশ বছর, সংবাদ-বার্তা ও সাহিত্য বিভাগ, এরশাদের ক্ষমতা দখল ও কবিতাচর্চা, কাইয়ুম চৌধুরীর অন্তিম মুহূর্ত, আলী আকসাদ ও শান্তি আন্দোলন, সৈয়দ হাসান ইমাম ও রক্তকরবী প্রযোজনার ইতিবৃত্ত বর্ণিত হয়েছে, যাঁরা লেখকের এবং এই দেশেরও জীবনবৃত্তে সম্পন্নতা আনে। বিষ্ণু দে–ইলা ও রমেন মিত্র-শঙ্খ ঘোষ-সন্‌জীদা খাতুনের মতো খ্যাতকীর্তি বাঙালির পাশাপাশি তিনি বিস্মৃত নন জীবনঝড়ে হারিয়ে যাওয়া সাধারণ বন্ধুকেও। কমরেড নূরুর রহমানের ভাগ্যাহত জীবনকে তুলে ধরতে গিয়ে তুলির সামান্য আঁচড়ে অঙ্কন করেন এ সমাজেরই বিষম ছবি:

নূরুর রহমান ছিলেন তেমনি একজন মানুষ। যাঁকে কমিউনিস্ট পার্টি আমেরিকা ভ্রমণের জন্য সাময়িকভাবে তাঁর সদস্যপদ স্থগিতও করেছিল। আজ বিস্মিত হই, বর্তমানে এই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের পুত্র ও কন্যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকায় এবং জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানে কতই না তাঁদের প্রয়াস! (পৃ. ২১৮)।

এই স্মৃতিকহনের মূল্য নিজের চেয়ে অন্যকে বিশদ করাতে। লেখক নিজে সংবাদ সাহিত্য সাময়িকী, গণসাহিত্য কিংবা কালি ও কলম সম্পাদনা করে কিংবদন্তি সম্পাদক হিসেবে বরিত, কিন্তু আত্মকথায় সে বিষয়ে বাগবিস্তার না করে বারবার বলেছেন শহীদুল্লা কায়সার, জহুর হোসেন চৌধুরী, আহমদুল কবির, সন্তোষ গুপ্ত, বজলুর রহমান কিংবা বন্ধু মতিউর রহমানের সম্পাদনা-সাফল্যের কথা। পরিপার্শ্বের সবার সাফল্য তাঁর কাছে নিজের অর্জনের চেয়ে অধিক উদ্‌যাপনীয়, কারণ, তিনি ‘আমি’র বদলে ‘আমরা’ প্রত্যয়ে আদ্যন্ত বিশ্বাসী।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পূর্ণতার জন্য আবুল হাসনাতের হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজের কাছে উৎসুক গবেষকদের আসতেই হবে আর সব শ্রেণির পাঠক এর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় পাবেন স্মৃতিগন্ধে ভরপুর এক পুষ্পপুস্তকের স্বাদ।