বন্দিত্বকালীন সময়ের সৃষ্টিগুলো

>কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণজনিত মহামারির ফলে পৃথিবীব্যাপী এখন চলছে স্বেচ্ছাবন্দী হওয়ার কাল। তবে পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম সময়কালগুলোতেই আমরা পেয়েছি মহান কিছু সৃষ্টি। বিভিন্ন সূত্র ঘেঁটে জানাচ্ছেন ফারহানা আজিম

শেক্‌সপিয়ারের ‘কিং লিয়ার’
১৬০৩ সালে ইংল্যান্ডে যখন প্লেগ মহামারি দেখা দেয়, সে সময় স্বেচ্ছা অন্তরীণ থাকা অবস্থায় ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) রচনা করেন তাঁর অনবদ্য মাস্টারপিস কিং লিয়ার। শেক্‌সপিয়রের লেখা ট্র্যাজেডিগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে মর্মান্তিক নাটক। ব্যক্তিজীবনে শেক্‌সপিয়ার রক্ষণশীল, রাজতন্ত্রের পক্ষপাতি হলেও রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র কতটা উন্মাদ করে তোলে, সেটি তিনি দেখিয়েছেন এ নাটকে। এখানে তিনি লিখলেন, ‘মেন মাস্ট ইনডিওর।’ কথাটি এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক।

পাবলো পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’
কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো (১৮৮১–১৯৭৩) তাঁর স্বদেশভূমি স্পেন থেকে যুবক বয়সেই প্যারিসে চলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ছিলেন প্যারিসেই। নাৎসি দখলদারিত্বের কালে প্যারিস শহরেই (সেখানে তখন তিনি স্থায়ী) গা ঢাকা দিয়ে, আঁকাজোকার জিনিসপত্র জড়ো করে একনাগাড়ে তিনি চালিয়ে যান শিল্পচর্চা। একপর্যায়ে গেস্টাপোরা তাঁর স্টুডিওর খোঁজ পেয়ে সেখানে এসে একটি পেইন্টিং দেখে জানতে চান, ‘তুমি করেছ এটা?’ উত্তরে পিকাসো বলেন, ‘না, তোমরা এটা করেছ।’ ১৯৩৭ সালে আঁকা সেই ছবিই হলো পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়া এবং যুদ্ধের বিভীষিকার প্রতীক হয়ে ওঠা আইকনিক চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’, যাতে চিত্রিত হয়েছে স্পেনের গোয়ের্নিকা শহরে নাৎসি বাহিনীর বর্বরতার চিত্র। ‘গোয়ের্নিকা’ ছাড়াও সে সময়ে পিকাসো ব্রোঞ্জ দিয়ে বেশ কিছু শিল্পকর্ম তৈরি করেন। ‘স্টিল লাইফ উইথ গিটার’সহ আরও অনেক উল্লেখযোগ্য ছবি আঁকেন তিনি।

দান্তের ‘দ্য ডিভাইন কমেডি’
রঁদ্যা থেকে দালি, উইলিয়াম ব্লেইক, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের শিল্পীদের অনুপ্রেরণার উৎস, ইতালির মহাকবি দান্তের (১২৬৫-১৩২১) দ্য ডিভাইন কমেডি। এটিও রচিত হয় চতুর্দশ শতকে রাজনৈতিক কারণে ফ্লোরেন্স থেকে বিতাড়িত দান্তের ২০ বছরের চিরনির্বাসিত জীবনে। তুসকান-ডায়ালেক্টে লিখিত এই সুদীর্ঘ ন্যারেটিভ কবিতাটি লেখার শুরু ১৩০৮ সালে, আর সমাপ্তি ১৩২০–এ, দান্তের মৃত্যুর এক বছর আগে। দিভিনা কোম্মেদিয়া বা দ্য ডিভাইন কমেডি মহাকাব্যটি তিন পর্বে বিভক্ত—ইনফারনো, পুরগাতোরিও ও পারাদিসো। খ্রিষ্টান ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে দান্তের নরক ভ্রমণ ও স্বর্গ গমনের কাহিনি এ মহাকাব্যের মূল বিষয়। মূলত এ কবিতায় স্রষ্টার দিকে আত্মার ভ্রমণের কথাই বলা হয়েছে।

লা মিজারেবল ছবির দৃশ্য
লা মিজারেবল ছবির দৃশ্য

ভিক্টর হুগোর ‘লা মিজারেবল’
ফরাসি সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী এবং উনিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী রোমান্টিক লেখক ভিক্টর হুগো (১৮০২-১৮৮৫) ১৮৫১ সালে রিপাবলিকানিজমের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ার কারণে রাজনৈতিক সমীকরণের শিকার হয়ে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন। তখন তিনি লেখেন, ‘এই নির্বাসন কেবল ফ্রান্স নয়, প্রায় সারা পৃথিবী থেকে আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।’ ১৮৪৫ সালে তিনি লা মিজারেবল লেখা শুরু করলেও ১৮৫১ সালে নির্বাসনে যাওয়ার পর ১৮৬০ সালে হুগো আবার হাত দেন উপন্যাসটিতে। বিচ্ছিন্নতা-একাকিত্বের সময়টিতে সব হতাশা ঝেড়ে ফেলে ব্রিটিশ চ্যানেলের গুয়েরেঞ্জির দ্বীপে বসে পরের বছরই তিনি শেষ করেন এই ক্ল্যাসিক উপন্যাস। উপন্যাসে লেখক উনিশ শতকের ফ্রান্সের সাম্রাজ্যতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের অধীনে সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের এক সকরুণ জীবনচিত্র এঁকেছেন, যারা দুঃখ-দৈন্যের অভিশাপে জর্জরিত। পরে এই উপন্যাস থেকে ছবিও হয়েছে।

সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মাস্টারপিস

মনোসমীক্ষণের পথিকৃৎ হিসেবে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (১৮৫৬-১৯৩৯) লেখা আমাদের এখনকার এই স্বেচ্ছা অন্তরীণ-সামাজিক দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা, এ সময়ের মানসিক টানাপোড়েন-আবেগ সামলাতে অনেকটা থেরাপির মতো কাজ করতে পারে। ৮২ বছর বয়সে ক্যানসারাক্রান্ত অস্ট্রীয় মনোরোগ চিকিৎসক ও মনস্তত্ত্ববিদ ফ্রয়েড নাৎসি দখলদারিত্বের সময় ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়া থেকে লন্ডনে পালিয়ে থাকছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে অসুস্থতা ও বিচ্ছিন্নতার এ সময় তিনি লিখে শেষ করেন অ্যান আউটলাইন অব সাইকো-অ্যানালিসিস। তাঁর মৃত্যুর দুই বছর পর সেটি ছাপা হয়। অত্যন্ত আলোচিত এই মাস্টারপিসটি তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে রয়েছে মনোগত উপকরণ, দ্বিতীয় পর্বে রয়েছে মনোসমীক্ষণের কলাকৌশল আর তৃতীয় পর্বে আছে প্রাক্‌–চেতনা, চেতনা ও অবচেতনার আন্তসম্পর্ক।

ফ্রিদা কাহলোর আত্মপ্রতিকৃতি
ফ্রিদা কাহলোর আত্মপ্রতিকৃতি

ফ্রিদার চিত্রকর্ম
ছয় বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত হয়ে পাক্কা ২৭৩ দিন শয্যাশায়ী থাকতে হয় মেক্সিকান চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলোকে (১৯০৭-১৯৫৪)৷ কিন্তু এই শারীরিক যন্ত্রণার সঙ্গে তাঁর অনবদ্য শিল্পযাত্রার সেটা যেন ছিল কেবল শুরু। পোলিও থেকে সেরে উঠলেও আক্রান্ত হলেন গ্যাংগ্রিনে। কেটে ফেলতে হলো পা। এরও বছরখানেক পর ছাত্রাবস্থায় এক মারাত্মক বাস দুর্ঘটনায় আবারও শয্যাশায়ী হলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য। ঘরবন্দি থাকতে হলো তাঁকে। এই সময়ে ফ্রিদা ছবি আঁকলেন, আঁকলেন নিজের প্রথম আত্মপ্রতিকৃতি। জীবনের বিভিন্ন পর্বে শারীরিক আঘাতে কারণে ঘরে স্বেচ্ছাবন্দিত্ব বরণ করতে হয়েছে এ শিল্পীকে। এসব সময়ে তিনি এঁকেছেন অনেক ছবি। মেরুদণ্ডে আঘাত পাওয়ায় বডি-কাস্ট পরতে হতো ফ্রিদাকে। তাঁর কাছে কাস্টটি কখনো জেলের গরাদের মতো ঠেকত আবার অনেক সময় এ কাস্টই কখনো হয়ে উঠত ফ্রিদার ক্যানভাস। এই কাস্ট ও কর্সেটে ফ্রিদার আঁকা বহু চিত্রকর্ম সংরক্ষিত আছে মেক্সিকোর ‘কাসা আসুল’ বা ‘ব্লু হাউস’–এ।

সূত্র: ফরাসি ব্লগার ভানেসা গ্রলের ব্লগপোস্ট ও দ্য গার্ডিয়ান