তেষ্টা

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

সল্টলেকের বইমেলায় যখন ঢুকি, তখনো খাঁ খাঁ দুপুর। জানুয়ারির শেষটায় শীত থাকার কথা নয়। অথচ সন্ধ্যা গভীর হতেই পাতলা কাপড়ের ফাঁক গলে সুচের ডগার মতো কনকনে ঠান্ডা বিঁধতে থাকে। আমার অবশ্য খানিক ঠান্ডার ধাত। আম্মা বলেন, জল পড়ার শব্দ কানে গেলেও নাকি ঠান্ডা লেগে যায় আমার। আমি তাই ফুলহাতা শার্টের তলায় পুরু টি–শার্ট পরেই বের হয়েছি। কিন্তু এখন এই কাঠফাটা রোদ্দুরে কী করব! জামা খুলে টি–শার্ট গায়ে ঘুরে বেড়ানো যায় অবশ্য। কিন্তু ফিটফাট বাবু সেজে আসা কেতাদুরস্ত ভাবখানা তাতে আর থাকে না। এ এক অদ্ভুত সমস্যা। আমার দাদি বলতেন, ভদ্দরলোক মরে ভাতে আর শীতে। কিন্তু আমার ঘটনা উল্টো। আমি মরছি গরমে। আমাকে এই সমস্যা থেকে উদ্ধার করে সোমা। কলকাতায় আমার পুরোনো বন্ধুদের একজন। কোথা থেকে চড়ুই পাখির মতো উড়ে আসে সে। তারপর ডানা ঝাপটানো পাখির অস্থিরতায় বলে, ‘এই গরমে কেউ এমন ফুলহাতা কালো শার্ট পরে!’

আমি বিব্রত হাসি, ‘উপায় কী বলো?’

‘খুলে ফেলো!’

‘মানে?’ চোখ পাকিয়ে তাকাই আমি। সোমা অবশ্য তাতে ভড়কায় না। সে ভিড়ের মধ্যেই আমার শার্টের বোতামের দিকে হাত বাড়ায়। আমি তটস্থ ভঙ্গিতে ছিটকে সরে যাই। আশপাশের মানুষ বিরক্ত হয়। সোমা খিলখিল করে হাসে। সে এমনই। ছটফটে, উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। আমি বলি, ‘কাল দুপুরের ফ্লাইটে কিন্তু ফিরে যাচ্ছি আমি।’

‘তাতে কী?’ সোমা পাত্তাই দেয় না। আমরা হাঁটতে থাকি। শেষের দিকে মেলায় ভিড় বাড়ছে। বিকিকিনিও। আমরাও কিছু বই কিনি। আমার মন খারাপ হতে থাকে। কলকাতা শহরটা কেমন মায়ার। এখানে এলে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় আমার। কিন্তু ধীরে ধীরে চেনা মানুষগুলোর সাথেই কোথায় যেন একটা অচেনা দূরত্ব বাড়ছে। হয়তো ব্যস্ত হয়ে পড়েছে পুরোনো সব বন্ধুরা। বছর চারেক আগে প্রথম যেবার আসি, তারপরে আবার, তারপর আবার, প্রতিবারই যেন বুক ভরে তাজা নিশ্বাস নিয়ে ফিরে গেছি। এ শহর আর শহরের মানুষগুলো কী প্রবল ভালোবাসায়ই না ছুঁয়ে গেছে। কিন্তু তারপর কোথায় যেন একটা সুতো কাটার সুর। ক্রমশই ধূসর হতে থাকা অনুভব। নাকি আমারই কেবল এমন মনে হয়? 

সন্ধ্যা নামতেই অবশ্য খানিক চমকে যাই। রোহান, রাজিব আর শুভ্রা এসে হাজির। শুভ্রা ঝলমলে গলায় বলে, ‘চলো গিরিশ পার্ক যাই।’

‘ওখানে কী?’

‘চলো, গেলেই দেখবে’। আমি তেমন আগ্রহ পাই না। এদিক–সেদিক তাকাই। আর কেউ আসেনি? শুধুই ওরা এ কজন! আমার আগ্রহ আরও কমে যায়। করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে খানিক সামনে এগোই। ওখানে ভিড় কম। খোলা মাঠের মতো জায়গা। কোথা থেকে এলোমেলো শীতল হাওয়া এসে ঝাপটা মারে। আমি টের পাই, আমার ঘাড় বেয়ে সাপের মতো সন্তর্পণে নেমে আসছে ঠান্ডা। দূরে মিহি কুয়াশার আভাস। খানিক জড়সড় হয়ে যাই আমি। রাস্তার পাশে সারি সারি অটোরিকশা দাঁড়ানো। সোমা দরদাম করে। আমি আবার বলি, ‘গিরিশ পার্কে কী?’

কেউ জবাব দেয় না। সম্ভবত আমার জন্য কোনো আয়োজন আছে সেখানে। ভাবতেই চাপা উত্তেজনা অনুভব করি। টপাটপ অটোতে উঠে পড়ি সবাই। চারজন পেছনে। সামনে চালকের পাশের সিটে রাজিব। পেছন থেকে তাড়া দেয় অন্য চালক। আমাদের অটো চলতে থাকে। আমরা খানিক এটা–সেটা কথা বলি। তারপর চুপ হয়ে যাই। আমাদের কথা যেন ফুরিয়ে আসে। আমরা দীর্ঘ সময় ইঞ্জিনের একঘেয়ে শব্দ আর হাওয়ার হাহাকারে কান পেতে থাকি। তারপর আচমকা টের পাই, নির্জন রাস্তার পাশে, অন্ধকারে থেমে গেছে অটোরিকশাটা। হঠাৎই যেন ভয় পেয়ে যাই আমরা। চালকের পাশের সিট থেকে সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করে রাজিব, ‘কী হয়েছে দাদা? কোনো সমস্যা?’

চালক নিরুত্তাপ, ‘নাহ’। 

‘তাহলে?’ পেছন থেকে উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাই আমরা। 

‘আপনি একটু নামুন দাদা’। রাজিবকে উদ্দেশ্য করে বলে সে।

আমরা এবার ভীষণ অবাক হই, ‘কেন?’

চালক সে কথার জবাব দেয় না। তবে রাজিবকে তার পাশের সিট থেকে নামিয়ে দেয়। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকায়, ‘আপনি একটু এদিকে আসবেন?’

আমি থতমত খাওয়া গলায় বলি, ‘কেন?’ 

‘তাকে পেছনে দিয়ে আপনি একটু সামনে এসে আমার পাশে বসেন।’

আমার আচমকা ভয় লাগতে শুরু করে। দ্বিধাও। আমি অন্যদের দিকে তাকাই। অন্ধকারে তাদের মুখ ঠিক বোঝা যায় না। তবে সবার হতবুদ্ধ ভাবটা টের পাই। অন্ধকারে নির্জন পথের ধারে আমরা দ্বিধার কাছে, অনিশ্চয়তার কাছে আড়ষ্ট হতে থাকি। চালক যেন বিষয়টা বুঝতে পারে। সে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে, ‘আসেন, আসেন। ভয়ের কিছু নেই।’

তার এই ‘ভয়ের কিছু নেই’ যেন আমাদের অপ্রকাশ্য ভয়টাকে হঠাৎ উদোম করে ফেলে। আমি শুকনো গলায় বলি, ‘ও সামনে বসলে সমস্যা কী? আমাকেই কেন সামনে আসতে হবে?’

চালক এবার হাসেন। সাথে সাথে জবাব দেন না। তারপর আচমকা আমাদের চমকে দিয়ে বলেন, ‘এমনে করলে কি হইব ভাই? দেশি মানু যদি বিদেশেও দেশি মানুর গায়ের গন্ধ না নিতে পারে, তাইলে তারা বাঁচব কেমনে?’

আমি চট করে তার কথার কিছুই বুঝতে পারি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে সে বরিশালের উচ্চারণে কথা বলার চেষ্টা করছে। আমার দ্বিধা পুরোপুরি কাটে না। তারপরও বন্ধুদের কঠিন দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি নেমে যাই। গিয়ে তার পাশে বসি। সে আমাকে চমকে দিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘বরিশাল কোনহানে আপনেগো বাড়ি?’

আমি অবাক গলায় বলি, ‘আমার বাড়ি বরিশাল না। মাদারীপুর। তবে বরিশালের কাছাকাছি। কিন্তু আপনি বুঝলেন কীভাবে?’

সে অটো স্টার্ট দিতে দিতে বলে, ‘দিন–রাইত ঘরে ওই এক কথা। এক শব্দ। না বুইঝা উপায় আছে?’

‘ঘরে কে? আপনার বাবা?’ আমি এতক্ষণে বুঝলাম, আমার কথা শুনে সে আন্দাজ করেছে।

‘হু। সারা দিন কাশে। কাশির দমকে পাঁজর ভাইঙ্গা পরান বাইর হওনের দশা। ডাক্তার কইছে কথা কম কইতে। কিন্তু তার মুখ তো আর বন্ধ হয় না। দমে দমে বরিশাল।’ 

‘আপনাদের বাড়ি বরিশাল?’

‘আমার না, আমার বাপের। মুক্তিযুদ্ধের সময় আইছিল।’ 

আমি এতক্ষণে লোকটার দিকে তাকাই। বয়স কত হবে বোঝা না গেলেও জীবন যে তাকে অল্পতেই ন্যুব্জ করে ফেলেছে, তা স্পষ্ট। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চিমসানো মুখ। কোটরগ্রস্ত চোখ। জুলফির কাছটাতে চুলে পাক ধরেছে। বয়স চল্লিশের আশপাশে হবে। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘নাম কী আপনার?’

‘সঞ্জয়।’

‘কখনো গিয়েছিলেন বরিশাল?’

‘নাহ।’ 

‘কেন?’

সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘গিয়া আর কী হইব? কেউ তো নাই ওইখানে।’ সে যতটা সম্ভব বরিশালের উচ্চারণে কথা বলার চেষ্টা করছে। হয়তো তার বাবার কাছ থেকে শুনে শুনে শেখা। ঠিকঠাক হচ্ছে না জেনেও সে আনন্দিত। সঞ্জয় বলে, ‘শুনছি আগে বিরাট বড় বাড়ি ছিল আমাগো। পুকুর ছিল, আমের বাগান ছিল। ধানি খেত ছিল। যুদ্ধের সময় সবাই চইলা আইল। আর যাওয়া হয় নাই। আর এহন তো ভিসা, পাসপুট লাগে। ওইগুলানও তো নাই। টাকাপয়সারও ব্যাপার আছে। তা ছাড়া আমার বড় কাকু একবার গেছিলেন, কিন্তু...।’ 

‘কিন্তু কী?’ আমি আবারও জিজ্ঞেস করি। সঞ্জয় অবশ্য জবাব দেয় না। তার কথাও আর শেষ করে না। সামনে অন্ধকার। অন্ধকার আর মিহি কুয়াশা কেটে অটোর হেডলাইট টানেলের মতো আলোর রেখা টেনে দিচ্ছে। সেই রেখা ধরে যেন অন্তহীন এক সুড়ঙ্গের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। পেছনের মানুষগুলোও চুপচাপ। একটা অদ্ভুত, অস্বস্তিকর নীরবতা। যেন সেই নীরবতা কাটাতেই আমি বলি, ‘আপনার বাবা এখন কেমন আছেন?’

সঞ্জয় দীর্ঘ সময় চুপ করে থাকে। তারপর ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘যাইবেন আমার বাড়ি? আমার বাবারে দেখতে? এইহান থেকে কাছেই। এই মানিকতলা...।’ 

আমরা যাই। সারি সারি অনেকগুলো ঘর। টিমটিমে আলো জ্বলছে ঘরগুলোতে। মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। সেই রাস্তা পেরিয়ে উঠানের মতো খানিক খোলা জায়গা। কী একটা গাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করা যায় না। তার পাশেই একখানা ঘর। ঘরের সাথে বারান্দা। সেই বারান্দা থেকে একচিলতে আলো এসে পড়েছে গাছের গোড়ায়। সেখানে এক বৃদ্ধ বসা। আমাদের পায়ের শব্দ শুনতেই তিনি খনখনে গলায় আওয়াজ তোলেন, ‘কেডা ওইহানে? কেডা? সঞ্জয় আইছত?’

সঞ্জয় আমাদের চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলে। আমরা চুপ থাকি। বৃদ্ধ সম্ভবত স্পষ্ট চোখে দেখতে পান না। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। ঘিয়ে রঙের ফতুয়া পরনে। ভঙ্গুর শরীর। সঞ্জয় বলে, ‘খাইছো বাবা?’

বৃদ্ধ খেঁকিয়ে ওঠা গলায় বলেন, ‘এই চাউলের ভাত মোহে দেওন যায়নি, অ্যাঁ? নাইকোলের ছ্যাবড়ার মতন লাগে। রস নাই, কস নাই, হেই জিনিসরে আবার কয় ভাত! ভাত আছিল বরিশালে, আউশ ধানের ভাত। মোহে দিলে স্বাদ জিবরার আগায় লাইগ্যা থাকত। নুন–মরিচ দিয়া তিন থাল ভাত খাওন যাইত। আহা রে, ভাত, আহা রে। হেই ভাতের ফ্যান...।’ 

বৃদ্ধের গলা যেন বুজে আসে। তিনি অন্ধকারে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর বিড়বিড় করে কী সব বলেন। সঞ্জয় সতর্ক ভঙ্গিতে আমাকে ঘরে নিয়ে যায়। মাঝারি আকারের ঘর। মাথার ওপরে টালির ছাদ। অমসৃণ ইটের দেয়াল। দেয়ালজুড়ে অজস্র ছবি। বেশির ভাগই পেপার কাটিং। আমি অবাক চোখে তাকাই। তারপর ফিসফিস করে বলি, ‘এগুলো কী?’

সঞ্জয় গলার স্বর নিচু করে বলে, ‘এখানকার কাগজে বাংলাদেশের খবর। বাবা এখন আর ঠিকঠাক খবরের কাগজ পড়তে পারেন না। কিন্তু যখন পারতেন, বাংলাদেশের ভালো কোনো খবর দেখলেই কেটে দেয়ালে লাগিয়ে রাখতেন।’ 

আমি দেখি। বেশির ভাগই ক্রিকেট খেলার খবর। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো ম্যাচের বড় বড় ছবি। আমি অবাক চোখে তাকাই। এক কোনায় বঙ্গবন্ধুর ছবি। সঞ্জয় বলে, ‘এই ছবিটা ছোটবেলা থেকে দেখছি। বাবা নাকি আসার পর থেকেই সবাইকে বলত, দ্যাশ স্বাধীন হইবই। তারপর দ্যাশের পোলা দ্যাশে ফির‌্যা যামু। বাপের দ্যাশের মাটি, দপদপাইয়া হাঁটি। এই দ্যাশে আমাগো কী?’

‘যাননি কেন তাহলে?’

সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘বাবা তো তখন অত কিছু বুঝত না। বড় কাকুই সংসারের প্রধান। তিনি জলের দামে সব জমিজমা বিক্রি করে চলে এসেছিলেন। বসতভিটা, ধানি জমি, আমের বাগান, পুকুর সব।’ 

‘তারপর? ’ 

‘দেশ স্বাধীনের বছর পাঁচেক পর বাবার পীড়াপীড়িতে বড় কাকু আবার গেছিলেন, যদি কিছু করা যায়! কিন্তু তত দিনে তো আর কিছুই আগের মতো নাই।’ সঞ্জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমি এদিক–সেদিক তাকাই। ঘরজুড়ে অদ্ভুত সব জিনিস। তবে তার ভেতরও নজর কাড়ল সাদামাটা এক জলচৌকি। জলচৌকির পাশে পিঁড়ি। পিঁড়ির পাশে দেয়াল। দেয়ালে হেলান দেওয়া আয়না। আয়নার পাশে পিতলের ঘটি। ঘটিতে জল। জলের ভেতর খুর, কাঁচি। আস্ত ফিটকিরি। আমি অবাক গলায় বললাম, ‘এগুলো?’

সঞ্জয় পরিমিত হাসে। তারপর কলকাতার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বলে, ‘বাবা আসলে অনেক বছর ধরেই অসুস্থ। প্রথম দিকে ঠিক বুঝতে পারিনি। মনে হতো দেশের জন্য মন খারাপ। হয় না এমন যে ছেলেবেলার কথা খুব মনে পড়ে? তেমন। প্রথম প্রথম খুব একটা পাত্তা দিইনি আমরা। কিন্তু দিন দিন সমস্যা বাড়তেই থাকল। একটা ঘোরের মতো ব্যাপার। তেষ্টা পেলে যদি জল খেতে দিই, বলবে, মোগো মালোবাড়ির কলের জল তো? ওই জল হইলে দে। এক চুমুকেই পরান ঠান্ডা। আম খেতে দিলে বলবে, উত্তরের ভিটার ফজলি আম তো? তাইলে দিস। ওইটা খাইতে মজা। তাদের গাঁয়ের শচীন ঘোষের রসগোল্লা ছাড়া খাবে না। রাতদুপুরে হুটহাট ঘুম ভেঙে বলবে, দেখ তো নরেন এল কি না!’

‘নরেন কে?’

‘বাবার ছোটবেলার বন্ধু। ওই অতটুকু বয়সেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন। বাবাও চেয়েছিলেন যেতে। কিন্তু অত সাহস ছিল না। তা ছাড়া বড় কাকুও চাননি। এই নিয়ে বোধ হয় একটা অপরাধবোধও কাজ করত...।’ 

‘উনি আছেন এখনো? ’

‘নাহ, নরেন কাকুর আর কোনো খোঁজ পায়নি কেউ। এই সব নিয়ে সারাক্ষণ কেমন যেন হয়ে যেতে থাকলেন বাবা। মিষ্টি খাবে না, দুধ খাবে না। বরিশালের না হলে কিছু খাবে না। বাধ্য হয়ে আমরা তাকে নানাভাবে বোঝাতে থাকলাম, এটা বরিশালের, সেটা বরিশালের। কিন্তু এতে সমস্যা আরও বাড়ল।’

‘কী সমস্যা?’

‘তিনি মাঝেমধ্যেই গুলিয়ে ফেলতে লাগলেন, তিনি আসলে কোথায় আছেন! ওই যে ক্ষুর–কাঁচি, আয়না দেখছেন? চুল–দাড়ি কাটার সময় তাকে উঠানে পিঁড়ি পেতে বসিয়ে ওগুলো দিয়ে কেটে দিতে হয়।’ 

‘কেন? সেলুনেই তো যেতে পারেন!’

‘উঁহু। ছোটবেলায় বরিশালে নাকি ওভাবে বসিয়ে নাপিত চুল কেটে দিত। হারাধন নাপিত। যখন বাবার চুল কেটে দিই আমি, বাবা তখন হারাধন নাপিত ভেবে আমার সাথে রাজ্যের কথা বলেন!’

সঞ্জয় খানিক থামে। তারপর আবার বলে, ‘মাঝে মাঝে আবার ঠিকঠাক বোঝেন। তখন তার টিনের বাক্সে জমানো টাকা বের করে গোনেন।’ 

‘কিসের টাকা?’

‘বাংলাদেশ যাবার টাকা। এই যে টিনের বাক্সটা দেখছেন, এ ঘরের সবাইকে রোজ এটাতে টাকা দিতে হয়। রোজ গুনে দেখবে, কত টাকা হলো। আর কত টাকা হলে বাংলাদেশ যেতে পারবে। বরিশাল যেতে পারবে।’ 

‘নিয়ে যান না কেন একবার? একবার তো ঘুরিয়ে আনতে পারেন?’

সঞ্জয় হাসে। কান্নার মতো হাসি। তারপর বলে, ‘তাহলে আর বাঁচবে?’

‘বাঁচবে না কেন?’

‘যে মানুষটা বছরের পর বছর বেশির ভাগ সময় এই উঠান, এই বারান্দা থেকে এক পা বাইরে যায় না এই ভয়ে, যদি বাইরে গিয়ে দেখে সে এখনো কলকাতায়, বরিশালে না। একটা ঘোরের মধ্যে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। আজ এত বছর পর সেই মানুষটা যদি সত্যি সত্যি তার সেই বরিশালে গিয়ে দেখে সেখানে কিচ্ছু আর আগের মতো নেই। সেই পুকুর, ঘর, ভিটে, আমবাগান কিচ্ছু নেই। বা সেসব এখন অন্য কারও। সেখানে হয়তো এখন হাইরাইজ বিল্ডিং হয়ে গেছে। পুকুর ভরাট হয়ে হাটবাজার বসেছে। হয়তো আমবাগানে মার্কেট হয়েছে। একবার ভাবুন তো, সেই মুহূর্তটার কথা! বাঁচবেন উনি?’

‘উঁহু, বাঁচবেন না’, বলতে চেয়েও বলি না আমি। আর কোনো কথাই বলি না। তবে ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারি না। আমার হঠাৎ মনে হয়, যদি কোনো কারণে আমি আর দেশে ফিরতে না পারি! যদি কোনো কারণে বাকিটা জীবন আমার এখানে আটকে থাকতে হয়, তাহলে কী করব আমি? আমার হঠাৎ দমবন্ধ লাগতে শুরু করে। মনে হয়, আমার বুকের ভেতরটা তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে। আমি জগ থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে খেতে থাকি। কিন্তু তাতে আমার তেষ্টা মেটে না। মনে হয় আকণ্ঠ তেষ্টায় নিমজ্জিত এক গৃহহীন মরুপথিক আমি। আমার ভয় হতে থাকে। উঠানে বসে থাকা ওই বৃদ্ধের মতো আমারও কি কোনো চেনা ঘ্রাণ, চেনা প্রাণ, চেনা গানের গ্রামের মায়াময় ছায়ায় শান্ত দুপুরে ক্লান্ত হয়ে থাকা মালোবাড়ির কলের মতো কোনো কলের জল লাগবে, যেখানে আমার শৈশব, যেখানে আমার মাটি, যেখানে আমার দেশ, আমার আকণ্ঠ তেষ্টার জল?

আমি উঠানে তাকাই। বৃদ্ধ মানুষটা বসে আছেন। স্থির, অনড়। তাঁর দীর্ঘ ছায়া পড়েছে এ বাড়ির উঠান ছাড়িয়ে ও বাড়ির উঠানে। কিন্তু তিনি ঠায় বসে আছেন। তাঁর ছায়া পেরিয়ে যাচ্ছে সীমানা। কেবল তিনিই পেরোতে পারছেন না।

স্বাধীন ছায়ার এক পরাধীন মানুষ।