আমরা সব সময় আলাদা সাহিত্য করতে চেয়েছি

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

[বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। জন্ম: ৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ সালে, চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার গুলবাহার গ্রামে। মৃত্যু: ২৩ মার্চ ২০২০ ঢাকায়। বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান পুরুষ। গদ্য, কবিতা ও শিল্পতত্ত্বে সমান মুনশিয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন। ৪৭–এর দেশভাগের পর কলকাতার সাহিত্য প্রভাব থেকে বের হয়ে নিজস্ব ঢঙে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন। মার্জিত, রুচিশীল ও সৎচিন্তার মানুষ হিসেবে তাঁর দখল ছিল দেশি-বিদেশি সমকালীন সাহিত্য ও শিল্পকলায়। সাহিত্য–নিবেদিতপ্রাণ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর অধ্যাপনা করেছেন প্যারিস, অক্সফোর্ড, সাসেক্স, কনস্টানজ, টোকিও, সিরাকিউজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি যুক্ত ছিলেন সমাজ নিরীক্ষণ কেন্দ্রের সঙ্গে। বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী এ মানুষটি যুক্তিযুক্ত কথায় ছিলেন। সবার জন্য সমান সমাজব্যবস্থা যাঁর চাওয়া ছিল। তাঁর চিন্তাচেতনা ও সাহিত্যে নানাভাবে উঠে এসেছে গ্রামীণ জীবনের কথা। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ষাটের ওপরে। সাহিত্য ও সমকালীন বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ এক আলাপচারিতার অংশ এ সাক্ষাৎকারটি। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয় ২০১৫ সালে।]

প্রশ্ন: শিক্ষাজীবনের শুরুতে (চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত) বরিশালের ঝালকাঠিতে কেটেছে। শুনেছি, ওই স্কুলে আজিজ স্যার নামে আপনার অত্যন্ত প্রিয় একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি তখন আপনাকে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে দিতেন। এবং সেখান থেকেই আপনার শিল্প–সাহিত্যে হাতেখড়ি?

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: তিনি আমাকে কিছু বই পড়তে দিয়েছিলেন। প্রথম দিককার বইগুলো সাহিত্যবিষয়ক ছিল না। যে বইগুলো আমায় পড়তে দিতেন, তা ছিল জীবন সম্বন্ধে, সাহিত্য সম্বন্ধে, লেখাপড়া সম্বন্ধে। তিনি আরও চাইতেন, আমি যেন আস্তে আস্তে যাকে বলা যায় সাহিত্যের যে ধারাগুলো আছে, যেমন কংগ্রেসি ধারা, মুসলিম ধারা বা যেকোনো ধারা থেকে বেরিয়ে এসে সাহিত্যের মূল ধারায় আত্মনিয়োগ করি। সে কাজটিই তিনি আমাদের দিয়ে করাতেন। আর আমরাও তা স্বাচ্ছন্দ্যে করেছি। তবে আমার শুরুর পেছনে আজিজ স্যারের ভূমিকা ছিল বিশাল। প্রত্যেকেরই শুরুর পেছনে কারও না কারও কোনো ধরনের ভূমিকা থাকে। তেমনি আমার বেলায়ও ছিল। ব্যস। তবে আমার আগ্রহটা ছিল অনেক বেশি। আমার আগ্রহ না থাকলে তাঁর পক্ষে কিছু করা সম্ভব হতো না।

প্রশ্ন: আরেকজন শিক্ষকের ভূমিকার কথাও শুনেছি। তিনি মুসলিম হাইস্কুলের শিক্ষক জিয়াউদ্দিন স্যার। এই জিয়াউদ্দিন স্যার প্রথম জীবনে আপনাকে কবিতা লেখায় উদ্বুদ্ধ করতেন। এমনকি আপনার প্রথম কবিতা জিয়াউদ্দিন স্যারই ছেপেছেন।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: জিয়াউদ্দিন স্যার খুব মেধাবী মানুষ ছিলেন সত্য। তিনি দ্রুত বুঝতেন। তিনি প্রধানত কমিউনিস্ট ছিলেন। কমিউনিস্ট হিসেবে আমরা যারা তাঁর ছাত্র ছিলাম, তিনি আমাদের অনেক বিষয়ে পড়াতে চাইতেন। সেগুলো রাজনৈতিক কিংবা গোপন কিছু ছিল না। অন্যদিকে তিনি যে সময়ে পাকিস্তান হয়েছে, সে সময়ে সেই অবস্থায় একজন মুসলিম শিক্ষক হিসেবে তিনিই আস্তে আস্তে আমাদের জীবনের বিভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি একদিন হঠাৎ আমাকে ডেকে বললেন, তুমি তো মনে হয় কবিতা লেখো। তখন ম্যাট্রিকও দিইনি। ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি। তিনি বললেন, আমার পত্রিকাটির জন্য একটি কবিতা লিখে দাও। আমি স্যারের কথামতো একটা কবিতা লিখে দিলাম। মজার ব্যাপার কি (হাসি), আমি কোনো দিন ভাবিওনি এটা ছাপা হবে। কিন্তু দেখলাম, ওটা ছাপা হয়ে গেছে। আমার নাম কোনো কাগজে লেখা হয়েছে! সত্যি, আমার জন্য খুব বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। এটা আজও, আমার কাছে খুব বড় একটা ঘটনা বলে মনে হয়।
জিয়াউদ্দিন স্যার আমার কাছে এখনো অনেক প্রাসঙ্গিক। ও রকম সোনার মানুষ আজ নেই, এটা ভাবতে গেলে খারাপ লাগে।
প্রশ্ন: হ্যাঁ, প্রথম কবিতা ছাপানোর অনুভূতি বিস্ময়কর।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: আসলে এ রকম অনুভূতি সবারই হয়। আমি ব্যতিক্রম না। আসল কথা, আমি তো ভাবিনি বা আমার ভাবনাতেই ছিল ব্যাপারটা। তাই উত্তেজনা-আনন্দ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। আর আমার এ কবিতা বের হওয়ার পরপর অন্যান্য কবি যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছিল। এর মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান উল্লেখযোগ্য।
প্রশ্ন: ওই সময়ে অনেক তরুণ লেখক প্রায় একসঙ্গে লেখালেখি শুরু করেছিলেন, আপনি ছাড়া সেসব লেখকের মধ্যে কারা কারা ছিলেন, মনে পড়ে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: ওই সময়ের তরুণ বলতে আমরাই ছিলাম। আমরাই শুরু করেছি। ভেঙেছি। নতুন করে গড়েছি। আমরা এই ঢাকার লেখকেরা, অল্প বয়সের সাহিত্যিকেরা এখানে নতুন একটা ধারা তৈরি করেছি। আমরা, কলকাতার প্রভাব এড়িয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে নিজেদের মতো করে লেখালেখির চেষ্টা করেছি। যে কারণে আমাদের এই চেষ্টার সাফল্যে, দেখা গেল, বাঙালি মুসলমান লেখকেরা কলকাতা থেকে এখানে চলে আসা শুরু করেছেন। যেমন, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন এঁরা সবাই কলকাতার ধারাটাই অনুসরণ করে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। আমরা ঠিক ওই ধারাটি মানিনি, ও থেকে বেরিয়ে এসেছি। ঢাকায়, আমরা আমাদের মতো করে দেখার এবং লেখার চেষ্টা করেছি। তখনকার লেখালেখির এটাই মূল পার্থক্য ছিল। যদি এটাকে পার্থক্য বলা যায়। হা হা হা...।

প্রশ্ন: উনিশ শতকের, পঞ্চাশে যখন আপনাদের সাহিত্যচর্চার শুরু, আমরা বলতে তখনই আপনাদের মাধ্যমেই আমরা কলকাতা থেকে বের হয়ে আসি? এখন ২০১৫। এই যে ৬৫ বছরের মতো অতিক্রম হয়ে গেছে, তার মধ্যে আমাদের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, আত্মজীবনী আছে দুই জায়গায়। সাহিত্যে কলকাতা ও ঢাকার তফাতটি কোথায় পরিলক্ষিত হয়?

সাদা–কালো ছবির ক্যাপশন: তারুণ্যে শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আখতারুজ্জামান ও শিল্পী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
সাদা–কালো ছবির ক্যাপশন: তারুণ্যে শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আখতারুজ্জামান ও শিল্পী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: এসবই আমরা দেখবার চেষ্টা করেছি। আমরা যেমন কবিতা লিখেছি, তেমনি গল্প লিখেছি। আত্মজীবনী লেখার চেষ্টা করেছি এবং করছি। আর সবকিছুর ভেতর দিয়ে একটা স্বতন্ত্র ধারা তৈরি হয়েছে বলে মনে করি। সেটা সার্থক কতটুকু হয়েছে কি হয়নি, তা আলাদা বিষয়। কিন্তু একটা চেষ্টা তো আমাদের ছিল। কারণ, ওই সময়ে যাঁরা ভালো লিখেছেন, যেমন ধরুন, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ আতিকুল্লাহ। আমি এমনি কতগুলো নাম বলেছি। আলোচনার সুবিধায়। তাঁরা সবাই যেমন ছিল, তেমনি আমিও নিজের মতো করে লিখেছি। কারও থেকে ধার করে লিখিনি। আর ধার করে লিখলে তো তাকে লেখা বলা যায় না। বাংলাদেশে অনেক সমৃদ্ধ সাহিত্য আছে। আমরা সেই সেক্টরে যাই না কেন? বিশ্বসাহিত্যকে চ্যালেঞ্জ করার মতো সাহিত্যকর্ম আমাদের এখানেও আছে। আমরা কারও সাহিত্যের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের সাহিত্যের দিকে তাকানো উচিত। অনেক কিছু পাওয়া যাবে। মানিক বন্দ্যোপ্যাধায় আছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আছে। জহির রায়হানও অসাধারণ স্রষ্টা।

প্রশ্ন: আপনার কথায় বোঝা যাচ্ছে পঞ্চাশ দশক থেকে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের পরিবর্তন শুরু। ষাটের দশকেও তা অব্যাহত থেকেছে। আপনার বিচারে শেষ পর্যন্ত এ পরিবর্তন কতটুকু আসলে?

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: আমি বারবার বলছি, যেকোনো পরিবর্তনই দরকার। পরিবর্তন বা নতুনত্ব ছাড়া পরিবর্তন আশা করা সম্ভব নয়। পরিবর্তন সব সময় নতুন কিছু নিয়ে আসে। কারণ, আমরা যারা তখন লিখেছি, আমরা সব ধারার মধ্যেই ছিলাম। এবং এসব ধারায় বড় কিংবা ছোট কী হচ্ছে, সেসব নিয়ে চিন্তা করিনি। আমরা বরং চিন্তা করেছি কলকাতা থেকে স্বতন্ত্র হই। ঢাকায় স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে পারি কি না, বলতে পারেন আমাদের সেই চেষ্টা সার্থক হয়েছে। যেমন, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আমি এবং জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এখানে পরিবর্তন হয়েছে। এরা সবাই অনেক ঝুঁকি নিয়ে বড় কাজগুলো করেছে। তাই তাদের ত্যাগগুলোকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। পরবর্তী সময়ে আমাদের ধারাটি বজায় রেখেই অনেকে তা গতিশীল করবে বা করেছে—এ রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবং এটাই সত্য। আর পরিবর্তনটাও অবশ্যই দরকার ছিল। ছিল বলছি এ জন্য যে, না হয় আমরা ঢাকার সাহিত্যে কলকাতার কলোনি লেখক হয়ে যেতাম। যাঁদের শ্রমে আজকের অবস্থান, তাঁরা সবাই ধন্যবাদ পাবেন।

প্রশ্ন: এর বাইরে সে সময়ে আপনাদের চিন্তার জগৎ পরিবর্তনে কারা কারা ভূমিকা রেখেছেন বলে আপনার মনে হয়?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: এককথায় বললে আমরা নিজেরাই নিজেদের চিন্তার জগতে পরিবর্তন এনেছি। আরও বিশদ বললে, আমার যখন লেখালেখির শুরু, তখন গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশক চলছে। সে সময় আমার মতো অনেক তরুণ লেখালেখির জগতে আসতে শুরু করে। তাদের কারও বয়স আমার চেয়ে একটু কম বা বেশি। যেমন, আমি যখন ম্যাট্রিক পাস করেছি, হাসান হাফিজুর রহমান তখন আইএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। শামসুর রাহমান সম্ভবত বিএ পরীক্ষা দেবেন বা দিয়েছেন। তখন আমাদের চিন্তাভাবনা বিশ্বের সেরা সেরা বই পড়া। এ জন্য একজন অন্যজনকে বই দিয়ে কিংবা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছি। এভাবেই আমরা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু কিংবা কাছের মানুষ হওয়ার চেষ্টা করেছি। কাছাকাছি ছিলাম। আর সেই সময় শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান কিংবা পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে শিল্পী সুলতান আমাদের চিরায়ত ধারণাটাকে নতুনভাবে আঁকা শুরু করলেন। সেই পরম্পরা আমিনুল ইসলাম, মর্তুজা বশীর কিংবা দেবদাস চক্রবর্তী, তারও পরে রশিদ চৌধুরী ও রাজ্জাক এই জগৎটাকে আরও বেশি বেশি পাল্টানো শুরু করে দিলেন। এখনকার জেনারেশনের কাছে ওই ধারাটা এখন পুরাতন লাগবে।
এরা তখনই হয়তো ধারণা করতে পেরেছিল যে একটা সময় আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকব না, আলাদা একটা জাতি হিসেবে দাঁড়িয়ে যাব, কিংবা ওটা বাদ দিলেও কলকাতার শিল্প, সাহিত্য আর্ট থেকে বের হয়ে নতুন একটা ধারা তৈরি করতে হবে—এই চিন্তা সবার মধ্যেই ছিল।
এখানে আরেকজনের কথা বাদ পড়ে গেছে। তিনি শিল্প–সাহিত্যের নন, অন্য সেক্টরের, স্থাপত্যের। যদিও স্থাপত্যটাও শিল্প। মাযহারুল ইসলাম। তিনি ছিলেন আধুনিক মুসলমান সমাজের অন্যতম আধুনিক একজন স্থপতি। তিনি অনেক কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আধুনিক আর্ট ইনস্টিটিউট। এর আগে এসব কাজ ছিল না। এখন যে আছে, তেমনও না। সমস্যা হলো, এখন কেউ মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে চায় না। মনোযোগের অভাব। বলতে পারেন একাগ্রতা। একাগ্রতা আর মনোযোগ দুটি ভিন্ন জিনিস। তখন আমরা যারা শুরু করেছিলাম, সবার মাঝে এই দুটি ব্যাপার ছিল।

প্রশ্ন: ছোটবেলা থেকেই আপনি মার্ক্সসিজম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন। এই মার্ক্সের কারণে চিন্তার জগৎ কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে বলে ভাবেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: মানব মুক্তি সেখানেই আছে বলে আমি মানি। বিশ্বাসও করি। একটা কথা প্রায় সব জায়গায় বলি, তা হলো তখন বাম রাজনীতি না করা মানে পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেওয়া। আমার মতো সচেতন একজন মানুষ তা করতে পারে না। এই প্রভাবটা মার্ক্সের থেকে নেওয়া বলতে পারেন। মানে জগৎটা। তখন কলকাতার বড় বড় সব লেখক বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সক্রিয় বাম রাজনীতির কর্মী। তিনি পার্টির প্রোগ্রামে ঢাকা আসছেন। কলকাতা যাচ্ছেন। সেই প্রোগ্রামে আমরাও যারা শিল্প–সাহিত্য করছি, আবার বয়সে তরুণ, তারাও অংশগ্রহণ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ।

প্রশ্ন: কলকাতা থেকে আলাদা হতে চাইলেও ওখানকার খোঁজখবর আপনারা রাখতেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: অবশ্যই। কলকাতা থেকে আলাদা হওয়া বলতে আপনি বোধ হয় একটু ভুল বুঝেছেন। ওই সময়ে আমি সাহিত্য ও সাহিত্যের ধারার পৃথক হওয়া নিয়ে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম আমরা যারা শুরু করেছি, সেই শুরুর সমন্বয়ের কথা। শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমানদের কথা।
প্রশ্ন: সাহিত্য আর রাজনীতি আলাদা? সাহিত্য আর ধর্ম কতটুকু আলাদা মনে করেন আপনি?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: এখানে ধারা বিবেচনা করলে আলাদা। আবার আলাদা না। একটা আরেকটার সঙ্গে আপস করে, কিংবা আপস না করেও জড়িত। এই জড়িত থাকার কারণেই এত এত আলোচনার সূত্র তৈরি হয়।
প্রশ্ন: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য করতে এসে রাজনীতি শুরু করেন। বাম রাজনীতি। তখন কি এটা এই অঞ্চলের রাজনীতির গতানুগতিক ধারার বাইরে যাওয়া?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: মানিক এটা বুঝেই করেছেন। সাহিত্য করতে এসেই তিনি বুঝতে পারলেন গতানুগতিক ধারা নিয়ে সামনে যাওয়া যাবে না। ভাঙতে হবে। সেই ভাঙনটা একজন সাহিত্যিককেই করতে হয় বা হবে। মানিক সেটা চেষ্টা করেছেন। ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘ইতিকথার পরের কথা’, ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘অতসী মামী’ ও ‘অন্যান্য গল্প’ বইয়ের তিনি লেখক। তিনি জানতেন তিনি ভালো লিখেছেন। তিনি জানতেন তিনি বাংলা সাহিত্যে একটা অবস্থান তৈরি করেছেন। ভালো লেখকেরা নিজের সাহিত্যের মূল্যায়ন নিজে করতে পারেন জীবদ্দশায়। তিনি সেটা জানতেন। জানার পরও তিনি বাম রাজনীতি করেছেন। রাজনীতিতে সময় দিয়েছেন। এটা করেছেন একটা পরিবর্তনের জন্য। সবাই একটা উদ্দেশ্য নিয়েই সামনের দিকে অগ্রসর হয়। যেভাবে আমরা হয়েছিলাম।

প্রশ্ন: আপনারা নতুন সাহিত্য শুরু করবেন বলে কলকাতাকে অনুসরণ করবেন না, আবার ডানপন্থী রাজনীতি করলে পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া হবে। এ ধরনের চিন্তার বাইরে তখন অন্য লেখক কবি সাহিত্যিক কি ছিলেন না?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: দেখুন, আমাদের এখানে ফলো করার মতো বড় কবি–সাহিত্যিক তখন যে ছিলেন না, তা না। ফররুখ আহমেদ ছিলেন। তিনি পাকিস্তানপন্থী লেখক। এ রকম আরও কয়েকজন হয়তো খোঁজ করলে পাওয়া যাবে। কিন্তু আমরা ভিন্নপথ অনুসরণ করতে চেয়েছি।

প্রশ্ন: শুনেছি ওই সময়ে শামসুর রাহমান কিংবা সুফিয়া কামালের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ ছিল। এটাকে কীভাবে দেখবেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: কারও ইচ্ছার ওপর তো আর জোর প্রয়োগ করা যাবে না। লিখতে পারেন। আমার চোখে পড়ে না, মানে আমি দেখি না। কিন্তু একটা কথা এখানে বলা যায়, যাঁদের কথা বললেন, তাঁরা পরবর্তী সময়ে আর পাকিস্তানপন্থী থাকেননি। কিংবা পাকিস্তানের সাফাই করেননি। তাঁরা মনেপ্রাণে এই সংস্কৃতিকে ধারণ করেছেন। পরবর্তীকালেও আমরা তা হতে দেখেছি।

প্রশ্ন: তাহলে একসময় যাঁরা পাকিস্তানকে সাপোর্ট করে লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ দেশের হয়ে লেখালেখি করে গেছেন, এটা কীভাবে দেখবেন?

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: এমনটা যদি হয়ে থাকে এঁরা মনেপ্রাণে কখনো সৎ হতে পারবেন না। ভেতরে ভেতরে তাঁদের একধরনের অস্থিরতা থাকবেই।

প্রশ্ন: কলকাতার সাহিত্যের সঙ্গে প্রায়ই আমাদের বর্তমান সাহিত্যের তুলনা করা হয়। এই তুলনায় আপনি কতটুকু যেতে আগ্রহী, কিংবা গেলেও আমাদের সাহিত্যকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: আমি একটা কথা বলি, যে যাঁর মতো করে সাহিত্য করবেন। আপনি যে সাহিত্য লিখছেন, সেই সাহিত্য নতুন। আপনি যদি কারও মতো করেও লিখেন, সেটাও নতুন। পৃথিবীর সব সাহিত্যিক যেমন আলাদা, একইভাবে নতুনও। আমাদের সাহিত্যকে আমরা একটা অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য কাজ করেছি। পরবর্তী সময়ে আপনারা কাজ করছেন। এই সাহিত্যকে আমি শতভাগ নম্বর দেব। সেই সঙ্গে কলকাতার সাহিত্যের সঙ্গে তুলনায় যাব না। তুলনায় যাওয়ার আগে আমাদের ভাবা উচিত, তাদের কালচার, আমাদের কালচার। তাদের প্রতিদিনের জীবনপ্রণালি, আমাদের প্রতিদিনের জীবন। ভাষা এক হলে কালচার এক হবে, এমনটা না। একই ভাষায় শত রকমের পার্থক্য রয়েছে। একটা ঘটনা আমি প্রায়ই বলি, একবার সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় আমার ধানমন্ডির বাসায় বেড়াতে আসেন। এসে তো তাঁরা অবাক! বললেন, আপনাদের বাসায় থেকে আকাশ পাওয়া যায়। বাসায় সব আছে। তখন আমার বাসায় টিভি, ফ্রিজ ছিল। মধ্যবিত্ত আমরা আমাদের দেশকে নিয়ে অন্য রকমভাবে ভাবতাম এবং গড়ার চেষ্টা করেছি। যা সে সময় কলকাতায় খুবই কম ছিল। এটা কিন্তু সাহিত্যে প্রভাব পড়ে। আপনি অর্থ ও সম্পদে যত বড় হবেন, আপনার চিন্তা তত বড় হবে। আমাদের এখানে অনেক বড় মানের সাহিত্যিক কম নেই। আবার কলকাতায়ও অনেক বড় সাহিত্যিক রয়েছেন।

প্রশ্ন: দেশভাগের কলকাতা আর ঢাকা আলাদা হয়ে যাওয়াটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: যা হয় ভালোর জন্যই হয়। যা হয় না, তা নিয়ে অনেক কথা বলার অর্থ হলো নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, ভালোই হয়েছে। এতে আলাদা আলাদাভাবে বাঙালি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এটা বলা ঠিক আবার ঠিক না, আমরা যেহেতু বাঙালি মানে কলকাতা আর বাংলাদেশের মানুষরা, এবং বাংলায় কথা বলি, দিন শেষে বাঙালির উন্নতি আসল। কলকাতায় আর বাংলাদেশ একসঙ্গে হলে কারও প্রতি কারও কোনো আগ্রহ থাকত না। এখন ঢাকায় লেখক পাঠক খোঁজখবর করে কলকাতায় কারা কারা ভালো সাহিত্য করেছে। আবার কলকাতার লেখকেরা তাকিয়ে থাকেন এখানে কারা ভালো সাহিত্য করছেন।

প্রশ্ন: এই আলাদা হওয়া শুধু ভাষা কিংবা সাহিত্যের নয়। বন্ধনও ছিন্ন হয়েছে, সম্পর্ক ঘুচে গেছে। এর বড় উদাহরণ পবিত্র সরকার আর তাঁর বোন।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: বিচ্ছিন্নতা শুধু যে দূরে ঠেলে দেয়, তেমনই না, বিচ্ছিন্নতা কাছেও টানে। বিচ্ছেদ না হলে কাউকে কেউ পাওয়ার চেষ্টা করবে না। তাদের প্রতি আমাদের, আবার আমাদের প্রতি তাদের এখন যে টান, সেটা কেবল ওই বিচ্ছিন্নতার ফসল। আমরা তো দিনাজপুরের মানুষের প্রতি এত টান অনুভব করি না, আবার দিনাজপুরের মানুষ চাঁদপুরের মানুষের জন্য টান অনুভব করে না। যতটুকু করে করলেও দেশের মানুষ হিসেবে করে। দেশভাগের চিত্র আমরা কখনোই ভুলব না। যেকোনো জাতি গঠন হয় তখন, যখন হৃদয়ে ক্ষত তৈরি হয়। ক্ষত নেই অথচ জাতি হবে, এমনটা খুবই কম হয়েছে। পাকিস্তান থেকে আমরা ছুটে এসেছি কেবল জমানো ওই ক্ষতের কারণে। ক্ষত বাধ্য করে আমাদের পার্টিশন দিয়েছে।

প্রশ্ন: আপনি কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার, চিত্রসমালোচক, গবেষক এবং শিক্ষক। এত পরিচয়ের ভেতর কোন পরিচয়কে নিজের জন্য আলাদা করবেন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: আসলে আমার কাছে সব ধারাই সমান। কারণ, এককভাবে একেকটা জিনিস দেখাতে চেয়েছি, আলাদাভাবে নয়। এ জন্য সব ধারা যেমন জরুরি, সব ধারার যেমন সার্থকতা আছে, ঠিক আমরাও আমাদের পথ খুঁজে পেয়েছি বা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছি। এই যে খুঁজে বের করাটা, আমরা মনে করেছি খুব বড় একটা কাজ। এভাবে তো অনেকেই বের করার চেষ্টা করেনি। এই যে আলাদা ধারা তৈরি করা, ঠিক তখন আলাদা ধারা তৈরি করার মতো লেখক কম ছিল। কিন্তু আমি এগুলোকে খুব সহজেই করতে চেয়েছি। আমার সব শাখায় লেখালেখিটাকে বলতে পারেন ঐশ্বরিক অবদান। ঐশ্বরিক অবদান ছাড়া অনেক কিছুই সম্ভব নয়। আমি যেটা করেছি বা করতে পেরেছি, তাতে আমার শ্রম ও একনিষ্ঠতা ছিল। অনেকের হয়তো ছিল না। এ জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিই। তাই আলাদাভাবে কোনো একটা পরিচয়কে আমি সামনে আনতে চাইনি। প্রত্যেকটিই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়েছি।

প্রশ্ন: ছোটগল্প নিয়ে আপনার অনেক কাজ আছে। সাহিত্যের এই মাধ্যম চর্চায় অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: দেখুন কতটুকু ভালো হয়েছে, এটা বলার চেয়ে বলা ভালো হবে ‘সাহিত্য বোধের কতটুকু অগ্রগতি’ হয়েছে বললে। বোধ ছাড়া ভালো সাহিত্য হবে না। উন্নতি–অবনতি কিছুই বুঝতে পারব না। এর জন্য প্রথমেই বোধ বাড়াতে হবে। দেখবেন ভালো সাহিত্য হয়ে গেছে। অনেক সময় এমন হয়, একজন উন্নত বোধসম্পন্ন মানুষ অথচ তিনি যা চিন্তা করছেন, সেটি কারও সঙ্গে মিলছে না। তিনি নিজেও চিন্তাটাকে ভুল বলে ভাবছেন। চিন্তাটা নিয়ে সামনের দিকে যাচ্ছেন না। এর কারণ হলো, সমাজে একজন চ্যাম্পিয়ন নিয়ে সামনের দিকে যাওয়া কিছুটা কঠিন। তাঁর সমমনা না থাকার কারণে দ্বান্দ্বিকতায় পড়ে যান তিনি। তাই ওই রুচির আরও কয়েকজন লাগবে। যেটা ফুটবল খেলায় বেশি হয়। রবীন্দ্রনাথ পরিণত বয়সে এসে কথা কম বলতেন। কারণ, তিনি কথা বলার মতো লোক পেতেন না। আবার বলার মতো লোক পেলে সারাক্ষণ কথাই বলতেন। একবার কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ ওষুধ খাওয়া ভুলে কেবল কথা বলে যাচ্ছেন। বলেই যাচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথের ছেলে বারবার রুমে আসেন আবার চলে যান। পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বললেন, তুমি কিছু বলার জন্য এসেছ? ছেলে তখন বললেন, আপনার ওষুধ খাওয়ার সময় আরও আগে শেষ হয়েছে। জালালুদ্দিন রুমি কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী সবাইকে বাদ দিয়ে তাবরেজির সন্ধানে বাড়ি ছেড়েছেন। বোধের জায়গা পরিপূর্ণ হলে সাহিত্যের সব শাখা ভালো হবে।
প্রশ্ন: এই বোধের জায়গায় পৌঁছানোর জন্যও সাহিত্যে সময় দিতে হবে। পাঠ ও চর্চার দরকার।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: যারা সাহিত্যের কিংবা সাহিত্যচর্চার সঙ্গে জড়িত, আমি তাদের কথাই বলছি। বাকিদের এই বোধের কাছে আসা সম্ভব না। একজন সত্যিকারের রাজনীতিবিদেরও এই বোধ থাকা দরকার।
প্রশ্ন: আপনার সময়ে, আপনার সঙ্গে কিংবা আগে পরে অনেকেই এসেছেন। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। আপনি ব্যতিক্রমী হয়ে সৃজনশীল শাখায় থেকে গিয়েছেন, কেন। আপনার অন্য কিছু করার কথা মনে আসেনি?

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: সেটা আমি মানি। কিন্তু এটা তো নয় যে আমি একেবারে সফল হয়ে গেছি বা অন্য একটি ধারার মধ্য দিয়ে স্বতন্ত্র বড় একটা কিছু করছি। এমন তো নয়। তার কারণ আছে, এখানে অনেকগুলো ধারা একসঙ্গে হয়েছে। আর তখন আমি যেহেতু অনেকের তুলনায় বয়সে সবচেয়ে ছোট ছিলাম, তাই আমার কাছে গদ্য ও পদ্য এই ধারা এবং ওই দুই ধারার কোনোটাকে আলাদা বলে মনে হয়নি। প্রতিটি সেক্টরকে আমি সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যখন যেটা করেছি তখন সেটাতে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। সফলতা কতটুকু, সেটা জানি না। আসল কথা, যখন যা ভালো লেগেছে, তখন তা করার চেষ্টা অব্যাহতভাবে করেছি। আর করার প্রয়োজনও ছিল। কারণ, আমি না করলেও কেউ না কেউ করে যেতেন। অথবা ওই সময়ে করতে হয়েছে। দেশভাগের পর কাউকে না কাউকে শুরু করতে হবে, সেই শুরুটা আমি করলাম।
প্রশ্ন: এখনকার কবিতা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সংযোজন-বিয়োজন হচ্ছে। এতে কবিতার ভবিষ্যৎ কেমন দেখেন?

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: দেখুন, সংযোজন কিংবা বিয়োজনের ফলে কবিতা কোন দিকে যাবে, সেটাকে আমি জরুরি কিছু বলে মনে করি না। কারণ হচ্ছে, আপনি কবিতা যদি লিখতেই পারেন, নিজস্ব পদ্ধতিতে তা প্রকাশও করতে পারবেন। নিজের ধারায় চলাচল করবেন। আর সেটা যদি না পারেন, হাজার রকমের চেষ্টা–তদবির করেও কিছুই করতে পারবেন না। আসলে পথটা তো আপনার। এটা আর কারও নয়। এখন কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা মুখ্য নয়। মুখ্য হলো আপনার লেখা। তবে কবিতার ভালোটা বুঝতে হবে। কবিতা যে কারও অটোমেটিক হয় না, হবেও না। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই যেমন আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই চেয়ারটাতে বসে থাকি। ওই লেকের দিকে তাকিয়ে কত কিছু দেখি আর উপলব্ধি করি। তবে ভাবনাটা পাল্টেছে। বিশ বছর আগের ভাবনা আর এখনকার ভাবনার মধ্যে অনেক ফারাক।

প্রশ্ন: আপনার বাবা আশেক আলী খান একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ছিলেন, স্বাভাবিক নিয়মে তিনি চেয়েছেন আপনিও শিক্ষাবিদ হবেন। কিন্তু একজন লেখক হবেন, এটা চেয়েছেন কি তিনি?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: তিনি আমাকে অনেকভাবে অনেক কিছু করার উৎসাহ দিতেন। তিনি যদি আমার হাতে বইপত্র জোগান না দিতেন, তাহলে আমার পক্ষে আজকের অবস্থানে হয়তো আসা সম্ভব হতো না। বাবা আমাদের বিচিত্রমুখী বই সংগ্রহ করে দিতেন। আর না হয় এতটা এগোতে পারতাম না। বই পড়ার ব্যাপারে এমনটা মনে করতেন না, যে এই বইটা পড়বে, ওই বইটা পড়বে না। এ জন্য আমি মনে করি, এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে আমার আব্বার অবদান অনেক, যা বলে শেষ করার নয়। তিনি নিজে বড় হতে পেরেছিলেন বলে আমরা বড় হতে পেরেছি। এভাবেই চলেছে, একটা রাস্তার সঙ্গে আরেকটা রাস্তার সম্পর্ক। আর এই সম্পর্কও চলতে থাকবে।

প্রশ্ন: কবিতা ও গল্পের পাশাপাশি চিত্রসমালোচক হিসেবেও আপনাকে পাওয়া যায়। চিত্রকলায় আগ্রহী হলেন কীভাবে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: আসলে আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম এবং কাজ করেছিও। ওসব ক্ষেত্রের একটা বড় দিক হচ্ছে, যাকে আমরা বলি আধুনিকতাবাদ করা। এই ছবিগুলো আপনারা দেখছেন (দেয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে) এখানে কিছু কাজ এ সময়ের, কিছু কাজ আগের। আমি এখানকার সব কাজ নিজের মতো করে রেখে দিয়েছি। আমার কাছে কোন কাজ বড়, কে বড় বা ছোট, এসব কিছু মনে হয় না। বরং প্রতিটির ভেতর দিয়ে নিজেকে তৈরি করতে পেরেছি। এটা স্বীকার করি। আমার মূল লক্ষ্য নিজেকে তৈরি করা, অন্যকে অনুসরণ করা নয়। সেটা আমার কাছে সব সময় প্রধান ছিল, যা আমি বাস্তব জীবনেও করেছি। নিজেকে একটা জায়গায় আটকিয়ে রাখলে জানাশোনা এবং সুন্দরের ভেতর দিয়ে হাঁটা পথের দূরত্ব কমে আসে। আমি কখনো এক জায়গায় নিজেকে আটকে রাখতে চাইনি। এমনকি এখনো না। আমি সচলভাবে সবকিছু করেছি।

প্রশ্ন: লিখিত আকারটাকে কবিতা বলব। কিন্তু অনেকেই চিত্রকর্ম বা অন্যান্য শিল্পকেও কবিতা বলে, এভাবে বলা যাবে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: পৃথিবীতে কোনো কিছুই অর্থহীন নয়। অর্থ উদ্দেশ্যে তৈরি হয়। একটা মান ও মৌলিকতা আছে। এটা কবিতা, এটা কবিতা না, এটা বলা খুব কঠিন। আপনি নিজের মধ্য থেকে, নিজের ভেতর থেকে একটা জিনিস খুঁজে বের করেছেন এবং সেই খোঁজাটা হচ্ছে সবচেয়ে দামি। আপনি তো কাউকে অনুসরণ করেন না। আর যদি করেই থাকেন, সেটা নিজেকে করেছেন। অন্য কাউকে নয়। আর কবিতা ও চিত্রকর্মে কোনো তফাত আছে বলে মনে করি না। ভালো করে দৃষ্টি দিলে একই রকম মনে হবে। একটা লাইন দিয়ে সাজানো আছে, অন্যটি মনের চক্ষু দিয়ে সাজাতে হয়।

প্রশ্ন: কবিতার মতো চিত্রকর্মেও শব্দ বা উচ্চারণ আছে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: শব্দ আছে, উচ্চারণ আছে। উপমা আছে। এসব আছে। সবকিছুই তো আমি পরিষ্কার দেখতে পাই। দেখেন, (দেয়ালের দিকে আঙুল বাড়িয়ে। ওই দেয়ালজুড়ে পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক চিত্রকর্ম রয়েছে।) প্রতিটি চিত্রকর্ম কবিতার কথা বলছে। আমি মনে করি, একজন কবির এই চিত্রকর্মের ভাষাটা জানা দরকার। আর্ট বোঝা দরকার। আদতে ওই কবির বোধ বাড়বে। গল্পকার, ঔপন্যাসিকরা করবেন না, এমন না। সাহিত্যের সবার এসব জানা দরকার।

প্রশ্ন: বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, বিশ্বসাহিত্য পড়েছেনও। যদি জিজ্ঞেস করি ইউরোপ, আফ্রিকা বা আমেরিকার কবিতা কেমন?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: ওদের কবিতা ওদের মতোই চর্চা হচ্ছে। ওদের ভূগোল এবং ভূ-প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই ওদের সাহিত্য–পরিবেশ। পৃথিবী যাঁরা দেখবার চেষ্টা করেছেন চোখ খুলে। সেই চোখ খুলে দেখাটা একেক সময় একেক রকম। কারও মতো কারওটা নয়। অতএব, একেক দেশের সাহিত্যে একেক রকম কিংবা তাদের মতো হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর সেই স্বাভাবিকতাই সুন্দর বলে মানি আমি।

প্রশ্ন: আমার প্রশ্নটি ছিল ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকার তুলনায় আমাদের সাহিত্য কতটা সমৃদ্ধ? নাকি পিছিয়ে?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: তুলনায় আসা যেত ধারা এক হলে, কারও সঙ্গে কারও লেখা কখনোই এক না, এক হতে পারে না। এক হলে তুলনা করা যেত। কিংবা একই বিষয় নিয়ে একই ছন্দে যখন লেখা হতো, সেটাকে তুলনা করা যেত। আমাদের সাহিত্য আমাদের মতো। আমাদের ভূগোল, জল, পরিবেশের মতোই। সমগ্র পৃথিবীকে এক করে সেখান থেকে একটি সেরা সাহিত্য বই নির্বাচিত করা ঠিক হবে না। সেটা কেউ করেও না। নোবেল কমিটিও করতে পারে না। এখানে সবার সীমাবদ্ধতা আছে।


প্রশ্ন: আমরা প্রয়োজন অনুযায়ী বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ করি। কিন্তু আমাদের নিজেদেরই অনেক সাহিত্য আছে, আপনি কি মনে করেন সেসব ভালোভাবে অনুবাদের অভাবে বিশ্বায়ন হচ্ছে না?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: এটা সত্য নয়। আমাদের কবিতা নিচ্ছে না, তা কেবল আমাদের ধারণা। আসলে এর সত্যতা নিয়ে আমার সন্দেহ হয়। এটা হতে পারে যে তারা আমাদের কবিতা আমাদের মতো করে পড়তে পারছে না। কিন্তু তারা আমাদের কবিতা পড়ছে, এখনো পড়ে, তা আমি জানি। ভবিষ্যতে আরও পড়বে। সেখান থেকে অনেক কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। যেমন করে আমরা তাদের সাহিত্য থেকে অনেক কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীটা ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। আমাদেরগুলো তাদের প্রয়োজনে তারা গ্রহণ করবে। বর্জন করা এত সহজ! সহজ না। যেহেতু সহজ না, এমন অনেকে আছেন আমাদেরটা নতুনভাবে আস্তে আস্তে গ্রহণ করবেন। কারণ, সেখানে আমাদের শ্রম আছে। শ্রম বৃথা যাবে না। আর আছে রক্তক্ষরণের ইতিহাস। বিশ্ব এই সব জানতে চাইবে একটা সময়। বিশ্বসাহিত্যে প্রতিযোগিতা করার অনেক সাহিত্য আছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বা জাতি আমাদের সাহিত্য গ্রহণ করছে। ভবিষ্যতেও গ্রহণ করবে। এর জন্য আমাদেরও মাথাটা আরেকটু উঁচু করতে হবে। সেই গাছই মানুষের নজরে আসে, যেটি বাগানের অন্য গাছের তুলনায় বড়। বড়দের নিয়ে সবাই আলোচনা করে। কিন্তু এর মানে এটা না, আমরা খুবই ছোট। জাতি হিসেবে আমাদের পথচলা খুব বেশি দিনের নয়। এটাই বলতে চেয়েছি।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের তরুণ সাহিত্যিকদের ব্যাপারে কেমন জানাশোনা আপনার? তাঁদের সাহিত্য নিয়ে আপনি আশাবাদী?
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর: প্রয়োজনে মানুষ মানুষকে স্মরণ করে। কে ছোট, কে বড়, সেটাকে আমি ওই রকমভাবে দেখিনি। দেখার কিছু নেই। সবাই মানুষ। হয়তো অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার কথা বলা যায় বা আলোচনায় আনা যায়। সাহিত্য বড়–ছোট, এভাবে দেখলে হবে বলে মনে করি না। সবাইকে সবার মতো লিখতে দিতে হবে। হাঁটতে দিতে হবে। তাঁদের মতো তাঁদের ভাবতে দিতে হবে। আমাদের পরে অনেক ভালো সাহিত্যিক এসেছেন। যদি না আসত, তাহলে আমাদের পক্ষে এত দূর আসা সম্ভব হতো? হয়তো সম্ভব ছিল না। একেবারে তরুণ যাঁরা লিখছেন, তাঁদের সম্পর্কে আমার জানাশোনা কম। আগের মতো বের হতে পারিনি। কিংবা কোনো প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ, তা–ও হচ্ছে না। তবে একেবারে ভালো কিছু হচ্ছে না, তা হয়তো বলা সম্ভব। তরুণদের ভালোভাবে অংশগ্রহণে বাংলা সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর তরুণ যাদের যতটুকু পড়েছি বা শুনেছি, সেটাকে খারাপ বলা যাবে না।