মার্কেসের মাকান্দো গ্রামের মহামারি

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

অনিশ্চয়তা! কেমন একটা ব্যাখ্যাতীত অদ্ভুতুড়ে অবাস্তব অনিশ্চিত সময়ের গোলকধাঁধায় বন্দী গোটা দুনিয়া। প্রায় ২০০টি দেশেই চলছে গুরু-লঘু লকডাউন, কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গরোধ অবস্থা। এই অবরুদ্ধকালে আমরা স্মরণ করতে পারি ক্ল্যাসিক কয়েকটি উপন্যাসের কথা যেখানে লেখকেরা ভাবীকথন করে গেছেন, যা মিলে যায় বর্তমান দুনিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে। এমনই কয়েকটি অসামান্য রচনা হলো আলবেয়ার কামুর ‘লা পেস্ত’ (দ্য প্লেগ, ১৯৪৭), যোযে সারামাগোর ‘এনসাইয়ো সোব্রে আ সেগেইরা’ (ব্লাইন্ডনেস, ১৯৯৫) এবং গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ’ (হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুড, ১৯৬৭) ও এল আমোর ‘এন লোস তিয়েম্পেস দেল কোলেরা’ (লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা, ১৯৮৫)। উল্লেখের দাবি রাখে যে গার্সিয়া মার্কেসের ফিকশনে রোগবালাইয়ের ব্যাপারটা ঘুরেফিরে এসেছে। তাঁর প্রিয় বইগুলোর তালিকায় ছিল ১৭২২ সালে প্রকাশিত ড্যানিয়েল ডেফোর ‘আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’।

শিল্পীর চোখে মাকান্দো গ্রাম
শিল্পীর চোখে মাকান্দো গ্রাম

‘সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ’ (নিঃসঙ্গতার এক শ বছর) উপন্যাসের তৃতীয় অধ্যায়ের ওই পর্বটিতে চলুন খানিকটা ঘুরে আসি, যখন স্মৃতিহীনতার মহামারি রোগ মাকোন্দো গ্রামকে সংক্রমিত করে:
‘হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া যখন বুঝল যে মহামারি গোটা গ্রামকে সংক্রমিত করেছে, পরিবারগুলোর প্রধানদের তিনি ডেকে জড়ো করলেন ইনসমনিয়া সম্পর্কে তিনি যা জানেন, সেটা বুঝিয়ে বলার জন্য, আর জলাভূমির অন্যান্য গ্রামে যেন রোগটা ছড়িয়ে না যায়, এর দুর্ভোগ থেকে কীভাবে নিজেদের রক্ষা করা যায়, সেসব বিষয়ে একমত হয় তারা। সে কারণেই তারা ছাগলের গলা থেকে ঘণ্টা খুলে ফেলল, যে ঘণ্টাগুলো ভিনদেশি আরবরা ম্যাকাউ পাখির বদলে তাদের দিয়ে গেছে। আর গ্রামে ঢোকার মুখে ঘণ্টাগুলো গার্ডদের হাতে অর্পণ করল এই ভেবে বহিরাগতরা কেউ যদি তাদের উপদেশ না শুনে গ্রামটি ঘুরে দেখার ব্যাপারে কাকুতি-মিনতি করে গোঁ ধরে, তবে তাদের যেন দেওয়া হয়। সে সময় মাকোন্দোর পথ দিয়ে চলতি সব বহিরাগতকে তাদের সেটা নাড়াতে হতো, যাতে গ্রামের অসুস্থজনেরা জানতে পারে যে এই বহিরাগতরা সুস্থ। তারা যতক্ষণ থাকত গ্রামে, তাদের কোনো খাবার বা পানীয় দেওয়া হতো না, কারণ এ ব্যাপারে কোনো রকমের সন্দেহই বাকি ছিল না যে এ রোগ মুখের মাধ্যমেই ছড়ায়, আর সব রকমের খাবার ও জল অনিদ্রারোগ দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। এভাবে তারা গ্রামের চৌহদ্দির বাইরে মহামারি ছড়িয়ে পড়তে দেয়নি। এই গৃহবন্দী-পর্ব এতটাই ফলপ্রসূ হলো যে জরুরি অবস্থা হয়ে গেল স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, আর জীবনটা এমনই হয়ে পড়ল যে কাজকর্ম তার নিজের গতি ফিরে পেল এবং কেউই ঘুমের মতো বেহুদা একটা অভ্যাস নিয়ে আর মাথা ঘামাল না।...

বুদ্ধিটা এসেছিল আউরেলিয়ানোর মাথা থেকে। স্মৃতিভ্রষ্টতা থেকে কয়েক মাসের জন্য নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিল সে। বুদ্ধিটা এসেছিল আচমকা। একজন দক্ষ অনিদ্রারোগী যে যাদের সর্বপ্রথম অনিদ্রায় পেয়ে বসেছিল, সে তাদের একজন, স্যাকরার শিল্পকর্মে সে রীতিমতো হাত পাকিয়েছে। একদিন সে ছোট নেহাইটা খুঁজছিল, যেটা নিয়ে সে ধাতু পেটায়, কিন্তু ওটার নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছিল না। তার বাবা তাকে বলে দিলেন, ‘খোটা’। আউরেলিয়ানো একটা কাগজে নামটা লিখে আঠা দিয়ে কাগজটা সে ছোট নেহাইটার নিচটায় সেঁটে দিল। এভাবে সে নিশ্চিন্ত হলো ভবিষ্যতে আর নামটা ভুলবে না। সে এটা টেরই পেল না যে বিস্মৃতির প্রথম লক্ষণ ছিল সেটা, কারণ বস্তুটার নামটা মনে রাখার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু কয়েক দিন পর সে আবিষ্কার করল যে ল্যাবরেটরির প্রায় সব জিনিসের নাম মনে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে। তারপর সেসব জিনিসের যার যার নামটা চিহ্নিত করে রাখল। তাতে সে ওগুলোর গায়ে লেখা নামটা দেখলেই চিনতে পারে। তার বাবা তখন তাকে, এমনকি শৈশবের হৃদয়ছোঁয়া সব ঘটনা ভুলে যাওয়ার শঙ্কার কথা জানালেন, আউরেলিয়ানা তখন তাঁকে তার কৌশলের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল, আর হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া সে পদ্ধতি অনুসারে সারা বাড়িতে এর চর্চা শুরু করে দিল এবং আরও কিছুদিন পর সারা গ্রামে সেটা আরোপ করল। একটা রং-তুলি নিয়ে প্রতিটি জিনিস সে চিহ্নিত করে রাখল নামসহ: টেবিল, চেয়ার, ঘড়ি, দরজা, দেয়াল, খাট, তাওয়া। খোঁয়াড়ে গিয়ে পশু আর গাছপালাগুলোর নাম লিখে রাখল: গাভি, ছাগল, শুয়োর, মুরগি, মিষ্টিআলু, কচুরমুখী ও গিনিকলা। ধীরে ধীরে, বিস্মৃতির অন্তহীন সম্ভাবনার কথা পড়তে পড়তে, সে বুঝতে পারল যে হয়তো একদিন আসবে যখন সে জিনিসগুলোকে তাদের গায়ে লেখা নাম দেখে তাকে চিনতে হবে; কিন্তু তাদের কার্যকারিতার কথা তার মনে থাকবে না। এরপর সে চূড়ান্ত রকমের কাজটা করল। গাভির ঘাড়ে সে যে ফলকটি ঝুলিয়ে দিল, তা ছিল নজির স্থাপনকারী একটি সাক্ষ্য যে মাকোন্দোর বাসিন্দারা বিস্মৃতির বিরুদ্ধে সম্ভাব্য লড়াইটা কীভাবে মোকাবিলা করছিল: এটি একটি গাভি, একে প্রতিদিন সকালে দুধ খাওয়াতে হবে, যাতে সে দুধ দিতে পারে আর দুধকে জ্বাল দিতে হবে কফির সঙ্গে মেশাতে হলে, যা দিয়ে দুধ-কফি তৈরি করা যাবে।

(নিঃসঙ্গতার এক শ বছর উপন্যাসের মাকান্দোয় মহামারীর এ অংশটুকু মূল স্প্যানিশ থেকে অনূদিত)