জহির রায়হানের 'হাজার বছর ধরে'

করোনাভাইরাসের আক্রমণে সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত। এরই মধ্যে এর প্রাদুর্ভাবকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শুধু করোনাই নয়, নানান সময়ে নানান রূপে আমাদের প্রিয় এই গ্রহে মহামারি এসেছে, লাশের পর লাশ ফেলে রেখে আবার সুপ্ত হয়ে গেছে কিছুকালের জন্য। নিজেদের লাশ ঠেলে মানুষও সেসব ভুলে নতুন করে আবার শুরু করেছে। আবার এসেছে মহামারি, আবার লুকিয়েছে। এসবের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে আলবেয়ার কাম্যুর ‘দ্য প্লেগ’-এর মতো মহৎ উপন্যাস। শুধু ‘দ্য প্লেগ’-ই নয়, মহামারি নিয়ে আরও অনেক লেখা বিশ্বসাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ, বিপুল বৈচিত্র্যময়। বাংলা সাহিত্যেও এসেছে মহামারির চিত্র, কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে; কখনো সংক্ষিপ্ত, সামান্য আভাস, কখনো বিস্তারিতভাবে। অন্য আলোর পাঠকদের জন্য সেসব সাহিত্য থেকে আমরা তুলে দিচ্ছি অংশবিশেষ।

আজ থাকছে জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস থেকে। এ উপন্যাসে মহামারি হিসেবে প্রাদুর্ভাব ঘটে ওলা ওঠা বা কলেরা রোগের। হিন্দু লৌকিক দেবী ওলাইচণ্ডীকে মুসলমানরা বলে ওলা বিবি। সেই ওলা বিবির হঠাৎ আগমনে শান্ত একটি গ্রামের জীবনযাত্রা কীভাবে পালটে যায়, তা-ই দেখতে পাই আমরা।

হাজার বছর ধরে
(কলেরার কাল)

চৈত্র মাসের রোদে মাঠটা খাঁ খাঁ করছে।
যেদিকে তাকানো যায়, শুধু শুকনো মাটি—পাথরের চেয়েও শক্ত। আর অসংখ্য ফাটল। মাটি উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে ফেটে যায়। দাঁড়কাকগুলো তৃষ্ণায় সারাক্ষণ কা-কা করে উড়ে বেড়ায় এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে বাড়ির আনাচে কানাচে।
নদী-নালাগুলোতে পানি থাকেনা। মানুষ গরু ইচ্ছেমতো পায়ে হেঁটে এপার-ওপার চলে যায়। পুকুরগুলোর পানিও অনেক কমে আসে।
গরমে ঘরে থাকে না কেউ। গাছের নিচে চাটাই বিছিয়ে শুয়ে বসে দিন কাটায়। বাতাসে একটি পাতাও নড়ে না। সারাক্ষণ সবাই শুধু হা-হুতাশ করে।

এমনি সময়ে হীরনকে দেখবার জন্যে ওর শ্বশুরবাড়িতে গেছে বুড়ো মকবুল। যাবার সময় একটা ন্যাকড়ার মধ্যে এককুড়ি মুরগীর ডিম সঙ্গে নিয়ে গেছে সে। শূন্য হাতে বেয়াই বাড়ি গেলে হয়তো ওরা লজ্জা দিতে পারে, তাই।
পথে বামুন বাড়ির হাট থেকে চার আনার বাতাসাও কিনেছে সে। বাড়ির বাচ্চাদের হাতে দেবে।

ভর সন্ধ্যায় মেয়ের বাড়ি থেকে ফিরে এলো মকবুল। বার বাড়ি থেকে ওর ক্লান্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল সুরত! সুরত! ও মন্তু, কেউ কি নাই নাকি রে।
মন্তু গেছে মিয়া বাড়ি। গাছ কাটার চুক্তি নিয়েছে সে।
সুরতও সেখানে।
আবুল বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী ভাইসাব, কী অইছে?
টুনি আর আমেনাও বেরিয়ে এলো বাইরে।
মকবুল বললো, সুরত, রশীদ ওরা কই?
আমেনা বললো, সুরত কাজে গেছে, রশীদ গেছে হাটে, সালেহার লাইগা সাবু আনতে।
ওর জ্বর হইছে ভীষণ।
জ্বর নাহি, আহা কখন আইলো? গায়ের ফতুয়াটা খুলতে খুলতে মকবুল বললো, বাপু তোমরা সক্কলে একটু সাবধানে থাইকো। ও বিন্তির মা, বঁইচির মা শোনো, তোমরা একটু সাবধানে থাইকো।
গেরামে ওলা বিবি আইছে।
ইয়া আল্লা মাপ কইরা দাও। আতঙ্কে সবাই শিউরে উঠলো।
গনু মোল্লা ওজু করছিলো, সেখানে থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করলো, কোন্হানে আইছে। ওলা বিবি? কোন্ বাড়িতে আইছে?
মকবুল বললো, মাঝি-বাড়ি।
মাঝি-বাড়ি? এক সঙ্গে বলে উঠলে সবাই। কয়জন পড়ছে?
তিনজন।

তিনজন কে কে সেকথা বলতে পারবে না মকবুল, পথে আসার সময় ও বাড়ির আম্বিয়ার কাছ থেকে শুনে এসেছে সে। বাড়ির সবাইকে আরেক প্রস্থ সাবধান করে দিলো বুড়ো মকবুল, তোমরা সক্কলে একভু হুইসারে থাইকো বাপু। একডু দোয়া দরুদ পাইড়ো। বলে খড়মটা তুলে নিয়ে ঘাটের দিকে চলে গেলে সে।
ফকিরের মা বুড়ি এতক্ষণ নীরবে শুনছিলো সব। এবার বিড়বিড় করে বললো, বড় খারাপ দিন কাল আইছে বাপু। যেই বাড়িডার দিকে একবার নজর পড়ে সেই বাড়িডারে এক্কেবারে শেষ কইরা ছাড়ে ওলা বিবি। বড় খারাপ দিন-কাল আইছে। বলে নিজের মৃত ছেলেটার জন্য কাঁদতে শুরু করলো সে।

টুনি দাঁত মুখ শক্ত করে তেড়ে এলো ওর দিকে, বুড়ি যহন তহন কান্দিছ না কইলাম। শিগগীর থাম।
ধমক খেয়ে ফকিরের মা চুপ করে গেলো। সেই বিয়ের সময় সালেহাকে মারার পর থেকে টুনিকে ভীষণ ভয় করে বুড়ি।
ইতিমধ্যে মন্তু, সুরত ফিরে এসেছে।
কাঁধের উপর থেকে কুড়োলটা মাটিতে নাবিয়ে রাখতে না রাখতে টুনি একপাশে টেনে নিয়ে গেলো ওকে।
মাঝি-বাড়ি যাও নাই তো?
মন্তু ঘাড় নাড়লো, না, ক্যান কী অইছে।
টুনি বললো, ওলা বিবি আইছে ওইহানে। বলতে গিয়ে মুখখানা শুকিয়ে গেলো ওর।
মন্তুর দুচোখে বিস্ময়। বললো, কার কাছ থাইকা শুনছ?
ও কথার কোনো জবাব না দিয়ে টুনি আবার বললো, শোন, ওই বাড়ির দিকে গেলে কিন্তু আমার মাথা খাও। যাইও না ক্যাম?
মন্তু সায় দিয়ে মাথা নাড়লো কিন্তু বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারলো না সে। আজ সকালে মিয়া-বাড়ি যাওয়ার পথে একবার করিম শেখের সঙ্গে দেখা করে গেছে মন্তু। নৌকোটাকে ভালোভাবে মেরামত করার বিষয়ে অনেকক্ষণ আলাপ করে গেছে ওর সঙ্গে। কিন্তু তখন তো এমন কিছু শোনেনি সে।

আম্বিয়ার সঙ্গেও দেখা হয়েছিল, সে-ও কিছু বলেনি।
উঠোনের এক কোণে দাড়িয়ে সাত পাঁচ ভাবলো মন্তু। বুড়ো মকবুলকে তামাক সাজিয়ে দেবার জন্যে রসুইঘরে গেছে টুনি। এই সুযোগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো সে।
দীঘির পাড়ে মন্তু শেখের ভাইঝি জামাই তোরাবের সঙ্গে দেখা হলো। পরনে লুঙ্গি আর কুর্তা। হাতে লাঠি। বগলে একজোড়া পুরনো জুতো। মন্তুকে দেখে প্রসন্ন হাসির সঙ্গে তোরাব প্রশ্ন করলো, কী মিয়া খবর সব ভালো তো?
মন্তু নীরবে ঘাড় নাড়লো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, কই যাও, শ্বশুরবাড়ি বুঝি? হুঁ, তোরাব শ্বশুরবাড়িতেই যাচ্ছে। কাজকর্মের ফাঁকে অনেক দিন আসতে পারেনি, খোঁজ-খবর নিতে পারেনি। তাই সুযোগ পেয়ে একবার সকলকে দেখে যেতে এসেছে সে।
পকেট থেকে দুটি বিড়ি বের করে একটা মন্তুকে দিয়ে আরেকটা নিজে ধরালো সে। বিড়ি খেতে ইচ্ছে করছিলো না ওর। তবু নিতে হলো।
সগন শেখের পুকুর পাড়ে এসে থামলো তোরাব। জুতো জোড়া বগল থেকে নামিয়ে নিয়ে হাত-পা ধোঁয়ার জন্যে ঘাটে নেমে গেলো সে।
বললো, একটুহানি দাঁড়ান মিয়া। অজু কইরা নিই।

হাত-পা ধুয়ে জুতোজোড়া পরে আবার উপরে উঠে এলো তোরাব।
পকেট থেকে চিরুনি বের করে নিয়ে বললো, মাঝি-বাড়ির খবর জানেন নাহি, সক্কলে ভালো আছে তো?
মন্তু বললো, ভালো তো আছিলো, কিন্তুক একটু আগে শুনছি, ওলা লাগছে।
ওলা? তোরাব যেন আঁতকে উঠলো। পায়ের গতিটা কমিয়ে এনে সে শুধালো, কার কার লাগছে।
মন্তু বললো, কী জানি ঠিক কইবার পারলাম না।
হুঁ। হঠাৎ থেমে গেলো তোরাব। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল, তারপর পায়ের জুতোজোড়া খুলে আবার বগলে নিতে নিতে বললো, এই দুঃখের দিনে গিয়া ওনাগোরে কষ্ট দেয়নের কোনো মানি অয় না মিয়া। যাই ফিইরা যাই। যেতে যেতে আবার ঘুরে দাঁড়ালো সে। আস্তে করে বললো, আমি যে আইছিলাম এই কথাডা কেউরে কইয়েন না মিয়া। বলে মন্তুর উত্তরের অপেক্ষা না করে যে পথে এসেছিলো, সে পথে দ্রুতপায়ে আবার ফিরে চললো তোরাব।
হাতের বিড়িটা অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মন্তু।
মাঝি-বাড়ি থেকে করুণ বিলাপের সুর ভেসে এলো সেই মুহূর্তে। একজন বুঝি মারা গেলো। কলজেটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠলো মন্তুর। মাঝি-বাড়ির দেউড়িটা পেরিয়ে ভেতরে আসতে সারা দেহ কাঁটা দিয়ে উঠলো ওর। নন্তু শেখ মারা গেলো। হাঁপানি জর্জর করিম শেখ মৃত বাবার পাশে বসে কাঁদছে। আম্বিয়া কাঁদছে তার বিছানায় শুয়ে। ওলা বিবি তাকেও ভর করেছে। তাই বিছানা ছেড়ে ওঠার শক্তি পাচ্ছে না মেয়েটা। সেখান থেকে কাঁদছে সে।
দাওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে রইলো মন্তু।

মাঝি-বাড়ির ছমির শেখ ওকে দেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো। এই কি মুছিবত আইলো মিয়া, আমরা বুঝি এইবার শেষ অইয়া যামু। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো মন্তু। তারপর ওর কাছ থেকে বাকি খোঁজ-খবর নিলো সে। ছোট ভাই জমির শেখ কবিরাজ আনতে গেছে দুক্রোশ দূরে রতনপুরের হাটে। এখনো আসেনি; ভোরের আগে যে আসবে তারও কোনো সম্ভাবনা নেই। এই একটু আগে ছমির শেখ, পরিবারের ছেলেমেয়ে সবাইকে তার মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। বুড়োরা মরে গেলেও ছেলেমেয়েগুলো যাতে বাঁচে। নইলে বাপ-দাদার ভিটার ওপর বাতি দিবার কেউ থাকবে না। ছমির শেখের দুগণ্ড বেয়ে পানি ঝরছে। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজের চোখজোড়াও ভিজে এলো ওর। আম্বিয়ার ঘরের দিকে তাকাতে দেখলো, বিছানায় শুয়ে বিলাপ করছে মেয়েটা।

পরদিন ভোরে একটা খন্তা আর কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মন্তু।
পরীর দীঘির পাড়ে জায়গাটা আগেই দেখিয়ে গেছে ছমির শেখ। কথা ছিলো একটা কবর খোঁড়ার। এখন দুটো খুঁড়তে হবে। একটা নন্তু শেখের জন্য, আরেকটা ছমির শেখের জন্য। রাতে কবিরাজ আনতে যাওয়ার সময় ভেদবমি শুরু হয় ওর। বাড়িতে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরে মারা গেছে ও।
আগে মরার জন্যে কবর খোঁড়ার কাজটা নন্তু শেখ করতো। গত ত্রিশ বছর ধরে এ গায়ে যত লোক মরেছে সবার জন্যে কবর খুঁড়েছে সে। কোদাল হাতে কবর খোঁড়ার সময় প্রায় একটা গান গাইতো নন্তু শেখ। আর ওর কবরের ছক কাটতে গিয়ে সে গানটার কথা মনে পড়ে গেলো মন্তুর।
এই দুনিয়া দুই দিনের মুসাফিরখানা ও ভাইরে।
মইলে পরে সব মিয়ারে যাইতে হইবো কবরে।

জহির রায়হান
জহির রায়হান

মাটি খুঁড়তে আর টেনে টেনে গান গাইতো নন্তু শেখ। বলতো, কত মানুষেরে কবর দিলাম, কত কবর খুঁইড়লাম এই জীবনে। তার হিসাব কি আর আছে মিয়া। এমনও দিন গ্যাছে, যহন একদিন সাত-আটটা কইরা মাটি দিছি।
গোরস্থানে কার কোনটা কবর, কাকে কোনদিন এবং কোথায় কবর দিয়েছে সব কিছু মুখে মুখে বলে দিতে পারতো নন্তু। আর যখন কবর খুঁড়তে গিয়ে মানুষের অস্থি কিম্বা মাথার খুলি পেতো সে, তখন সবাইকে দেখিয়ে বিজ্ঞের মতো বলতো, চিনবার পার এরে? না না তোমরা চিনবা কেমন কইরা? আমি চিনি। এই কলিমুল্লা মাঝির মাইয়ার খুলি। এইহানেই তো কবর দিছিলাম ওরে। আহা মাইয়া আছিল বটে একডি। যেনো টিয়া পাখির ছাও। যে একবার দেইখছে, সেই আর তারে ভুলবার পারে নাই। বলে খুলিটার দিকে খুব ভালো করে তাকাতে নন্তু শেখ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার করে দেখতে ওটা, আহা কি মাইয়া কি অইয়া গেছে। সোনার চাঁদসুরত এহন চিনবারই পারা যায় না। অতি দুঃখের সঙ্গে নন্তু আবার বলতো, গলায় ফাঁস দিয়া মইরছিলো অভাগী। জামাইর সঙ্গে বনিবনা অইতো না তাই। খুলিটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নন্ত বলে যেতো, সেই বহুত দিনের কথা মিয়া, তহন তোমরা সব মায়ের পেটে আছিলা।

সেই নন্তু শেখের মৃতদেহটা কবরে নামাতে গিয়ে চোখজোড়া পানিতে ঝাপসা হয়ে এলো মন্তুর। মইরলে পরে সব মিয়ারে যাইতে অইবো কবরে। সারাদিন আর বাড়ি ফিরলো না মন্তু। দীঘির পাড়ে কাটিয়ে দিলো সে। ওর মায়ের কবরটা দেখলো। এককালে বেশ উঁচু ছিলো ওটা। অনেক দূর থেকে চোখে পড়তো, এখন মাটির নিচে খাদ হয়ে গেছে এক হাঁটু। অনেকগুলো ছোট ছোট গর্ত নেমে গেছে ভেতরের দিকে, সেখানে মায়ের দু-একখানা হাড় হয়ত আজও খুঁজে পাওয়া যাবে। মায়ের জন্যে আজ হঠাৎ ভীষণ কান্না পেলো ওর। মনে হলো ও বড়ো একা। এ দুনিয়াতে ওর কেউ নেই। শুকনো পাতার শব্দে পেছনে ফিরে তাকালো মন্তু। টুনি দাঁড়িয়ে পেছনে। সারা দিন ওর দেখা না পেয়ে অনেক খোজের পর এখানে এসেছে সে। মন্তুকে ওর মায়ের কবরের পাশে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো টুনি।

তারপর ওর কাঁধের ওপর একখানা হাত রেখে আস্তে করে বললো, ঘরে যাইবা চলো।
কোনো কথা না বলে নীরবে উঠে দাঁড়ালো মন্তু। কিন্তু তক্ষুণি বাড়ি ফিরলো না সে।
বললো, তুমি যাও আমি আহি।
টুনি উৎকণ্ঠিত গলায় বললো, কই যাইবা?
মন্তু বললো, যাও না, আইতাছি। বলে টুনিকে সঙ্গে নিয়ে পরীর দীঘির পাড় থেকে নেমে এলো সে।

ও যখন বাড়ি ফিরে এলো, তখন বেশ রাত হয়েছে। বারবাড়ি থেকে মন্তু শুনতে পেল গনু মোল্লা ওরা বসে বসে কী যেন আলাপ করছে।
গনু মোল্লা বলছে, সব অইছে খোদার কুদরত বাপু। নইলে এই দিনে তো কোনদিনই ওলা বিবিরে আইতে দেহি নাই।
মকবুল বললো, ওলা বিবির আর আজকাইল দিনকাল কিছু নাই। যহন-তহন আহে।
আমেনা বললো, এক পা খোঁড়া বিবির। তবু যেন কেমন কইরা এত বাড়ি বাড়ি যায়, আল্লা মালুম।
ওর কথা শেষ না হতেই টুনি জিজ্ঞেস করলো, কেমন কইরা ওর এক পা খোঁড়া অইল বুয়া?
তখন টুনিকে বোঝাতে লেগে গেলো আমেনা।
ওলা বিবি, বসন্ত বিবি আর যক্ষ্মা বিবি ওরা ছিলো তিন বোন এক প্রাণ। যেখানে যেত এক সঙ্গে যেতো ওরা। কাউকে ফেলে কেউ বেরুতো না বাইরে।
একদিন যখন খুব সুন্দর করে সেজেগুজে ওরা রাস্তায় হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলো, তখন। হঠাৎ হজরত আলীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো ওদের। রঙ্গিন শাড়ি পরে বেরুলে কি হবে, ওদের চিনতে এক মুহূর্তও বিলম্ব হলো না হযরত আলীর। তিনি বুঝতে পারলেন এরা একজন কলেরা, একজন বসন্ত, আর একজন যক্ষ্মা বিবি। মানুষের সর্বনাশ করে বেড়ায় এরা। আর তহনি এক কাণ্ড কইরা বইসলেন তিনি। খপ কইরা মা ওলা বিবির একখানা হাত ধইরা দিলেন জোরে এক আছার। আছাড় খাইয়া একখানা পা ভাইঙ্গা গেলো ওলা বিবির। আহা সব খোদার কুদরত।
মকবুল সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, একখানা পা দিয়া দুনিয়াডারে জ্বালাইয়া খাইছে বেটি। দুই পা থাকলে তো দুনিয়াডারে একদিনে শেষ কইরা ফালাইতো।
হঠাৎ মন্তুর দিকে চোখ পড়তে বুড়ো মকবুল মুহূর্তে রেগে গেলো। কীরে নবাবের বেটা, তোরে একশবার কই নাই, মাঝি-বাড়ি যাইস না, গেলি ক্যান অ্যাঁ।
গনু মোল্লা বললো, আক্কেল পছন্দ নাই তোর।
সুরত আলী বললো, বাড়ির কারো যদি এহন কিছু অয়, তাইলে কুড়াইল মাইরা কল্লা ফালাইয়া দিমু তোর।
ফকিরের মা বুড়ি এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার সে বললো, বাপু গেলেই কী অইবো, আর না গেলেই কী অইবো? যার মউত আল্লায় যেই দিন লেইখা রাইখছে, সেই দিন অইবো। কেউ আটকাইবার পারবে না।
ঠিক কইছেন চাচি, আপনে ঠিক কইছেন। সঙ্গে সঙ্গে ওকে সমর্থন জানালো টুনি।
ওর কথা শেষ হতেই হঠাৎ ফাতেমা জানালো গত রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে।
দেখেছে একটা খোঁড়া কুকুর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ওদের গ্রামের দিকে এগিয়ে আসছে।
বড় ভালা দেখছ বউ। বড় ভালা দেখছ। ফকিরের মা পরক্ষণে বললো, ওই খোঁড়া কুত্তা, খোঁড়া মোরগ আর গরুর সুরত ধইরাই তো আহে ওলা বিবি। এক গেরাম থাইকা অন্য গেরামে যায়। বলে সমর্থনের জন্যে সবার দিকে এক নজর তাকালে সে।
মকবুল জানালো, শুধু তা-ই নয়, মাঝে মাঝে খোঁড়া কাক, শিয়াল কিম্বা খোঁড়া মানুষের রূপ নিয়েও গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যাতায়াত করে ওলা বিবি।
হ্যাঁ মিয়ারা। বুড়ো মকবুল সবাইকে সাবধান করে দিলো। খোঁড়া কিছুরে বাড়ির ধারেকাছে আইতে দিয়ো না তোমরা। অচেনা কোনো খোঁড়া মানুষও না। দেখলেই ওইগুলোরে তাড়ায়ে খাল পার কইরা দিয়ো।
সকলে ঘাড় নেড়ে যায় দিলো। হ্যাঁ তাই করবে।
রাতে ঘুম হলো না মন্তুর।
সারাক্ষণ বিছানায় ফটফট করলো সে। না, একটা বিয়ে ওকে এবার করতেই হবে। এমনি একা জীবন কতদিন কাটাবে মন্তু। কিন্তু বিয়ের কথা ভাবতে গেলে ইদানীং টুনি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের কথা ভাবতে পারে না সে। শান্তির হাটের সেই রাত্রির পর থেকে টুনি তার সমস্ত অন্তর জুড়ে বসে আছে। গ্রামের কত লোক তাদের বউকে তালাক দেয়। বুড়ো মকবুল কেন তালাক দেয় না টুনিকে।
হঠাৎ পরীবানুর পুঁথির কথা মনে পড়লো মন্তুর। সুরত আলী মাঝে মাঝে সুর করে পড়ে ওটা।
ঘর নাই বাড়ি নাই দেখিতে জবর।
পরীবানুর আসিক লইল তাহারি উপর।
কুলাটিয়া গ্রামের এক গৃহস্থের বউ পরীবানু। স্বামীর সঙ্গে মিলমিশ হতো না। অষ্টপ্রহর ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকতো। ঘর ছেড়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে নীরবে বসে থাকতো সে। আর সেখান থেকে দেখতে একটি রাখাল ছেলেকে। দূরে একটা বট গাছের নিচে বসে এক মনে বাঁশি বাজাতো সে। এমনি চোখের দেখায় প্রেম হয়ে গেলো।
তারপর।
তারপর একদিন সময় বুঝিয়া।
দুইজনে পালায়া গেলো চোখে ধুলা দিয়া।
মন্তুর তা-ই মনে হলো। টুনিকে নিয়ে যদি একদিন পালিয়ে যায় সে। দূরে বহুদূরে, দূরের কোনো গ্রামে কিংবা শহরে। শান্তির হাটে যদি ওকে নিয়ে যায় সে, তাহলে মনোয়ার হাজী নিশ্চয় একটা বন্দোবস্ত করে দেবে। সেখানে টুনিকে নিয়ে সংসার পাতবে মন্তু। যেকোনো দোকানে হাজীকে দিয়ে একটা চাকরি জুটিয়ে নেবে সে।
এমনি আরও অনেক চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লো মন্তু।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরুতেই আমেনা জিজ্ঞেস করলো, নন্তু শেখের বাড়ির কোনো খবর জানো।
না।
ওমা জানো না? নন্তু শেখের ছেলে করিম শেখ পড়েছে আজ।
মন্তু কোনো কথা বললো না।
আমেনা বলে চললো, কবিরাজে কিছু কইরবার পারলো না। তাই ও গনু মোল্লারে ডাইকা নিছে। একটু ঝাড়ফুঁক দিয়া যদি কিছু অয়।
মন্তুকে চুপ করে থাকতে দেখে আমেনাও চুপ করে গেলো।
অবশেষে আরও দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলা বিবি।
গ্রামের সবাই মসজিদে সিন্নি পাঠালো। মিলাদ পড়ালো বাড়ি বাড়ি।
ওলা বিবি গেলেন। আর দিন কয়েক বৃষ্টি এলো জোরে। আকাশ কালো করে নেমে এলো অবিরাম বর্ষণ। সারা রাত মেঘ গর্জন করলো। বাতাস বইলো আর প্রচণ্ড বেগে ঝড় হলো।
আগের দিন বিকেলে আকাশে মেঘ দেখে বুড়ো মকবুল তার পুরনো লাঙলটা ঠিক করে নিয়েছে। গরু নেই ওর। রওশন ব্যাপারীর কাছ থেকে এক জোড়া গরু ঠিকে নেবে। যে কদিন হাল চলবে, সে কটা দিনের জন্যে নগদ টাকা দিতে হবে। তা ছাড়া গরুর ঘাসবিচালির পয়সাও জুটাতে হবে তাকে।
ভোর না হতেই সবাই বেরিয়ে পড়লো মাঠে।
আবুল, মন্তু, সুরত আলী, রশীদ, বুড়ো মকবুল আর গ্রামের সবাই।

-----
গ্রন্থনা: রাসেল রায়হান