লকডাউন - সাইমন আর্মিটেজ

সঙ্গনিরোধ চলাকালে গ্রামের সীমান্তে রাখা এই পাথর অতিক্রম করে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।
সঙ্গনিরোধ চলাকালে গ্রামের সীমান্তে রাখা এই পাথর অতিক্রম করে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।

ভূমিকা: যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত কারণে ক্রমশ লকডাউন হয়ে পড়া পরিস্থিতিতে সাইমন আর্মিটেজ কবিতাটি রচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ভয়ংকর দুর্যোগে শিল্পকলা জোগাতে পারে প্রয়োজনীয় সান্ত্বনা, কারণ ‘শিল্পের দাবি হচ্ছে মনঃসংযোগ, চিন্তা ও ধ্যান’।

পোয়েট লরিয়েট হিসেবে যশস্বী এ কবির রচিত সাম্প্রতিক কবিতা ‘লকডাউন’। এর শুরুতে বর্ণিত হয়েছে সপ্তদশ শতকে বিলাতের জনপদ ইয়ামে ছড়িয়ে পড়া বুবনিক প্লেগের প্রসঙ্গ। ওখানকার ডার্বিশায়ার গ্রামে লন্ডন থেকে নিয়ে আসা কাপড়ের বেইলে লুকিয়ে থাকা মাছি থেকে সংক্রমিত হয়েছিল ভয়াবহ প্লেগ। পরবর্তী স্তবকে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ থেকে কবি আহরণ করেন সংস্কৃত যুগের ধ্রুপদি দৃশ্যকল্প।
বর্তমানে বিলাতের ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারে তাঁর পরিবারের সঙ্গে বাসরত কবি আর্মিটেজ প্রসঙ্গক্রমে মন্তব্য করেন, ‘লকডাউনের সম্ভাবনা যেখানে দ্রুত সামাজিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেখানে প্লেগ উপদ্রুত ইয়ামের ঘটনা স্মৃতিপটে অনুরণিত হয়ে ওঠা স্বাভাবিক।’
তাঁর কবিতায় প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখিত হয় প্লেগ উপদ্রুত ইয়েম নামের জনপদের সীমানানির্দেশক পাথরের কথা, যার ছয়টি গর্তে গ্রামবাসী সংক্রমণ রোধের প্রত্যাশায় শিরকায় চুবানো মুদ্রা রেখে দিত, যাতে ভিন্ন জনপদের বণিকেরা তা তুলে নিয়ে বিনিময়ে করিন্টিন রেখার কাছে রেখে যেতে পারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য। কবিতায় আরও উল্লেখিত হয় একটি ট্র্যাজিক প্রণয়ের প্রসঙ্গ। ইয়েমে বাস করা একটি মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসা ছিল ভিন্ন গ্রামের এক যুবকের, যে প্রতিদিন এসে দাঁড়াত করিন্টিন রেখার কাছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কথা বলত... তারপর একদিন ছেলেটি এসে দাঁড়াল, অপেক্ষা করল কিন্তু মেয়েটি আর এল না... । এ প্রসঙ্গে কবি মন্তব্য করেন, ‘মেঘের ভেলা যক্ষের বার্তাটি বয়ে নিয়ে যেতে রাজি হয়, কারণ সে যক্ষের কাছ থেকে জেনেছে যে যাত্রাপথ শোভিত হয়ে আছে নিসর্গের অসামান্য সম্পদে। আমি মনে করি, এ বর্ণনা জোগায় রোমান্টিক আশাবাদ।’

কবির ধারণা, এ বার্তা থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ‘জীবন সম্পর্কে সহজিয়া দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ এবং বিশ্বাস রাখা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ধারাপ্রবাহে। চলমান দিনযাপনের গতি হয়তো খানিকটা শ্লথ হয়ে আসবে, সম্প্রসারিত হবে বুদ্ধিবৃত্তির বৃত্ত এবং পরিশেষে আমরা সচেতন হব আমাদের বিরামহীন অর্জন ও দ্রুতগতিসম্পন্ন দিনযাপনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে।’
কবি আর্মিটেজের বক্তব্য হচ্ছে, ‘কবিতার সংজ্ঞার মধ্যে নিহিত আছে সান্ত্বনার ব্যাপার, কারণ ‘কবিতার দাবি হচ্ছে মনঃসংযোগ, চিন্তা ও প্রগাঢ় ধ্যান।’
তিনি আরও বলেন, ‘মহামারি-জনিত সংকটের প্রতিরোধে সান্ত্বনাধর্মী কবিতার সংকলনের সম্ভাবনা কম, তবে কবিতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রচ্ছন্ন সংবেদনশীল ভাষার ব্যাপারটা। কবিতার চিরায়ত আবেদন হচ্ছে, জগৎ-সংসারে আমরা যেন একে অপরের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠি।


লকডাউন

আধো ঘুমের বিপন্ন স্বপ্নে দেখি ছেয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশ
বীজাণুবাহী মক্ষিকায়,
সংক্রামক রোগে বিক্ষত
পুরানো দিনের জনপদ ইয়েম-এর দরজি দোকান,
ফায়ারপ্লেসে রাখা আর্দ্র কাপড় ও সুতোয়
কিলকিল করছে কুৎসিত মক্ষিকা,
চেষ্টা করেও পারি না এ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে।

চারদিকে তাকিয়েও দেখতে পাই না
সীমান্তের নিশানা চিহ্নিত কিংবদন্তির পাথর,
যার মোরগ-চুখো ছক্কা-ডাইসে গাঁথা ছয়টি ছিদ্র
আমজনতা যাতে শিরকায় চুবিয়ে রাখত সংক্রামিত মুদ্রা।
এ স্বপ্নদৃশ্যে মনে ফিরে আসে এমট সিডাল ও রাওল্যান্ড টোরের
ট্র্যাজিক গাথা-রাহুগ্রস্ত প্রেমিক যুগল এসে দাঁড়াত
করিন্টিন রেখার দুপাশে,
বজায় রেখে নিরাপদ দূরত্ব
চেয়ে থাকত নীরবে পরস্পরের দিকে।

নিদ্রিত হই ফের-স্বপ্নে ভেসে ওঠে ভিন্ন দৃশ্যপট,
নির্বাসিত যক্ষ ভাসমান মেঘের ভেলায় পাঠাচ্ছে
হারিয়ে যাওয়া পত্নীর কাছে তার বিরহ বার্তা,
যে মেঘখণ্ড ভেসে যায়
গবাদিপশু চরা প্রান্তরের ওপর দিয়ে,
অতঃপর ঊষর মরুভূমিতে
উটের কাফেলা বালুকায় পদছাপ এঁকে হেঁটে যায়।
নিচে তন্বী নারীর গলার মণিহারের মতো নদী ও ঝরনা
বনানীতে পেখম মেলছে ময়ূর,
হেঁটে যাচ্ছে আলপনা আঁকা হস্তিযূথ,
নকশিকাঁথার মতো মাঠ ও ঝোপঝাড়ের জ্যামিতিক বিন্যাস
মেঘের বার্তাবাহী ভেলা পেরিয়ে যায়
বাঁশবন, তুষারের মুকুট পরানো পর্বত
জলপ্রপাত ও ঝোরা।

বৃষ্টিভেজা পদ্মের কোরক মুখে ডানা ছড়ানো সারস
আকাশে তৈরি করে মিসরি লিপির মতো নকশা,
নিচে বিরল রকমের স্বচ্ছতায় সম্মোহিত হয়ে
বাতাস বইছে,
এ পরিভ্রমণ দীর্ঘ, ক্লান্তিকর, শ্লথ ও বিপদসংকুল
তবে অতীবও প্রয়োজনীয়।


কবি পরিচিতি: যুক্তরাজ্যের পোয়েট লারিয়েট সাইমন রবার্ট আর্মিটেজ (১৯৬৩) একাধারে কবি, নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক। পেশাগত জীবনে কবি প্রফেসার অব পোয়েট্রি হিসেবে লিডস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

** ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত কবিতা ও প্রাসঙ্গিক ভূমিকাটি প্রকাশিত হয় ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়। ইন্টারপ্রিটেশন-ধর্মী ভূমিকার রচয়িতা হচ্ছেন অলিসন ফ্লড।