কোলাহল তো বারণ হলো

এলডার ব্রুগেলের আঁকা ‘মৃত্যুর বিজয়োল্লাস’, ১৫৬২, মাদ্রিদ
এলডার ব্রুগেলের আঁকা ‘মৃত্যুর বিজয়োল্লাস’, ১৫৬২, মাদ্রিদ

কদিন ধরে খুব সুন্দর রোদ উঠছে লন্ডনের আকাশ রাঙিয়ে দিয়ে, ভুট্টার তেলের মতো লালচে রোদ, আকাশ নির্মেঘ। আমি মনে মনে ভাবছি, পৃথিবীময় মারী-মড়কের আগ্রাসনে হয়তো অ্যাটমসফেয়ার খানিকটা স্বস্তির শ্বাস ফেলছে, ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো’ তারা সবাই ঘরকে গেছে বলে। তাই যেন হঠাৎ করে অবারিত নীল ফিরে এসেছে আকাশ ভেঙে, দিগন্তের কোলে কোলে আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্মগ নেই, সালফার ডাই-অক্সাইডের মেঘ ঘনিয়ে নেই, বরং ঘরে ঘরে মানুষ গিজগিজ করছে বলে বাড়িগুলোর ওপর অন্য রকম মেঘ যেন, কমলকুমার মজুমদার যেমন করে দেখিয়েছিলেন সারি সারি ঘরের ওপর রান্নাবাড়ির ধোঁয়া—তার মানে সবকিছু মেঘ, রুইমাছের ঝোলের মেঘ, সোনামুগের ডালের মেঘ।

আমাদের মাথার ওপর, ছাদের টালির ওপর এমনি কতশত মেঘ কত শরৎরাত্রির ছল করে ভেসে যাচ্ছিল, ঘূর্ণমান পৃথিবীর উপরিতলে আমাদের অসংখ্য পেরেকের মতো সেঁটে। অঁরি রুশোর আঁকা গোলাপির সর্বনাশের মতো মেঘ, এল গ্রেকোর সেই রুপালি লেস দেয়া মেঘ, জীবনানন্দের ‘রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক’-এর মতো মেঘ…কই মাথা উঁচু করে তাকিয়েছিলাম কি?

ঘাড় গুঁজে হিসাব মিলিয়েছি, হিসাব না মিললে তর্ক করেছি, আর আমাদের কেন্দ্র করে ঋতুপরিক্রমা গেছে, সূর্য জ্বলেছে, পলাশ ফুটেছে, নির্বিচার উজাড় হয়েছে বন, মাতৃক্রোড়চ্যুত হয়েছে পশুরা।

আমরা ভেবেছি, তাতে কী? যেন ভালোবাসার আতিশয্যে আমাদের কেন্দ্র করে আপূর্যমান কোনো নারীকে আমরা অসম্মান করে গেছি, উপেক্ষা করে গেছি দিনের পর দিন, ভেবেছি সে যে সর্বংসহা, তাকে নির্যাতন করলেও সে ভালোবাসবে ভেবেছি, ভেবেছি এমনকি সৎকার করে ফেললেও সে রেখে যাবে তার ভালোবাসার নিদর্শন।

কিন্তু এ তো যে সে নারী নয়, এ মা, এ ধরিত্রী, বড় সহ্য তার আবার বড় তেজ। তার বুকে যে বা কবর বেঁধেছে, তার রেহাই নেই।

এডফার্ড মুংখ, আত্মপ্রতিকৃতি, স্প্যানিশ ফ্লুর পর ১৯১৯
এডফার্ড মুংখ, আত্মপ্রতিকৃতি, স্প্যানিশ ফ্লুর পর ১৯১৯

আমি এই করোনাভাইরাসের কালকে প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে দেখি, মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করেছে বারংবার, একরকম প্রকৃতিবিরুদ্ধ নিষ্ঠুরতায় সে অস্বীকার করেছে পৃথিবীর গাছপালা-পশুপাখির সমস্ত সম্বন্ধকে, ভুলে গেছে প্রাণী হিসেবে তার নিজের সম্বন্ধের কথা, ভুলে গেছে প্রাণী হিসেবে তার প্রয়োজনের অধিক না দোহন করার প্রতিজ্ঞার কথা, ভুলে গেছে অপর প্রাণী আর অপর মানুষকে ভালোবাসার কথা।

এই যে এখন নগর আর গ্রাম—সারা পৃথিবী প্যানডেমিকের ভয়ে কাঁপছে, মৃত্যুভয়ের মতো আদি এবং অকৃত্রিম একটি ভয়ে, এ ভয় এসেছে আমাদের নশ্বরতাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যই। মেরু-শিয়াল ভোলে না মৃত্যুর কথা, হিমালয় ডিঙোনো হাঁস ভোলে না মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা, এমনকি অত যে পরাক্রমশালী আমুর টাইগার, সেও মৃত্যুকে ভোলে না; আমরা কেন ভুলে ছিলাম প্রাকৃতিক মৃত্যুদণ্ডকে?

ঘরগুলো এখন দিনমান আবাসিক, মৌমাছি-ঠাসা মৌচাকের মতো গুনগুন করছে না, গুঞ্জনও এখন শোনা যায় না, মানুষ স্তব্ধ, সে সহসা সচকিত। তার সড়ক জনশূন্য, তার উদ্যান শিশুর কাকলিহীন, তার প্রতাপের প্রতীক কলকারখানাগুলো মৃত নগরীর চেয়ে নিশ্চুপ।

ভরে উঠছে হাসপাতাল, ভরে উঠছে কবরখানা। দেশে দেশে। এখানে এক্সসেল সেন্টারের মতোন বিশাল ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টার রাতারাতি ভরে উঠছে আপৎকালীন হাসপাতালের বেডে, লিকুইড অক্সিজেন ট্যাংকে। ঘরের অন্দর ভরে উঠেছে সাইবার ক্রাইম আর ফ্রডে, করোনাকে সামনে রেখে চলছে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার খেলা। অন্তর্জাল ভরে উঠেছে নকল স্যানিটাইজারে, ভরে উঠেছে ফিন্যান্সিয়াল ডিটেইল চেয়ে চালানো চালিয়াতি ই-মেইলে, স্বাস্থ্যকর্মীর পরিচয় দিয়ে বুড়ো মানুষের ঘরে হানা দেওয়া ডাকাতের খবরে।

আমরা অনেককাল ধরে আমাদের হৃদয়কে টুঁটি টিপে ছোট করে এনেছি, তাই ভরে উঠছে আমাদের ভান্ডার, আমার শিশুটি বাঁচবে, ওর শিশুটি মরলেও আমারটি থাকবে।

আমরা অনেককাল ধরে ‘হ্যাভ’ আর ‘হ্যাভ নট’দের পঙ্‌ক্তিতে বিভাজ্য, আমাদের নেওয়া-দেওয়ায় অন্বয় নেই, আমাদের সমূহ সর্বনাশের ভয়ে আমরা পথেঘাটে জীবিকার সন্ধানে বের হওয়া একান্ত নিরুপায় মানুষকে অপমান করছি, ফিরিয়ে দিচ্ছি বেঁচে থাকবার ইচ্ছায় অধীর মানুষকে, ফিরিয়ে দিচ্ছি মৃতপ্রায় স্বজনকে। এভাবেই ‘দুঃসময় লাফ মেরে ধরে মোরগের লাল ঝুঁটি’।

অতিমারীর একটা খুব দৈবী শক্তি আছে, সে ‘সকলি সমান করে’, প্রথম বিশ্বও মরে, তৃতীয় বিশ্বও মরে। যে ইংরেজ গর্ব করে বলত, আমার বাড়ি আমার দুর্গ, যার সামাজিক জীবনে সত্যিই অজস্র পরিখা আর তাক করা কামান উঁচিয়ে আছে অপরাপর জাতের দিকে, সে তার গলির প্রতিবেশীদের অনলাইনে জিজ্ঞেস করছে—সে আজ রুটি-দুধ-ডিম-ডিটারজেন্ট কিনতে যাচ্ছে, আর কারও বাজার কি সে করে দিতে পারে, কারও কিছু চাই কি না! তাই বা কম কিসে।

অসংখ্য রিটায়ার্ড ডাক্তার-নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মী ফিরে আসছেন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন দুর্গত মানুষের দিকে। আমাদের দেশে অসংখ্য মানুষ যে যেভাবে পারছেন, সচেতনতা সৃষ্টি করছেন, স্যানিটাইজার বানাচ্ছেন, পিপিই তৈরি করছেন, কম কী! যিনি আর কিছু করতে সক্ষম নন, তিনিও কাছের আর দূরের প্রিয়জনকে শান্ত করছে, সংহতি আর স্নেহ বিলি করছে। এখনো তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এ এমন দিন যখন ‘মানুষ বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু’!

তা, কোলাহল তো বারণ হলো, এবার কথা কানে কানে… প্রকৃতিই আমাদের নৈঃশব্দ্যের কাছে বারবার ফিরিয়ে আনে, জলের ছলাত ছলাত শব্দের সঙ্গে যে নৈঃশব্দ্য জড়িয়ে আছে, পাহাড়ের ছায়ানীল উপত্যকায় যে নৈঃশব্দ্য ভরে আছে, আমাদের ঘরের আমাদের আলিঙ্গনের মানুষদের মাঝখানে যে নৈঃশব্দ্য জমাট বেঁধে শুকিয়ে গেছে, সেসবের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

এই যে গৃহান্তরীণ মানুষ, যারা জীবন কাটাত, তারা এ অবসরে এই নৈকট্যে জীবনকে ‘যাপন’ আর ‘উদযাপন’ করতে পারবে না আবার?

আমাদের দীর্ঘশ্বাস, সরল গাছেদের দুচ্ছাই নিঃশ্বাস, ঘুমন্ত শিশুদের ঘামের স্বতঃবাষ্পীভূত আর্দ্রতা, ঢ্যাঁড়স-ভাজা আর মসুর ডাল রাঁধার ধোঁয়া—এসব মিলেঝিলে মেঘ গড়ে উঠছে আকাশে, অনেক দিনের নির্মলতার দাবি নিয়ে। এসব দিনে আমার মনে পড়ে যায়, অর্ধশতক আগে সিনেমার গরবিনী ‘চিত্রলেখা’কে দিয়ে সাহির লুধিয়ানভী বলিয়েছিলেন, ‘রচনাকে (সৃষ্টিকে) যদি তুচ্ছ করো, তবে রচয়িতার অপমান।’ আর বলিয়েছিলেন ‘হম জনম বিতাকার যায়েঙ্গে, তুম জনম গাওয়াকার যাওগে’, অর্থাৎ এ জীবন আমি উদযাপন করে যাব, আর তুমি কেবল জীবন কাটিয়ে যাবে।

প্রকৃতি বলুন, ধরিত্রী বলুন, সে চায় না আপনি তার ঐশ্বর্যময় রূপকে অস্বীকার করে জীবন কাটিয়ে যান, এই গরবিনীও চায়/ চেয়েছিল আপনি চেয়ে দেখুন, মগ্ন হয়ে দেখুন, দিয়ে দেখুন, ভালোবেসে দেখুন তাকে, একটিমাত্র মানবজীবন— তাকে উদযাপন করুন। যদি তা করতেন/ করতাম, তবে এই ক্ষুব্ধ অপমানিত প্রকৃতির রোষ দেখতে হতো না আমাদের।

আমার আট বছর আগে বোনা রোজমেরিগাছটা এখন একাই একখানা ঝোপ, সেই অতিকায় ঝোপে এন্তার মৃদু-বেগুনি ফুল এসেছে, অসংখ্য মৌমাছি আর বাম্বল বীর আনাগোনা তাতে।

রোজমেরি ঝাড়
রোজমেরি ঝাড়

চৌকাঠে এন্তার রোদ এসেছে বলে সদর দরজা খুলে বসে ছিলাম, সামনের দিনগুলোতে দুধ ডিম চাল ডাল ইত্যাদি কী কী পাওয়া যাবে না তার উদ্বিগ্ন হিসেব করে করে ক্লান্ত। বসে বসেই শুনতে পেলাম—ভোমরার গুনগুন শোনা যায় এত নিরালা…দেয়ালে তাকিয়ে দেখি রোদের তাপে বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে যে জলকণারা তাদের ছায়া, এইভাবে জল শুকিয়ে আসে। আমার পায়ের কাছে ঝরে পড়া বেগুনি ফুলগুলির ওপর দিয়ে একটা মৃত বাম্বল বীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ের দল, এইভাবে জীবন অপরের খাদ্য হয়ে আসে…না না, বলা যায় এইভাবে মৃত্যু জীবনের জোগান দেয়।

এ সময়ে যা যা হয় তা-ই তাই হচ্ছে, ব্লু বেলগুলোর চকচকে সরস পাতা গজিয়ে উঠছে, ঘাসের রং ফিরেছে, টিউলিপের কলি এসেছে, খুব ফুল ফুটেছে আপেলগাছে, বোলতার বাসা মাটির ঘণ্টার মতো দুলছে হালকা বাতাসে। কারা যেন আরও কিছু সওদা নিয়ে হেলেদুলে ঢুকে গেল তাদের গহ্বরে, তাদের শিশুরা বাঁচবেই এই প্রত্যয়ে, তা হোক, জীবজগতের সব জীবই অপরের সন্তানকে শিকার করে নিজ বাছাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটায়।

একটা ভ্যান এই কানাগলিতে গজরাচ্ছিল, চলে গেল পরে। এমনিতেই আমাদের এই গলিটা সুনসান, মারীর প্রভাবে আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। মহাযুদ্ধের সময় আমার বাড়িটায় এক স্কুলশিক্ষিকা থাকতেন, সে আমি জানি, এ গলির সবচেয়ে বুড়ো লোকটা একদিন বলেছেন আমায়। ওর নাম টম। টমের কাছ থেকেই জেনেছি এসব গলিতে মহাযুদ্ধের সময় গলি বন্ধ করে মানুষ এসে মিলিত হতো মানুষের সঙ্গে, গান গাইত, জাদু দেখাত, ভ্যারাইটি শো হতো— কেননা মানবসঙ্গ ভুলিয়ে দিতে পারে সব মানবিক শোক, ভুলিয়ে দিতে পারে আসন্ন মৃত্যুকেও। কিন্তু মড়ক যুদ্ধের চেয়ে ভয়ানক, কেননা তা মানবসঙ্গবিরোধী, কেননা মড়ক খুব জোর গলায় সেই পাগলের মতো বলে ‘তফাত যাও, সব ঝুঁট হ্যাঁয়’। অবশ্য সঙ্গী ভাবলেই কত কিছু সঙ্গী, রেডিওর ক্রমাগত আওয়াজ, পিঁপড়েসারি আর মৌমাছির স্বর্গের দিকে পিঠ দেওয়া দুনিয়া, আপেলফুলে নুয়ে পড়া গাছটা, নালার দিকের ঝিম-ধরা নীল ব্লুবেল।

ঠাওর করে তাকালে দেখা যাবে কাচঘেরা বারান্দায় টম আর টমের বউয়ের অস্পষ্ট ছায়া, ভালোবাসার দুখানা অমর বিগ্রহের মতো পাশাপাশি বসে তাকিয়ে আছে রৌদ্রঢালা পৃথিবীর বিপুল বিথারের দিকে, এদিকে চোখ পড়লে ওখান থেকেই টম হেঁকে বলবে, ‘খবরের কাগজ নিয়ে এলাম ইস্টিশন থেকে, বৌকে বের হতে দিচ্ছি না!’ (এখানে অবশ্য ‘বউ’ ডাকে না, ডাকে ‘দ্য মিসেস/দ্য মিসাস’, ডেফিনিট আর্টিকল-সহ, বউ বলে কথা!) সিকামোরগাছে প্রায় অ্যামপ্লিফায়ারে বাজছে কাঠপায়রা আর ঘুঘুদের গান, ভালো করে কান পাতলে বোঝা যাবে ঠাট্টায় নাকাল হয়ে রাগে-ছদ্ম বিরক্তিতে আমরা ঠিক যেভাবে হুঁউউউ বলি তেমন শব্দ করে মৌমাছি উড়ে আসে। দুঃসময়েও যে কত নীল থাকে আকাশ—সে আমি কতবার দেখেছি, দুঃসময়েও কুলকুল করে হাসে আপেলফুল আর ছায়া-নীল ব্লুবেল। কেন যেন ভুলে গেছিলাম জগতের সব খেলা নিষ্ঠুর, সব চক্র অ্যাপাথেটিক, সেখানে এক বেলা খেলতে পাওয়াটাই কত না!

২৮/০৩/২০২০