পরাজয় মানে না মানুষ

করোনাকালের ফাঁকা ঢাকা ঘরবন্দী মানুষকে দিয়েছে পাখির ডাক ও নীরবতার আনন্দ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
করোনাকালের ফাঁকা ঢাকা ঘরবন্দী মানুষকে দিয়েছে পাখির ডাক ও নীরবতার আনন্দ। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘আমার দিন ফুরাল...’

একা হয়ে বেঁচে থাকতে পারব? তাহলে কেন বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে? কেন আমি পরিবার-সুহৃদবঞ্চিত হয়ে গৃহবন্দী থাকব? কেবলই কি তা মৃত্যু কিংবা মৃত্যুভয়ের কারণে? ভয় কি আমার সঙ্গে অন্যদের নিয়েও পাশা খেলছে? প্রশ্ন আছে, উত্তর নেই। তারপরও আশা, আকাঙ্ক্ষা, তারপরও স্বপ্ন—সর্ববিসর্জনের মধ্যে গৃহকেই জেনে নেওয়া একমাত্র বন্ধু।

হে আমার গৃহ, হে আমার প্রেমময় ঘর—বিছানা-বালিশ, চেয়ার-টেবিল, বই-খাতা, টেলিভিশন-ফোন—তোমরা জড় থেকে চৈতন্যে প্রবেশ করো। আমি আমার সর্বসত্তায় তোমাদের ধারণ করি—লালন করি—যাপন করি, অন্তত নির্দেশ অনুসারে দুই সপ্তাহ। দুই সপ্তাহ এমন কিছু নয়। কিন্তু ভয়, সে তো দিন–ঘণ্টা মানে না—মুহূর্তে মুহূর্তে চেপে ধরে, কাঁপিয়ে দেয় হৃৎপিণ্ড। ফুসফুসের শ্বাস—আশ হয়ে বাঁচার ইচ্ছায় বয়স নিয়ে লোফালুফি করে। ‘আমার দিন ফুরাল...’

না, দিন ফুরাবে না সূর্য ডোবার আগেই। জড় ও চৈতন্যের বিহারে সৌহার্দ্য দেবে নতুন ভরসা; সহনশীলতা দূর করবে সব ভগ্নদশা।

‘আত্মহত্যার রহস্যটি উন্মোচিত হইল না’

রাত ফুরালেই একাডেমির যে টান প্রতিদিন চুল থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত, তাতে বুঝি ঢিল লাগল। কোনো তাড়া নেই, উত্তেজনা নেই—গা ঢেলে দেওয়া বিছানাও বুঝি শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকে। বালিশ বলে, আরেকটু মাথা রাখো। তারপরও বেলা বাড়ে। নাশতার টেবিলে রুটি-সবজি-ডিম মুখ তুলে ফিক করে হেসে দেয়। ভরা চায়ের কাপে দুধের পিঁপড়া ঘুরতে ঘুরতে মনে করিয়ে দেয় ওষুধ-ইনসুলিনের সেবন-গ্রহণের কথা। তারপর কী? আজ সোমবার, গত বৃহস্পতিবার রাতে চলো পাল্টাই অনেকটা রাত নিয়েছে। আমাদের বদলানোর ফিরিস্তি দীর্ঘ হচ্ছে ক্রমশ। তার মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সঙ্গে বসবাসের বিষয়টি দিয়ে যাচ্ছে বড় একটি ঝাঁকুনি। দুপুরে পরিণীতা এমন প্রশ্ন সম্মুখে নিয়ে এল—যাতে করে উত্তর খুঁজতে হলো দুপুরের আহার ফাঁকে ফেলে। ছবিটিতে ‘বাবাই দা’ নামক চরিত্রটি হুট করে আত্মহত্যা করে বসল। কেন? ইনিয়ে-বিনিয়ে শেষাংশে কারণ হিসেবে যা দেখা গেল—তাতে মনে হলো, বাংলা ছায়াছবি কোথায় যেন তার মাথাটি বন্ধক দিয়ে রেখেছে! ধ্যাৎ, বেশ কিছু কাজ করব বলে সকাল থেকে পরিকল্পনা ছিল, সব গুলিয়ে গেল। তা যেমন হোক, আত্মহত্যা মাথা থেকে নামছে না। এই যে ১০ দিনের ছুটিতে ঢাকা শহর উজাড় করে মানুষজন গ্রামে ছুটল—তা-ও তো অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দেবার শামিল। অপ্রতুল যানবাহনে গাদাগাদি গমন; ঘাম ঝরিয়ে, ট্যাঁক শূন্য করে আত্মীয়-পরিজনদের কাছে ফেরা তো ‘করোনাকালে’ আত্মহত্যারই নামান্তর। এক থেকে বহু, বহু থেকে বহুতর প্রশ্ন—দুনিয়াজোড়া ভাইরাসের হুংকারে কম্পিত। সন্ধ্যা নামছে। শান্ত নগরের অচেনা পথে কি বসন্তের হাওয়া শিস দেয়?

‘তবু আশা, তবু স্বপ্ন আগামীর মোহনায়’

আলস্যের এ সূত্র এ বয়সে এসে বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কালে ঘরে শুয়ে-বসে থাকা মহাগ্লানির। তবু নিজের কথা ভেবে, পরিজনের কথা ভেবে—সর্বোপরি সবার কথা ভেবে সময়কে কেবল সহানুভূতিতেই পরিণত করতে পারছি। আর না বললে অন্যায় হবে, সংস্পর্শহীন দিনগুলোয় কিছু না কিছু তো নতুন পাঠ হচ্ছেই; হচ্ছে সামান্য লেখালেখি। শিশু-কিশোর উপযোগী একটি নতুন জীবনীগ্রন্থ প্রণয়নে হাত দিয়েছিলাম—ভাবছি চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে ফেলতে পারব। কটি কবিতা যেন ঘোরে ঘোরেই লিখে ফেললাম। সামনের দিনগুলোয় সবার সঙ্গে যোগাযোগ হবে ফোনে, ফেসবুকে। আর বড় কথা, বাস্তবতার নিরিখে এবং আমাদের সামর্থ্যর কথা বিবেচনা করেই আশায় বুক বাঁধব—মানুষের জয় হবেই।

‘পরাজয় মানে না মানুষ

প্রকৃতির গুপ্তক্রীড়া নির্ধারিত তল

মৃত্যু তার সাময়িক ছল

জন্মের প্রভাবে শুদ্ধ গুণমুগ্ধ ফল।’