আলথুসার: আলো-অন্ধকারের বাস্তব পৃথিবী

মাসরুর আরেফিনের সাহিত্য পাঠ মানে তা থেকে দর্শন জানা যাবে। দেশ-দুনিয়ার রাজনীতির নানা পাঠ থাকবে। আর অবশ্যই থাকবে বিশ্বসাহিত্য। কোনো লেখা লেখার আগে লেখক নিজে যে দীর্ঘ সময় পাঠে ডুবে থাকেন, জীবন থেকে নানা কিছু আহরণ করেন, তা তাঁর লেখা পড়ে বোঝা যায়। সম্প্রতি প্রকাশিত মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস ‘আলথুসার’ প্রসঙ্গে এখানে দু-চার কথা বলব। এ লেখাকে বই আলোচনা না বলে পাঠ-প্রতিক্রিয়া বলাই হয়তো সঙ্গত হবে।

গোটা উপন্যাসে লেখকের যে জীবন আমাদের চোখে পড়ে, তা কখনো ঢাকার, কখনো বরিশালের, আবার কখনো-বা লন্ডনের। লেখকের অভিজ্ঞতা থেকেই চরিত্ররা চিত্রিত হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত বলি, মাসরুরের প্রথম উপন্যাস ‘আগস্ট আবছায়া’, এবার এল দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আলথুসার’। বিষয়ের দিক দিয়ে দুটি উপন্যাস পৃথিবীর দুই মেরুতে আলো ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের গন্তব্য একই দিকে ধাবিত হতে চায়, মানুষের অস্থিরতা থেকে স্থিরতার গলি-ঘুপচি খোঁজার চেষ্টা। আর তাই বুঝি ‘আলথুসার’ নিয়ে মাসরুর আরেফিন নিজেই বলছেন, ‘ওটা লিখতে গিয়েই বুঝলাম, পৃথিবী বদলানোর স্বপ্নবিষয়ক লেখালেখির, নৈতিক অবস্থানবিহীন আজব লেখালেখির, আমার মাত্র শুরু হলো, শেষ নয়।’

‘আলথুসার’ অবশ্যই আমরা একটি কাহিনি হিসেবে পড়ব। কিন্তু এর উৎস বাস্তবের এক জমিন। তাই এটা পাঠের আগেভাগে প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার সম্পর্কে জানা থাকলে পাঠকের সুবিধা হবে। বিংশ শতকের অন্যতম একজন মার্কসবাদী চিন্তক লুই আলথুসার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাঁর জীবনে এক বিভীষিকা নিয়ে হাজির হয়েছিল। কারণ, হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তিনি বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন কিছুকাল। সেখানেই তিনি মার্কসবাদীদের সান্নিধ্যে আসেন। তাঁর জীবন পায় নতুন এক পথ। তবে পার্টির ইচ্ছার কাছে নিজেকে সমর্পিত করেননি আলথুসার। তাই তাঁর সব চিন্তা দলের চিন্তার সঙ্গে মেলানো যায় না। ফলে আলথুসারের মার্কসীয় তত্ত্ব অনেক বিতর্কও তৈরি করে সময়ে সময়ে। কারণ তিনি দলে থেকেও চিন্তা করেছেন নিজের মতো করে। নিজের মতো করেই লিখেছেন।

জার্মান ক্যাম্পের বন্দিত্ব ও নিপীড়ন আলথুসারের জীবনে বামপন্থাই শুধু নিয়ে আসেনি, একই সঙ্গে এটা তাঁর মানসিক রোগের কারণ হিসেবেও দেখা দেয়। এই মানসিক পীড়ন থেকেই সম্ভবত ১৯৮০ সালে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেন তিনি। তারপর আলথুসারের ঠাঁই হয় মানসিক হাসপাতালে। ১৯৯০ সালের ২২ অক্টোবর ৭২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। একজন দার্শনিকের মানসিক স্বাস্থ্যের সংকট, আর স্ত্রীকে হত্যা—‘আলথুসার’ উপন্যাস এগিয়েছে এ কাহিনির ওপর ভর দিয়ে।

এখানে সমস্ত পৃথিবীর বিশাল এক ক্যানভাসই উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসিক। তাই চিত্রায়িত হয়েছে আন্দোলনে উন্মাতাল লন্ডন, পরিবেশবাদীদের কর্মযজ্ঞ, ব্রেক্সিটের রাজনীতিসহ আরও অনেক কিছু। তবে বাংলার সবুজ প্রকৃতি, নদীমাতৃক দেশের শ্যামলিমাও কিন্তু হাজির থেকেছে অন্য আবেদনে। যেখানে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়ি নদীর অতীত নাব্য আর বর্তমান মৃতবৎ পরিস্থিতির মধ্যে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার চিত্রটি চলে এসেছে। তাই মাসরুরের বৈশ্বিক ক্যানভাসে বাংলাদেশ আসে অন্য রকম ভালোবাসার তুলিতে। বিশ্ব-রাজনীতির দার্শনিক ভাষণ তুলতে গিয়ে লেখক ভুলতে পারেন না বাংলার সামান্য এক গণ্ডগ্রামও। বুঝে নিতে পারি আলথুসার থেকে:

‘আমরা ঠিক করলাম যে যাই দেখে আসি আমানতগঞ্জের বিলটাকে, মানে আমি বিলটা দেখাই ওদের, যেখানে একদিন বিলে মাছ ধরতে গিয়ে দেখি এক হিলহিলে ঢোঁড়া সাপ কী সুন্দর এঁকেবেঁকে, একদম আমার গায়ের পাশ দিয়ে, চলে যাচ্ছিল মূল নদীর দিকে। আমরা পৌঁছে গেলাম সেখানে, প্রচুর রিকশার টিং টিং পেরিয়ে, আর যেতে যেতেই আমি শুনে নিলাম যে কবি আর নেই, কবি চলে গেছেন কলকাতায়।’

কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন একজন কবিও বটে। তাই তার গদ্যের গাঁথুনিতে একধরনের চোরা কাব্যময়তা থাকে, যা পাঠককে এগিয়ে নিয়ে চলে বাক্যের পর বাক্যে আলাদা এক আকর্ষণে। এখানে এসে অন্য রকম সার্থকতা অবশ্যই পেয়েছে ‘আলথুসার’। উপন্যাসটি বহুল পঠিত হবে, পাঠকে ভাবাবে, এই আশাবাদ রেখে এখানে শেষ করি। 

>

আলথুসার
মাসরুর আরেফিন

প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০
৩৪৪ পৃষ্ঠা
দাম: ৬৫০ টাকা।