হাইকু

কয়েক শ বছর ধরে জাপানের কবিরা হক্কু বা হাইকু মখশ করে আসছেন। মূলে এই পাঁচ পঙিক্তর কবিতা টানকার প্রথম অংশ ছিল। অনেক সময় দুজনে লিখতেন, একজন তিন লাইন, অন্যজন দুই লাইন। কালক্রমে হাইকুর বিকাশ ঘটে স্বয়ংসম্পূর্ণ রীতি হিসেবে।হাইকুতে সতেরোটি সিলেবল থাকে। প্রথম ও তৃতীয় লাইনে পাঁচটি এবং দ্বিতীয় লাইনে সাতটি। মওশুম বা মওসুম-সংক্রান্ত কুজোকো-শব্দ, যার থেকে মওশুমের ঠিকানা আন্দাজ করা যায়। দু-একটা কথা থেকে পাঠক বা শ্রোতা আবহাওয়া, গাছগাছড়া বা পোকামাকড়ের ইঙ্গিত পায়। হাইকু সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জাপান যাত্রী তে বলেন,‘এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়।’সবচেয়ে নামকরা হাইকু কবি বাশো (১৬৪৪-১৬৯৪) জেন বৌদ্ধধর্মের অনুসারী ছিলেন। এরপর দুজন নামকরা কবি হচ্ছেন বুসন (১৭১৫-১৭৮৩) ও ইসা (১৭৬৩-১৮২৭)। হাইকু অনুবাদ করা কঠিন। এর মধ্যে উদ্ধৃতি, উপমায় দ্ব্যর্থবোধক ভাব রয়েছে। এ ছাড়া বহু সিলেবল-বিশিষ্ট জাপানি ভাষা থেকে অনুবাদ করাও বেশ কঠিন। হাইকু অনেক সময় সমগ্র কোনো ভাব বা সম্পূর্ণ কোনো বক্তব্যের নিদর্শন নয়। পাঠক তাঁর চিন্তা, কল্পনা ও কামনা-বাসনার রঙে রং মিশিয়ে হাইকু পড়বেন স্বাধীন নির্ভার মন নিয়ে। হাইকু বিশেষ মৌসুম, মৌসুমের ফুল, পোকামাকড় ও আরও-ছায়ার প্রতিনিধি। প্রায় প্রতিটি হাইকুতে প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্নভাবে মৌসুমের ইঙ্গিত রয়েছে। শুধু এক অনুভূতির প্রকাশ বা প্রকৃতির প্রতিকৃতি নয় হাইকুর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী বিষয়ের সমন্বয় দেখা যায়। হাইকুর বিষয় বিবিধ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, বৃষ্টি, কুয়াশা, শিশির, শীত, বসন্ত, ফুজি, গাছ, ফুল, ক্রিসেনথেমাম, পোকামাকড়, জোনাকি, ঝিঁঝি পোকা, শুঁয়াপোকা, পৃথিবীর জীবনবুদ্ধ, ধর্ম, শাস্ত্র, মৃত্যু, সমাধি ইত্যাদি ইত্যাদি।আমি জাপানি ভাষা জানি না। আমি টাকাশি ইকোমোটো, শোয়াকু শিগেমাৎসু রবার্ট ব্লাই, ডোনাল্ড কিন, লুসিয়েন স্ট্রাইক, স্যাম হামিল, টোনি বার্নসেস্টান, প্রমুখ এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলা করেছি।এখানে ঋতুভিত্তিক কয়েকটি হাইকুর বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলো।গ্রীষ্মের ঘাম ওইসব অবশেষে মহাসেনাপতিদের সাম্রাজ্যিক স্বপ্নের —বাশোএক ছোট্ট গ্রীষ্মের রাত কিন্তু এই ভাবগম্ভীর অন্ধকারেএকটা পিওনি ফুল ফুটল —ওয়েমারুচকমকে পাখার ফেরিওয়াল বইছে তার বাতাসের বস্তা শ্বাসরোধকারী গরম —বাশোপুকুরের আয়নায় আকাশের তারারা হঠাৎ গ্রীষ্মের বৃষ্টি জলে টল ফেলে —সেসসিও খুশনবিশ ফকির উজ্জ্বল আকাশ ও ঠান্ডা পৃথিবীতোমার গ্রীষ্মের পোশাক —বুসনমোগামি নদী এই গরম দিকটাকে টেনে নিয়ে গেল সমুদ্রে —বাশোদীর্ঘ গ্রীষ্মের দিন অলস পদচিহ্নে আঁকে সমুদ্রের বালি —বুসন বাঁশের মাথাল, খড়ের জামা বাশো’র সারাৎসার পড়ন্ত শীতের বৃষ্টি —বুসনদমকা শীতের বৃষ্টিআমার বোকা বড় ছাতাটাপেছন দিকে হাঁটতে চায় —শিকিপুরোহিতের দারিদ্র্য— দীর্ঘ এক শীতের রাতে কাঠের এক বুদ্ধ খোদাই করেএই শরতের শেষেআমার পুরোনো ময়লার ঢিপিতেফুটেছে নীল মহাশ্বেতা। —ইসাপরিষ্কার নুড়িগুলো চকচক করে আর পরিষ্কার ছয়টি নিশ্চুপ মাছগভীর শরতের জল —ওয়েমারতুমি মুখ ফেরাওআর হঠাৎ শরতের গোলাপি আকাশশুভ্র ফুজিয়ামি —বুসনবিকেলের বৃষ্টি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথাছাতা আর বর্ষাতি —ইয়ায়ুশোনা যায়, দেখা যায় না নিচু হলে ক্যামেলিয়া বৃষ্টির জল ঢালে —বাশোকলাগাছ বাতাসের তাড়া খেয়ে বালতিতে বৃষ্টির জল ঢালে —বাশোবসন্তকে মিলিয়ে যেতেই হবে? সব পাখি কাঁদে আর মাছেদেরঠান্ডা পাণ্ডুচোখে অশ্রু ঝরে। —বাশোখেয়া ছেড়ে গেছে দেরি করে আসা লোকটা দাঁড়িয়ে শীতের প্রথম বৃষ্টিতে বিদ্যুতের ঝলকানি—জলপড়ার শব্দ বাঁশের মধ্য দিয়ে সন্ধ্যার মেঘগর্জন অসহায় চড়ুইরা আঁকড়ে থাকে কাঁপুনে ঝোপে মিষ্টি বসন্তের বর্ষণভাষায় বলা যায় না সবই যে কী বিষণ্ন দূরে নিচে কুয়াশায়থেকে থেকেহ্রদ তুষারশুভ্র পাল তোলে —বাশোশরত আসছে মন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে চার তাতামে চাটাইয়ের ঘর —বাশো