লাল মৃত্যুর মুখোশ

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

ভূমিকা

মার্কিন কথাসাহিত্যিক এডগার অ্যালান পো করোনা মহামারি দেখেননি বটে, কিন্তু জীবদ্দশায় এই বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিককেও মহামারির মুখোমুখি হতে হয়েছিল; এবং ওই মহামারিটির নাম ছিল প্লেগ। ১৮৩৬ সালে ভারতের রাজস্থানে প্রথম প্লেগ শুরু হয়। এরপর এটি ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে, বিভিন্ন মহাদেশে। এই প্লেগকে উপজীব্য করে অ্যালান পো লেখেন তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘লাল মৃত্যুর মুখোশ’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪২ সালের মে মাসে, ‘গ্রাহামস’ পত্রিকায়। এ গল্প নিয়ে ১৯৬৪ সালে সিনেমাও বানানো হয়েছে। বলা ভালো, উনিশ শতকের ওই মহামারির সময়ে প্লেগকে অনেকেই ‘লাল মৃত্যু’ নামে ডাকত। তখন প্লেগ মানেই ছিল হাজারো লোকের মৃত্যু। এখানেও সেই লাল মৃত্যু নামের প্লেগ মহামারিকে আঁকা হয়েছে রূপকথার ঢঙে। গল্পটি নেওয়া হয়েছে এডগার অ্যালেন পোর ‘কমপ্লিট টেলস অ্যান্ড পোয়েম’ বইটি থেকে। গল্পটি অনুবাদ করেছেন হুমায়ূন শফিক

লাল মৃত্যুর মুখোশ
দেশজুড়ে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে লাল মৃত্যু। এ রকম কদর্য ও মারাত্মক মহামারি কখনো দেখা যায়নি। রক্তই এই রোগের প্রধান লক্ষণ। রক্তের লাল রং আর বীভৎসতাই যেন লাল মৃত্যুর আত্মপরিচয়। রক্তই এই অবতারের পার্থিব রূপ। হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা, চোখে ঝাপসা দেখা, লোমকূপ দিয়ে অঝোর ধারায় রক্তক্ষরণ। সারা গায়ে, বিশেষত মুখভর্তি টকটকে লাল ক্ষতচিহ্নের দরুন রোগীর ধারে-কাছে কেউ এগোয় না—সেবা করা তো দূরের কথা! এই রোগে আক্রান্ত যেকোনো রোগী আধঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়।

তবে প্রিন্স প্রসপারো কিন্তু দারুণ সাহসী ও ভীষণ সুখী মানুষ। তাঁর রাজত্বে যখন লাল মৃত্যু জনপদের পর জনপদ জনশূন্য করে দিল, তখন তিনি হাজারখানেক সুস্থ বন্ধুবান্ধবকে বেছে নিলেন। সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নিলেন কেল্লার মতো সুরক্ষিত একটি মাঠে। জায়গাটা চমৎকার আর জমকালো। আয়তনেও বিশাল। সাজসজ্জার দিক দিয়ে প্রসপারো বরাবরই সুরুচিপূর্ণ। প্রিন্স বাতিকগ্রস্ত হলেও রুচিবান পুরুষ। সম্পূর্ণ মাঠটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পাঁচিলের গায়ে লোহার ফটক। আগুনের চুল্লি আর হাতুড়ি সঙ্গে এনেছিল পারিষদবর্গ। ভেতরে ঢুকে ঝালাই করে এঁটে দিল ছিটকিনিগুলো। হঠাৎ মন খারাপ হলে, বাইরে যাওয়ার জন্যে খেপে উঠলে, কোনো রকমেই যাতে বেরোনো না যায়, তাই এ ব্যবস্থা। খাবারদাবারের অভাব নেই মাঠে। সুতরাং লাল মৃত্যুকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই! বাইরের দুনিয়ার যা খুশি হোক, দুঃখে ভেঙে পড়াও মূর্খতা। প্রিন্স আমোদ-প্রমোদের ঢালাও ব্যবস্থা রেখেছেন মাঠের মধ্যেই। আছে ভাঁড়, স্বভাব কবি, নর্তকী, গায়ক,বাদক, সুন্দরী নারী আর পানীয়। সেই সঙ্গে নিরাপত্তা। এখন বাইরে থাকুক লাল মৃত্যু।

মাস পাঁচ-ছয় পর অসাধারণ এক মুখোশ নাচের আয়োজন করলেন প্রিন্স। সুরক্ষিত নিরাপত্তার ভেতরেই। বাইরে তখন লাল মৃত্যুর অখণ্ড রাজত্ব।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ভয়াল দর্শন এক আগন্তুক
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ভয়াল দর্শন এক আগন্তুক

মুখোশ নৃত্য শুধু ইন্দ্রিয় সম্ভোগের জন্যই। জাঁকজমকপূর্ণ বিলাসবহুল এ নাচের আসরে ভোগ করা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না। কিন্তু তার আগে যে ঘরগুলোয় নাচের ব্যবস্থা হয়েছিল, তার বর্ণনা দেওয়া যাক। মোট সাতটি রাজকীয় বিশাল বিশাল ঘরে মুখোশ নাচ হয়। অনেক রাজপ্রাসাদে এই সাতখানা ঘর পরপর সাজানো থাকে এবং মাঝের প্রকাণ্ড দরজাগুলো ভাঁজ করে দুপাশের দেয়ালের সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয় যে সাতখানা ঘরের উৎসব-দৃশ্য একসঙ্গে দেখা যায়। প্রিন্স গতানুগতিকতা ভালোবাসতেন না, একটু উদ্ভট, একটু সৃষ্টিছাড়া আয়োজন না হলে তাঁর মন ভরত না। তাই মুখোশ নাচের সাতখানা ঘর এখানে এমনভাবে নির্মিত, যাতে একবারে একখানা ঘরের দৃশ্যই দেখা যায়, এর বেশি নয়। বিশ-ত্রিশ গজ অন্তর অন্তর আচমকা বাঁক নিয়েছে ঘরগুলো এবং প্রতি বাঁকে রয়ছে নানা রকম অদ্ভুত চমকের ব্যবস্থা। ডান-বামের দেয়ালের ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা সরু গথিক জানালা। জানালার বাইরে বারান্দা—সাতখানা ঘরকে বেষ্টন করে রেখেছে এটি। জানালার কাচ আঁটা—পাল্লা বন্ধ। একেকটি জানালার একেক রকম রং। ঘরের মধ্যে যে রঙের সাজসজ্জা, জানালার কাচের রং-ও তাই। যেমন পুব প্রান্তের ঘরটি নীল সজ্জায় সজ্জিত। জানালার রং-ও গাঢ় নীল। দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠের অলংকরণ ও দেয়াল-ঢাকা পর্দার রং নীলাভ। লাল-জানালা দুটোর রং-ও তাই। এইভাবে তৃতীয় ঘরের জানালা সুবজ রঙের, চতুর্থটির আসবাব হালকা কমলা রঙের, পঞ্চমটিতে সাদা, ষষ্ঠ ঘরে বেগুনি। সপ্তম ঘরটির কড়িকাঠ থেকে মেঝে পর্যন্ত ঝুলছে কালো মখমল—দেয়াল ঢাকা পর্দা—কালো গালিচার ওপর লুটাচ্ছে এই ভেলভেট পর্দা। কিন্তু এ ঘরের জানালার রঙের সঙ্গে ঘরের রঙের মিল নেই। এ ঘরের দুই জানালার কাচ দুটি টকটকে রক্তলাল।

সাতখানা ঘরের কোনোটাতেই ঝাড়বাতি রাখা হয়নি। সারি সারি দীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করা হয়নি কড়িকাঠ, মেঝে আর দেয়ালজোড়া বিস্তর স্বর্ণখচিত বিলাসসামগ্রীকে। রঙিন কাচের মধ্য দিয়ে জানালার বাইরে থেকেই আলো আসছে। জানালার ঠিক বাইরে বারান্দার ওপর দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। তিন পায়ার ওপর রাখা কাঁসার পাত্র জ্বলন্ত অঙ্গারে পরিপূর্ণ। আগুনের আভা রঙিন কাচের মধ্যে দিয়ে সেই রংটিকেই ছড়িয়ে দিচ্ছে ঘরের মধ্যে। ফলে একেকটি ঘরে সৃষ্টি হয়েছে একেক রকমের কাল্পনিক, উদ্ভট ও রোমাঞ্চকর পরিবেশ। পশ্চিম প্রান্তে কালো ঘরটির মধ্যে রক্তলোহিত জানালার রং এসে এমন এক নারকীয় পরিবেশ জাগিয়ে তুলেছে, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। রক্তলাল সেই আলোকরশ্মি যার মুখে পড়ছে, তাকেই মনে হচ্ছে মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। লোমহর্ষক এই দৃশ্য দেখে বুক কেঁপে ওঠে না—এমন কেউ নেই। তাই এ ঘরে সচরাচর কেউ পা দিতে চায় না।

এক মৃত্যু দূত
এক মৃত্যু দূত

এই ঘরেরই পশ্চিম দেয়ালে বসানো আছে আবলুস কাঠের তৈরি একটি বিশাল ঘড়ি। একঘেয়ে ধাতব শব্দে পেণ্ডুলাম দুলছে তো দুলছেই, মিনিটের কাঁটা এক চক্কর ঘুরে এলেই শোনা যায় এক ঘণ্টা সম্পূর্ণ হওয়ার বাজনা। গান গেয়ে ওঠে যেন ধাতুর ফুসফুসে ভারি মিষ্টি সুরে। গভীর স্পষ্ট ও উচ্চগ্রামের সেই বাজনা এত মধুর যে অর্কেস্ট্রা স্তব্ধ হয়ে যায় ক্ষণিকের জন্য। উৎকর্ণ হয়ে থাকে বাজনাওয়ালারা। শুধু ঘড়ির বাজনা শোনার জন্য। বাজনা যখন শুরু হয়, তখন যেন ছন্দ কেটে যায় সাতখানা ঘরের আমোদ-প্রমোদের—কারও মাথা ঘোরে, বয়োজ্যেষ্ঠরা কপাল টিপে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। প্রতিধ্বনির রেশ পুরোপুরি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই কিন্তু চাপা হাসি ছড়িয়ে পড়ে সাতখানা ঘরে, বাজনাওয়ালারা বিমূঢ় হাসে, ফিসফিস করে কথা বলে। ভাবে, কী বোকামিই না হয়েছে, পরের বার আর হবে না। কিন্তু ষাট মিনিট মানে, তিন হাজার ছয় শ সেকেন্ড ঘুরে আসার পর মিনিটের কাঁটা যখন ঘণ্টার বাজনা বাজায়, আবার দেখা যায় ঘরজোড়া সেই বিহ্বলতা, ছন্দ-পতন, রোমাঞ্চ ও অন্যমনস্কতা।

এই সব সত্ত্বেও কিন্তু নাচের আসরে ফূর্তির অভাব ঘটে না। প্রিন্সের রুচি ভিন্ন ও অদ্ভুত। বর্ণচ্ছটার তারতম্যেও সূক্ষ্ম দৃষ্টি ছিল তার। তাই মামুলি অলংকরণ দুচোখে দেখতে পারতেন না। তাঁর পরিকল্পনা একদম ঠিকঠাক এবং কিছুটা পাগলাটেও বটে—তার ধ্যানধারণায়ও রয়েছে আদিম জ্যোতি, কেউ কেউ তাকে এই কারণেই বলে উন্মাদ। তবে তার ভক্তরা তা বলে না। প্রিন্সের কথা শুনলে, তার দর্শন পেলে, স্পর্শলাভ ঘটলে মনেই হবে না তিনি আদৌ উন্মাদ।

বোঝাই যাচ্ছে সে কারণেই ঘরসজ্জা অত উদ্ভট, কিম্ভূতকিমাকার! সব মিলিয়ে কিন্তু একটা ভয়ানক রূপকথার দেশ। ঐশ্বর্য, আভরণ, জাঁকজমকের ঘাটতি নেই, কিন্তু সবই বিদঘুটে। আরব্য মূর্তিগুলোর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেমানান। আসবাবপত্রের পরিকল্পনায় ক্ষিপ্ত মস্তিস্কের দূরন্ত কল্পনার ছাপ। যেন প্রলাপের ঘোরে সৃষ্টি করেছে অপ্রকৃতিস্থ কোনো শিল্পী। সুন্দর, অথচ ভয়ংকর। সৃষ্টিছাড়া, কিন্তু ন্যক্কারজনক নয়, দেখলে মুখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না। সাতখানা ঘরে ছড়ানো এ ধরনের অজস্র স্বপ্ন। অর্কেস্ট্রায় প্রণয়বাজনা বাজলেই এই স্বপ্নগুলো যেন নেচে ওঠে, জানালার মধ্য দিয়ে ফিল্টার হয়ে আসা বিশেষ রং শুষে নিয়ে জীবন্ত হয় এবং অস্বাভাবিক ছায়ামায়ার মধ্যে কচ্ছপগতিতে সঞ্চারমান হয়। সবই অবশ্য দৃষ্টিবিভ্রম, কিন্তু মনে হয় সব সত্যি সত্যি। ঘণ্টা শেষে বাজে ভেলভেট কক্ষের বিশালাকৃতির ঘড়ি। সাতখানা ঘরে নেমে আসে শ্বাসরোধী নৈঃশব্দ্য। ঘড়ির শব্দে সবাই নীরব হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতিধ্বনির ঢেউ মিলিয়ে যেতে না-যেতেই চাপা হাসির ঢেউ আছড়ে পড়ে সাতখানা ঘরে। আবার উদ্দাম হয় ঐকতান সংগীত। জাগ্রত হয় স্বপ্নগুলো, কাঁসার পাত্রস্থিত অগ্নি-আলোকের রং শুষে নিয়ে নেচে-দুলে ঘুরতে থাকে যেন ঘরময়। পশ্চিম প্রান্তের মখমল-ঘরে কেউ কিন্তু ভুলেও আসে না। সেখানকার কালো ভেলভেটের পটভূমিকায় রক্তলাল রশ্মি রক্ত হিম করে দেয়, অত কাছ থেকে আবলুস ঘড়ির টিকটিক হাতুড়ির মতো আছড়ে পড়ে কানের পর্দায়।

প্রিন্স ছুটে গেল ছুরি হাতে তাকে আক্রমণ করতে
প্রিন্স ছুটে গেল ছুরি হাতে তাকে আক্রমণ করতে

অন্য ঘরগুলোতে কিন্তু পা রাখার জায়গা নেই। প্রাণস্পন্দনে উত্তাল হয়েছে বাকি ছটি ঘরে। ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরে ঘুরে নাচ চলছে তো চলছেই। হাসি, ফূর্তি, আনন্দ, উচ্ছ্বাস তুফান-ঝড় সৃষ্টি করেছে ছখানা ঘরে। এমন সময়ে শুরু হলো মধ্যরাতের বাজনা। বিশালাকৃতির ঘড়ির বুকের পিঞ্জর থেকে ভেসে এল সুরেলা সংগীত—তীক্ষ্ণ,তীব্র অথচ মধুর। সবাই নীরব। সবাই উৎকর্ণ ঘণ্টাধ্বনির জন্য! পরপর বারোবার বাজল দানব আকৃতির ঘণ্টা। সাতখানা ঘর থেকে শেষ ঘণ্টার গমগমে রেশ তখনো মিলিয়ে যায়নি। এমন সময়ে হাজার মানুষের খেয়াল হলো মুখোশ পরা এক আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটেছে নাচের আসরে। অথচ একটু আগেও তাকে দেখা যায়নি। গুঞ্জন ছড়িয়ে গেল ঘরে ঘরে। গুজব, গুঞ্জন বিস্ময়াভিভূত করল হাজার মানুষকে। সবশেষে তাদের ওপর ভর করল আতঙ্ক, বিভীষিকা। ঘৃণার বিষে কুঁকড়ে গেল হাজারটি হৃদয়। কাল্পনিক ঘরগুলোর অপচ্ছায়াময় এই যে ছবি আমি আঁকলাম, সেই পরিবেশে সাধারণ মানুষের আবির্ভাব এতখানি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারত না। অলীক, উদ্ভট, অবাস্তব রূপকথার রাজত্বে নিশ্চয় এমন কোনো আগন্তুকের আবির্ভাব ঘটেছিল, যা এই কাল্পনিক পরিবেশকেও ম্লান করে দিয়েছে। কিন্তু মুখোশ নৃত্যের অনুমতি তো সবাইকে দেওয়া হয় না। আগন্তুক কিন্তু অনুমতির ধার ধারেনি। প্রিন্সের অসীম সৌজন্য উপেক্ষা করে আবির্ভূত হয়েছে নাচের আসরে।

আগন্তুকের শরীর দীর্ঘকায় ও বলিষ্ঠ। আপাদমস্তক কফিনসাজে আবৃত। মুখোশটি হুবহু মড়ার মুখের মতো। আড়ষ্ট মুখচ্ছবি খুটিয়ে দেখলেও মুখোশ বলে মনে হয় না, এত নিখুঁত মুখোশ। গা ঘিনঘিনে চেহারাও মেনে নেওয়া যেত, কিন্তু অস্ফুট গুঞ্জন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল অন্য কারণে। অদ্ভুত এই মূর্তিটি আসলে লাল মৃত্যু। সারা গায়ে কাঁচা রক্তের দাগ। মুখে বীভৎস ক্ষত।

বাজনাওয়ালাদের মাঝে ধীর পদক্ষেপে হাঁটছিল এই প্রেতচ্ছায়া। দেখেই শিউরে উঠলেন প্রিন্স। পরমুহূর্তে মুখ আরক্ত হল প্রচণ্ড ক্রোধে।

হুংকার দিয়ে বললেন তিনি পারিষদদের, ‘এত সাহস কার? কার আমাকে অপমান করার এত স্পর্ধা? ঘাড় ধরে টেনে আনুন, টান মেরে খুলে দিন মুখোশ, কাল সূর্য উঠলেই ফাঁসি দেব ওর!’

নীল ঘরে দাঁড়িয়ে গর্জে উঠলেন প্রিন্স। তাঁর হাতের ইশারায় অর্কেস্ট্রা স্তব্ধ হয়েছিল আগেই। তাই সাতখানা ঘরে গমগম করে উঠল তাঁর বজ্রগকণ্ঠের হুংকার।

মেঝেতে আসছে পড়ল প্রিন্সের মাথা। কেল্লার ঘরগুলো রক্তে রঞ্জিত করে জয় নিশ্চিত করল লাল মৃত্যু
মেঝেতে আসছে পড়ল প্রিন্সের মাথা। কেল্লার ঘরগুলো রক্তে রঞ্জিত করে জয় নিশ্চিত করল লাল মৃত্যু

ফ্যাকাসে মুখে পারিষদরা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল তাকে—অদূরে আগন্তুক। হুংকার শুনেই কেউ কেউ এগোলো সেই দিকে, কিন্তু আচমকা দীর্ঘ পদক্ষেপে প্রিন্সের দিকে এগিয়ে এল প্রেতমূর্তি। সভয়ে সরে গেল সবাই, পথ ছেড়ে দিল মূর্তিমান আতঙ্ককে। কারও সাহস বা প্রবৃত্তি হলো না রক্তসহ সেই দেহকে স্পর্শ করতে। বিনা বাধায় তাই সেই মূর্তিমান আতঙ্কিত প্রিন্সের এক গজ দূর দিয়ে হেঁটে গেল নীলাভ লাল ঘরের দিকে। অদৃশ্য হাতের ধাক্কায় ঘরশুদ্ধ লোক পিছু হটতে হটতে ঘেঁষে রইল দেয়ালের সঙ্গে। আগন্তুক বাধা পেল না কোথাও, তাড়াহুড়োও করল না। মেপে মেপে পা ফেলে ধীরে-সুস্থে নীলাভ লাল কক্ষের মধ্যে দিয়ে পৌঁছাল সবুজ ঘরে। সেখান থেকে কমলা ঘরে। তারপর সাদা ঘরে। এরপর বেগুনি প্রকোষ্ঠে, কিন্তু তার পথ রোধ করল না কেউই।

বেগুনি ঘরে পৌঁছাতেই সাময়িক কাপুরুষতা কাটিয়ে উঠে রুদ্ধশ্বাসে ধেয়ে গেলেন প্রিন্স। কোষ থেকে টেনে নিলেন শাণিত ছুরি। কিন্তু তখনো কারও সাহস হলো না তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার। আতঙ্কে নীল হয়ে ঘেঁষে রইল দেয়ালের গায়ে। আগন্তুক তখন ভেলভেট কক্ষের প্রান্তে পৌঁছেছে। ছুটতে ছুটতে খোলা ছুরি হাতে তার তিন চার ফুট দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রিন্স।

ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়াল আগন্তুক। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলেন প্রিন্স। ছুরি ছিটকে গেল কার্পেটে, নিষ্প্রাণ দেহটা সটান আছড়ে পড়ল আগন্তুকের পায়ের কাছে।

সম্বিত ফিরে পেল কক্ষের সব লোক। বিষম ক্রোধে ধেয়ে এল কালো ঘর। আবলুস ঘড়ির গা ঘেঁষে নিথর দেহে দাঁড়িয়ে ছিল আগন্তুকের দীর্ঘ মূর্তি—রাগে চেঁচাতে চেঁচাতে টান মেরে খসিয়ে আনা হলো মড়ার মুখের মুখোশ আর কফিন সাজের পোশাক। রক্ত জল হয়ে গেল পরক্ষণেই—কফিন সাজের অন্তরালে শুধু শূন্যতা—শরীর নেই।

এইভাবে এল লাল মৃত্যু—এল রাতের আঁধারে চোরের মতন নিঃশব্দে। একে একে সব লোক আছড়ে পড়ল রঞ্জিত দেহে, আর নড়ল না। স্তব্ধ হলো আবলুস ঘড়ি। নিভে গেল সমস্ত অগ্নিশিখা। অন্ধকার, অবক্ষয় আর লাল মৃত্যুর নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো এই ভূখণ্ডে।

[ব্যবহৃত চিত্রকর্ম বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত মাসিক অফ রেড বের গল্প থেকে নেওয়া। শিল্পীর পরিচয় অজ্ঞাত]