আরেক মহামারির কাহিনি

ব্লাইন্ডনেস ছবির একটি দৃশ্য
ব্লাইন্ডনেস ছবির একটি দৃশ্য

বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের বাসিন্দারা বহুকাল আগে থেকেই মহামারি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। এক অর্থে মহামারির বয়স মানুষের সভ্যতার সমানই হবে। কিছুদিন পরপর যেন নিয়ম বেঁধে কোনো একটি জানা বা অজানা রোগের হাত ধরে এই শব্দ হানা দেয়, তছনছ করে দেয় চেনা দুনিয়া, পাল্টে যায় মানুষের হালচাল। সেই আদিকালের অ্যান্টোনাইন প্লেগ থেকে শুরু করে ব্ল্যাক ডেথ, সতেরো শতকের গ্রেট প্লেগ, বিভিন্ন সময়ে দেখা দেওয়া গুটিবসন্ত, কলেরা, বার্ড ফ্লু, এশিয়ান ফ্লু, এইডস হানা দিয়ে কেড়ে নিয়েছে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ। আমাদের দেশে বিশেষ করে উনিশ শতক এবং বিগত শতকের গোড়ার দিকে মহামারির আক্রমণে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে। ছোটবেলায় প্রায়ই ওলা ওঠা আর শীতলা বিবি নাম বড়দের মুখে শুনেছি আমরা। ধর্মীয় ইতিহাস থেকে আমরা জানি, পয়গম্বর মূসার আমলে পরপর দশটি মহামারি দেখা দেয়; সেগুলোর ভেতর একটি ছিল আজকের দিনে বহুল পরিচিত ডেঙ্গু। মহামারি মানুষের নিত্যসঙ্গী বলেই তার চেতন-অবচেতন মনে এর বিপুল প্রভাব রয়েছে। সেটি প্রতিফলিত হয়েছে তার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে, নানাভাবে। মহামারির ওপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে গল্প-উপন্যাস, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র; অনেক ক্ষেত্রে সেই সব চলচ্চিত্রের ভিত্তিও ছিল সাহিত্যই। মহামারির ওপর ভিত্তি করে রচিত সাহিত্যকর্মের ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ড্যানিয়েল ডিফোর ‘আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’ (১৭৭২), শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয়ের ‘গৃহদাহ’ (১৯২০), সমারসেট মমের ‘দ্য পেইন্টেড ভেইল’ (১৯২৫), ক্যাথেলিন আনা পর্টারের ‘পেল হর্স পেল রাইডার’ (১৯৩৯), আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগ’ (১৯৪৭), গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (১৯৮৫) মার্গারেট অ্যাটউডের ‘অরিক্স অ্যান্ড ক্রেক’ (২০০৩)। ১৯৯৫ সালে বেরোনো নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পর্তুগিজ লেখক হোসে সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ অন্ধত্বের কাল্পনিক মহামারি কেন্দ্র করে রচিত ভয়ংকর একটি উপন্যাস। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মহামারি সবার আগে ছিনিয়ে নেয় মানুষের মৌলিক মূল্যবোধ, প্রাণ বাঁচানোর সহজাত আদিম প্রবৃত্তি বিস্তার করে আধিপত্য। স্বার্থপরতার চূড়ান্ত নজির তৈরি হতে থাকে। তবে আবার এসবের ভেতরেও কারও কারও মাঝে টিকে থাকে মানবিকতা, অসহায়ের প্রতি হাত বাড়িয়ে দেয় সে বা তারা। যেমনটি আমরা আজকের পৃথিবীতে, আমাদের দেশে দেখতে পাচ্ছি।

উপন্যাসটি শুরু হয়েছে খুবই সাদামাটাভাবে, এক ট্রাফিক সিগন্যালে:

ব্লাইন্ডনেস বই
ব্লাইন্ডনেস বই

হলুদ বাতি জ্বলে উঠল। লাল বাতি জ্বলে ওঠার আগেই গতি বাড়াল সামনের দুটি গাড়ি। পথচারী পারাপারে সবুজ মানুষের একটা চিহ্ন জ্বলে উঠল। রাস্তা পেরোবার অপেক্ষায় যারা ছিল, কালো অ্যাসফল্টের গায়ে আঁকা সাদা ডোরাকাটায় পা ফেলে পার হতে শুরু করল তারা, জেব্রার মতো এমন আর কিছু হয় না, অবশ্য ওটার নামও তাই। ক্লাচের ওপর অধৈর্য পা চেপে রেখেছে মটরিস্টরা, গাড়ি প্রস্তুত রাখছে, চাবুকের আঘাত আশঙ্কাকারী শঙ্কিত রেসের ঘোড়ার মতো এগোচ্ছে, পিছু হটাছে। পথচারীরা কেবল রাস্তা পেরোনো শেষ করেছে, কিন্তু গাড়িগুলোকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার সংকেত দেখা দিতে কয়েক সেকেন্ড দেরি হবে, কারও কারও ধারণা এই দেরি আপাত-তাৎপর্যহীন হলেও গোটা শহরের হাজার হাজার ট্রাফিক লাইট ও সেগুলোর পর্যায়ক্রমে তিন রঙে বদল দিয়ে গুণ করলেই, ব্যস, ট্রাফিক জ্যাম বা আরও হালনাগাদ বুলি ব্যবহার করলে অচলাবস্থা সৃষ্টির অন্যতম বিরাট একটা কারণ হতে পারে।
অবশেষে সবুজ বাতি দেখা দিলে ঝটিতি আগে বাড়ল গাড়িগুলো, কিন্তু পরক্ষণেই এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে সব কটি গাড়ি সমান গতিতে ছুটতে পারেনি। মাঝখানের লেনের সবচেয়ে সামনের গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, নিশ্চয়ই কোনো রকম যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে, ঢিলে হয়ে যাওয়া অ্যাক্সিলারেটর পেডাল, আটকে যাওয়া গিয়ার লিভার, সাসপেনশনে কোনো ঝামেলা, জ্যাম হয়ে যাওয়া ব্রেক, ইলেকট্রিক সার্কিটে কোনো ব্রেকডাউন, যদি না স্রেফ পেট্রল শেষ হয়ে গিয়ে থাকে, এমনটি ঘটা এটাই প্রথমবার হবে না। পথচারী পারাপারে জমায়েত হওয়া পথচারীদের পরের দলটা থেমে থাকা গাড়িটার ড্রাইভারকে উইন্ডস্ক্রিনের পেছনে হাত নাড়তে দেখল, ওদিকে তার পেছনের গাড়িগুলো পাগলের মতো হর্ন বাজিয়ে চলেছে। ইতিমধ্যে যার যার গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে ড্রাইভারদের কয়েকজন, আটকে পড়া গাড়িটাকে এমন একটা জায়গায় ঠেলে নিয়ে যেতে চায়, যেখানে ওটা ট্রাফিকের পথে বাধা হতে পারবে না। বন্ধ জানালায় ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে আঘাত করতে লাগল ওরা, ওদের দিকে ঘাড় ফেরাল ভেতরের লোকটা, প্রথমে এক পাশে, তারপর অন্য পাশে, স্পষ্টতই চেঁচিয়ে কিছু বলছে, ঠোঁটের নড়াচড়া থেকে বোঝা যাচ্ছে একই কথা বারবার বলছে সে, একটা কথা নয় বরং দুটো কথা, কেউ একজন অবশেষে দরজা খোলার পর যেমন বোঝা গেল, আমি অন্ধ।

এরপর একে একে অন্ধ হতে থাকে শহর-দেশের সমস্ত নাগরিক। শহরজুড়ে দেখা দেয় আশ্রয় ও খাদ্যাভাব। লুটপাট, রাহাজানির রাজত্ব তৈরি হয়। এমনি ভীষণ অবস্থায় পরিস্থিতি সামাল দিতে আক্রান্তদের নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত কোয়ারেন্টিনে। উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলোর আশ্রয় জোটে তেমনি কোয়ারেন্টিনে রূপান্তরিত এক পাগলা গারদে। ভবনের বাইরে যাওয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বারবার ঘোষণা দেওয়া হতে থাকে :

‘... যার বলার ঢঙে বোঝা যায় হুকুম দিয়েই অভ্যস্ত সে। ওরা যে দরজা দিয়ে ঢুকেছে, সেটার মাথার ওপর বসানো লাউডস্পিকার থেকে এসেছে কণ্ঠস্বরটা। অ্যাটেনশন কথাটা তিনবার উচ্চারিত হলো, তারপর কণ্ঠটা শুরু করল: বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন অন্ধত্বের একটা মহামারি দেখা দেওয়ার সব রকম লক্ষণ দেখা দিয়েছে, সাময়িকভাবে যা শ্বেত রোগ নামে পরিচিত, সম্ভাব্য সব উপায়ে জনগণকে রক্ষা করার জন্যে সরকার তার যথাযথ অধিকার বিবেচনায় সব রকম তাগিদের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করছে, এবং আমরা আরও সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য জনগণের চেতনা ও সহযোগিতার ওপর নির্ভর করছি, এটা ধরে নিয়ে যে আমরা একটা সংক্রামক ব্যাধির মোকাবিলা করছি এবং কেবল এ পর্যন্ত ব্যাখ্যাতীত কাকতালীয় কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করছি না। আক্রান্তদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করার এবং ওদের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক আছে, এমন সবাইকে কাছেই কিন্তু আলাদা কোয়ার্টারে রাখার সিদ্ধান্ত কোনো রকম সযত্ন বিবেচনা ছাড়া নেওয়া হয়নি। সরকার তার দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন এবং আশা করে যে যাদের উদ্দেশে এই বার্তা প্রচারিত হচ্ছে, নিঃসন্দেহে সচেতন নাগরিক হিসাবে তারাও তাদের দায়িত্ব পালন করবে, এ কথা মনে রেখে যে বর্তমানে নিজেদের তারা যেমন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করেছে, তা কোনো রকম ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতির বাকি অংশের সঙ্গে সংহতি তুলে ধরবে। এটুকু বলার পর আমরা প্রত্যেককে অত্যন্ত মনাযোগের সঙ্গে পরবর্তী নির্দেশনা শোনার আহ্বান জানাচ্ছি, প্রথমত, সারাক্ষণ বাতি জ্বালানো থাকবে, সুইচ নিয়ে কোনো রকম জোরাজুরির চেষ্টা হবে অনর্থক, কাজ করবে না ওগুলো; দ্বিতীয়ত, কোনো রকম অনুমোদন ছাড়া বিল্ডিং ছাড়ার অর্থ হবে তৎক্ষণিক মৃত্যু; তৃতীয়ত, প্রত্যেক ওয়ার্ডে একটা করে টেলিফোন আছে, যেটা কেবল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্যে বাইরে থেকে নতুন রসদ আনার প্রয়োজনেই ব্যবহার করা যাবে; চতুর্থত, ইন্টার্নরা যার যার কাপড় হাতে ধুতে বাধ্য থাকবে; পঞ্চমত, ওয়ার্ড প্রতিনিধি নির্বাচন করার পরামর্শ দেওয়া যাচ্ছে, এটা নির্দেশ নয়, বরং সুপারিশ, ইন্টার্নদের অবশ্যই তাদের সুবিধামতো নিজেদের সংগঠিত করতে হবে—যদি তারা ওপরে উল্লেখ করা নির্দেশনা এবং যেগুলো আমরা ঘোষণা করতে যাচ্ছি, সেগুলো মেনে চলে; ষষ্ঠত, দিনে তিনবার খাবারভর্তি কন্টেইনার মেইন ডোরে রেখে আসা হবে, ডানে একটা, বাঁয়ে একটা—যথাক্রমে রোগী ও সন্দেহভাজন আক্রান্তদের জন্য; সপ্তমত, সমস্ত উচ্ছিষ্ট অবশ্যই পুড়িয়ে ফেলতে হবে এবং কেবল খাবারই এর অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং কন্টেইনার, প্লেট ও কাটলারিও, যেগুলো দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি, পোড়ানোর কাজটা করতে হবে বিল্ডিংয়ের ইনার কোর্টইয়ার্ড কিংবা এক্সারসাইজ ইয়ার্ডে। অষ্টমতম, এ ধরনের আগুনের যেকোনো রকম ক্ষয়-ক্ষতির জন্যে ইন্টার্নরা দায়ী থাকবে, দশমত, আগুন আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে, সেটা দুর্ঘটনাবশত বা ইচ্ছাকৃত যা-ই হোক, ফায়ারম্যানরা হস্তক্ষেপ করবে না; নবম, একইভাবে, কোনো রকম অসুস্থতা ছড়িয়ে পড়লে, এমনকি কোনো রকম বিশৃঙ্খলা বা আগ্রাসনের বেলায়ও, ইন্টার্নরা বাইরের হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে না; দশম, মৃত্যুর ক্ষেত্রে, কারণ যা-ই হোক, ইন্টার্নরা কোনো রকম আচার ছাড়াই মৃতদেহ ইয়ার্ডে কবর দেবে; একাদশ, রোগীদের উইং এবং আক্রান্ত বলে সন্দেহভাজনদের যোগাযোগ অবশ্যই সেন্ট্রাল হলে হতে হবে, যেদিক দিয়ে তারা ঢুকেছে; দ্বাদশ, সন্দেহভাজনদের কেউ হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেলে অবিলম্বে তাদের অন্য উইংয়ে স্থানান্তরিত করা হবে; ত্রয়োদশ, নবাগতদের সুবিধার্থে এই বার্তা প্রতিদিন একই সময়ে প্রচারিত হবে। সরকার এবং জাতি আশা করে, প্রত্যেক নারী-পুরুষ যার যার দায়িত্ব পালন করবে। গুড নাইট।
এখানে ওরা মুখোমুখি হয় নির্মম কিছু মানুষের নিপীড়নের। ইন্টার্নদের একটা অংশ জোট বাঁধে বাকি সবার বিরুদ্ধে। খাবার এবং অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে চাঁদা দাবি করতে থাকে ওরা। কেউ ওদের দাবি মানতে অস্বীকার করলেই তার কপালে জুটতে থাকে অকথ্য নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুও। ইন্টার্নদের দল গড়ে তোলে প্রতিরোধ। সংঘাত বাঁধে দুদলের ভেতর। একসময় আগুন লেগে যায় পাগলা গারদের আবদ্ধ ভবনে। কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসে ওরা।

সাহিত্যের দুই নোবেল জয়ী হোসে সারামাগো ও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
সাহিত্যের দুই নোবেল জয়ী হোসে সারামাগো ও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

এরপর অন্ধদের খাবারের খোঁজে বেরোনোর বর্ণনা দিচ্ছেন সারামাগো এভাবে:
প্রতিটা ঘণ্টা পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তা-ঘাটের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অন্ধকার সময়ে আবর্জনার পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে, যেন বাইরে থেকে, এখনো স্বাভাবিক জীবন চলছে এমন অজানা কোনো দেশ থেকে ডাস্টবিন খালি করার জন্য হাজির হচ্ছে ওরা, আমরা অন্ধদের দেশে না থাকলে এই সাদা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ভৌতিক ঠেলাগাড়ি আর ট্রাক দেখতে পেতাম, জঞ্জাল, ডেব্রিজ, রাব্ল, রাসায়নিক আবর্জনা, ছাই, পোড়া তেল, হাড়গোড়, বোতল, চ্যাপ্টা ব্যাটারি, প্লাস্টিক ব্যাগ, কাগজের পাহাড়ে বোঝাই, শুধু বেঁচে যাওয়া খাবার আনেনি ওরা, সামান্য ফলের বাকলও নয়, যা দিয়ে হয়তো আমরা ক্ষুধা মেটাতে পারতাম, রাস্তার বাঁকে অপেক্ষমাণ সুখের দিনের প্রত্যাশায় থাকবার সময়। এখনো বেশ সকাল, কিন্তু এরই মধ্যে অসহনীয় হয়ে উঠেছে তাপ। বিশাল জঞ্জালের চূড়া থেকে টক্সিক গ্যাসের মেঘের মতো দুর্গন্ধ উঠে আসছে, শিগগিরই মহামারির প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে, আবার বলল ডাক্তার, বৃষ্টি না হলে কেউ রেহাই পাবে না, আমাদের আর কোনো প্রতিরোধ নেই, জোর হাওয়া দিচ্ছে, বলল মহিলা, সেটাও নেই, বৃষ্টিটা অন্তত আমাদের তৃষ্ণা মেটাত, আর বাতাস খানিকটা হলেও দুর্গন্ধ দূর করত। অস্থিরভাবে চারপাশে গন্ধ শুঁকে চলেছে অশ্রু-মোছা কুকুরটা, একটা নির্দিষ্ট ময়লার স্তূপ পরখ করতে থামছে, হয়তো ওটার নিচে বিরল কোনো সুখাদ্য লুকিয়ে আছে, যেটা এখন আর খুঁজে পাচ্ছে না, একা হলে এ জায়গা ছেড়ে এক ইঞ্চিও নড়ত না ওটা, কিন্তু যে মহিলা কেঁদেছিল এরই মধ্যে হাঁটা ধরেছে সে, ওকে অনুসরণ করা তার দায়িত্ব, কেউ জানে না কখন কাউকে আবার অশ্রু মুছে দিতে হবে।
অন্তরের আরেক বর্ণনা:
….হাঁটাটা বেশ কষ্টকর, কোনো কোনো রাস্তায়, বিশেষ করে ঢালুগুলোয়, প্রবল বৃষ্টির পানি স্রোতে পরিণত হয়ে গাড়িগুলোকে অন্যান্য গাড়ি বা দালানের গায়ে ঠেসে দিয়েছে, দরজা ভেঙে ফেলেছে, দোকানের জানালা চুরমার করে দিয়েছে, ভাঙা কাচের পুরু টুকরায় ঢেকে আছে জমিন। দুটো গাড়ির মাঝখানে আটকা পড়ে পচছে এক লোকের লাশ। দৃষ্টি সরিয়ে নিল ডাক্তারের স্ত্রী। আরও কাছে এগিয়ে গেল অশ্রু-মোছা কুকুরটা, কিন্তু মৃত্যু ভীত করে তুলল ওটাকে, তবু দুকদম আগে বাড়ল সে, আচমকা গায়ের পশম খাড়া হয়ে গেল তার, তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল গলা চিরে। এই কুকুরটার সমস্যা হচ্ছে মানুষের বড্ড বেশি কাছাকাছি থেকে বেড়ে উঠেছে সে, মানুষের মতোই কষ্ট পাবে। একটা চত্বর পেরোল ওরা, যেখানে অন্ধ লোকদের বিভিন্ন দল অন্য অন্ধদের বক্তৃতা শুনে মজা লুটছে, প্রথম দর্শনে কোনো দলকেই অন্ধ মনে হলো না, বক্তারা উত্তেজিতভাবে শ্রোতাদের দিকে তাকাচ্ছে আর শ্রোতারাও মনোযোগের সঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে রেখেছে বক্তাদের দিকে। মহান সংগঠিত ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, মুক্তবাজার, অর্থনীতি, বাজার অর্থনীতি, স্টক এক্সচেঞ্জ, করারোপ, সুদ, এক্সপ্রোপ্রিয়েশন আর অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন, উৎপাদন, বণ্টন, ভোগ, চাহিদা-জোগান, দারিদ্র্য-সম্পদ, যোগাযোগ, নিপীড়ন ও অপরাধ, লটারি, জেলখানা, পেনাল কোড, সিভিল কোড, হাইওয়ে কোড, অভিধান, টেলিফোন ডিরেক্টরি, পতিতাবৃত্তির নেটওয়ার্ক, অস্ত্র কারখানা, সেনাবাহিনী, কেমিস্ট্রি, পুলিস, চোরাচালান, ড্রাগস, অনুমোদিত অবৈধ ট্রাফিক, ওষুধ গবেষণা, জুয়া, ক্রেস্ট আর ফিউনারেলের দাম, বিচার, বর্জ্য, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন, পার্লামেন্ট, উত্তল, অবতল, আনুভূমিক ,উলম্ব, তীর্যক, কেন্দ্রিক, বিকেন্দ্রিক সরকার, চকিত ভাবনা, কণ্ঠনালির ক্ষয়, কথার মৃত্যুর মৌলিক নীতিমালার গুণকীর্তন করছিল। এখানে সংগঠন নিয়ে কথা বলছে ওরা, স্বামীকে বলল ডাক্তারের স্ত্রী, খেয়াল করেছি, বলল ডাক্তার, এর চেয়ে বেশি কিছু বলল না। হেঁটে চলল ওরা, একটা রাস্তার মোড়ে স্ট্রিট-প্ল্যান দেখতে গেল ডাক্তারের স্ত্রী, পুরোনো রোডসাইড ক্রসের মতো পথ নির্দেশ করছে। সুপারমার্কেটের খুব কাছে এসে গেছি আমরা, এখানেই যেদিন হারিয়ে যাওয়ার পর ভেঙে পড়ে কেঁদেছিল ও, প্লাস্টিক ব্যাগগুলোর ভারে ভূতের মতো নুয়ে পড়েছিল, ভাগ্যক্রমে কানায় কানায় ভর্তি ছিল ওগুলো, বিভ্রান্তি আর যন্ত্রণার ভেতর সান্ত্বনার জন্যে একটা কুকুরের ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল ওকে, এই কুকুরটাই, যেটা বেশি কাছে চলে আসা অন্য কুকুরগুলোর উদ্দেশে গর্জন ছাড়ছে, যেন ওদের বলছে, আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না, এখান থেকে দূরে থাকো। বাঁ দিকে একটা রাস্তা দিয়ে গিয়ে আবার ডানে মোড় নিলেই সুপারমার্কেটের পথ। খালি দরজাটা, হ্যাঁ, ওই তো দরজাটা রয়েছে, গোটা বিল্ডিংটা আছে, কিন্তু মানুষের আসা-যাওয়া চোখে পড়ল না, পিঁপড়ের সারির মতো মানুষ এই সব দোকানে সারাক্ষণই দেখতে পাই আমরা, যেগুলো বিশাল জনতার আনাগোনার ওপরই টিকে থাকে। সবচেয়ে খারাপটাই আশঙ্কা করল ডাক্তারের স্ত্রী, এবং তার স্বামীকে বলল, বেশি দেরি করে ফেলেছি আমরা, একটা কণাও মিলবে না ওখানে।
কেন এ কথা বলছ, কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখছি না আমি, হয়তো এখনো বেইসমেন্ট স্টোর রুমের খোঁজ পায়নি কেউ, সেটাই আশা করছি আমি। কথাগুলো বলার সময় সুপারমার্কেটের উল্টো দিকের পেভমেন্টে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। ওদের পাশে, যেন ট্রাফিক লাইট সবুজ হওয়ার অপেক্ষা করছে, তিনজন অন্ধ মানুষ ছিল। ওদের চেহারায় ফুটে ওঠা অভিব্যক্তি খেয়াল করেনি ডাক্তারের স্ত্রী, বিভ্রান্ত বিস্ময়ের ছাপ ছিল সেটা, একধরনের দ্বিধান্বিত ভয়, ডাক্তারের স্ত্রী লক্ষ করল না যে ওদের একজন কথা বলার জন্যে মুখ খুলেও আবার বন্ধ করে ফেলল, আকস্মিক কাঁধ ঝাকানোও লক্ষ করল না সে, দেখতে পাবে তোমরা, আমরা ধরে নিচ্ছি, অন্ধ লোকটা ভাবছে। ওরা রাস্তার মাঝখানটা পার হওয়ার সময় ডাক্তারের স্ত্রী আর তার স্বামী দ্বিতীয় অন্ধের মন্তব্য শুনতে পেল না, মহিলা কেন বলল, দেখতে পাচ্ছে না, কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দেখছে না, এবং তৃতীয় অন্ধ জন জবাব দিল, ওটা স্রেফ কথার কথা, একটু আগে আমি হোঁচট খাওয়ার পর দেখেশুনে পা ফেলতে বলেছিলে তুমি, ঠিক সে রকমই, আমরা এখনো দেখার অভ্যাসটা হারাইনি, হায় ঈশ্বর, কথাটা আগে কতবারই না শুনেছি আমি, জোরে বলে উঠল প্রথম অন্ধজন।

এমনিভাবে শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় উপন্যাসটি। সারামাগো তার নিজস্ব ব্যতিক্রমী ভঙ্গি আর ভাষায় এভাবে আসলে বেশির ভাগ মানুষের ভেতরের রূপটি অত্যন্ত নিপুণ ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তুলেছেন, সেই রূপ প্রীতিকর নয়।

[বেশ কয়েক বছর আগে সারামাগোর এই অসাধারণ উপন্যাসটি অনুবাদের সুযোগ হয়েছে আমার, 'অন্ধত্ব' নামে বেরিয়েছে কালোহরফ থেকে। এটির দ্বিতীয় একটি পর্বও আছে, ব্লাইন্ডনেসের পরবর্তী ঘটনা নিয়ে: 'দ্য সিয়িং'—এটিরও বাংলা তর্জমা করেছি আমি। করোনার এই ভয়াবহ দিনগুলোতে গৃহবন্দিত্বের একঘেয়েমি কাটাতে কিংবা এই অসহনীয় অবস্থার অবসানের পর আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।
শওকত হোসেন: অনুবাদক]