নীলোৎপল সাধ্য: সুরের গুরু, দাও যে সুরের দীক্ষা!

ওয়াহিদুল হক ও  সংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জনের সঙ্গে। ছবিতে আরো আছেন ছায়ানটের শিল্পী- শিক্ষার্থীরা
ওয়াহিদুল হক ও সংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জনের সঙ্গে। ছবিতে আরো আছেন ছায়ানটের শিল্পী- শিক্ষার্থীরা

করোনার এই বিপন্ন সময়ে খানিকটা চুপি চুপিই চলে গেলেন তিনি। অথচ, এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশে শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষা ও অনুশীলনের চিরব্রতী আচার্য ওয়াহিদুল হকের ভাবশিষ্য, জীবদ্দশায় ওয়াহিদ কাকুর ছায়াসঙ্গী তথা ‘ছায়ানট’-এর অন্যতম রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক ও এ দেশের ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’-এর অক্লান্ত পরিশ্রমী সংগঠক ও রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী নীলোৎপল সাধ্য ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে সারা দেশে অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে রবীন্দ্রসংগীত শিখিয়েছেন, রবীন্দ্র ভাবাদর্শে দীক্ষিত করেছেন। অথচ গত দু-আড়াই বছর ক্যানসার বা কর্কট রোগের সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের পর সহসা এমন এক সময় তাঁকে চলে যেতে হলো, যখন দেশজুড়ে বা গোটা পৃথিবীব্যাপীই করোনার মহামারি বা দুঃসময়। তিনি চলে যাওয়ার পর তাঁর মরদেহটুকু শহীদ মিনার তো দূরের কথা, তাঁর আজীবন ভালোবাসার প্রতিষ্ঠান ছায়ানটেও একবারের জন্য নেওয়া গেল না। তাঁর মৃত্যুতে তাঁর অকালবিধবা পত্নী ঝর্না মল্লিক বা একমাত্র কন্যা অঝরা সাধ্যর জন্য এটা যে প্রিয়তম স্বামী বা পিতার চলে যাওয়ার মতোই আরও এক বড় শোক; শোক তাঁর ছাত্রছাত্রী, সহকর্মী, সতীর্থ শিল্পী, শুভাকাঙ্ক্ষীসহ সংগীতভুবনের সবার জন্যই—সে আর বলার নয়।

আজীবন খানিকটা প্রচারবিমুখ আর ব্যক্তিগত তারকাখ্যাতি অর্জনের চেয়ে পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা ছড়িয়ে দিতেই বেশি আগ্রহী নীলোৎপলদার উল্লেখ কিন্তু আছে এ দেশের খ্যাতনামা লেখক তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ক’-তে, যেখানে আশির দশকের শেষ বা নব্বইয়ের শুরুতে ছিমছাম, নিভৃত শহর ময়মনসিংহে তসলিমা নাসরিনের ছোট বোন ইয়াসমীনকে গান শেখাতে আসেন দীর্ঘকায়, কাঁধে কাপড়ের ঝোলা এক যুবক—শিক্ষক নীলোৎপল সাধ্য।

ময়মনসিংহের এক ছোট ও নিভৃত গ্রামে ১৯৫৫ সালের ৬ ডিসেম্বর নীলোৎপলদার জন্ম। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর কাকা সুনীল সাধ্যর কাছে প্রথম গানে হাতেখড়ি। তাঁর বাবা স্বর্গীয় জ্ঞানেন্দ্রনাথ সাধ্যও গ্রামে তবলা বাজানো, অভিনয় করা বা ফুটবল খেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময়েই নীলোৎপল সাধ্য প্রথম একটি জারিগানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হন। সেই থেকে তাঁর গানের প্রতি ভালো লাগা বা ভালোবাসা তৈরি হয়। তাঁদের গ্রামের বাড়িতে বেতার শোনা হতো এবং বেতারে নিয়মিত ওপার বাংলার আকাশবাণীতে রবীন্দ্রসংগীতের আসর শোনা এক ভদ্রলোক গান শোনার সময় বালক নীলোৎপলকেও পাশে বসাতেন। সেই থেকে রবীন্দ্রসংগীতের ওপর তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। তবে প্রথম যেদিন সংগীতাচার্য শৈলজারঞ্জনের সামনে বসে তিনি গান শেখার সুযোগ পান, সেদিন তাঁর নিজেকে সত্যিই সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল, ‘সেদিন মনে হয়েছিল যেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই আমার সামনে বসা। মনে হলো যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি এটাই।’

পেশাগত জীবনে বাংলাদেশ টিঅ্যান্ডটি বোর্ডে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন ২০১৬ সালে। পেশাগত জীবনের পাশে নেশাগত জীবনেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। ১৯৮১ সালে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ময়মনসিংহ শাখার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২৬ বছরের নীলোৎপল সাধ্যর সাংস্কৃতিক জীবনের সূচনা। তারপর আর থেমে থাকেননি। ড. নূরুল আনোয়ার ছিলেন এই পরিষদের চালিকা শক্তি। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৩ সাল থেকে সংগীত বিভাগে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক হিসেবে খণ্ডকালীন অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। পাশাপাশি ২০১৪ সাল থেকে ত্রিশালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়েও সংগীত বিভাগে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। একবার কলকাতাস্থ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁর সংগীত পরিবেশনার পর কলকাতার ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় সে গানের প্রশংসা করে সংবাদ ছাপা হওয়ার মতো সম্মাননার পাশাপাশি সারা জীবন সমাজের নানা স্তরের মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান অর্জন করেছেন তিনি।

সনজীদা খাতুনের সঙ্গে নীলোৎপল সাধ্য
সনজীদা খাতুনের সঙ্গে নীলোৎপল সাধ্য

এবার নীলোৎপলদার সঙ্গে আমার পরিচয় বা যোগাযোগের প্রসঙ্গে আসি। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব ছোটবেলায় কিছুদিন গান শিখেছিলাম। ১৯৯২ সালের অক্টোবরে মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফুসফুসের এক দুরারোগ্য রোগে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আমি গান ছেড়ে দিই। তখন জীবনে বাঁচব কি না, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন ছিল। আমার মমতাময় পরিবারের ঐকান্তিক সংগ্রামে সে যাত্রা জীবন-যুদ্ধে বেঁচে গেলেও এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা অব্যাহত রাখলেও জীবনে আর গান গাইতে পারব না ভেবে শিল্পের প্রতি আমার ভালোবাসা মোচড় খেয়ে সংগীতের দিক থেকে সাহিত্যে বাঁক নেয়, যা পরে আর কাউকে জানানোও হয়নি। আসলে ফুসফুস ক্যানসারের তৃতীয় স্তরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে হার্মোনিয়াম-তবলা আর প্রথম জীবনের সামান্য সংগীতশিক্ষাকে সেই যে বিদায় জানিয়েছিলাম, ২০০৯-এ নীলোৎপলদার কাছে আবার রবীন্দ্রসংগীত শেখা শুরু করলাম শুধু কর্মক্ষেত্র ও সাহিত্যভুবনের নানামাত্রিক লড়াইয়ের ডিপ্রেশন কাটাতে। তার আগে ২০০৭ থেকেই অবশ্য ছায়ানটের নামী উচ্চাঙ্গ সংগীতশিক্ষক লাভলু স্যারের বাসায় যাওয়া শুরু করেছিলাম। নীলোৎপলদা যখন আবার আমাকে রবীন্দ্রসংগীত শেখানো শুরু করলেন, তখন কী যে অবস্থা আমার! ভেতরে ১৭ বছরের ফাঁক। সব ভুলে বসে আছি। ওয়াহিদ কাকু বা ওয়াহিদুল হকের যথার্থ উত্তরসূরি নীলোৎপলদা কী ধৈর্য আর মমতায় যে একে একে আমাকে বেশ কিছু গান শেখালেন। আর কী অসম্ভব উদ্যম! ষাটোর্দ্ধ দেহে দেশের নানা জায়গায় ছুটছেন, ছেলেমেয়েদের গান শেখাচ্ছেন, টিঅ্যান্ডটির চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল বিশ্ববিদ্যালয় আর ছায়ানটে গান শেখান। ছাত্রছাত্রীদের বাড়িতে যান, টিভিতে অনুষ্ঠান করেন। ২০১৬ সালের শেষের দিকে একদিন আমাদের বাসায় এলেন। বললেন, ডান পায়ের পাতায় একটি ছোট ফোড়ার মতো হয়েছে। মাত্র দু-তিন সপ্তাহ পরই দাদা আর বের হতে পারছেন না। তখন আমি বাংলা একাডেমিতে। অসম্ভব আত্মমর্যাদাবোধ দাদা ও বউদির। কোনো সাহায্য চাইবেন না কারও কাছে। ২০১৮ সালের শুরুতে দাদা যখন প্রাথমিকভাবে সুস্থ হলেন, তখন আমার ‘ব্র্যাক আফগানিস্তান-এর নতুন চাকরিতে জেন্ডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাবুল যাওয়ার কথা। যাওয়ার আগের দিন দাদা এলেন হন্তদন্ত হয়ে।

‘তুমি যাবেই? গানের প্রতি তোমার কোনো ভালবাসা নেই? ও দেশে গিয়ে আর গাইতে পারবে?’

‘আমি তো এমন কিছু গাই না।’

‘তোমার কত বছরের গ্যাপ! অনেকটা তো কাটিয়ে উঠছিলে।’

ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে
ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে

পরের দিন সত্যিই আমার যাওয়া হয় না নানা কারণেই। কিন্তু দাদার ক্লাসে বসাও খুব হয় না। আমি একাডেমি ছেড়ে কক্সবাজার যাই-আসি। গত বছর থেকে ঢাকায় আবার যখন একটু থিতু, দাদা আবার অসুস্থ। চেন্নাই গিয়ে কয়েক মাস থেকে এসে ফেরেন ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষে। তখন আমি আবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আবার একটি ভালো কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবু ৬ ডিসেম্বর দাদার জন্মদিনে গেলাম। এদিকে চেন্নাই থেকে দাদার স্ত্রীকে শেষ কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর স্ত্রীর ভাষ্যমতে, ‘২০১৭ সালের মার্চে তাঁর প্রথম ক্যানসার ধরা পরে, সেটা প্রাইমারি বা প্রথম স্তরে ছিল। তখন আমরা কলকাতায় ছিলাম। সেখানে একটা কেমোথেরাপি নিয়ে বাংলাদেশে আসার পর অসুস্থ হয়ে গেলে তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে তাঁর স্টুডেন্ট বিভাগের প্রধান খুরশিদ আলমের তত্ত্বাবধানে ভর্তি করানো হলো। এরপর হেমাটোলোজি ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর এম এ খান ও মাফরুহা আক্তারের তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা পুরোদমে শুরু হয় এবং কয়েক মাস চিকিৎসার পর ২০১৮ সালের প্রথম দিকে একটা পেট-সিটিস্ক্যান পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে তাঁরা বলেন যে সে এখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু জুন মাসে আবার তা ফিরে আসে এবং তখন ডাক্তাররা সার্জারি করে কেমোথেরাপি না দিয়ে রেডিওথেরাপি দেন। বিদেশে চিকিৎসা করানোর কথা বলা হলেও তাঁরা এখানেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে বলেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আবার তাঁর শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়।

অবস্থার অবনতি হওয়ার কারণে হেমোটোলজি বিভাগের আরেকজন চিকিৎসক অখিলরঞ্জন বিশ্বাসের কাছে চিকিৎসা শুরু হয়। ঢাকা মেডিকেলে দুমাস চিকিৎসার পর অখিলরঞ্জন বিশ্বাস চেন্নাই ভেলোরে ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ যাওয়ার পরামর্শ দেন। ছমাস চেন্নাইয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পর ঢাকায় আসার চার মাসের মাথায় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।

১৭ মার্চ সন্ধ্যায় যখন অনলাইনে নেদারল্যান্ডসের একটি সামাজিক বিজ্ঞান কোর্সে পরীক্ষার উত্তরগুলো বেশ গুছিয়ে লেখা শুরু করেছি...সেদিন দুপুরেও ভাবছিলাম যে দাদাকে ফোন দিয়ে জানতে চাইব, তিনি এখন কেমন আছেন, কত দিন নতুন গান তুলি না, তখনই এমন খবর এল। আমাদের সব ছাত্রছাত্রীকে অনাথ করে দিয়ে বড় অসময়ে তাঁর চলে যাওয়া। অথচ সেদিন দুপুরেই ভাবছিলাম, কবে দাদা সুস্থ হবেন? আমি তাঁর কাছে ‘আমার মল্লিকাবনে’ গানটি শিখব।

শান্তিতে থাকুন নীলোৎপলদা! গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে আপনি চিরবিশ্রাম নিন।