সূর্যের আবর্তন ও ফসল ঘিরে যত আয়োজন

এমন নববর্ষ এর আগে বোধ করি কখনোই দেখিনি আমরা। গোটা পৃথিবী তথা মানবসভ্যতা এক ক্রান্তিকাল পার করছে। অথচ বৈশাখ তো তাপস নিশ্বাসে মুমূর্ষুকে উড়িয়ে দেবার প্রতিজ্ঞাতেই আসে। উড়ছে কই? এক অচেনা, নতুন ব্যাধির বীজাণুতে নিউইয়র্ক থেকে ভ্যাটিকান সিটি, বাংলাদেশ থেকে জাপান—পুরো মানব প্রজাতিই লকডাউন অবস্থা পার করছে। সম্পদশালী পাশ্চাত্য সভ্যতাই যেখানে এই সহসা বিপর্যয়ের অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে পারছে না, সেখানে আমাদের মতো দেশে, যেখানে আজও অসংখ্য মানুষকে দিন এনে দিন খেতে হয়, তাদের নাভিশ্বাস উঠে যাবার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। গত বছরও বাংলা নববর্ষের আগে একটি গবেষণার কাজে বরিশালের গ্রামে গিয়ে দেখেছি, পালপাড়ায় বর্ষীয়ান শিল্পী চৈত্রসংক্রান্তির গ্রামীণ মেলায় বিক্রির জন্য মাটির ময়ূর বা হাতি উনুনে পুড়িয়ে, শক্ত করে সেই শিশুতোষ খেলনায় বুলিয়ে দিচ্ছেন রঙের প্রলেপ আর পাশের মাদ্রাসা থেকে ক্লাস শেষ করে এসে কয়েকটি বালক গভীর বিস্ময় ও মুগ্ধতায় দেখছে সেই দৃশ্য...এবার গ্রামে গ্রামে বসেনি হয়তো চৈত্রসংক্রান্তির মেলা! বরগুনার পায়রা নদে বিস্তীর্ণ যত নৌকার সারিতে কোনো কৃষকের সার সার তরমুজ ও বাঙ্গির পশরা অথবা রাঙামাটির এক চাকমা বা মারমা কৃষক তাঁর কাঁঠাল ও আনারস পাঠাতে পারছেন না ঢাকা অবধি। গ্রাম থেকে নগর অবধি অর্থনীতির বিপুল চলমান চক্র স্থবির হয়ে পড়ায় কী করেই-বা প্রত্যাশা করব যে আজ সকালে যথারীতি এই ঢাকাতেও নামবে লাল-সাদা শাড়ি, চুলে বেলী ফুলের মালা আর দুহাত ভরা লাল-সাদা চুড়ি পরা নানা বয়সী নারীর ঢল? অবস্থা এমন যে সামান্য দই-মিষ্টি মুখে দেবার অবস্থাতেও আমরা নেই। কারণ তো সেই একটাই: করোনা ভাইরাস! গত দিন পনেরো ধরেই যখন মানসিকভাবে আমরা সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছি যে এবার আর ‘নববর্ষ’ সেভাবে পালন করা যাবে না, তখনই আজকের এই বিশ্বায়িত পৃথিবীর নেটিজেন হিসেবে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি যে ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষা করতে গিয়ে বাতিল হচ্ছে ইরানের ঈদ-ই-নওরোজ, ইহুদিদের ধর্মীয় পর্ব ‘পাসওভার,’ খ্রিষ্টানদের ‘ইস্টার’ বা থাইল্যান্ড-মিয়ানমার-লাওস-কম্বোডিয়ার ‘সংক্রাম’ অনুষ্ঠানও। অবাক করা নয়? পৃথিবীর নানা দেশে ও নানা সভ্যতায় বেশ কিছু ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক পর্ব আয়োজন বা উদ্যাপনের সময়টি এমন গায়ে গায়ে লাগোয়া সময়েই-বা কেন? আর সেটি নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে গিয়েই মনে হলো, বাংলা নববর্ষ বলুন, পারস্যের ঈদ-ই-নওরোজ, ইহুদিদের পাসওভার, বৌদ্ধ ভুবনের সংক্রাম বা খ্রিষ্টানদের ইস্টার—এই যাবতীয় পর্বের সূচনার শিকড় কি কোনো আদি সূত্রে এক ও অভিন্নভাবে গ্রথিত? কী সেই শিকড় বা সূত্র? প্রতিবছর সূর্যের কক্ষপথে পৃথিবীর আবর্তনের পর বসন্তের শেষ ও গ্রীষ্মের শুরুতে কৃষকদের ঘরে ফসল তোলার সঙ্গে কি কোনো সম্পর্ক আছে এই নানা সভ্যতার ‘নববর্ষ’ বা ধর্মীয় কিছু পর্ব উদ্যাপনেরও? বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে কিছু তথ্য যেহেতু আমরা সবাই কমবেশি ইতিমধ্যেই অবগত, আসুন তো আগে দেখে নিই পৃথিবীর অন্য নানা দেশের নানা পর্বের আদি কারণ ও ঠিক কেন আমাদের নববর্ষের আগে-পরে বা কাছাকাছি সময়েই পর্বগুলো উদ্যাপিত হয়, তার পেছনের যুক্তিটি!

পাসওভার:
প্রতিবছর ইহুদি বর্ষপঞ্জের নিশান মাসের পনেরো তারিখে বা গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের মার্চ বা এপ্রিলে পাসওভার শুরু হয়। এক সপ্তাহব্যাপী এই আয়োজন এ বছর শুরু হয়েছে ৮ এপ্রিল এবং শেষ হবে ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যায়। বহু শতাব্দী আগে ইসরায়েলে ‘পাসওভার’ পর্বের সূচনা হয়েছিল মূলত একটি বাসন্তী আয়োজন হিসেবে, যখন যবের দানা প্রথম পাকতে শুরু করত। নিয়ম ছিল যে যবের মঞ্জরীতে যখন প্রথম ফল বা দানা দেখা যাবে, তখন ইসরায়েলের ভূমিতে ‘পাসওভার’ পর্ব উদ্যাপন শুরু হবে। ইহুদিদের তিনটি প্রধান পর্ব পাসওভার, শাভুয়োত ও সুক্কোত কৃষি তথা মৌসুমি চাষের পর্ব উদ্যাপন হিসেবে শুরু হলেও কালানুক্রমে মিশরে ফারাও বা ফেরাউন শাসকদের হাত থেকে মোজেস বা মুসা নবী তাঁর অনুসারীদের নিয়ে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে নিরাপদে পার হবার কাহিনির সঙ্গে এই পর্বকে জুড়ে দেয়া হয়। অতীতে ইহুদিদের ভেতর এটাই নিয়ম ছিল যে যবের দানা পাকতে শুরু না অব্দি বছর শুরু হবে না বা নিশান মাসের এক তারিখ এসেছে বলে গণনা করা হবে না। সে ক্ষেত্রে ইহুদি বর্ষপঞ্জিতে ফসল না পাকা অবধি আর একটি বাড়তি মাস হিসেবে ‘আদার (দ্বিতীয়)’ যুক্ত করা হতো। তবে চতুর্থ শতক থেকে ইহুদি চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জি অনুসারে, গাণিতিকভাবে সময়ের বেশকম সংশোধন করে নেওয়া হয়। ইসরায়েলে আজও ‘পাসওভার’ হচ্ছে সাত দিনব্যাপী ‘খামিরবিহীন রুটি’ ও আনুষঙ্গিক অন্য নানা পানাহার ও সাত দিন ধরে কাজ থেকে বিশ্রাম নেবার দিন। বিশ্রাম নেবার এই সাত দিনকে তারা বলে ‘চল হামোয়েদ।’ ইসরায়েলের বাইরে অন্যত্র ইহুদিরা এই অনুষ্ঠান পালন করে আট দিন ধরে। রুটির পাশাপাশি একটি ভেড়া বা ছাগলকে পাসওভার পর্বে জবাই করা হয় (‘কোরবান পেসাচ’)। জেরুজালেমের আদি মন্দিরে ইহুদি বর্ষপঞ্জির ১৪ তারিখে ন্যূনতম সামর্থ্যবান প্রতিটি ইহুদি পরিবারই একটি মেষশাবক বা বুনো ছাগল কোরবানি দেবে এবং ১৫ তারিখ সকাল হবার আগেই সেই মাংস খাবে—এটাই ছিল নিয়ম। ‘মাতজো’ নামে বিশেষ ধরনের রুটি এবং ‘মারোর’ নামে তিতা লতাপাতা বা শাকের সঙ্গে এই রুটি-মাংস খাওয়ার নিয়ম ছিল। পরের দিন সকাল নাগাদ এই মাংস আর অবশিষ্ট থাকবে না। উল্লেখ্য, এই ভেড়া বা ছাগল জবাই করার সময় ‘হাল্লেল’ সংগীত গাওয়া হতো এবং কোনো ধর্মত্যাগী, ভৃত্য, ইহুদি হয়েও সুন্নত হয়নি—এমন পুরুষ এবং অ-ইহুদিরা পাসওভারে ভেড়া বা ছাগল বলি দেওয়া বা তার মাংস খাওয়ার জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হতেন। ইহুদিদের অন্যতম গ্রন্থ ‘দ্য বুক অব এক্সোডাস’-এ বলা হয়েছে যে মিশরীয় ফারাও শাসকেরা যখন ইসরায়েলিদের দাসত্বের শিকলে আটকে ফেলে, তখন মহামহিম ঈশ্বর তাঁর করুণা বর্ষণের মাধ্যমে মিশরীয়দের ওপর ১০টি মড়কের অভিশাপ দেন, যাতে মিশরীয়রা মারা গেলেও ইসরায়েলি ক্রীতদাসেরা মরবে না বলে মোজেস বা মুসা নবীর কাছে বাণী আসে। ঈশ্বর এই নির্দেশও পাঠান যে ইসরায়েলি দাসেরা যদি একটি মেষশাবক জবাই করে তার রক্ত তাদের বাড়ির দরজায় লেপে দেয়, তবে সেই বাড়িতে মড়ক দেখা দেবে না। মড়কের বিপদ ‘পাস ওভার’ বা ‘পার’ হয়ে যাবে। এভাবেই পুরাণের নানা কথকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসরায়েলের আদি কৃষক সভ্যতার নানা উদ্যাপন।

ইস্টার
ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জিতে ইস্টার উদ্যাপিত হয় ইহুদি পর্ব পাসওভারের কাছাকাছি সময়েই। আধুনিক ইংরেজিতে ‘ইস্টার’ পর্বটি ডাচ ‘উস্টার’ ও জার্মান ‘অস্টার্ন’ শব্দ থেকে এসেছে; আর পুরোনো ইংরেজিতে ‘ইয়োস্টোরের মাস’, হ্যাঁ, আজ আমরা যাকে ‘এপ্রিল’ মাস বলি, সেই সময়টাতেই হতো। প্যাগান ইউরোপে দেবী ইয়োস্টোরের জন্য এপ্রিল মাসে যে ভোজ আয়োজন করা হতো, সময়ের নানা বিবর্তন পার হয়ে সেই অনুষ্ঠানই কি আজ ‘ইস্টার’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়? সময়টা সেই এপ্রিল। শস্য কর্তন ও কৃষিজীবী সমাজের কয়েক দিনের অবসর যাপন ও পানাহারের সময়। তলস্তয়ের ধ্রুপদি উপন্যাস ‘পুনরুত্থান’ বা ‘দ্য রেজারেকশনে’র নায়ক নেখলিয়ুদভ যখন তার দুই ফুফু বা পিসিদের বাড়িতে যাচ্ছে ইস্টারের ছুটি কাটাতে আর সেখানেই পরিচয় হয় কাহিনির নায়িকা তথা সেই বাড়ির ভদ্রস্থ পরিচারিকা কাতিয়ুশার সাথে, দীর্ঘ ‘লেন্ট’ বা উপবাসের পর মাঝরাতে গ্রিক-রুশি অর্থোডক্স ঘরানার গির্জায় সবার সমবেত হয়ে ইস্টারের গান গাওয়া, কাতিয়ুশার হাতে রংবেরঙের সেদ্ধ ডিমের ঝুড়ি...বহুদিন এই পাঠ অভিজ্ঞতা আমাদের সম্মোহিত করে রাখে। চান্দ্র-সৌর বর্ষপঞ্জির ভিত্তিতে ইস্টারের দিন গণনা করা হয়ে থাকে। ইস্টার পর্বের পান-ভোজনে ডিম খুব গুরুত্বপূর্ণ। ডিমকে মনে করা হয় নবজীবন বা পুনরুত্থানের প্রতীক। যিশুর রক্ত হিসেবে আগে সেদ্ধ ডিমে লাল রঙ করা হতো। এখন লাল রং ছাড়াও নানা রঙে ইস্টার পর্বে সেদ্ধ ডিমের উপরিভাগ অলংকৃত করা হয়। হালে সেদ্ধ ডিমের জায়গায় চকোলেটও গুরুত্ব পাচ্ছে। সবটাই কিন্তু অতীতের কৃষি পর্বের শেষে প্রচুর ভোজের সম্ভার ও প্রোটিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের অন্বেষা।

নওরোজ
পার্সি বা ইরানি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ‘নওরোজ’ হলো ইরানি নববর্ষের প্রথম দিন। ইরান, তুরস্ক, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান বা আফগানিস্থানসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় আরও কিছু নৃতাত্ত্বিক-ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী নওরোজ পালন করে। ৩ হাজার বছর ধরে পশ্চিম এশিয়া, মধ্য এশিয়া, ককেশাস, ব্ল্যাক সি উপত্যকা এবং বলকানে নওরোজ পালিত হয়ে আসছে। পার্সি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস ‘ফারভারদিনে’র প্রথম দিন হলো নওরোজ। সাধারণত প্রতিবছর ২১ মার্চ অথবা তার এক দিন আগে বা পরে নওরোজ পালিত হয়ে থাকে।

নওরোজ একটি পার্সি যৌগিক শব্দ যার ভেতর আছে দুটো শব্দ: নও এবং রোজ। নও অর্থ নব (প্রাচীন পার্সি ভাষায় শব্দটিকে ‘নব’-ই উচ্চারণ করা হতো) শব্দটি প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর ‘নিউয়োস’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ইংরেজিতে এর সতীর্থ শব্দ হলো নিউ, জার্মানে নিউ (বানান ভিন্ন), ল্যাটিনে নভুস, রুশে নভি এবং সংস্কৃতে নব। যদিও আজ এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয়ানরা তাদের ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটি ভোজ অনুষ্ঠানে উদ্যাপন করতেন কি না, তবে শরৎকাল ও বসন্ত—দুটোই প্রাচীন ইরানিরা শস্য কাটা এবং বীজ বপনের সূত্রে পালন করত বলে খোঁজ মেলে ইতিহাসের পাতায়। এভাবেই গড়ে উঠেছিল নববর্ষ পালনের রীতি। মেরি বয়েস ও ফ্রাঞ্জ গ্রেনেট মনে করেন যে ব্যাবিলনীয় সভ্যতার নানা হইচই ও আড়ম্বর উদ্যাপন হয়তো ইরানিদেরও অনুপ্রাণিত করে থাকবে তাদের নিজেদের বসন্ত অনুষ্ঠানকে নতুন বছরের অনুষ্ঠান হিসেবে পালন করার রেওয়াজ গড়ে তুলতে। আকামেনীয় কালপর্বে নওরোজকে বলা হতো নবসারদা (নতুন বছর—সে সময় মধ্য পার্সি ভাষায় নতুন বছরের নাম ছিল এটিই)।

ইসলাম আগমনের পূর্বে ইরানে প্রচলিত প্রধান দুই ধর্ম মিত্র ধর্ম ও জরাথ্রুস্তীয় মতবাদেও নওরোজ অনুষ্ঠানের শিকড় লুকিয়ে রয়েছে। মিত্র ধর্মে সব অনুষ্ঠানেরই গভীর সংযোগ ছিল সূর্যের আলোর সঙ্গে। অতীতে কিংবা বলা চলে মিত্র ও অগ্নি উপাসকদের ধর্মই যখন প্রবল বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তখন মেহরগান (শারদানুষ্ঠান), তিরগান এবং শীতের শুরুতে উদ্যাপিত ‘শেল-ই-জেমেস্তান’—এই প্রতিটি পার্বণেরই শিকড় ছিল সূর্যদেবতার প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনের সূত্রে। পারসিক ধর্মে সাতটি প্রধান অনুষ্ঠানের ভেতর ছিল ছয়টি গাহামবর এবং সবচেয়ে বড় ও পবিত্র অনুষ্ঠান নওরোজ। ষষ্ঠ গাহামবার বা দিনের শেষে, মানে কিনা ইরানি ক্যালেন্ডারে শীতের শেষ ছয় দিনের অন্তিমে বসন্তের প্রথম দিনই নওরোজ হিসেবে পালিত হতো। নওরোজ দিয়ে যে মাসের শুরু, তাকে অতীতে হামাসপথমেদায়া এবং পরে ফ্রাওয়ার্দিনেগান এবং বর্তমানে ফারভারদিগান বা ইরানি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস বলা হয়। আবেস্তায় এই অনুষ্ঠান বা পার্বণগুলোর বিবরণ রয়েছে। দশম শতকের পণ্ডিত বিরুনি তাঁর ‘কিতাব-আল-তাহফিম লি আওয়াইল সিনাত আল-তানজিম’ গ্রন্থে পৃথিবীর নানা জাতির ক্যালেন্ডারের বিবরণ দিয়েছেন। ইরানি ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি গ্রিক, ইহুদি, আরব, স্যাবিয়ানসহ আরও নানা জাতির ক্যালেন্ডারের কথাই তাঁর সে গ্রন্থে বলা হয়েছে। নওরোজ, সাদেহ, তিরগান, মেহগান এবং শীতের শেষ ছয় দিন বা ছয় গাহামবার, ফারভারদিগান বা ইরানি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস, বাহমানজা, এসফান্দ আরমাজসহ আরও বেশ কিছু পার্বণের কথা বলা হয়। প্রাচীন যুগের পার্সিরা বিশ্বাস করত যে নওরোজের দিন গোটা মহাবিশ্ব ঘোরা শুরু করে।

ইরানের সুবিখ্যাত পার্সেপোলিস প্রত্নতাত্ত্বিক নগরে এবং আপাদনা প্রাসাদের পাশে এক শ স্তম্ভবিশিষ্ট যে হলঘর পাওয়া যায়, তা নওরোজের ভোজ উদ্যাপনের জন্যই নির্মিত হয়েছিল। প্রাচীন আকামেনিদ শিলালিপিতে নওরোজের কথা হুবহু খোদিত না থাকলেও পার্সেপোলিস শহরে নওরোজ উদ্যাপনের কথা উল্লেখ করেছেন ঐতিহাসিক শেনোফোন। আকামেনিদ সাম্রাজ্যের এই পার্বণের ধারাবাহিকতার জানা যায়, যখন সাম্রাজ্যের অধীনস্থ বিভিন্ন রাজ্যের নৃপতিগণ ইরানের শাহেনশাহ বা রাজাধিরাজের জন্য নিয়ে আসত নানা উপহার। নওরোজের গুরুত্ব তখন এতটাই ছিল যে ব্যাবিলনের রাজা ক্যাম্বিস দ্বিতীয়ের নিয়োগ কেবল নওরোজ উদ্যাপনে অংশগ্রহণের পরই পোক্ত হয়। ৫৩৯ অব্দে ইহুদিরা ইরানি শাসনের আওতায় এলে উভয় জাতি পরস্পরের রীতি-নীতির সঙ্গে পরিচিত হয়। তবে ইহুদিদের ছিল চান্দ্রেয় বর্ষপঞ্জি আর পার্সিদের ছিল সৌর বর্ষপঞ্জি।

৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইরানে মুসলিম বিজয়ের পরও নওরোজ উদ্যাপন কিন্তু বন্ধ হয়নি। মধ্যশীতে সাদেহ পার্বণ উদ্যাপনের পরই নওরোজের প্রস্তুতি শুরু হতো। তবে কালক্রমে গাহামবের বা মেহরগানের মতো নানা পার্বণের উদ্যাপন কালক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে। আজ শুধু অগ্নি উপাসকেরাই সেই সব পার্বণ পালন করে। আব্বাসীয় যুগেও নওরোজকে প্রধান রাজকীয় পার্বণ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়—মানে পারস্যভূমিতে। বিখ্যাত কবি ওমর খৈয়ামকে উৎসর্গ করা নওরোজনামা বা ‘নববর্ষের গ্রন্থ’ বইটিতে নওরোজ পালনের জ্বলজ্বলে ছবি এভাবে আঁকা হয়: কায় খসরুর সময় থেকে ইয়াজদিগার্দের সময় অবধি ইরাণের প্রাক্-ইসলামি যুগের শেষ রাজার কাল পর্যন্ত, নওরোজের দিন রাজাকে প্রথম দেখতে আসতেন পার্সি ধর্মে এক উচ্চপর্যায়ের মোবাদ বা পুরোহিত। তিনি রাজার জন্য এক পানপাত্রপূর্ণ মদ, একটি আংটি, কিছু স্বর্ণমুদ্রা, বসন্তে ফলা একমুঠো গম, একটি তরবারি এবং একটি ধনুক নিয়ে আসতেন। অতঃপর রাজার জন্য শ্রায়োসা বা বার্তাবাহক দেবদূতের কাছে প্রার্থনা করতেন, যেন রাজা ধনে-মানে-যশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। রাজাকে জামশেদ বা পানপাত্র থেকে অমরত্ব পান করার আহ্বান জানাতেন।

খিলাফতের অবসানের পর পুনরায় সামানিদ বা ব্যুয়িদের মতো ইরানি রাজবংশের পুনরভ্যুদয়ের পর নওরোজ পালন আরও গুরুত্ব পায়। ব্যুয়িদরা খিলাফত যুগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা প্রাচীন পার্সি আরও কিছু অনুষ্ঠানের উদ্যাপন ফিরিয়ে আনে। ব্যুয়িদ সম্রাট আজোদ-উদ-দৌলার সময়ে (৯৪৯-৮৩ খ্রিষ্টাব্দ) রাজা প্রাসাদের বড় হলঘরে নওরোজ পালন করতেন। সোনা ও রুপার থালায় ভৃত্যরা রেখে যেত নানা রকম ফল এবং নানা রঙের ফুল। রাজা মসনদে বসার পর রাজজ্যোতিষী এসে ভূমিতে চুম্বন করে রাজাকে দিতেন নতুন বছরের বার্তা। পরবর্তী সময়ে তুর্কি বা মঙ্গোলরা এসেও নওরোজ পালনে কোনো বাধা দেয়নি। নওরোজ আজও ইরানের বৃহত্তম অনুষ্ঠান, ‘ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা’ নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ অবধি শুধু ইরানেই নওরোজ পালিত হতো। বর্তমানে ককেশাস এবং মধ্য এশীয় দেশগুলোতেও নওরোজ জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। ২০১০ সালে ইউনেসকো নওরোজকে ‘মানব সভ্যতার অমূল্য ভাবসম্পদ ও ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে।
আজকের ইরানেও নওরোজ আসার কয়েক দিন আগে থেকেই ‘খানে তেকানি’ বা ঘর পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়। সবাই নতুন জামাকাপড় কেনে। তবে নববর্ষের উদ্যাপনের মূল আয়োজন হলো ন্যূনতম সামর্থ্যসম্পন্ন প্রতিটি ইরানি পরিবারে ‘হপ্ত সিন’ বা ‘সপ্ত বস্তু’ সাজানোর একটি প্রথা। অতীত যুগে মহাবিশ্বের সাতটি সৃষ্টি এবং সেই সাত সৃষ্টিকে নিরাপত্তা দানরত সাত অমর সত্ত্বার প্রতীক হিসেবে এই ‘হপ্ত সিনে’র আয়োজন থাকত। এখন অবশ্যই সাতটি উপাদান ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তিত হয়েছে। তবু বর্তমান যুগেও টেবিল সাজানোর এই সাত উপাদানের প্রতিটি উপাদানের আদ্যাক্ষরকে হতে হবে ‘স’। এই সাত উপাদান হলো: সিব (আপেল), সবজে (সবুজ ঘাস), সেরকে (ভিনেগার), সামানু (গমের তৈরি একধরনের খাবার), সেঞ্জেদ (একটি বিশেষ জাতের বেরি ফল), সেক্কে (মুদ্রা) এবং সির (রসুন) বা সোমাঘ (একধরনের ইরানি মশলা)। গম বা ডালের দানা একটি পাত্রে জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। নতুন অঙ্কুর যখন ১৩ দিনে পদার্পণ করে, তখন এই সবজে (সবুজ, নতুন অঙ্কুর) জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। তার আগে নানা রঙিন ফিতায় তাকে বেঁধে রাখা হয়। এই ১৩তম দিনকে বলা হয় সিজদাহ বেহ দার। কিছু গোল্ড ফিশ সাজিয়ে রাখা হয় একটি অ্যাকুয়ারিয়ামে। অতীতে এই সোনালি মাছ পরে আবার নদীতে ছেড়ে দেওয়া হতো। কিন্তু আজকাল মানুষ বাসায় রেখে দেয়। জাফর পানাহির ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ সিনেমাটি নিশ্চিত মনে আছে? ওই যে সিনেমাটি শুরুই হয় দুই ছোটো ভাই-বোনের নওরোজ পালনের প্রস্তুতি দিয়ে? ঘর সাজানো, গোল্ড ফিশ কিনলেও রাস্তায় পড়ে যাওয়া আর খুঁজতে গিয়ে প্রাণান্ত হওয়া? অনেকে ঘরের ভেতর কোরআন আবার কেউ কেউ দিওয়ান-ই-হাফিজ বা শাহনামা সাজিয়ে রাখেন। সাল তাহভিল বা নওরোজ শুরু হবার মুহূর্তটিতে অনেকেই কবিতা পড়েন। সাল তাহভিল বা নওরোজ শুরু হবার মুহূর্ত পার হবার পর ইরানিরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে এবং চুম্বন করে, একে অপরকে নানা উপহার দেয় (সাধারণত টাকা, মুদ্রা বা সোনার মুদ্রা)। বড়রাই সাধারণত ছোটদের উপহার দিয়ে থাকেন। ১৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের প্রথম কদিন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের বাসায় ঘোরা হয়। বাচ্চারা নানা রকম মিষ্টি ও ‘আজিল’ (বিভিন্ন ধরনের বাদাম ও মিষ্টি দিয়ে বানানো) এবং ফল উপহার পায়। নওরোজের আগের রাতে ‘সবজি পোলাও মাহি (মাছ ও সবজি মেশানো পোলাও)’ রান্না করা হয়।

পয়লা বৈশাখ
আমাদের পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ সম্পর্কে ইতিহাসের একটি মত বলছে ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ বা ১৪ এপ্রিল গৌড়ের নৃপতি শশাঙ্ক প্রথম ‘বঙ্গাব্দ’ শুরু করেন। এই সাল গণনা একটি সংস্কৃত জ্যোতির্বিজ্ঞান গ্রন্থ ‘সূর্য সিদ্ধান্তে’র ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। আরেকটি মত বলছে আলাউদ্দিন হুসেইন শাহ (১৪৯৪-১৫১৯) বাংলা ও আসাম অঞ্চলে প্রচলিত সৌর ক্যালেন্ডারের সঙ্গে ইসলামি চান্দ্রেয় ক্যালেন্ডার যুক্ত করে নতুন বাংলা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। এই দুই মত নিয়ে মতদ্বৈধতা থাকলেও ইদানীং এটিই সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত হচ্ছে যে মুঘল সমাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫) খাজনা আদায় সহজতর করার জন্য বর্তমান বাংলা ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। আকবর প্রবর্তিত এই ক্যালেন্ডারকে সে সময় বলা হতো ‘তারিখ-ই-ইলাহি।’ এ দেশে মুসলিম শাসকদের সঙ্গে আসা ইসলামি চান্দ্রেয় ক্যালেন্ডারের সঙ্গে স্থানীয় কৃষকদের অনুসরণ করা সৌর ক্যালেন্ডারের প্রায়ই সংঘর্ষ হতো। সংঘর্ষ হতো মাস ও দিনের হিসাবে। ফলে ফসল কাটার সময় ও খাজনার হিসাব নিয়েও বেশ মুশকিল হতো। কাজেই ইহজাগতিক ও বাস্তববাদী সম্রাট আকবরের নির্দেশে তাঁর অর্থমন্ত্রী টোডর মল ক্যালেন্ডার সংস্কারের উদ্যোগ নেন। আকবরের রাজসভার জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতুল্লা সিরাজি পুনরায় ইসলামি চান্দ্রেয় ক্যালেন্ডার ও হিন্দু সৌর ক্যালেন্ডারের একটি সংশ্লেষণ করেন, যার বলে চান্দ্রেয় মাসের বদলে সৌর ও চান্দ্রবর্ষের মিলন মুহূর্তে নতুন ক্যালেন্ডারে বর্ষ গণনা শুরু হয়। এই ক্যালেন্ডারেরই নাম দেওয়া হলো ‘ফসলি সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ।’ ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ অথবা ৯৯২ হিজরি থেকে প্রকৃতপক্ষে এই পঞ্জিকা শুরু হলেও নয়া পঞ্জিকায় রেট্রোস্পেক্টিভ ইফেক্টে ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ বা ৯৬৩ হিজরি থেকেই বর্ষগণনা শুরু হয়। ৯৬৩ হিজরি সালের মহররম বাংলা ক্যালেন্ডারের বৈশাখের সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছিল এবং এভাবেই বৈশাখ বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। আকবর প্রবর্তিত ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ পঞ্জিকায় প্রতিটি মাসের আলাদা আলাদা নাম ছিল, যা আজকের প্রচলিত নামগুলো থেকে ভিন্ন। আকবরের পৌত্র শাজাহান সাত দিনে এক সপ্তাহ প্রচলন করতে পঞ্জিকার আরও কিছু সংস্কার করেন এবং প্রতি রোববার থেকে সপ্তাহ গণনা শুরু হতো। পরে ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ ক্যালেন্ডারে প্রচলিত মাসের নামগুলো এই অঞ্চলে প্রচলিত শক পঞ্জিকার সাথে মেলাতে মাসগুলোর নাম বদলে দেওয়া হয়। নাম বদলানোর এই সময়টির সঠিক দিন-ক্ষণ জানা যায় না। বাংলা পঞ্জিকা/ক্যালেন্ডারের ১২টি মাসের নাম ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ পঞ্জিকা থেকে নক্ষত্রগুলোর নামে নেওয়া। তবে এই নক্ষত্রগুলোর সঙ্গে চাঁদের অবস্থানগত গণনার ভিত্তিতে এই ১২ মাসের নামকরণ। বিশাখা নক্ষত্রের নামে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা নক্ষত্রের নামে জ্যৈষ্ঠ, উত্তরাষাঢ়ার নামে আষাঢ়, শ্রবণার নামে শ্রাবণ, পূর্বভাদ্রপদের নামে ভাদ্র, অশ্বিনীর নামে আশ্বিন, কৃত্তিকার নামে কার্তিক, মৃগশিরা নক্ষত্রের সাথে চাঁদের অবস্থানের প্রেক্ষিতে অগ্রহায়ণ, পুষ্যার নামে পৌষ, মঘার নামে মাঘ, উত্তরফাল্গুনীর নামে ফাল্গুন এবং চিত্রা তারার নামে চৈত্র। ১৫৮৪ সালে আকবর প্রবর্তিত ‘তারিখ-ই-ইলাহি’ পঞ্জিকায় মাসগুলোর নাম ছিল কারওয়ারদিন, আর্দি, খোরদাদ, তির, আমারদাদ, শাহারিয়ার, ভিহিসু, আবান, আজার, দে, বাহমান ও ইসফান্দা মিজ। বাংলা পঞ্জিকায় সাত দিনে এক সপ্তাহ এবং প্রতিদিনের নামই একটি না একটি গ্রহ বা ‘নবগ্রহে’র নামে হয়ে থাকে। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডাারের মতো মাঝরাতের বদলে আমাদের পঞ্জিকায় সূর্যোদয়ের সঙ্গেই নতুন দিনের সূচনা।

তবে একদমই সাম্প্রতিকতম সময়ে আকবরই আমাদের আজকের বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রণেতা কিনা, সেটা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। যেমন ওপার বাংলার স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী নামে এক তরুণ আইনজ্ঞ গত বছর এবং এ বছরও সোশ্যাল নেটওয়ার্কে তাঁর একাধিক লেখায় মূল পারসি ভাষায় ‘আইন-ই-আকবরি’র ই-বুকের স্ক্রিনশট তুলে দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে আকবরের রাজসভায় লিখিত ‘আকবরনামা’ বা আইন-ই-আকবরির কোনো অংশেই বাংলার জন্য আলাদা বছর চালুর কথা লেখা নেই। এমনকি খুব পরিষ্কার ভাষায় আইন-ই-আকবরিতে লেখা রয়েছে যে আকবর একটিই বর্ষ চালু করেন, যার নাম ‘তারিখ-ই-ইলাহি’! এই তারিখ-ই-ইলাহিও কিন্তু আরবের হিজরি সালের গণনা অনুযায়ী তৈরি হয়নি। কারণ, আকবর হিজরি সন পছন্দ করতেন না। সে জন্যই আকবর প্রবর্তিত তারিখ-ই-ইলাহি তৈরি হয় ‘মালিকি সাল’-এর গণনা পদ্ধতির সঙ্গে মিলিয়ে। এ ছাড়া আইন-ই-আকবরিতে আরও লেখা রয়েছে, তারিখ-ই-ইলাহির প্রথম বছর সেটাই, যে বছর আকবর সিংহাসনে বসেন। অর্থাৎ ইংরেজি ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দই হলো তারিখ-ই-ইলাহির প্রথম বছর। অর্থাৎ ইংরেজির ২০২০ খ্রিস্টাব্দে হবে তারিখ-ই-ইলাহি (২০২০-১৫৫৬) ৪৬৪ অব্দ। অথচ এ বছর পূর্ণ হবে ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। আকবর যদি তারিখ-ই-ইলাহি ও ‘বঙ্গাব্দ’—এই দুটোই চালু করে থাকেন, তাহলে বর্ষের সংখ্যাতে মিল থাকা অবশ্যই উচিত ছিল। আরও আশ্চর্যের বিষয়, তারিখ-ই-ইলাহির মাসের নামের সঙ্গেও বাংলা বছরের মাসের নামের কোনো মিল নেই, যেটা এই লেখার ওপরাংশে আমি উইকিপিডিয়ার ভিত্তিতে অনুবাদ করে ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি। ওপারের মেয়ে স্মৃতিলেখা যেটা বলতে চাইছেন যে বাংলার বাইরে ভারতের অন্য রাজ্যগুলোতেও হালের ইংরেজি বা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বাদে প্রচলিত বা ঐতিহ্যবাহী পঞ্জিকাতে প্রথম মাসের নাম এক—বৈশাখ।
স্মৃতিলেখা আরও বলেন যে ‘আকবর নিজের সাম্রাজ্যকে ১২টি সুবায় (রাজ্য) ভাগ করেন। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাকে নিয়ে তৈরি হয় সুবা-ই-বাঙ্গাল। যদি ধরেও নিই, আকবর শুধু বাংলার জন্যই বঙ্গাব্দ বানান, তাহলেও সেটা হবে সুবা-ই-বাঙ্গালের জন্য। অর্থাৎ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার জন্য। বিহার বা উড়িষ্যাতে বঙ্গাব্দের প্রচলন আছে বা ছিল, এ রকম অদ্ভুত কথা কেউ কখনো শুনেছেন? অতএব তারিখ-ই-ইলাহি ও বঙ্গাব্দের মাসের নাম, গণনা পদ্ধতি, কততম সাল—এসবে কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বরং বিপক্ষে প্রমাণই মিলছে।’

এই বক্তব্যের অর্থ ভারত উপমহাদেশের সবচেয়ে সহনশীল, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের অন্যতম মহামতি আকবরের চারিত্র্যের ইহজাগতিকতা এবং তাঁর নানাবিধ প্রশাসনিক সাফল্যকে একেবারেই ছোট করা নয়। অমর্ত্য সেন তো প্রমাণ করেই দিয়েছেন যে অশোক ও আকবরের সময় ভারতের যে জিডিপি ছিল, সেটা আর পরবর্তী সময়ে কখনোই ইতিহাসে হয়নি। কিন্তু আজকের বাংলা বর্ষপঞ্জির মূল শিকড় সংস্কৃত সৌর বর্ষপঞ্জিতে কি না, যা পরে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস বা কম্বোডিয়া অবধি ছড়িয়েছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। বাংলার পয়লা বৈশাখের এই একই উৎসব কেরালায় বিশু, তামিলনাড়ুতে পুথাণ্ডু আর মধ্য ও উত্তর ভারতে বৈশাখী নামে পরিচিত। আসামে এই উৎসবকেই রঙ্গালি বিহু, নেপালে বিক্রম সম্বৎ, উড়িষ্যায় বিষুব সংক্রান্তি, থাইল্যান্ডে সংক্রান, কাম্পুচিয়ায় চোল চনম থিমে, লাওসে সংকান ও বার্মায় থিংগ্যান নামে পরিচিত। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা-মারমা-ত্রিপুরারা ‘বৈসাবি’ উৎসব হিসেবে পালন করে। গোটা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ দেশগুলোতেও একই সময়ে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়। আমাদের পাবর্ত্য চট্টগ্রাম থেকে গোটা বৌদ্ধ বলয়ে সাত দিন ধরে সব ঘরবাড়ি জলে ধুয়ে, কয়েক দিন ধরেই জলকেলি অনুষ্ঠান বা এ ওকে পানি ছুড়ে খেলার যে বিপুল আয়োজন, তার সময় বা দিন-ক্ষণও আমাদের ‘সংক্রান্তি’ বা ‘বৈশাখে’র শুরুর সঙ্গে মিলে যায়। সব গ্লানি, সব জরা মুছে ফেলার এই বিপুল আয়োজন, আহারে বা পঞ্চ ব্যঞ্জনে নানা রকমের তিতা পদ দিয়ে শুরু করে মিষ্টি মুখ দিয়ে শেষের রীতিও যেন ইসরায়েল থেকে বাংলা পর্যন্ত এক ও অভিন্ন। কোথাও সে পাসওভার, কোথাও ইস্টার, কোথাও ঈদ-ই-নওরোজ আবার কোথাও সংক্রান্তি বা বৈশাখ। আজ গোটা বিশ্বের এক বিপর্যয়ের ভেতর এই সব আয়োজন থমকে গেলেও নিশ্চিত আমরা দ্রুতই কাটিয়ে উঠব এই সংক্রমণ। আবার মিলব বা মিলতে পারব লক্ষ প্রাণের আয়োজনে।