এই সঙ্গনিরোধকালে

বাইরে বেরোচ্ছি না বেশ কিছুদিন ধরে। বলা ভালো, বেরোতে পারছি না। করোনা নামের এক অদ্ভুত অচেনা শত্রু আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়েছে আমাদের জীবনে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে বিশ্বজুড়ে। অসম যুদ্ধ। কারণ, শত্রুপক্ষ মারাত্মক শক্তিশালী, কিন্তু আমরা তাকে চিনি না। পাশাপাশি এ যুদ্ধের বাস্তবতায় নতুন নতুন সব শব্দ ঢুকে পড়ছে আমাদের নিত্যদিনের অভিধানে—করোনা, কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, লকডাউন ইত্যাদি। কোনো দিন যেসব শব্দ শুনিওনি, সেগুলো এসে এখন দখল করে নিয়েছে আমাদের, শুধু শব্দই নয় শব্দ-সংশ্লিষ্ট ঘটনার অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। অভূতপূর্ব সেই অভিজ্ঞতা। 

বাংলাদেশেও লকডাউন শুরু হওয়ার পর (যদিও শব্দটি বলা হচ্ছে না) দিনগুলোও যেন অন্য রকম হয়ে গেছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কোলাহল নেই, নীরব-নির্জন হয়ে আছে সবকিছু। জানালা দিয়ে বা ব্যালকনি থেকে যত দূর দেখা যায়, দেখি, জনমানুষের চিহ্ন নেই কোথাও। নেই যানবাহনের শব্দ, ফেরিওয়ালার হাঁক, মানুষের হাসি। যেন এক মৃত নগরী, কিংবা কোনো এক জনমানবহীন শহরের স্থির চিত্র, যেন বহুকাল আগেই এখান থেকে মানুষের পদচারণা শেষ হয়ে গেছে। কেবল ভরদুপুরেও একটা কুকুরের করুণ কান্নার শব্দ শুনে ভেবেছি, কোথাও যেন অকল্যাণের আভাস পেয়েছে সে। মা বলতেন, যুদ্ধের সময়, দুর্ভিক্ষের সময় কুকুর এভাবে কাঁদত। দেখছি, পোষা বেড়ালটি, যে কিনা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে দুরন্ত সদস্য, সারাক্ষণ কোনো না কোনো দুষ্টুমিতে আর খেলাধুলায় আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখে, এখন ঝিম মেরে শুয়ে থাকছে। যেন খুব মন খারাপ তার, যেন সে–ও পেয়ে গেছে মানুষের দুঃসময়ের বার্তা। 

এই শহরেই তো কাটল আমার প্রায় পুরোটা জীবন, কখনো তো এমন দেখিনি! 

এই সব দেখতে দেখতে কত কথা মনে হতে থাকে! মনে হয়, এই যে একটা ভাইরাসের দাপটে বন্দী হয়ে পড়ল মানুষ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো মানতে শুরু করল অক্ষরে অক্ষরে, এগুলোকে কি কেবলই অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ বলে ভাবব, নাকি অন্য কোনো অর্থ আছে এর? গত কয়েক দশকে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাপনে যে অকল্পনীয় পরিবর্তন এসেছে, তার কথা ভাবুন। সবাই ব্যস্ত, সবাই দৌড়াচ্ছে, সবারই খুব তাড়া—যদিও কোথায় যে পৌঁছাতে চায়, সে সম্বন্ধে কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই তাদের। একটা যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে সবাই, যে জীবনে অনেক প্রতিযোগিতা, অনেক স্বার্থপরতা। সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে চাইছে মানুষ ব্যগ্রভাবে, যদিও জানে না ওখানে কী আছে, কিসের জন্য এই অধীর প্রচেষ্টা। কোনো সহমর্মিতা নেই কোথাও। শুধু কি তা–ই? এত প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকতে থাকতে আর অবিরাম দৌড়ানোর ফলে নিজের স্বজন-প্রিয়জনদের দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও পাচ্ছে না তারা। ভুলেই গেছে প্রিয়জনের মুখ। এই কোয়ারেন্টিন, এই ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতা মানুষকে সুযোগ করে দিয়েছে নিজের স্বজনদের দিকে তাকানোর। তাকিয়ে দেখছে, আহা শিশুটির মুখ কী মায়াভরা, মায়ের মুখটি কী পবিত্র, সঙ্গীর মুখটি কী প্রেমময়!

এ–ও ভাবছি যে এমন কি হতে পারে, এই করোনাভাইরাস আসলে প্রকৃতিরই কোনো পরিকল্পনার অংশ? প্রকৃতি যে অপূর্ব বৈচিত্র্য আর ভারসাম্য তৈরি করেছিল তার বিবিধ সৃষ্টি দিয়ে, ভয়ংকর আগ্রাসী ভঙ্গিতে আমরা তা ধ্বংস করে ফেলেছি। চেয়েছি প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে, নিজেদের ইচ্ছেমতো তাকে কাজে লাগাতে। এসব করতে গিয়ে আমরা দূষিত করেছি মাটি-পানি-বাতাস—সব, তাড়িয়ে দিয়েছি অন্য প্রাণীদের। বুঝতেই চাইনি, এই গ্রহে মানুষের যতটুকু অধিকার, ঠিক ততটুকুই অধিকার নিসর্গের প্রতিটি প্রাণী ও বৃক্ষের। এমনকি একটি পতঙ্গেরও আছে অবাধ বিচরণের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার। এসব বুঝতে চাইনি বলেই কি মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে তাদের ঘরে বন্দী করার ব্যবস্থা করেছে প্রকৃতি, আর এই অবসরে মানুষের তৈরি করা যাবতীয় দূষণগুলো মেরামত করে নিচ্ছে সে? লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই, বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণ কমছে, কমছে জলের দূষণও, শব্দদূষণ তো নেই-ই বলতে গেলে; এবং ফিরে আসছে প্রাণ-প্রকৃতির স্বাভাবিক রূপ!

প্রকৃতি এবার নিজের আধিপত্য দেখিয়ে দিচ্ছে, অবাধ্য মানুষকে বন্দী করে নিসর্গকে সাজিয়ে নিচ্ছে নতুন করে, সাজানো শেষ হলে করোনাকে সে ফিরিয়ে নেবে, মানুষও ফিরে পাবে তার ‘মুক্ত জীবন’—এমন কি হতে পারে না? এই সব এলোমেলো ভাবনা আসে, এই সঙ্গনিরোধকালে।