সত্যিকারের ম্যাজিক!

বাড়ির পাশেই ভিক্টোরিয়া পার্ক, বিকেল হলেই সেখানে ক্যানভাসাররা আসে, ম্যাজিশিয়ানরা জাদু দেখায়। শীতের এক পড়ন্ত বিকেলের কথা আমি কখনো ভুলব না। পাড়ার বন্ধু ইকবালকে নিয়ে জাদু দেখার আশায় গিয়েছিলাম সেখানে। ছিপছিপে শরীরের এক ম্যাজিশিয়ান জাদুর সরঞ্জামের স্যুটকেস আর পিচ্চি এক চ্যালা নিয়ে মাত্র এসেছে। এর আগে কিংবা পরে কখনো তাকে দেখিনি। লোকজনের জমায়েত ভারী হলেই শুরু করবে তার তেলেসমাতি। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও ভিড় বাড়ল না, স্যুটকেসের ওপর বসে হাই তুলল ম্যাজিশিয়ান।

‘একটা ম্যাজিক দেখান না’, অস্থির হয়ে বলল ইকবাল।

‘আরও মানুষ আসুক...’, জবাব দিল ম্যাজিশিয়ান।

১০ মিনিট পর আবারও ইকবালের তাড়া। বয়সের তুলনায় তার কথাবার্তা একটু বেশি মারমুখী, ‘আমরা এই এলাকার পোলা, আমাগো কথা না হুনলে খবর আছে! কাইল থিকা বইতে দিমু না।’

১২ বছরের ছেলের কাছ থেকে হুমকি পেয়ে উঠে দাঁড়াল ম্যাজিশিয়ান, ফুলহাতা শার্টের হাতা গোটাল। ভাবলাম, রেগেমেগে চড়ই মারবে বুঝি।

‘কী জাদু দেখবে?’ কাছে এসে জানতে চাইল সে। সুন্দর করে কথা বলে লোকটা।

‘জীবনে দেখি নাই এই রকম একটা জাদু দেখান’, একটুও ভড়কে না গিয়ে বলল ইকবাল।

মুচকি হাসল ম্যাজিশিয়ান। তার বেশভূষায় দারিদ্র্যের ছাপ থাকলেও ভাবভঙ্গি খুবই অভিজাত।

‘এই ভিক্টোরিয়া পার্কটা ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছ?’ ইতিবাচক জবাব পেয়ে পার্কের দক্ষিণ দিকে সবচেয়ে পুরোনো ফটোগ্রাফির স্টুডিওটা দেখিয়ে বলল, ‘মিউজিক্যাল মার্টটা...?’

‘কইলাম তো সব দেখবার পারতাছি।’

বাঁকা হাসি দিল ম্যাজিশিয়ান, ‘যা দেখছ সবকিছু চোখের নিমেষে উধাও করে দিতে পারব আমি!’

‘এহ্! কইলো আর কী! এত্ত সোজা?’

ম্যাজিশিয়ানের চ্যালাটা আমাদের বয়সীই। সে রাস্তার ওপরে বসে আছে গালে দুই হাত ঠেকিয়ে।

ইকবালের দিকে স্থির চোখে চেয়ে থেকেই আদেশের সুরে বলল ম্যাজিশিয়ান, ‘চোখ বন্ধ করো।’

তাই করল আমার বন্ধু। তারপরও ম্যাজিশিয়ান পেছন থেকে তার চোখ দুটো দুই হাতে চেপে ধরল। ইকবাল যে চালাকি করে পুরোপুরি চোখ বন্ধ করবে না, সেটা আমিও আন্দাজ করেছিলাম।

‘এখন কিছু দেখতে পাচ্ছ?’ জানতে চাইল ম্যাজিশিয়ান।

‘না।’

‘ভিক্টোরিয়া পার্ক, মিউজিক্যাল মার্ট...?’

‘না। কিচ্ছু দেখবার পারতাছি না।’

‘গুড।’ তারপরই ইকবালের চোখের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিল, ‘এখন দেখতে পাচ্ছ?”

‘না, পারতাছি না তো।’

‘চোখ খোল। এবার দেখতে পাচ্ছ?’

আমার বন্ধু একটু ভিরমি খেয়ে তাকাল চারদিকে, ‘হ, দেখবার পারতাছি তো!’

‘বলেছিলাম না, চোখের নিমেষে সবকিছু উধাও করে দেব’, বলেই ম্যাজিশিয়ান আবার ফিরে গেল তার স্যুটকেসের কাছে।

প্রতারিত হয়ে রেগেমেগে একাকার ইকবাল, ‘হালায় ভুয়া! ম্যাজিক-ফ্যাজিক কিচ্ছু পারে না, মানুষ ঠকায়া খায়।’

এ কথা শুনে ফিরে তাকাল ম্যাজিশিয়ান। শক্ত হয়ে গেল তার চোয়াল। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এল ইকবালের কাছে। এবার নির্ঘাত চড় দেবে। কিন্তু এ রকম কিছু না করে সে জানতে চাইল, ‘তুমি ছেলে না মেয়ে?’

‘ছেলে!’ জোর গলায় বলল ইকবাল।

‘শিওর?’ ভুরু কুঁচকে ফেলল ম্যাজিশিয়ান।

‘পুরা শিওর!’ দৃঢ়তার সঙ্গে জানাল সে।

অমনি আমাদের দুজনকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে ম্যাজিশিয়ান এক ঝটকায় ইকবালের হাফপ্যান্টটা টেনে নামিয়ে দিল হাঁটু পর্যন্ত। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভড়কে গিয়েছিলাম আমরা। তারপর সংবিৎ ফিরে পেতেই ইকবালের মতো আমিও আবিষ্কার করলাম, সে মোটেও ছেলে নয়!

‘ও মা-গো!’ আর্তচিৎকার দিয়ে উঠল বেচারা, প্যান্টটা টেনে তুলে কাঁদতে কাঁদতে দৌড় দিল মহল্লার দিকে।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। নির্বিকার ম্যাজিশিয়ান আবারও তার স্যুটকেসের ওপরে গিয়ে বসল। ভীরু পায়ে আমিও চলে এলাম মহল্লায়। কী করে সম্ভব হলো এটা! 

মহল্লায় এসে দেখি ইকবাল তাদের বাড়ির গেটের সামনে বসে চোখ মুছছে। আমি কিছু বলার আগেই বলে উঠল সে, ‘পুরা বেলাফ মারছে! আমি মাইয়া না...দ্যাখ!’ বলেই হাফপ্যান্টের জিপার খুলে প্রমাণটা দেখাল। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমিও।

পরবর্তীকালে ম্যাজিকের কলাকৌশল ধরাটা আমার শখের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটু মাথা খাটিয়েই বিশ্বের বড় বড় ম্যাজিকের কৌশল বের করতে পারতাম। ডেভিড কপারফিল্ডের স্ট্যাচু অব লিবার্টি উধাও করে দেওয়ার কৌশলটা ধরতে মাত্র ১০ মিনিট লেগেছিল আমার। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই ম্যাজিশিয়ানের ট্রিকটা আমি ধরতে পারিনি!

মাঝেমধ্যে ভাবি, সত্যি কি ম্যাজিক বলে কিছু আছে? সত্যিকারের ম্যাজিক!