দুনিয়া কাঁপানো কোভিড-১৯

স্লাভোয় জিজেক
স্লাভোয় জিজেক
মহামারী করোনা যখন উজাড় করছে নগর, জনপদ- বিশ্ব, মানব জাতির ঘোরতর এ সঙ্কটকাল মহামতি স্লোভেনিয়া দার্শনিক স্লাভয় জিজেক ছাড়া আর কে তার চুলচেরা, গভীর বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারে, কে পারবে করোনা পরবর্তী নতুন বিশ্বের চেহারা কেমন হবে তা অনুধাবনে -স্লাভয় জিজেক। জানতে হলে পড়ুন তার সদ্য প্রকাশিত বই প্যানডেমিক। শুরু হল নতুন ধারাবাহিক...

লেখকের উৎসর্গ

মাইকেল সরকিন—আমি জানি ওঁ আর আমাদের সঙ্গে নেই, কিন্তু এটা আমি বিশ্বাস করি না।

প্রবেশিকা

নলি মে টানজেরে(ক)

‘আমাকে ছুঁয়ো না’, জন (২০:১৭) বর্ণিত বয়ানে দেখা যায়, যিশুর পুনরুত্থানের পর মেরি ম্যাগডালিন যখন তাঁকে চিনতে পারেন, তখন যিশু ওই কথাটি মেরিকে বলছেন। একজন স্বীকৃত খ্রিষ্টান নাস্তিক হিসেবে এই কথার মাজেজা কী আমার কাছে? প্রথমত, আমি এই কথাকে শিষ্যের জিজ্ঞাস্য যে তিনি আদৌ ফিরে এসেছেন কি না, পুনরুত্থান ঘটেছে কি না, তার বিপরীতে খ্রিষ্টের জবাব হিসেবে দেখি। খ্রিষ্ট বলেন, বিশ্বাসীদের মধ্যে যখনই ভালোবাসা থাকবে, তখনই সেখানে তিনি বিরাজ করবেন। ধরাছোঁয়ার ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং ভালোবাসার বন্ধন ও ভক্তদের সংহতি হয়ে তিনি থাকবেন—কাজেই, ‘আমাকে ছুঁয়ো না, বরং ভালোবাসার শক্তি দিয়ে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে যাও, স্পর্শ করো।’

যাহোক, বর্তমানে আমরা করোনাভাইরাস মহামারির মাঝখানে রয়েছি, আর আমাদের উপর্যুপরি বলা হচ্ছে, অন্যদের যেন স্পর্শ না করি, এবং নিজেরা যেন আলাদা থাকি, তাতে ঠিকঠাকভাবে শারীরিক দূরত্ব রক্ষা হবে। তো এর সঙ্গে ‘আমাকে ছুঁয়ো না’ হুকুমের কী সম্পর্ক? হাত অন্যদের ছুঁতে পারবে না; আমরা কেবল ভেতরে ভেতরেই একে অন্যের কাছে পৌঁছাতে পারব—আর ‘ভেতরে’র সম্মুখ জানালা আমাদের চোখ। আজকাল, যখন আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ (বা কোনো আগন্তুক) কারও দেখা হয় এবং উচিত দূরত্ব মেনে দাঁড়াতে হয়, তখন অপরের চোখে গভীরভাবে দেখলে অন্তরঙ্গ স্পর্শের চেয়েও বেশি কিছু উন্মোচিত হয়ে পড়ে। নিজের তারুণ্যের কালে হেগেল লিখেছিলেন:

আপনজন আমাদের বিপরীতে নয়, সে আমাদের সত্তার ভেতরেই থাকে; আমরা তার ভেতর কেবল আমাদের দেখতে পাই, কিন্তু সে আর আমরা নই—এ এক ধাঁধা, বিস্ময় (ein Wunder), যা আমরা ধরতে পারি না।

এখানকার দুই রকম দাবিকে বৈপরীত্য হিসেবে না পড়াটাই শ্রেয়, এখানে আপনজন যেন আংশিকভাবে ‘আমরা’, আমারই অংশ, আর আংশিক ধাঁধা। এই যে ভালোবাসার বিস্ময়, তুমি আমার অস্তিত্বের অংশ অবিকল, তারপরও অধরা, বিস্ময় হয়ে থাকো, এ শুদ্ধ আমার জন্যই নয়, তোমার নিজের জন্যও কি এহ ধাঁধা নয়? হেগেলের আরেকটি চেনাজানা আলোচনা যদি উদ্ধার করি:

এই রাত, এই শূন্য অবস্তুই মানবসত্তা, যা সবকিছুই ধারণ করে এর সরলতার ভেতর—এই যে কত প্রতিরূপ (ইমেজ), রূপায়ণের (রেপ্রিজেন্টেশন) অশেষ সম্পদ, যার কিছুই তার নয়—অথবা যার কোনো কিছুই বর্তমান নয়। যদি কেউ মানবসত্তার চোখের দিকে তাকায় তো সে এই রাত্রির দৃশ্য দেখতে পারে।

কোনো করোনাভাইরাস এটাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। সুতরাং আশা আছে, এই শারীরিক দূরত্বই অন্যদের সঙ্গে আমাদের সংযোগের তীব্রতাকে আরও শক্তিশালী করবে। যদিও এখনকার জন্য যারা আমার কাছের, যাদের উপস্থিতি ও গুরুত্ব আমার অভিজ্ঞতালব্ধ, তাদের এড়িয়ে চলতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে অনেক ছিদ্রান্বেষী লোকের হাসি আমি শুনতে পাই: ঠিক আছে, আমরা হয় তো আধ্যাত্মিকভাবে কাছাকাছি আসার কিছু মুহূর্ত পাব, কিন্তু তাতে করে এই ঘটমান বিপর্যয়ে কী উপকার হবে? সেখান থেকে আমরা কি কিছু শিখতে পারব?

হেগেল লিখেছিলেন, ইতিহাস থেকে আমরা বিশুদ্ধ শিখতে পারি যে ইতিহাস থেকে আমরা কিছুই শিখি না, কাজেই এই মহামারি আমাদের জ্ঞানী করে তুলবে, তাতে আমার সন্দেহ আছে। একটা বিষয় পরিষ্কার, এই ভাইরাস আমাদের জীবনের ভিত নাড়িয়ে দেবে, শারীরিক ভোগান্তির কারণে শুধু নয়, অর্থনৈতিকভাবে যে ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা হবে মহামন্দার চেয়েও খারাপ। স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার কোনো পথ এখন আর খোলা নেই, নতুন ‘স্বাভাবিক’ নির্মাণ হবে আমাদের পুরোনো জীবনের ধ্বংসস্তূপের ওপর, অথবা আমরা নিজেদের এক নতুন বর্বরতার ভেতর আবিষ্কার করব, যার চিহ্ন এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবার বিন্যাসে সামান্য কিছু পরিবর্তন এনে, এর পরিণাম থেকে নিস্তার পেতে ও কাজকারবারকে আগের মতো মসৃণ অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে মহামারিটিকে শুধু দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করলে চলবে না। আমাদের মূল প্রশ্ন উত্থাপন করতে হবে: আমাদের ব্যবস্থায় কী ত্রুটি আছে, যাতে বিগত বছরগুলোতে বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও এই বিপর্যায়ে আমরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম?

আমরা এখন একই নৌকায়

লি ওয়েনলিয়াং, যে চিকিৎসক প্রথম আবিষ্কার করেন করোনাভাইরাস মহামারির রূপ নিতে যাচ্ছে এবং সেটা বলে কর্তৃপক্ষের কর্তনের শিকার হন, তিনিই আমাদের সময়ের প্রকৃত নায়ক, অনেকটা চেলসি ম্যানিং অথবা এডওয়ার্ড স্নোডেনের মতো, কাজেই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে তাঁর মৃত্যুতে দুনিয়ার মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। চীন রাষ্ট্র হিসেবে যেভাবে মহামারিকে সামলানোর চেষ্টা করেছে, তার অনুমানযোগ্য প্রতিক্রিয়ার ভেতর সবচেয়ে গুছিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন হংকংভিত্তিক সাংবাদিক ভেরনা ইয়ু, তিনি মন্তব্য করেন, ‘চীন যদি বাক্‌স্বাধীনতার মূল্য দিত, তাহলে করোনাভাইরাস নিয়ে এই সংকট তৈরি হতো না। চীনা নাগরিকদের বাক্‌স্বাধীনতা ও তাদের অন্য মৌলিক অধিকার মর্যাদা না পাওয়া পর্যন্ত, এমন সংকট ঘটতেই থাকবে…চীনে মানবাধিকারের বিষয়টি হয়তো বাকি বিশ্বের কাছে অতটা অর্থবহ নয়, কিন্তু এই সংকটকালে আমরা তো দেখলাম, চীন নাগরিকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করায় কী দুর্যোগ ঘটে গেল। নিশ্চিতভাবে এখনই সময়, বিষয়টিকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে।’          

ঠিক আছে, কেউ বলতে পারেন চীনা রাষ্ট্রযন্ত্রের গোটা কর্মকাণ্ড মাওয়ের মন্ত্র ‘জনগণের ওপর আস্থা রাখো’ থেকে সরে উল্টো পথে হাঁটছে। বরং তাদের মন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, জনগণকে একেবারেই বিশ্বাস করা ঠিক নয়: জনগণকে ভালোবাসা যাবে, রক্ষা করা, দেখভাল করা, এমনকি নিয়ন্ত্রণও করা যাবে…কিন্তু বিশ্বাস করা যাবে না। চীনা কর্তৃপক্ষ যে ভঙ্গিতে পরিবেশবাদী আন্দোলন অথবা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সমস্যার বিহিত করেছে, এই অবিশ্বাস হলো তারই সর্বোচ্চ প্রকাশ। চীনা কর্তৃপক্ষ প্রায়ই একটি নির্দিষ্ট কার্যবিধিতে আশ্রয় নেয়: দেখা যায় কোনো ব্যক্তি (সে হতে পারে পরিবেশ আন্দোলনকর্মী, মার্কসবাদী ছাত্র, ইন্টারপোলের প্রধান, ধর্ম প্রচারক, হংকংয়ের প্রকাশক, অথবা জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী) হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায় কয়েক সপ্তাহের জন্য, এরপর আবার যখন তারা জনসম্মুখে ফিরে আসে, তখন তাদের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো অভিযোগ দাঁড় করানো হয়, আর তাদের দীর্ঘ সময়ের জন্য চুপ হয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বার্তাই প্রকাশ করে: ক্ষমতা এমন উপায়ে জাহির করা হলো, যাতে কারও কিছু প্রমাণের সুযোগ নেই। আইনি যুক্তিতর্ক আসে বটে, তবে সেটা অনেক পরে, ততক্ষণে মূল বার্তা দেওয়া হয়ে গেছে। যাঁদের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে, তাঁদের কাছে মার্কসবাদী ছাত্র বা অন্যদের গুম হওয়ার ঘটনা উদ্বেগ তৈরি করে, আর উধাও হতে থাকা মার্কসবাদী ছাত্ররাও কখনো কখনো স্বয়ং সরকারি আদর্শের কাছে নিজেদের সোপর্দ করে সরকারের সমালোচনামূলক কাজকর্মকে বৈধতা দান করে।

কিন্তু কোন কারণে পার্টি নেতারা এতটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠছেন? ভূত দেখে, হ্যাঁ মার্কসবাদকে ভিত্তি করে, পার্টির পুরনো কর্মী, এমনকি সেনাবাহিনীর একাংশের সহানুভূতির ওপর ভর করে শিক্ষার্থী ও শ্রমিকদের দলগুলোর সঙ্গে অনুভূমিক সংযোগ স্থাপন করে যে সংগঠিত জাল বিস্তার হচ্ছে, সেটার ভূত। এ ধরনের জাল সরাসরিই পার্টি নিয়মের বৈধতার বিরুদ্ধাচারণ করে এবং প্রতারণা বলে নিন্দা করে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, আগের মতোই সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার বহু ‘মাওবাদী’ ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কসবাদী বিতর্ক সভাও নিষিদ্ধ করেছে। চীনে এখন সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো দেশটির দাপ্তরিক আদর্শে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা। এমন অবস্থানের কারণে চীনকে এখন মূল্য দিতে হচ্ছে:

‘যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে করোনা ভাইরাস মহামারি হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশে’, হংকংয়ের শীর্ষস্থানীয় গণস্বাস্থ্য ও মহামারি বিশেষজ্ঞ গাব্রিয়েল লিয়ুং তেমনটাই মন্তব্য করেন। ‘নিজেদের সরকারের ওপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রাখা দরকার, বিশেষ করে যখন নতুন প্রাদুর্ভাব নিয়ে বৈজ্ঞানিকগণ কাজ করছেন,’ তিনি বলেন, ‘আর আপনার হাতে যখন সামাজিক মাধ্যম, ভুয়া খবর ও আসল খবর মিলেমিশে আছে, আর আছে শূন্য বিশ্বাস, তখন মহামারির সঙ্গে আপনি কী করে লড়বেন? আপনার অতিরিক্ত বিশ্বাস প্রয়োজন, বাড়তি সংহতিবোধের প্রয়োজন, বেশি বেশি সদিচ্ছার প্রয়োজন, যার সব কটিই পুরোপুরি ব্যবহৃত হয়ে গেছে।’২,(খ)     

প্যানডেমিক
প্যানডেমিক

একটি সুস্থ সমাজে একাধিক কণ্ঠস্বর থাকা জরুরি, হাসপাতালের বিছানা থেকে মৃত্যুর আগমুহূর্তে কথাটি বলেছিলেন ডক্টর লি, কিন্তু অন্য কণ্ঠস্বরকে শোনার যে অতিপ্রয়োজনীয়তা, সেটা পশ্চিমা ঢংয়ের বহুদলীয় গণতন্ত্রের মতো হতে হবে, তা কিন্তু নয়, লি শুধু দাবি করেছিলেন, নাগরিকেরা যেন সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়া সমাজে বাধাহীনভাবে প্রকাশ করতে পারেন। আতঙ্ক যেন না ছড়ায়, সে জন্য গুজব নিয়ন্ত্রণ করার যে ভাবনা, তার বিরুদ্ধে প্রধান মতানৈক্যটি হলো, এই নিয়ন্ত্রণ নিজেই অবিশ্বাস ছড়ায় এবং এতে করে আরও ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়। আমজনতা আর রাষ্ট্রের ভেতর পারস্পরিক বিশ্বাসই পারে এসব বন্ধ করতে।

মহামারিকালে একটি ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের প্রয়োজন রয়েছে, যেহেতু সামরিক কায়দায় সঙ্গরোধের (quarantine) মতো বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়। কোটি কোটি লোককে সঙ্গরোধ করার ক্ষমতা চীনের ছিল। অসম্ভব মনে হলেও, দেখা গেল মহামারির একই রকম প্রকোপ যুক্তরাষ্ট্রেও, তাদেরও একই রকম পদক্ষেপ নেওয়ার সক্ষমতা আছে। এটা কষ্টকর কল্পনা নয় যে লিবারটারিয়ানদের (libertarians) বিশাল দল সন্দেহ পোষণ করছে—এই সঙ্গরোধ আসলে রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র—এটাকে তারা তাদের মতো করে শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করবে। কাজেই বাক্‌স্বাধীনতা দিয়ে এই প্রাদুর্ভাব কি ঠেকানো সম্ভব, নাকি দুনিয়াকে রক্ষা করতে চীন বাধ্য হয়েছিল হুবেই প্রদেশে নাগরিক স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে? কখনো কখনো উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপারটি সত্য। আসলে ঘটনা আরও ঘোলাটে, কারণ ‘ভালো’ বাক্‌স্বাধীনতা থেকে ‘খারাপ’ গুজবকে আলাদা করা অত সহজ নয়। যখন কোনো সমালোচক কণ্ঠ অভিযোগ তোলে চীনা কর্তৃপক্ষের দ্বারা ‘সকল সত্যই সর্বদা গুজব হিসেবে পরিগণিত’, তখন এটাও বলতে হবে, প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম ও ডিজিটাল খবরের বিশাল ভুবন এরই মধ্যে গুজবে টইটুম্বুর হয়ে উঠেছে। 

এর একটি ফোসকা পড়ার মতো উদাহরণ সরবরাহ করেছে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান জাতীয় টেলিভিশন নেটওয়ার্ক, চ্যানেল ওয়ান। তারা তাদের সন্ধ্যার প্রধান খবরের অনুষ্ঠান ‘ভ্রেমিয়া’য় (Vremya অর্থাৎ সময়) একটি নিয়মিত অংশের পুরোটাই ব্যবহার করে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারের জন্য। প্রতিবেদনের ধরনটি ছিল ধোঁয়া ধোঁয়া, তবে ভঙ্গিটি এমন ছিল যে দর্শক মনে করবে তারা সত্যের মর্মস্থলে প্রবেশ করে তত্ত্বের খোলস মুক্ত করছে। তাদের মূল বার্তা ছিল, ছায়াবৃত পশ্চিমা এলিট ও বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, এরাই করোনাভাইরাস মহামারির জন্য মূলত দায়ী, বার্তাটি তারা প্রচার করেছে সন্দিগ্ধ গুজব হিসেবে: এই সত্য পাগলেও বিশ্বাস করবে না, তারপরও, কে জানে…? অবাক ব্যাপার, প্রকৃত সত্যকে চাপা দিলেও এর প্রতীকী কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে যায় না। তা ছাড়া আমাদের এটাও স্বীকার করতে হবে, মাঝেমাঝে, জনগণকে পুরো সত্য না বলাটাও আতঙ্কের জোয়ারকে কার্যকরীভাবে দমাতে পারে, নয়তো তাতে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এমন অবস্থায়, সমস্যা সমাধানযোগ্য নয়—এ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ জনগণ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা। আর এটাই দারুণভাবে অনুপস্থিত চীনে।

বিশ্বব্যাপী যেভাবে মহামারি ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে নৈরাজ্য ও ক্ষুধা ঠেকাতে এখনকার বাজার পদ্ধতি যথেষ্ট নয়, সে ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে। পদক্ষেপ যা নেওয়া হচ্ছে, আমাদের অনেকের কাছেই সেটা ‘কমিউনিস্ট’ পদক্ষেপ মনে হতে পারে, তবে এমন পদক্ষেপই আমাদের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভাবতে হবে: বাজারের হিসাবের বাইরে সমন্বিত উৎপাদন ও বিলিবন্টন নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এক্ষণে হয়তো অনেকেরই ১৮৪০ সালীন দশকের আয়ারল্যান্ডকে ধসিয়ে দেওয়া ‘আইরিশ আলু দুর্ভিক্ষে’র কথা মনে পড়ে যাবে, লাখ লাখ মানুষ সে সময় হয় মারা গিয়েছিল, নয়তো দেশান্তরী হয়েছিল। ব্রিটিশ রাজ তখন নিজেদের বাজার ব্যবস্থার ওপর আস্থা অটুট রাখে, আর আয়ারল্যান্ড থেকে খাবার আমদানি করে, এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ তখন যন্ত্রণা ভোগ করছিল। আমরা নিশ্চয় আশা করতেই পারি, সেই রকম নিষ্ঠুর সমাধান বর্তমানে গ্রহণযোগ্য হবে না।

আপনি চাইলে চলমান করোনাভাইরাস মহামারীকে এইচ জি ওয়েলসের ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’-এর (১৮৯৭) উল্টো সংস্করণ হিসেবে পড়তে পারেন। সেই গল্পে দেখা যায়, মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দারা পৃথিবীকে কবজা করে নেয়, বেপরোয়া নায়ক-কথক আবিষ্কার করে, দুনিয়াবি এক প্যাথোজেন(গ) দিয়ে অতর্কিতে হামলা করা হলে তাদের হত্যা করা যাবে, প্যাথোজেনগুলো সামলানোর মতো প্রতিরোধক্ষমতা তাদের শরীরে নেই: ‘মরেছে, মানুষের তৈরি সব যন্ত্র বিফল হলেও, ঈশ্বরের ক্ষুদ্র বস্তু দিয়ে মরেছে, তিনি বিচক্ষণ, আগে থেকে তা [প্যাথোজেন] দুনিয়ায় রেখে দিয়েছিলেন।’ একটা ব্যাপার খুব মজার, ওয়েলস নিজেই বলছিলেন, গল্পের ছকটি তিনি পান ভাই ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে আদিবাসী তাসমানিয়ানদের ওপর ব্রিটিশদের ভয়াবহ প্রভাব নিয়ে কথা বলার সময়। ওয়েলস ভাবছিলেন, তাসমানিয়ানদের সঙ্গে ব্রিটিশরা যা করেছে, সেটা যদি মঙ্গলগ্রহবাসীরা করে ব্রিটিশদের ওপর, তখন কী হবে? তাসমানিয়ানদের অবশ্য আক্রমণকারীদের আটকানোর জন্য প্রাণঘাতী প্যাথোজেন ছিল না।

হয়তো, যে মহামারী এখন মানবজাতিকে শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, তাকে ওয়েলসের গল্পে উল্টো করে বসিয়ে দেখা যেতে পারে: ‘মঙ্গলগ্রহের আক্রমণকারীরা’ পৃথিবীতে থাকা আমাদের প্রাণকে, মানবজাতিকে, আমাদেরকে, নির্মমভাবে নির্যাতন ও ধ্বংস করে দিচ্ছে; এবং আমাদের পক্ষ থেকে ওদের ঠেকাতে সবচেয়ে উন্নত স্তন্যপায়ী প্রাণীর সব ধরনের যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে, আর এখন আমাদের শাসাচ্ছে ‘ঈশ্বরের ক্ষুদ্র বস্তু…, তিনি বিচক্ষণ, আগে থেকে তা [প্যাথোজেন] দুনিয়ায় রেখে দিয়েছিলেন’, বেকুব ভাইরাস, অন্ধভাবে শুধু নিজেদের সংখ্যায় বৃদ্ধি করে চলে—আর চরিত্রে পরিবর্তন ঘটায় (মিউটেট করে)।

যে অবস্থার ভেতর করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়াতে পারে, আমাদের অবশ্যই সেই সামাজিক অবস্থাটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শুধু ছড়ানোর উপায়টা ভাবুন, আজকের পরস্পরসংযুক্ত দুনিয়ায়, একজন ব্রিটিশ লোক আরেকজন লোকের সঙ্গে দেখা করল সিঙ্গাপুরে, এরপর ফিরে এল ইংল্যান্ডে, এবং তারপর সে ফ্রান্সে গেল স্কিয়িং করতে, ওখানে গিয়ে সে আরও চারজনকে আক্রান্ত করল…এরপর যথারীতি সন্দেহভাজনদের লাইন ধরে অপেক্ষায় রাখা হবে জেরা করার জন্য: বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদী বাজার, সম্পদশালীদের ভঙ্গুর দশা। যা-ই হোক, ঘটমান মহামারির গূঢ়ার্থ খোঁজার প্রলোভন আমাদের সামলাতে হবে: মহামারি নিষ্ঠুর, তবে পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণকে নির্দয় শোষণের জন্য এ মানবজাতির শাস্তি। আমরা যদি এমন গোপন বারতা খুঁজি, তো আমাদের আর আধুনিক বলা যাবে না: আদান-প্রদানে আমরা নিজেদের বিশ্বজগতের অংশীদার মনে করি। এমনকি আমাদের ন্যূনতম টিকে থাকাও যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখনো আমাদের মনে বারবার ঘুরেফিরে আসে, এটা নিশ্চয় কেউ শাস্তি দিচ্ছেন, বিশ্বজগৎ (অথবা আছেন এমন কেউ) থেকে আমরা বিযুক্ত নই। অন্তর্নিহিতভাবে আমরা এখানে গুরুত্ব বহন করি। আমাদের জন্য এটা মেনে নেওয়া সত্যিই কঠিন যে ঘটমান মহামারিটি একেবারে নিখাদ প্রাকৃতিক আকস্মিক ঘটনা, হুট করেই এটা হলো, আর এর ভেতর কোনো গভীর অর্থ নেই; বস্তুর এই বিপুল সংসারে আমরা শুধুই একটি প্রজাতি মাত্র, বিশেষ কোনো গুরুত্ব আমরা বহন করি না।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের হুমকির প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাৎক্ষণিকভাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সহায়তা ও সমন্বয়ের কথা বলেছেন—না সদাশয় হয়ে বা মানবিক বিবেচনা থেকে নয়—এটা তিনি করেছেন স্রেফ এ জন্য যে সেখানে ইহুদি আর ফিলিস্তিনিদের আলাদা করে চেনা অসম্ভব—একটি দল যদি আক্রান্ত হয়, আরেকটি গোষ্ঠী অবশ্যম্ভাবীভাবে ভুক্তভোগী হবে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা, এটাকে আমাদের রাজনীতির দৃষ্টিতে দেখতে হবে—এখনই সময় ‘আমেরিকা (বা আর যে কেউ) প্রথম’(ঘ) মন্ত্রটাকে বাদ দেওয়ার। অর্ধশতাব্দী বছরেরও অধিক সময় আগে মার্টিন লুথার কিং যেমনটা বলেছেন: ‘আমরা হয়তো সবাই ভিন্ন ভিন্ন জাহাজে করে এসেছি, কিন্তু আমরা এখন একই নৌকায়।’

(আগামী রবিবার পরের অধ্যায় পড়ুন)

লেখকের নোট

১. https://www.theguardian.com/world/2020/feb/08/if-china-valued-free-speech-there-would-be-no-coronavirus-crisis

২. https://www.theguardian.com/world/2020/feb/11/coronavirus-expert-warns-infection-could-reach-60-of-worlds-population

৩. https://www.bbc.com/news/world-europe-51413870

৪. https://en.wikipedia.org/wiki/The_War_of_the_Worlds

অনুবাদকের নোট

ক. ল্যাটিন কথা, যার অর্থ ‘ছুঁয়ো না আমায়’। যিশুখ্রিষ্ট মৃত্যুকে জয় করে ফিরে এসে এ কথাটি মেরি ম্যাগডালিনকে বলেছিলেন। জনের (২০:১৭) ল্যাটিন ভুলগেইট সংস্করণে এটি পাওয়া যায়। 

খ. হংকংয়ের সঙ্গে চীনের টানাপোড়েনের প্রেক্ষিতে এই কথা বলা হচ্ছে। হংকংবাসীর যে আর আস্থা নেই চীনের উপর, এর নানা ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। হংকং চীনের অধীন হলেও মূল ভূখণ্ড থেকে এটি আলাদা। আর তাই হংকংয়ের সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরেই চীন থেকে আলাদা হতে চাইছে, কিন্তু চীন সেটা না করে উল্টো নানা নতুন নতুন আইন তাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। আর এ নিয়ে নতুন করে সংঘর্ষ চলছে আট মাস ধরে।

গ. ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ধরনের আণুবীক্ষণিক জীবাণু।

ঘ. আমেরিকা ফার্স্ট—এটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ, যা গৃহীত হয় দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে। এই নীতি অনুযায়ী মার্কিন জাতীয়তাবাদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেশের জন্য যা যা করণীয়, সেটাকেই প্রথম বাস্তবায়ন করা হয়। জিজেক এখানে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনপ্রীতিকে মার্কিন জাতীয়তাবাদী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে তুলনা করেছেন।