বিদায় হে কিংবদন্তি, লুইস সেপুলবেদা

লুইস সেপুলবেদা (৪ অক্টোবর ১৯৪৯—১৬ এপ্রিল ২০২০)
লুইস সেপুলবেদা (৪ অক্টোবর ১৯৪৯—১৬ এপ্রিল ২০২০)

অদ্ভুত সংকটময় সময় পার করছে বিশ্ব। অনির্বচনীয় ভাইরাসের কারণে মানব প্রজাতির অস্তিত্ব সংকটের মুখে। দুঃস্বপ্নে দিন যায়। আর ভাবি সুদিন আসবে কাল। ১৬ এপ্রিল দিনটি তেমন ছিল! সকাল শুরু হয়েছিল সুসংবাদে, গ্রিসের নামজাদা কবি ও মনোবিজ্ঞানী সতিরিস পাস্তাকাসের মেইল পেয়ে। কিন্তু রাতে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন লেখকের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম ইউটিউবে! আর ফাঁকে ফাঁকে দেখছিলাম ফেসবুকের নিউজফিড। আচানক এক দুঃসংবাদে চোখ আটকে গেল। দেখলাম, চিলির প্রধানতম লেখক ও চলচ্চিত্রকার লুইস সেপুলবেদা আর নেই। অবিশ্বাস্য ঠেকল! বিবিসির নিউজ দেখলাম! স্প্যানিশ পত্রিকা এল পাইস দেখলাম। ঘাতক করোনা কেড়ে নিল চিলির সমকালীন শ্রেষ্ঠ লেখকের প্রাণ! বস্তুত, আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর সাক্ষাৎ পাই পাস্তাকাসের দৌলতে!

লুইস সেপুলবেদার নাম দুটো কারণে পরিচিত ছিল আমার। প্রথমত, রাজনৈতিক কর্মী, দ্বিতীয়ত, লেখক হিসেবে। লাতিন আমেরিকার বামপন্থী আন্দোলনে উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে জান্তা শাসক অগুস্তো পিনোচেত চিলির ক্ষমতা দখল করলেন। এ সময় জান্তাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নায়ক লুইসই প্রথম আটক হন। প্রায় আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন। লুইসের বাবা হোসে সেপুলবেদাও ছিলেন চিলির কমিউনিস্ট পার্টির মিলিট্যান্ট সদস্য। ফলে লুইসের নির্যাতনের মাত্রাও ছিল বেশি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় শর্ত সাপেক্ষে সে সময় মুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন গৃহবন্দী আর ফেরারি জীবন তাঁর সুখের ছিল না। জান্তা শাসক দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন। এমনকি তাঁকে আশ্রয় দেওয়ায় তাঁর বান্ধবী কারমেন আনেজকেও সইতে হয় নানা নির্যাতন। অবশ্য লুইস বলেছিলেন, ‘তাঁরা আমাদের সময় ও যৌবন চুরি করে নিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কী অভাব ছিল, তা জেনে বাঁচতে শিখেছি আমরা আর সামনে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেছি!’ ১৯৭৮ সালে গোপন গেরিলাদের সহায়তায় প্যারাগুয়ে হয়ে দেশান্তরি হন জার্মানিতে। শুরু হয় নতুন জীবন।

দেশান্তরি জীবনে লুইস লিখেছেন বিস্তর। সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন জীবনকল্পে। প্রথম গল্পগ্রন্থ ক্রোনিকেল অব পেদ্রো নোবডি প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। কিন্তু তাঁকে চরম খ্যাতি এনে দেয় দুটি গ্রন্থ—দ্য ওল্ডম্যান হু রিড দ্য লাভ স্টোরি (১৯৮৯) ও শিশুতোষ গ্রন্থ দ্য স্টোরি অব আ সিগাল অ্যান্ড দ্য ক্যাট হু থট হার টু ফ্লাই। প্রথম বইটি ৭০ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর অনবদ্য স্মৃতিকথা দ্য শ্যাডো হোয়াট উই উইয়ার। নির্মাণ করেছেন ফিল্ম ও ডক্যুফিল্ম। পাবলো নেরুদা ও হোর্হে লুই বোর্হেসকে নিয়ে ডকুমেন্টারি আছে তাঁর। কী ধরনের লেখক ছিলেন তিনি? তাঁর লেখার উপজীব্য বৈচিত্র্যময় লাতিন জনজীবন। ভাষার মাধ্যমে রসাত্মক ভঙ্গিতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে এক সূত্রে গেঁথেছেন তিনি। মানুষের মুক্তি দেখেছেন প্রাণ জগতের সমন্বয় সাধনে।

লুইসের সর্বশেষ ফেসবুক পোস্ট ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। এর আগের পোস্টটি ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি—স্ত্রী কারমেন ও তাঁর ছবি, পর্তুগালের একটি সাহিত্য সম্মেলনে। পর্তুগাল থেকে মার্চে ফেরেন স্পেনে। আর টের পান, তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। শেষ নাগাদ মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন স্প্যানিশ সাহিত্যের অসামান্য শিল্পী লুইস সেপুলবেদা। আজন্ম লড়াকু এই লেখকের জন্ম ১৯৪৯ সালে, চিলির লিমারি প্রেদেসের ওভালিতে। মাঝেমধ্যে কবিতাও লিখতেন। অনেক দিন হয়তো মনে থাকবে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘আমরা শিখেছি আমাদের থেকে আলাদা কারও প্রশংসা ও ভালোবাসা আর মত গ্রহণ করতে। যারা আমাদের মত গ্রাহ্য করে তাদের গ্রহণ করা সহজ, তবে আলাদা মতের কাউকে গ্রহণ করা কঠিন আর আপনাকে সেই কাজটি করতে হবে!’

বিদায় কিংবদন্তি হে লেখক, লুইস সেপুলবেদা!