জরুরি সব দিনের লেখকদের কথা, পড়া

কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউ
কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউ

এখন আমাদের মনে কত প্রশ্ন! এই যে থমকে গেছে জীবন, এই যে বাধ্যতামূলক সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, অস্তিত্বের তীব্র সংকট, মানুষ কি মানুষের সঙ্গে আর কোনো দিন আগের মতো মিলবে না? করোনা-পরবর্তী মানবিক সম্পর্ক কেমন হবে? মহামারি তো পৃথিবীর ইতিহাসে আছে, অগুনতি মানুষও মরেছে, সেই প্রচণ্ড নৈরাশ্য থেকে আবার জেগেও তো উঠেছে মানুষ। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করেছে। ভেবেছে শুধু নিজের কথা। উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোটি কোটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। ফুরিয়ে গেছে সুপেয় পানি। উষ্ণায়ন বেড়ে উত্তপ্ত হয়েছে পৃথিবী। যুদ্ধের উন্মাদনা যত বেড়েছে, মানুষ ততই বিপন্ন হয়েছে। অভিবাসনসংকট আজ ভয়াবহ। শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েছে, দেশহীন ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যাও আজ কোটি ছাড়িয়েছে। মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক করোনাভাইরাসের আঘাত এমন ব্যাখ্যাতীত অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে যে মানুষ তার নিজের হাতের কাছে অসহায়। বিচ্ছিন্নতার অদ্ভুত এক গোলকধাঁধায় দুনিয়ার মানুষ আজ আত্মহত্যাপ্রবণ। উৎপাদনের চাকা অচল। হাসপাতালগুলো রোগী রাখতে পারছে না, জায়গা নেই; নেই জরুরি চিকিৎসা উপকরণ। কিন্তু দেশে দেশে আণবিক বোমা আছে। সুতরাং লকডাউন, কোয়ারেন্টিন। এ বিচ্ছিন্নতার কালে পাঠকের কাছে আবারও নতুন তাৎপর্যে উঠে আসছে কিছু রচনা—আলবেয়ার কাম্যুর 'প্লেগ', সারামাগোর 'অন্ধত্ব', মার্কেসের 'কলেরার সময়ে প্রেম', ড্যানিয়েল ডি ফোর 'প্লেগের সময়ের জার্নাল', কিম স্ট্যানলি রবিনসনের 'ভাত ও লবণের বছর', ক্রিস এড্রিয়ানের 'শিশু হাসপাতাল'। লেখাগুলো মানবিকতার নতুন বোধ জাগাচ্ছে ভেতরে। এ পাঠের সম্পূরক হিসেবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, সাময়িকী, সংকলন, দিনলিপি, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি থেকে বিশ্ববরেণ্য লেখকদের লেখালেখি, পাঠ এবং বিশ্বদর্শন থেকে এমন কিছু কথা নেওয়া হলো, যে কথাগুলো মানসিক শক্তি দেবে, পৃথিবীর জন্য নতুন মায়ার জন্ম হবে।

হোসে সারামাগো।
হোসে সারামাগো।


হোসে সারামাগো: লিসবন, অন্ধত্ব, আশা

লিসবনের কথা খুব মনে পড়ে?
মনে পড়া না-পড়া—এসব দিয়ে ব্যাপারটিকে পুরোপুরি ব্যক্ত করা যাবে না; লিসবনের কথা মনে পড়া যখন অনিবার্য হয়ে পড়বে, যেভাবে কবিরা বলে থাকেন নস্টালজিয়া সম্পর্কে, নস্টালজিয়ার যে অনুভূতিটি একেবারে হাড়ে এসে বেঁধে, লিসবনকে মনে পড়ার ব্যাপারটিও সে রকম। কিন্তু আমি হাড়মাংসে তীব্র কোনো অনুভূতি টের পাই না।

বিষয়টি নিয়ে মাঝেমধ্যে আমি ভেবেছি। লিসবনে আমার বন্ধুদের অনেকেই এখনো আছেন, সেখানে কিছুদিন আগে আমরা খুব অল্প সময়ের জন্য গিয়েওছিলাম। কিন্তু এখন লিসবন নিয়ে আমার যে সংবেদন, যে বেদনা, তাতে আমি সত্যিই জানি না যে এই শহরের আর কোথায় আমি যাব! লিসবনে গিয়ে আমি কী করব, তা-ও এখন আর জানি না।
মাত্র কয়েকটি দিনের জন্য কিংবা এক বা দুই সপ্তাহের জন্য লিসবনে গেলে আমি আবারও সেই পুরোনো অভ্যাসগুলো ফিরে পাই, যেন পুরোনো দিনগুলোতেই ফিরে এসেছি, কিন্তু আমি তো চাই-ই যত দ্রুত সম্ভব এখানে, লিসবনে ফিরে আসতে। এই শহর আর তার অধিবাসীদের আমি ভালোবাসি। এখানে আমি নিজের মতো করে থাকতে পারি। আমি যে এই শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব, তা-ও ভাবতে পারি না। হ্যাঁ, সবকিছুর পর সত্য হচ্ছে, সবাই একদিন সবকিছু ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু আমি যে যাব, সেটা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে।

বহু বছর ধরে যেখানে বসবাস করেছেন, লেখালেখি করেছেন, একদিন স্মৃতিময় সেই জায়গাটি ছেড়ে ল্যানযেরোয় চলে এলেন, এখানে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন? লেখার পুরোনো জায়গাটির কথা মনে পড়ে না?

এখানে, নিজেকে খুব সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়েছি। আসলে আমি এমন এক ধাঁচের লোক, নিজের জীবনকে যে দুর্বোধ্য করে না। জীবনকে অতিনাটকীয় না করেই আমি বেঁচে থেকেছি, জীবনকে যাপন করেছি। ভালোমন্দ যা-ই ঘটুক না কেন, আমি কেবল সেই মুহূর্তগুলোতেই বেঁচে থাকতে চেয়েছি। আর হ্যাঁ, আমি যদি দুঃখ পেতে শুরু করি, তাহলে সেই দুঃখকে অনুভবও করতে পারি, কিন্তু...আমি অন্যভাবে বলতে চাই, জীবন খুব আকর্ষণীয় হয়ে উঠুক, আমি হয়তো তা চাইনি! 

আমি এখন একটি বই লিখছি। বইটি লিখতে গিয়ে আমি কেমন যাতনা ভোগ করছি, চরিত্র নির্মাণে কী রকম বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি, কমপ্লিকেটেড ন্যারেটিভের সূক্ষ্ম দ্যোতনা সম্পর্কে কীভাবে জানতে পারছি—আপনাকে এ সম্পর্কে কিছু বলাটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার হবে। আসলে বোঝাতে চাইছি, আমি সেটাই করব, যতটুকু করা আমার পক্ষে সম্ভব। লেখালেখি সব সময়ই আমার কাছে কাজ। কাজ থেকে লেখালেখিকে কোনোভাবেই আমি আলাদা ভাবতে পারি না; আমি মনে করি, লেখা ও কাজ—দুইয়ে মিলে আসলে একই ব্যাপার। লেখা ও কাজের পরস্পরের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। শব্দগুলোকে আমি পরপর লিখে যাচ্ছি, একের পর এক কিংবা একটি শব্দের পাশে বসিয়ে দিচ্ছি অন্য আরেকটি শব্দ, গল্পটিকে বলতে গিয়ে, কিংবা আমার ভেতরের সেই সব কথাকে অবিরাম লিখে চলেছি, যাকে আমি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেই মনে করি; অন্ততপক্ষে আমার নিজের কাছে তো কথাগুলো মূল্যবান। লেখালেখির নিরন্তর প্রক্রিয়াটিকে আমি কাজ হিসেবে ধরে নিয়েছি।

'অন্ধত্ব' লেখার ধারণা কীভাবে পেয়েছিলেন?

অন্য উপন্যাসগুলোর ক্ষেত্রে যে রকম হয়েছে, সেভাবে 'অন্ধত্ব'ও একটি বিশেষ আইডিয়া থেকে বিকশিত হয়েছে, হঠাৎ করেই আমার চিন্তায় ফুটে উঠেছে। (এভাবে লিখবার এটাই যে যথাযথ পদ্ধতি, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম না, কিন্তু এ ছাড়া ভালো কোনো উপায়ও খুঁজে পাইনি)। রেস্টুরেন্টে বসে দুপুরের খাবারের অপেক্ষা করছিলাম, হঠাৎ কী হলো জানি না, ভাবতে শুরু করলাম, আমরা সবাই যদি অন্ধ হতাম? প্রশ্নটির উত্তর চিন্তা করলাম, কেন জানি মনে হলো, আসলে প্রত্যেকে আমরা অন্ধ, এই হলো উপন্যাসটির ভ্রূণ। তারপর আমি শুধু লিখে গেছি, ঘটনাপরম্পরাকে লিপিবদ্ধ করে গেছি। একটি বিশেষ পরিণতিকে জন্ম দিতে চেয়েছি, কিন্তু পরিণতিটি ছিল রোমহর্ষক, কিন্তু তাতে শক্ত যুক্তিও ছিল। কারণ ও ফলের মধ্যকার সম্পর্কের একটি পদ্ধতিগত প্রয়োগ ছাড়া অন্ধত্বে কিন্তু কল্পনাশক্তির ব্যবহারও নেই।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি তার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব অন্য দেশগুলোর রাজনীতিবিদদের মতোই কমবে। আর তারা তাদের আসল চেহারায় ফিরে আসবে। রাজনীতিবিদ মানে এজেন্ট। রাজনীতিবিদেরা এখন নিছক এজেন্ট ছাড়া আর কিছু নয়, কেননা, আমাদের সময়ের মহত্তম বিভ্রান্তি হচ্ছে গণতন্ত্র নিয়ে আলাপ, আলোচনা, বক্তৃতা। এই পৃথিবীতে গণতন্ত্র আর কাজ করছে না। গণতন্ত্রের পরিবর্তে কাজ করছে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাজনীতিবিদেরা বিশ্বকে শাসন করছে। রাজনীতিবিদেরা প্রতিনিধি মাত্র। তথাকথিত রাজনৈতিক শক্তি ও অর্থনৈতিক শক্তির মধ্যে এটা একধরনের সম্পর্ক রক্ষার ধরন, যা সত্যিকারের গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত।
লোকে হয়তো জিজ্ঞেস করবে, আপনার বিকল্প প্রস্তাবগুলো কী? আমি বিকল্প কিছুর কথা বলব না। আমি তো নিতান্তই একজন ঔপন্যাসিক, আমি এই বিশ্ব সম্পর্কে তা-ই লিখি, যেভাবে আমি তাকে দেখি। কিছু পরিবর্তন করা আমার কাজ নয়। আমি সবকিছুতে একা একা পরিবর্তন আনতে পারব না, এমনকি আমি এটাও জানি না যে কীভাবে পরিবর্তনটা সম্ভব। নিজের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই আমি পৃথিবী সম্পর্কে ভাবিত হই।
কথা হলো, আমি যদি কোনো প্রস্তাবনা রাখতে চাই, তাহলে সেটা কী হবে। আমরা যাদেরকে পিছিয়ে পড়া বলে ধরে নিয়েছি, তাদের জীবনমানের উন্নয়ন নিয়ে নানামুখী দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে থাকে। সবাই চাইবে যারা উন্নয়নে এগিয়ে আছে, তারা আরও উন্নতি করুক। পিছিয়ে পড়াদের উন্নয়নের মানেটা সাধারণ ও সরল। যারা উচ্চমধ্যবিত্ত স্তরে আছে, তারা স্বস্তিপূর্ণ জীবনযাপন করার সুযোগ পায়। উন্নয়নশীলতায় পিছিয়ে পড়াদের বলতে হবে, বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ, তোমরা যারা পিছিয়ে পড়েছ, তোমরা নিজেরা নিজেদের এগিয়ে নাও। এবার ভাগ্য পরিবর্তন করো। কথাগুলো সবই ইউটোপিয়া। আমি ল্যানযেরোতেয় থাকি, জায়গাটি পঞ্চাশ হাজার জনসংখ্যা-অধ্যুষিত একটি দ্বীপপুঞ্জ; এখানেই পঞ্চাশ হাজার! তাহলে সারা বিশ্বের বেলায় কী হবে? আমার উদ্দেশ্য কিন্তু পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা হওয়া নয়। আমি তো এই সরল বিশ্বাসটি বুকে ধারণ করেই বেঁচে আছি যে পৃথিবী আরও সুন্দর এবং বাসযোগ্য হতে পারত; আর খুব সহজেই তাকে বাসযোগ্য এবং সুন্দর করে গড়ে তোলা যায়।
এই বিশ্বাসটি আমাকে দিয়ে বলাতে বাধ্য করে, যে পৃথিবীতে আমি আছি, সে পৃথিবীকে আমি পছন্দ করি না। দুনিয়াজোড়া বিপ্লব আমার কল্পনা। আমার এই ইউটোপীয় ভাবনাকে ক্ষমা করে দিলেই হয়তো আমি, আপনি ও অন্যদের জন্য মঙ্গল হবে। আমরা দুজনই যদি ঘুম ভেঙে জেগে উঠি এবং বলতে শুরু করি, আজকের দিনটিতে কাউকে নির্যাতন করব না; এভাবে যদি পরের দিনও আবার বলি আর প্রতিজ্ঞামতো চলতে থাকি, তাহলে পরিবর্তন আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না। পৃথিবী বদলে যাবে আমূল। এটা আমার অর্থহীন ভাবনা। এ রকম কখনোই ঘটবে না।
এই সব কারণই আমার ভেতর অবিরাম প্রশ্নের জন্ম দেয়। 'অন্ধত্ব' উপন্যাসটি লিখেছিলাম এই প্রশ্নগুলো মাথায় রেখেই। এসবই আমাকে সাহিত্যের কাজ করতে শক্তি জোগায়, বিষয়গুলোকে সাহিত্যের ভাষায় তুলে ধরি।

গুন্টার গ্ৰাস।
গুন্টার গ্ৰাস।


গুন্টার গ্রাস : পোকামাকড়ের ঘরবসতি

লেখালেখি কি আনন্দহীন ও বেদনাময়?
লেখায় আসলে হয় কী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মিলে একটি সমগ্র তৈরি হয়, ঠিক যেভাবে পাথর খোদাই করতে করতে পূর্ণতা পায় সম্পূর্ণ একটি ভাস্কর্য। ভাস্কর্য গড়তে গেলে আপনাকে চারপাশে কাজ করতে হবে, আপনি যদি তার এদিকের একটুখানি বদলে দেন তো ওদিকেরও একটুখানি বদলাতে হবে। তো, আপনি পাথরটিতে এমন এক পরিবর্তন ঘটালেন, ফলে একটি মূর্তি দেখা দিল, বিমূর্ত থেকে জেগে উঠল মর্মর এক মূর্তি এবং একটি বিশেষ কিছুতে সে প্রকাশ করতে লাগল। সে যেন শিল্পীর হাতে বিশেষ কিছু হয়ে উঠেছে। টের পাওয়া যাচ্ছে এই মূর্তির ভেতরে সংগীত আছে, জমাট বাঁধা সংগীত। লেখার ক্ষেত্রেও আসলে একই ব্যাপার। দিনের পর দিন আমি লেখাটির প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় খসড়া নিয়ে পড়ে আছি, কিংবা সারা দিন হয়তো একটি মাত্র বাক্য নিয়েই বসে আছি, এগোতে পারছি না, পরের বাক্যটি মাথায় আসছে না কিন্তু ভেতরে ভেতরে লেখাটা প্রবহমান। আমি কাজের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা পছন্দ করি। জানেন, মাঝেমধ্যে আমি অদম্য হয়ে কেবল লিখতেই থাকি এবং লিখতেই থাকি এবং এভাবেই লেখাটা একসময় দাঁড়িয়ে যায়। লেখায় আমার যা কিছু বলার, সব ঢুকে পড়ে, কিন্তু কী যেন একটা দম-বন্ধ-করা ব্যাপার, ভারী অসহ্য ব্যাপার, একটা বেদনা...কী এক অতৃপ্তি! তখন আমি বদলাতে থাকি, যা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, খসড়ার পর খসড়ায় তা বাদ পড়তে থাকে, হঠাৎ কোনো একটি বাক্য ঝিলিক মেরে উঠেছে। জীবনের প্রগাঢ় অনুভূতির প্রকাশক বলে বাক্যটিকে চিহ্নিত করে ফেলি, তখন টের পাই লেখালেখি তো বেদনার ব্যাখ্যাকারীই নয়, আনন্দদায়কও। কিন্তু এই অনুভূতির স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক সেকেন্ড। কারণ তৃপ্ত হলে লেখকের চলবে না। আমি অসমাপ্ত লেখার কাছে আবারও ফিরে যাই, ফলে কাজ এগোতে থাকে।

আপনার বেশিরভাগ উপন্যাসের, যেমন 'দ্য র‌্যাট', 'দ্য ফ্লাউন্ডার', 'ফ্রম দ্য ডায়েরি অব আ স্নেইল', 'ডগ ইয়ার্স'—এদের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আছে কোনো না কোনো প্রাণী। এর পেছনে কি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে?

থাকতে পারে। আমার সব সময় মনে হয়েছে মানবপ্রজাতি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বলা হয়েছে। পৃথিবী মানুষের চিৎকারে ভরা, কিন্তু মানুষ ছাড়াও পশুরা, পাখিরা, মাছ এবং পোকামাকড়েরাও সে চিৎকারে শামিল আছে। মানুষের আগে পৃথিবীতে তারাই এসেছিল, মানুষ বিলুপ্ত হলেও তারা টিকে থাকবে, এখানেই তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। আমরা মিউজিয়ামে বিলুপ্ত ডাইনোসরের হাড়গোড় এনে রেখেছি, অতিকায় প্রাণীগুলো কয়েক লাখ বছর ধরে বেঁচে ছিল। মৃত্যুর বহু বছর পর আমরা তাদের খুঁজে পেলাম পবিত্র, সুন্দর, কোনো মারাত্মক বিষ তাদের শরীরে নেই। হাড়গোড় পরিষ্কার। মানুষের ক্ষেত্রে এ রকম পবিত্রতার বালাই নেই। আমরা মরলে চারপাশ বিষাক্ত বাতাসে ভরে যায়। আমাদের নিশ্বাসে বিষ মিশে থাকে। আমাদের বুঝতে হবে, কেবল আমরাই এই পৃথিবীতে থাকি না, আমরাই একমাত্র নই। বাইবেল যখন বলে, 'মানুষ কর্তৃত্ব করবে মাছের ওপর, কর্তৃত্ব করবে বুনোপাখিদের ওপর এবং কর্তৃত্ব করবে প্রতিটি পোকামাকড়ের ওপর', তখন আমি প্রশ্নের মুখোমুখি হই। আমরা পৃথিবীকে শুধু জয়ই করার চেষ্টা করেছি, যার ফল হয়েছে হতাশাজনক।

ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা: মাটির টান

আমি বেড়ে উঠেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে। দুনিয়ার সমস্ত শিশুর মতো, প্রতিটি জিনিস, আসবাব, লতাগুল্মবৃক্ষ আর পাথরগুলো অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ছিল আমার কাছে। তাদের পৃথক সত্তাগুলোকে শ্রদ্ধা করতাম। অবিরাম কথা বলতাম তাদের সঙ্গে। জীবনের সূচনাকাল থেকে তাদের সঙ্গে আমার কতই না কথা হলো আর তাদের কী তীব্র ভালোই না বাসতাম! আমাদের বাড়ির উঠানে বেশ কয়েকটি পপলার গাছ ছিল, এক ঘোরগ্রস্ত বিকেলে আমার মনে হল, কালো কালো এই পপলারগুলো গান গাইছে! বাতাস প্রবল বেগে যখনই গাছগুলোকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে পপলারদের গান পাল্টাচ্ছে সুর, পাল্টাচ্ছে তাল, লয় আর হতবিহ্বল আমি ভাবছি, এই তো সংগীত, হৃদয়ের অন্তঃস্থ সংগীত। পপলার বৃক্ষদের গান শোনার সহগামী হয়ে পড়েছিলাম, দিনের বড় একটি অংশ চলে যেত তাদের গান শুনে। আসলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একদিন আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম, যখন শুনতে পেলাম কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে, 'ফে-দে-রি-কো', তাকাচ্ছি চারপাশে। না, কেউ নেই, কাউকে দেখছি না। কে এমন শব্দ করে ডাকল? অনেকক্ষণ পর আবার সেই ডাক। আমার উপলব্ধি হলো এই প্রাচীন পপলারদের শাখা-প্রশাখাগুলো বিপুল বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে, পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে বিষণ্ণভাবে।
আমি এই মাটিকে ভালবাসি। আমার অনুভূতিগুলো এই মাটির সঙ্গেই আমাকে কড়িকাঠের মতো বন্ধনে জড়িয়েছে, আটকে রেখেছে।
আগাগোড়াই আমি হিস্পানি, আর তাই আমার নিজস্ব ভৌগোলিক সীমার বাইরে গিয়ে বসবাস করাটা আমার পক্ষে অসম্ভব। তবে, আমি কিন্তু তাদের ঘৃণা করব, যে কিনা শুধু হিস্পানি হওয়ার জন্যই হিস্পানি। আমি সবার ভাই। আমি ঘৃণা করছি তাকে, যে নিজেকে উৎসর্গ করছে বিমূর্ত জাতীয়তাবাদী আদর্শের জন্য। নিজের দেশকে সে ভালবাসছে কালো কাপড় দিয়ে চোখ দুটিকে বেঁধে। আর এসব কারণেই একজন ভালো চীনা আমার কাছে বাজে হিস্পানির চেয়েও বেশি প্রিয়। আমি স্পেনের জন্য গান গাই আর তাকে অনুভব করি আমার মজ্জার ভেতর। তবে এই সবকিছুর আগে আমি এই পৃথিবীর লোক, সবার ভাই। না, আমি কোনো রাজনৈতিক সীমানায় বিশ্বাসী লোক নই। শোনো, সাক্ষাৎকারীরা সব সময় সবকিছু জিজ্ঞেস করে না, তাদের জিজ্ঞাসার অধিকার থাকে সীমাবদ্ধ। তাই এখন আমাকে তুমি বলো, কী সেই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সারা দুনিয়ায় বিরাজমান কোন সে বুভুক্ষা, যা তোমাকে অস্থির করে তুলেছে? তুমি কি এখন কবরের ভেতর লুকিয়ে থেকে টিকে থাকবার লড়াই করবে? তুমি কি দেখছ না, ইতিমধ্যে সবকিছুকেই কেমন করে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে? মানুষ কোনোভাবেই এই বাঁধা নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না, কিছুই করতে পারবে না, তা সে নিয়মে বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক।

অ্যলিস মুনরো।
অ্যলিস মুনরো।


এলিস মুনরো: পৃথিবীর বুকের ভেতরের রস

প্রতিদিনের লেখালেখি, পড়াশোনা ইত্যাদি সম্পর্কে বলুন। লেখার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করেন? প্রতিদিনই কি লেখেন? লিখতে বসেন কখন? একটি গল্প শেষ করতে কত দিন লাগে?
বছরখানেক হবে লেখার কাজে কম্পিউটার ব্যবহার করছি, আসলে প্রযুক্তির এই সব সুবিধার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়েছি বেশ দেরিতে, আমি এখনো একটি মাইক্রোওয়েভ ওভেনের মালিকও হতে পারিনি। হ্যাঁ, কম্পিউটারে লিখি তো বটেই, কিন্তু কি-বোর্ডে যাওয়ার আগে গল্পটিকে কয়েকবার হাতে লিখেই খসড়া করে ফেলি। এভাবে কাজ করতেই আমি অভ্যস্ত। একটি গল্প লিখতে দুমাস লাগতে পারে; গল্প ভাবনা শুরু, তারপর লিখতে থাকা। কিন্তু একটি গল্পের জন্য মাত্র দুমাস বিরল ঘটনা, খুব সম্ভবত ছয় থেকে আট মাস লেগে যায় একটি গল্পের চূড়ান্তে পৌঁছাতে; অনেক পরিবর্তন, কাটাকাটি, ভুল পথে চলে যাওয়া, তারপর গল্পের গতিপথ বদলে দেওয়া; ভাবনার কিছু হয়তো এসেছে, কিছু আর খুঁজেই পাওয়া যায় না, কিছু তো চিরতরে হারিয়েই যায়, এভাবে...লেখাটি আমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত টানা লিখতে থাকি, সকালে ঘুম ভাঙলেই লেখার কাছে ফিরে যাই, এক মগ কফিও বানিয়ে ফেলি, তারপর জীবনের নানামুখী ব্যস্ততা এসে জাপটে ধরার আগে পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা লিখে যেতে মরিয়া হয়ে উঠি।

আপনার গল্পের বেশির ভাগ চরিত্রই আশপাশের লোকজন, সবাই আপনার সেই অন্টারিওর; কী এই মাটিকে এত উর্বরাশক্তি দিয়েছে যে এত আশ্চর্য সব গল্প এখানকার অন্টারিওর পটভূমিতে লিখতে পারলেন?

নিজেকে আমি কোনোভাবেই অন্টারিওর ইন্টারপ্রেটার বলে মনে করি না, এখানে আমি নিজেই বসতি গেড়েছি। এখানে থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ সম্পর্কে জানতে পারা, যারা এই অন্টারিওতে বড় একটি কমিউনিটি তৈরি করেছে। ভাষাবন্ধন, আয়-উপার্জন, শারীরিক গঠন—সব মিলিয়েই তাদের আপনি বুঝতে পারবেন। আমি এ অঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ ভালোবাসি, সে ভালোবাসা শুধু দৃশ্যের জন্য নয়, প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠার জন্য, আরও গভীর বন্ধনে জড়াবার জন্য; এখানকার আবহাওয়া, গ্রাম, মফস্বল শহরগুলো, তাদের পরপর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য নয়। পৃথিবীর বুকের ভেতরের রস টেনে টেনে বৃক্ষদের মতো যেভাবে গড়ে উঠেছে তারা, সে জন্য। মানুষের সম্মিলিত জীবনাভিজ্ঞতা থেকে তো নিজেকে আলাদা ভাবতে পারি না, ফলে মানুষের প্রথা, অভ্যাস আর পারিপার্শ্বিকতাও আমার যাপনের অংশ হয়ে ওঠে। রূপকথার জগতের কথা অবশ্য আলাদা।

স্মৃতি আপনার গল্পে প্রধান ভূমিকা পালন করে। স্মৃতির কী এমন শক্তি, কীভাবে আমাদের জীবনকে এত প্রভাবিত করে যে কারণে আপনিও এত কৌতূহলী?

স্মৃতি হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে আমরা আমাদের গল্পগুলো নিজেদেরকে শোনাই, গল্পগুলোকে নানা ভঙ্গিতে, নানা সংস্করণে অন্যদেরও বলি। এভাবে আমরা আখ্যান বর্ণনার শক্তিটিকে চলমান রেখে জীবনকে অবিরাম চালিয়ে নিয়ে যাই। বলতে বলতে মুখে মুখে বদলে যাওয়া, প্রেরণাদানকারী কিংবা শুধুমাত্র বিনোদনমূলক এই গল্পগুলোর গভীরে, আনাচেকানাচে আমরা সন্ধান পাই এমন এক বিস্ময়ের, এমন এক বিশেষ সত্তার, যাকে বলা হয় 'সত্য'।

সালমান রুশদি।
সালমান রুশদি।


সালমান রুশদি : জীবনের জয়গান

সর্বশেষ কোন বইটি আপনাকে কাঁদিয়েছে?
যখন পড়ি তখন কিছুতেই কাঁদি না, সত্যি, যদিও আমি একবার কেঁদে ফেলেছিলাম 'শালিমার দ্য ক্লাউন'-এর একটি চরিত্রের মৃত্যু দৃশ্য লিখতে গিয়ে, চরিত্রটিকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম।

এই যে আজকের আপনি, তাকে যে বইটি তৈরি করেছে সে বইটির নাম বলতে পারবেন?
'সহস্র এক আরব্য রজনী'।

আপনি যদি প্রেসিডেন্টকে কোনও বই পড়তে বলেন, কোন বইয়ের নাম বলবেন?
'সহস্র এক আরব্য রজনী'।

কোন বইগুলোর কাছে আপনি বারবার ফিরে গেছেন?
কাফকা'র 'দ্য মেটামরফোসিস'; বেলো'র 'দ্য এডভেঞ্চার অব ওগি মার্চ'; বোর্হেসের 'ফিকশন'; কালভিনো'র 'দ্য ব্যারোন ইন দ্য ট্রি'স'; গ্রাসের 'দ্য টিন ড্রাম; গার্সিয়া মার্কেসের 'ওয়ান হানড্রেট ইয়ার অব সলিচ্যুড'; এঞ্জেলা কার্টারের 'দ্য ব্লাডি চেম্বার'; ক্রিস্তোফার লগের- 'ওয়ার মিউজিক'; ডেরেক ওয়ালকটের 'ওমেরোস'।

আপনার বিরুদ্ধে যখন ফতোয়া জারি হল, তখন কোন বইগুলো মানসিক শক্তি যুগিয়েছিল?
সে-সময়ের বাস্তবতায় এনলাইটেনমেন্ট লেখকদের লেখাপত্র পড়তে শুরু করেছিলাম। ভলত্যরের 'কাঁদিদ', দিদেরো'র 'জ্যাকোস দ্য ফ্যাটালিস্ট'; রুশো'র 'কনফেশনস', এছাড়াও জন স্টুয়ার্ট মিলের 'অন লিবার্টি'। আর সেই সময় আমি কিছু বুক রিভিউও করেছিলাম যাতে লেখার হাতটা চালু থাকে। মনে আছে ফিলিপ রথের 'দ্য ফ্যাক্টস' বইটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছিলাম; তখন কুর্ট ভনেগাটের 'হোকাস পোকাস' বইটি তেমন টানেনি; যার কারণে ভনেগাট আমাকে কখনোই ক্ষমা করেননি, আর আমিও বিষণ্ণ হয়ে পড়েছিলাম, আর সেকারণে আমি তার অন্যান্য বইগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে পেরেছিলাম- 'দ্য সাইরেন্স অব টাইটান', 'ক্যাটস ক্রেডল', এবং অবশ্যই যে-বইটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করব- 'স্লটারহাউজ-ফাইভ'।