করোনা-ক্রাইসিসে জিব্রানের চিত্র-মাইফেল

মেরি হাসকেলের বহুমাত্রিক প্রতিকৃতি
মেরি হাসকেলের বহুমাত্রিক প্রতিকৃতি

জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর সাভানাতে করোনা সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান হার বৃদ্ধির মোকাবিলায় কিছুদিন লকডাউনের পর গেল সপ্তাহ দুয়েক ধরে জোরেশোরে শুরু হয়েছে স্টে অ্যাট হোম প্রক্রিয়া। এতে প্রয়োজনীয় কাজ তথা গ্রোসারি শপিং প্রভৃতি ছাড়া ঘর থেকে বেরোনো অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। আজ সন্ধ্যাবেলা আমি যে অনানুষ্ঠানিক সামাজিকতার সন্ধানে পথে বেরিয়েছি, তাকে প্রয়োজনীয় কাজের ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না। আমি জানাশোনা সুহৃদ স্কট ক্লার্কের বাড়িতে যাচ্ছি—সমমনা আরও চারজন বয়োবৃদ্ধ নাগরিকের সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বহাল রেখে স্রেফ আড্ডা দিতে। এ মানুষজনদের মধ্যে বয়সের নিরিখে আমি সর্বকনিষ্ঠ, টেকনিক্যালি অবসরভোগী নই, তবে বেকার এবং বয়সজনিত নানাবিধ অক্ষমতার শিকার। অন্যরা সকলে অতিক্রম করেছেন সত্তর-পঁচাত্তর বছর বয়সের সীমানা, আমরা সকলে আন্ডারলায়িং হেলথ কন্ডিশনস তথা হাইপার টেনশন, ডায়াবেটিস প্রভৃতি রোগের ভুক্তভোগী। তাই আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার বেশ আগে থেকে—প্রায় মাস দুয়েক হলো—আমরা আর নগরীর ট্রেন্ডি কফিশপ ফক্সিলক্সিতে বসছি না। ক্রমাগত ঘরবন্দী থেকে আমাদের যে মানসিক হালত হয়েছে, তাকে আজকাল মিডিয়ার কেবিন ফিভার বলা হচ্ছে। আমরা কুটিরজ্বর থেকে নিস্কৃতিলাভের উপায় হিসাবে আজ সন্ধ্যায় একটি ছোটখাট সৃজনশীল মাইফেলের উদ্যোগ নিয়েছি।

আজকের মাইফেলে যারা আসছেন, সকলেই লিখেছেন দুটি-একটি বইপুস্তক। ফক্সিলক্সি ক্যাফেতে বসে এরা ল্যাপটপে টুকটাক লেখালেখি করেন। বই পড়াও আমাদের সকলের নানাবিধ প্যাশনের প্রবল অঙ্গ। বই পড়েই আমরা ক্ষান্ত হই না, ক্যাফেতে বসে এ নিয়ে বাতচিত করে সময় কাটাই। গেল হপ্তা কয়েকের লকডাউনে আমরা সকলে কেন জানি ফের পাঠ করেছি লেবানিজ-আমেরিকান লেখক খলিল জিব্রানের 'প্রফেট' বইটি। যেহেতু কফি টেবিলে বসে এ নিয়ে তর্পণ করা যাচ্ছে না, তাই আমরা নানাবিধ চ্যাট ও ক্ষেত্র বিশেষে স্কাইপে বা জুমের মাধ্যমে কথাবার্তা চালিয়েছি। আমি জিন্দেগিভর কাগজে ছাপা বই পড়ে অভ্যস্ত, এবার সমমনা পাঠকদের উৎসাহে কিন্ডোলে গ্রন্থটি খরিদ করেছি। আমার মতো উত্তরাধুনিক টেকনোলজিতে অদক্ষ বান্দার কিন্ডোলে পাঠের ধান্দাকে প্রিয় নারী বয়োবৃদ্ধা কেইশা লাইটগ্রিন ইউরি গ্যাগারিনের মহাশূন্যযাত্রার মতো এক্সাইটিং বলে ম্যাসেঞ্জারে উল্লেখ করেছেন। আমার উত্তরণ এখানেই থেমে থাকেনি। অনলাইনে আমি টেলফেয়ার মিউজিয়ামের দর্শকদের কাতারে নাম লিখিয়েছি। ওখানে খোঁজ নিয়েছিলাম, তাদের সংগ্রহে জিব্রানের কী কী চিত্র আছে? জাদুঘরওয়ালা অনুগ্রহ করে একটি লিংক দিয়েছেন, যা ইস্তেমাল করে পরপর শতখানেক চিত্র ও ড্রয়িং পর্যবেক্ষণ করা যায়।

জিব্রানের আত্মপ্রতিকৃতি
জিব্রানের আত্মপ্রতিকৃতি

হাজারবার চেষ্টা করেও আমি লিংকটি খুলতে ব্যর্থ হই। অতঃপর খাজুল হয়ে ফক্সিলক্সির বান্ধবদের শরণাপন্ন হলে স্কট ক্লার্ক তাঁকে লিংকটি ফরোয়ার্ড করতে বলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি টেলিফোন করে সকলকে আজ সন্ধ্যায় তাঁর উডেন ডেকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, চিত্রগুলো প্রকান্ড স্ক্রিনে একত্রে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। সাথে সাথে তিনি মাইফেলে সামাজিক দূরত্ব বহাল রাখার জন্য কিছু স্ট্রিক্ট নীতিমালাও অফার করেছেন। কথা হয়েছে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আগে আমরা থার্মমিটারে নিজেদের টেম্পারেচার চেক করব, কফ-কাশি বা মাথাধরার আলামত থাকলে বাইরে বেরোনো থেকে বিরত থাকব এবং আসরে গিয়ে মাস্ক ইত্যাদিতে সুরক্ষিত হয়ে বসব আট ফিট দূরে দূরে অ্যারেঞ্জ করে রাখা কুরসি-কেদারায়।

আজকের মাইফেলে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি রাজসড়ক ছেড়ে একটি পায়ে চলা ট্রেইল ধরে ঢুকে পড়ি পাইনের হাল্কা বনানীতে। ঝরা পাতায় মোড়া ট্রেইলটি প্রশস্ত হয়। কাঠের ব্রিজ অতিক্রম করে ছড়া নদীটির ওপাড়ে আসতেই চোখে পড়ে নুড়িপাথর ছড়ানো সড়কজুড়ে দাঁড়িয়ে শিংগালের তত্ত্বাবধানে তিনটি চকিত-চোখের মাদি হরিণ। এ উপবনে অতীতে হাঁটাচলার সময় হরিণের লেজ কিংবা দ্রুত সঞ্চারমান শরীরের খানিকটা চোখে পড়েছে, তবে তাদের সঙ্গে সামনাসামনি সাক্ষাৎ এই প্রথম। বোধ করি লকডাউনের পরিস্থিতিতে এরা বুক চিতিয়ে ঘোরাফেরার উদ্যোগ নিচ্ছে। আমার পদচারণে বিরক্ত হয়ে মৃগকুল ফিরে যায় ঝোপঝাড়ের আবডালে। আর আমার মস্তিষ্কে আবার ফিরে আসে একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও চিত্রকর হিসাবে মশহুর খলিল জিব্রানের 'প্রফেট' গ্রন্থের প্রসঙ্গ। ১৯২৩ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। কবিতার ভঙ্গিতে লেখা ২৬টি ভিন্ন ভিন্ন চ্যাপ্টারে বিভক্ত মাত্র ১০৭ পৃষ্টার পরাক্রান্ত এ পুস্তক তর্জমা হয়েছে কমসে কম ১০০টি ভাষায়। লেবাননের মানুষ জিব্রান যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হন ১৮৯৫ সালে। 'দ্য প্রফেট' ও 'স্যান্ড ও ফোম' গ্রন্থ দুটির জন্য তাঁর জগৎজোড়া পরিচিত হলেও আদতে তিনি ছিলেন একজন সফলকাম চিত্রকর। ১৯০৪ সালে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় বোস্টন শহরের এক আর্ট স্টুডিওতে। তার চার বছর পর জিব্রান ছবি আঁকার কলাকৌশল মশকো করতে ফরাসি দেশে যান। তখন প্যারিসের নামজাদা শিল্পালয়ে নাকি প্রদর্শিত হয়েছিল তাঁর কিছু চিত্রকর্ম। মূলত লেখক হিসেবে মহৎ প্রতিভার অধিকারী হলেও চিত্রাঙ্কনের তুমুল প্যাশন দ্রাক্ষার নির্যাসে মিশে থাকা সুরার মতোই তাঁর গহন-নিভৃতে ক্রিয়াশীল ছিল হামেশা। এ প্রসঙ্গে তিনি সরাসরি মন্তব্য করেছিলেন, 'আমার প্রিয়তম স্বপ্নগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ হচ্ছে, কোনো নগরীর নির্দিষ্ট এক প্রেক্ষাগৃহের দেয়ালজুড়ে—ধরা যাক—টাঙানো থাকবে পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তরটি চিত্রকর্ম, যা মানুষজন পর্যবেক্ষণ করবে, এবং পরিশেষে ভালোবাসবে।'

মেঠোপথটি এদিকে ইংরেজি এস অক্ষরের মতো এঁকেবেঁকে ঢুকে পড়েছে জঙ্গলের আরও গভীরে। সুরুজ বোধ করি অস্তমিত হচ্ছে, উল্টো দিকে সড়কটির বাঁকে ম্যাগনেলিয়ার চিরসবুজ বৃক্ষে সফেদফুলগুলো লড়াইয়ের ময়দানে সন্ধির ইঙ্গিতবাহী রুমালের মতো নড়ছে। তার তলা দিয়ে অতিধীরে গালফকার্ট চালিয়ে আগুয়ান হচ্ছেন ডেভিড মরগ্যান। ছিটকে আসা খানিকটা সূর্যালোক পড়ে তাঁর অরেঞ্জ বর্ণের বেসবল ক্যাপটি ঝলসে ওঠে। আমি যে মাইফেলের দিকে যাচ্ছি, তাতে মরগ্যানেরও শরীক হওয়ার কথা, বোধ করি তিনি ওই দিকে—স্কট ক্লার্কের বসতবাড়ির পথে রওয়ানা হয়েছেন। সাতাত্তর বছরের বয়সের এ মানুষটি হালফিল স্থায়ীভাবে বাস করেন নিউইয়র্ক মহানগরীতে। বাত ব্যাধিতে ভুগছেন, তাই শীতের শুরুয়াতে অত্যধিক তুষারপাত এড়াতে ফি বছর এসে হাজির হন সাভানার উষ্ণ শহরতলীতে। পেশায় আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার মরগ্যান এক জমানায় প্রায় দেড় যুগ এখানকার নগর উন্নয়ন বিভাগে কাজ করেছেন। আর্বান পরিকল্পনায় সৌন্দর্যানুরাগের কীভাবে সংযোজন করা যায়, তা নিয়ে লিখেছেন একাধিক বইপুস্তক। এখনো শহরতলীতে আছে তাঁর ছোট্ট একটি কটেজ। ভদ্রলোক বিবাহিত হয়েছিলেন বার তিনেক, কিন্তু পত্নীরা তাঁকে ত্যাগ করেছেন, একাধিক ডিভোর্সে ঘায়েল হয়ে ভেবেছিলেন বাকি জিন্দেগি কাটিয়ে দেবেন একাকী। কিন্তু কপালগুণে বছর দুয়েক আগে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় সত্তরোর্ধ্ব বয়সের নারী এলসার। রীতিমতো তাঁরা ডেট করছিলেন। শীত সিজনে মহিলাকে নিউইয়র্কে ফেলে মরগ্যান চলে এসেছিলেন সাভানায়। তারপর সপ্তা দুয়েক আগে এলসা মাত্র পাঁচ দিন হাসপাতালে ভুগে কোভিড-১৯-এর প্রকোপে প্রয়াত হয়েছেন। এর পর থেকে ভারি অস্থির হয়ে আছেন মরগ্যান! শুনেছি তিনি নাকি দিনে একাধিকবার এ জংলা জায়গায় গালফকার্ট চালিয়ে ঘুরে বেড়ান।

জিব্রান ও মেরি হাসকেলের যুগল প্রতিকৃতি
জিব্রান ও মেরি হাসকেলের যুগল প্রতিকৃতি

বনানী থেকে বেরিয়ে আমি গালফ কোর্সের প্রান্ত ঘেঁষে সামান্য হেঁটে ঢুকে পড়ি স্কট ক্লার্কের বসতবাড়ির বিশাল আঙিনায়। অনেকগুলো পামগাছের ছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন সাইড-গেটে সাবানজলে হাত ধোয়ার বন্দোবস্ত। পাশে পোস্টার পেপারে মার্কার দিয়ে মাইফেলে সামাজিক দূরত্ব মেইনটেন করার আবেদন ও তির চিহ্ন দিয়ে ঘরে না ঢুকে সরাসরি ব্যাকইয়ার্ডের উডেন ডেকে চলে যাওয়ার অনুরোধ। না, আমাদের অভ্যর্থনা করতে আগের মতো স্কট দাঁড়িয়ে নেই ড্রাইভওয়েতে। মানুষটি স্বভাবে উষ্ণ, শাহ পাহলভির রাজত্বের শেষ দিকে তিনি ইরানের মাসাদ শহরে দুবছর পিস কোরের ভলানটিয়ার হয়ে কাটিয়েছেন। কামকাজ চালানোর মতো ফারসি বলতে পারেন। মাসাদ থেকে ফিরেছিলেন ইরানি পত্নী নিয়ে, ওই দেশে বসবাসের অভিজ্ঞতা ও পারস্যের মিনিয়েচার চিত্রকলা নিয়ে এক যুগে বই-পুস্তকও লিখেছিলেন, এসবই হালফিল স্মৃতি, বর্তমানে বিপত্নীক মানুষটি কাঠের দ্বিতল বাড়িতে একা বসবাস করেন, সুযোগ পেলে কোনো থিমকে কেন্দ্র করে পার্টি করতে ভালোবাসেন।

গলফকার্ট ঘরঘরিয়ে এসে ড্রাইভওয়েতে নামেন মি. মরগ্যান। কোনোরকমের সামাজিক সম্ভাষণ না করে.. কেমন যেন তেতোবিরক্ত হয়ে বলেন, 'সুলতান, আমি অনলাইন কোর্সে রেজিস্ট্রি করেছি, সি হোয়াট হ্যাপেনস।' তারপর চুপচাপ হেঁটে যান পেছনের আঙিনার দিকে। জর্জিয়ার একটি ইউনিভারসিটি ষাটোর্ধ্ব সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য অনলাইনে ফ্রি কোর্স অফার করছে, মরগ্যান ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে আগ্রহী, আন্দাজ করি, তিনি প্রাসঙ্গিক কোর্সে ভর্তি হতে পেরেছেন। কোনো কিছু নিয়ে তাঁর এ মুহূর্তে এনগেজ থাকাটা জরুরি।

কৃষ্ণাঙ্গ নারী কেইশা লাইটগ্রিন ভ্যানগাড়িটি চালিয়ে এসে তা পার্ক করেন। তাঁর সঙ্গে বাতচিত করার জন্য আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি, তাই অপেক্ষা করি। সহজে তিনি গাড়ি থেকে বের হন না। বছর কয়েক আগে কেইশা শহরের একটি লাইব্রেরির ডিরেক্টর ছিলেন। এখনো মাঝেসাঝে লাইব্রেরিতে গিয়ে আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশনের ওপর ওয়ার্কশপ দেন। তারুণ্যে তিনি একটি স্কুলে আর্ট টিচার হিসাবে কাজ করতেন। বেশ কিছু শিশুতোষ বইয়ের ইলাস্ট্রেশন করেছেন। কিছুদিন হলো আমাকে তিনি 'ইয়াংম্যান' সম্বোধন করে বাচ্চাদের জন্য একটি বই লিখে দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন, যার ইলাস্ট্রেশন তিনি করতে চান। কেইশার ভ্যান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসে রাম্প, কিন্তু তাঁর মোটরাইজড হুইলচেয়ারটি এখনো নামছে না। আমি একটু উদ্বিগ্ন বোধ করি। দিন কয়েক আগে আমরা জুম ব্যবহার করে কথাবার্তা বলেছি। তখন জানতে পারি, নিউ অরলিন্সে তাঁর এক বয়োবৃদ্ধ কাজিন ও তাঁর স্ত্রীর সংক্রমণে মৃত্যুর সংবাদ। অত্যন্ত দরিদ্র এ দম্পতির মেডিকেল ইনস্যুরেন্স ছিল না, অসুস্থ হয়ে দশ-বারো দিনের মতো তাঁরা বাড়িতেই কাটান, কীভাবে চিকিৎসার ব্যয় বহন করবেন, এ দুশ্চিন্তায় পাবলিক হেলথ বিভাগে টেলিফোন পর্যন্ত করেননি। একপর্যায়ে প্রতিবেশীরা আবিষ্কার করে তাঁদের মৃতদেহ। নিউ অরলিন্সে ষাটজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের চিকিৎসার অভাবে নিজ বাড়িতে মৃত্যুর সংবাদ আমরা মিডিয়ায় পাঠ করেছি। ওই শহরে এ অব্দি মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ৪০৫ জন মানুষের, কোনো কোনো সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, লুইজিয়ানা নামে যে অঙ্গরাজ্যে নিউ অরলিন্স নগরীর অবস্থান, ওখানকার জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান, কিন্তু করোনা ভাইরাসে এদের সম্প্রদায়ে মৃত্যুর হার হচ্ছে ৭০ শতাংশ।

রাম্প বেয়ে হুইলচেয়ারটি নেমে আসে। আমি স্বস্তিবোধ করি। কেইশা মাস্ক ফাঁক করে চেককাটা গিলাফে নাক-মুখ প্যাঁচানো আমার দিকে তাকান, বাঁকানো খঞ্জরের মতো বিদ্রূপের হাসিটি তাঁর ঠোঁটে খেলে যায়, আওয়াজ দিয়ে বলেন, 'স্টুপিডম্যান, একটা মাস্কও জোগাড় করতে পারোনি...তবে চাদর প্যাঁচানোতে তোমাকে ঠিক ফিলিস্তিনি গেরিলাদের মতো দেখাচ্ছে।' এ মন্তব্যে আজাইরা উদ্দীপ্ত হয়ে আমি দুপা এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনের ভঙ্গি করি। পাঁচফোঁড়নের সম্ভারের মতো ঝাঁঝিয়ে উঠে তিনি বলেন, 'ব্যাকঅফ ইয়াংম্যান…আট ফিট তফাতে গিয়ে দাঁড়াও...দূরে দাঁড়িয়ে অ্যাপ্রিশিয়েট করার চেষ্টা করো আমার উপস্থিতি।' আমি ঘা খেয়ে হাত কয়েক পেছনে রিট্রিট করি।

রোজ স্লিভ—হার্প বাজানো নারী
রোজ স্লিভ—হার্প বাজানো নারী

পেছনের আঙিনায় উডেন ডেকটি মাটি থেকে প্রায় চার ফিট উপরে ভাসমান জেটির মতো দাঁড়িয়ে আছে। হুইলচেয়ারে র্যা ম্প বেয়ে ওঠা কেইশার পিছু পিছু যথেষ্ট দূরত্ব রেখে আমিও উঠে পড়ি। আধো অন্ধকারে চেয়ারগুলো সত্যি সত্যি অনেক দূরে দূরে অ্যারেঞ্জ করে রাখা। এককোণে পেল্লায় মাপের স্ক্রিনওয়ালা একটি টেলিভিসন সেট ও ল্যাপটপ, তাতে ঝিলমিল করছে টেলফেয়ার মিউজিয়ামের চকমিলান দালানটির ছবি। চেয়ারে পা তুলে ডুবুরির হেলমেটের মতো একটি ব্যতিক্রমী মাস্ক পরে বসেছেন ওয়াল্টার আর্চ। আমি তাঁকে 'গুড ইভিনিং' বলি, তিনি জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেন না। চীনা ধ্রূপদি কবিতার এ তর্জমাকার নগরীতে 'ফ্রিল্যান্স রাইটার্স হুইস্কি গিল্ড' নামে একটি আসর চালান। এরা শনিবার সন্ধ্যায় বসেন গুডটাইম জ্যাজ বলে লাইভ মিউজিকে সরগরম একটি রেস্তোরাঁয়। এ আসরের সদস্য হওয়ার জন্য শরাবপান অত্যাবশ্যক নয়, আর্চ নিজেও আজকাল আর পান করেন না, তিনি অম্বলে ভুগছেন, আমি তাঁকে সুবেসাদেকের সময় ঘোলের শরবত পান করার পরামর্শ দিয়েছি। মি. আর্চ একবিংশ শতাব্দীতেও রেমিংটন টাইপরাইটারে কবিতা লিখেন। তাঁর পদাবলির বিষয়বস্তু সিন্ধুঘোটক থেকে মুরগির ভোলা-আন্ডা অব্দি বিস্তৃত। করোনার সংক্রমণের কারণে গুডটাইম জ্যাজ বন্ধ হয়ে গেছে, তাই তিনি পার্কের বেঞ্চে বসতে শুরু করেছেন। কানের কাছে মিনিয়েচার একটি রেডিও লাগিয়ে মি. আর্চ হামেহাল সংবাদ শোনেন, ইয়ারফোন নামক টেকনোলজির সাথে তিনি আদৌ পরিচিত নন, মাঝেমধ্যে অ্যান্টেনা উঁচিয়ে ভলিউম বাড়িয়ে দেন, সংবাদে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিথ্যাচার প্রচারিত হলে কখনোসখনো চীনা ভাষায় চ্যাঙ-ব্যাঙ আওয়াজ দিয়ে তাঁকে শাপশাপান্ত করেন। এ মুহূর্তেও তিনি কানের কাছে ধরে আছেন মিনিয়েচার রেডিওটি। কেইশা তাঁর দিকে তাকিয়ে 'ফর হেভেনস সেইক...ম্যান, জাস্ট শাট দ্যাট থিং আপ', বলে ধাতিয়ে ওঠেন।

আমাদের মেজবান স্কট ক্লার্ক এখনো উডেন ডেকে আসেননি। প্রিয় সুহৃদ মরগ্যান তাঁর সেলফোনে টাইপ করছেন। অস্বস্তি লাগে। আমাদের কারও কারও মুঠোফোনে মৃদুভাবে বিং আওয়াজ হয়। মরগ্যান ইশারায় ফোন তুলতে বলেন। দেখি, তাঁর কাছ থেকে টেক্সটে শোকবার্তা এসেছে। স্কটের বৃদ্ধা অ্যান্ট, তাঁর বাবার সর্বকনিষ্ঠ বোন মিসেস মার্শা ওয়াইজম্যানের মৃত্যু হয়েছে করোনা সংক্রমণে আজ ভোরবেলা। তিরানব্বই বছর বয়সের এ নারী গেল বছর দশেক ধরে বাস করছিলেন অ্যাসিসটেড লিভিং ফ্যাসিলিটি বা বৃদ্ধাশ্রমে। এ রাজ্যে লংটার্ম কেয়ার ফ্যাসিলিটি ও নার্সিংহোমে আজ অব্দি মৃত্যু হয়েছে তিন শতাধিক সিনিয়র সিটিজেনের।

বড়সড় একটি গামলা ক্যারি করে বেরিয়ে আসেন স্কট ক্লার্ক। তিনি তা ফ্লোরে রেখে বসতে বসতে বলেন, 'লেটস বিগিন দ্য শো।' গামলায় সাবানজলে হাবুডুবু খাচ্ছে জ্যাক ডানিয়েল ও ভিনোসান্তোর মিনিয়েচার বোতল ও মোমের মোড়কে পোরা গোডা চিজ। আমাদের কেউ কেউ সুরার ছোট্ট বোতল বা চিজ-টিউব তুলে কাছের বেসিনে গিয়ে ধুয়ে নিয়ে জুত হয়ে বসেন। অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। গামলার পাশে পেল্লায় একটি মোম জ্বলছে টিমটিমিয়ে। ল্যাপটপে টেলফেয়ার মিউজিয়ামের ওয়েবসাইটে গিয়ে স্কট আমার পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ক্রমাগত ক্লিক করছেন, কিন্তু কিছুতেই ভার্চ্যুয়াল শোটি খুলতে পারেন না। কীভাবে তিনি যেন মিউজিয়মের ওয়েব পেজ থেকে ছিটকে বেরিয়ে চলে আসেন গুগলের অ্যাড্রেস বারে। রাজ্যের সব নিউজফিডের ভিড়ে উঁকি দেয় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মুখ, এতে অহেতুক উত্তেজিত হয়ে ওয়াল্টার আর্চ তাঁর মুখোশটি সরিয়ে আওয়াজ দেন, 'প্যাথলজিক্যাল লায়ার।' স্কটও অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন।

অধৈর্য কেইশা নড়েচড়ে নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, 'স্কট, কামঅন ম্যান...দিস ইজ সো সিম্পল...লেট মি টেক কেয়ার অব দিস।' স্কট ল্যাপটপ ছেড়ে বেশ খানিকটা তফাতে গিয়ে দাঁড়ান। কেইশা হুইলচেয়ারে আগ বেড়ে মাউসে ক্লিক করে মুহূর্তে ফের টেলফেয়ার মিউজিয়মের পেজে ফিরে গিয়ে ফুচুৎ করে খুলে ফেলেন ভার্চ্যুয়াল আর্ট শো। আমরা হাততালি দিই। কেইশা কপাল কুঁচকে বলেন, 'ইউ গাইজ রিয়েলি নিড টু লার্ন অল দিজ সুপার সিম্পল টেকনোলজি..।' আমি তাঁকে তোষামোদ করে বলি, 'দ্যাটস রাইট.. ইনডিড।' এ মন্তব্যে বিদ্রূপের গ্রেনেড ফাটিয়ে আমাকে সরাসরি টার্গেট করেন তিনি, 'মাই কমেন্ট ওয়াজ অলসো এইমড অ্যাট ইউ, সুলতান। তোমার আচরণে মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি বাস করছ প্রস্তরযুগে।' প্রতিক্রিয়ায় আমি নিরুত্তর থাকি, তবে কি এ নারীর মধ্যে তৈরি হচ্ছে আমার প্রতি অস্ফুট ক্র্যাশ, সুযোগ পেলেই কেইশা আমার নিন্দা করেন, মুখ ফুটে কিছু বলতেও শরমিন্দা বোধ করি। তিনি ঝাঁঝিয়ে উঠে ফের বলেন, 'দিস ইজ ইয়োর শো...ইয়োর বেইবি...সো কামঅন আপ, সে সামথিং ইন্টারেস্টিং আবাউট জিব্রানস পেইনটিং।'

এ ধরনের জবরদস্ত নারীর সান্নিধ্যে হিম্মত হারানোটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমি এ রকম কিছু অনুমান করে আটঘাট বেঁধেই এসেছি। তো মুখ থেকে চেককাটা গিলাফ সরিয়ে মিন মিন করে বলি, 'জিব্রানের ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলে গেল শতকের দুটি আর্ট মুভমেন্টের কথা দর্শকদের মনে পড়ে যেতে পারে—এ আন্দোলনগুলোর একটি হচ্ছে অ্যাসথেটিজম ও অন্যটি সিম্বলিজম।' কেইশা বিরক্ত হয়ে বলেন, 'দিস ইজ টু থিয়োরিটিক্যাল।' তিনি জিব্রানের একটি-দুটি চিত্র দেখিয়ে বলেন, 'হ্যান্ডসাম ম্যান, জাস্ট লুক অ্যাট দ্য পেইনটিং অ্যান্ড ট্রাই টু ইন্টারপ্রিট...।' প্রতিক্রিয়ার আমি বে-আক্কেলের মতো হে হে করে হাসি। স্ক্রিনে পাথর কুঁদে তৈরি 'স্পিরিট অব লাইট' শিরোনামে যুগলমূর্তির চিত্রটি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ভালো করে তাকালে মনে হয়, ভিন্ন কোনো গ্রহের পাথুরে বাতাবরণে সম্পূর্ণ অচেনা দুটি মানব-মানবীর মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছে প্রণয়ের পুষ্পিত ইমোশন। সাহস করে বলে ফেলি, 'প্যারিসবাসের দিনগুলোতে জিব্রান স্টাডি করেছিলেন ভাস্কর রদ্যাঁর শিল্পকর্ম। তাই কোনো কোনো চিত্রকর্মে তিনি মানুষকে আঁকেন ধ্রুপদি ভঙ্গিতে।' প্রশ্রয়ের হাসি হেসে কেইশা, 'দ্যাটস রাইট, কিপ গোয়িং, ডার্লিং..,' বলে এনকারেজ করেন। স্ক্রিনে ফুটে ওঠে পোশাকবিবর্জিত কিছু ন্যুড ফিগার। খুব গভীরভাবে তাকালে মনে হয় ছবির চরিত্রগুলো যেন এ পৃথিবীর বাসিন্দা নয়, ত্রিশঙ্কু হালতে তারা ঝুলে আছে মহাশূন্যে। পরবর্তী চিত্রগুলোতে তাঁর রেখা ও বর্ণ নরম...মেদুর হতে হতে ঝাপসাভাবে অভিব্যক্তিতে ছড়াতে থাকে নৈব্যক্তিক ব্যঞ্জনা। কেইশা 'রোজ স্লিভ' শিরোনামে একটি চিত্রকে এনলার্জ করেন। এ পর্বে জিব্রান স্পষ্টত বিমূর্ততা কাটিয়ে বর্ণের বিদুর অনুরাগে মূর্ত করে তুলেছেন সম্ভবত চেনা কোনো মানবীকে। গোলাপি টপ পরে হার্পের তারটি ছুঁয়ে মূর্ছনা ছড়ানো এ নারী যেন সুফি-সন্তের মতো নিমগ্ন হয়ে আছেন সুরধ্বনির মরমি মোরাকাবায়।

নারী-পুরুষের যুগলমূর্তি]
নারী-পুরুষের যুগলমূর্তি]

স্ক্রিনে 'জিব্রান ও মেরি হাসকেল' শিরোনোমের যুগল প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তুলে কেইশা তাড়া দিয়ে বলে ওঠেন,' কামঅন, গিভ আস সাম ব্যাকগ্রাউন্ড হিয়ার।' যতটা জানি, মেরি হাসকেল নামে এক প্রয়াত নারী জিব্রানের ১০০ চিত্র ও ড্রয়িং টেলফেয়ার মিউজিয়ামকে দান করেন। স্বীকার করতে বাধ্য হই, মেরি হাসকেলের সঙ্গে জিব্রানের সম্পর্ক নিয়ে আমি তেমন কিছু জানি না। কেইশা বিদ্রূপ করে বলেন, 'ইউ ডিডন্ট ডু ইয়োর হোমওয়ার্ক, ইয়াংম্যান।' বিরক্ত হয়ে বলি, 'স্টপ হেরাসিং মি, ইফ নো সামথিং আবাউট দেয়ার রিলেশনশিপ, প্লিজ স্পিট ইট আউট।' আমার উষ্মা আমলে না এনে কেইশা জবাব দেন, 'দ্যাটস দ্য বেস্ট পার্ট অব জিব্রানস পেইনটিং বিজনেস...আই অ্যাম গোয়িং টু টেল ইউ অল...রাইট নাউ, রাইট অ্যাট দিস মোমেন্ট।'

লাইব্রেরিতে আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশনের ওপর ওয়ার্কশপ দেনেওয়ালা কেইশা এবার গুছিয়ে আমাদের লেকচার দেন। জানতে পারি, শিক্ষাবিদ ও শিল্পসমঝদার হিসেবে পরিচিত মেরি হাসকেল (১৮৭৩-১৯৬৪) বোস্টন শহরের একটি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রিন্সিপাল হিসাবে কাজ করতেন। জিব্রানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯০৪ সালে এক চিত্রকর বন্ধুর স্টুডিওতে। ৩১ বছর বয়সী রমণী মেরির সঙ্গে ২১ বছরের যুবক জিব্রানের অন্তরঙ্গতা হতে দেরি হয়নি। মেরি তাঁকে ৭৫ ডলার স্টাইপেন্ড দিয়ে প্যারিসে পাঠিয়েছিলেন শিল্পকলা স্টাডি করতে। এ প্রসঙ্গে কোনো এক সময় জিব্রান মেরিকে 'শি অ্যাঞ্জেল' অভিহিত করে মন্তব্য করেছিলেন, 'এমন একদিন আসবে, যেদিন আমি বুক চিতিয়ে বলতে পারব, চিত্রকর হতে পেরেছি মেরির কল্যাণে।' মেরির কাছে তাঁর লেখা অনেকগুলো অন্তরঙ্গ চিঠিপত্রের রেফারেন্স দিয়ে কেইশা ঘোষণা করেন, 'দ্যাট ইজ গোয়িং টু বি আ হৌল সেপারেট ডিসকাশন।' স্ক্রিনে মেরি হাসকেলের বহুমাত্রিক একটি প্রতিকৃতি ঝলসে ওঠে। চার-চারটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আঁকা এ চর্তুমুখ প্রতিকৃতিতে একত্রে মূর্ত হয়েছে মুগ্ধতা, ভাবনাঋদ্ধ প্রতিফলন, বিস্ময় ও বিষণ্নতা।

পরের চিত্রটি জিব্রানের আত্মপ্রতিকৃতি। চেষ্টা করি, লেবাননে জন্ম নেওয়া এ তরুণের নিবিড় নিমগ্নতার স্বরূপ আঁচ করতে। মেজবান স্কট ইশারায় কেইশাকে আর্ট-শো গুটিয়ে ফেলতে অনুরোধ করেন। স্ক্রিনে মুহূর্তের জন্য জিব্রানের একটি কবিতার দুটি চরণ ফ্লাশ করে, 'অনলি হোয়েন ইউ ড্রিংক ফ্রম দ্য রিভার অব সাইলেন্স/ শ্যাল ইউ সিং..।' তারপর নিভে যায় ল্যাপটপের পর্দার শুভ্র-নীলাভ আলো।

মেজবান স্কট টাইপ করতে করতে ইশারায় আমাদের সেলফোনের টেক্সটে নজর দিতে অনুরোধ করেন। তাঁর প্রতিবেশী কৃষ্ণাঙ্গ এক দম্পতি লকডাউনের মাস দেড়েক ধরে কর্মচ্যুত হয়ে বাড়িতে বসে আছেন। পরিবারের পুরুষটির ডায়াবেটিসের ওষুধ ফুরিয়েছে। এখনো বেকার ভাতার কোনো সংকুলান করতে পারেননি। তাঁদের সন্তানসংখ্যা তিন, সংসারের খরচ চালানো দিনকে দিন কঠিন হয়ে উঠছে। তাই হাইস্কুলপড়ুয়া মেয়ে হেইলি জানাশোনা প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গান করে ফান্ডস সংগ্রহের চেষ্টা করছে।

টেক্সট পড়া শেষ করে পদশব্দে চোখ তুলতেই দেখি, ব্যাকইয়ার্ডের স্যান্সার লাগানো মৃদু বাতিটি জ্বলে ওঠেছে। তার আলোয় দেখতে পাই, উডেন ডেকের নিচে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যাঞ্জো গলায় একটি কৃষ্ণাঙ্গ কিশোরী। সে রংচঙে ব্যান্ডেনা দিয়ে বানানো মাস্ক সরিয়ে ব্যাঞ্জোর রিদমিক বাদনের সাথে সুর মিলিয়ে গেয়ে ওঠে। তার গলা রেওয়াজে পরিশীলিত নয়, তবে সুরেলা ও সুইট। 'এভরি ডে ইজ মাই ভ্যালেনটাইন..' গানের এ কথাটি সান্ধ্য নীরবতায় ছড়িয়ে পড়ে জোরেশোরে। আমাদের দিনযাপন থেকে ভ্যালেনটাইনের সম্ভাবনা উবে গেছে অনেক বছর হলো, বোধ করি তাই এ ধরনের লিরিকে কেউ বিশেষ উদ্দীপ্ত বোধ করে না। গানটি শেষ হতেই আমরা দায়সারাভাবে হাততালি দেই। ওয়াল্টার আর্চ ডুবুরির মতো দেখতে মাস্কটি সরিয়ে মুখমণ্ডল তেড়াবেড়া করে হাই তুলেন। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মনে হয়, গোর আজাবের আসন্ন সম্ভাবনায় চেয়ারে পা তুলে তাঁর শরীর ক্রমশ গুটিয়ে যাচ্ছে।

ব্যাঞ্জোটি বেজে ওঠে ফের। এবার খুব ধীরলয়ে হেইলি বাজাচ্ছে কান্ট্রি ওয়েস্টার্ন মিউজিকের মরমি টিউন। অনেক পুরোনো দিনের বিস্মৃত সুর। মরগ্যানের হঠাৎ করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা অভিব্যক্তি থেকে আন্দাজ করি, তিনি ধরতে পেরেছেন, কে কবে কোন সালে এ সংগীতটি প্রথম রেকর্ড করেছিলেন। থার্মোমিটারের পারদ নেমে যাওয়ার মতো আমাদের মুড দ্রুত পরিবর্তিত হয়। স্কটের কাছ থেকে ফের টেক্সট আসে। তিনি একটি লিংক দিয়ে জানাচ্ছেন, কেউ হেইলিকে টিপস দিতে চাইলে এখানে ক্লিক করতে। ব্যাঞ্জো থেকে এবার ছড়াচ্ছে বৃষ্টি-মেদুর মূর্ছনা। সচেতন হয়ে উঠি সংগীতের থেরাপিউটিক ভূমিকা সম্পর্কে। দেখি, ওয়াল্টার আর্চও চোখ মুদে মশগুল হয়ে তাল ঠুকছেন।

● এ রচনায় মানুষজনদের নাম প্রাইভেসি রক্ষা করার প্রয়োজনে বদলে দেওয়া হয়েছে। ছবি ও প্রাসঙ্গিক তথ্যের সূত্র ইন্টারনেট