আলোর পথযাত্রী

আবদুস ছাত্তার খান
আবদুস ছাত্তার খান

কোনো এক সকালে খাসিয়াদের গাছ কাটার প্রতিবাদে জাতীয় জাদুঘরের সামনে মানববন্ধনটা শেষ করে একটু ছায়ায় দাঁড়িয়েছি। এমন সময় এক তরুণ এসে দাঁড়ায়। চোখভরা স্বপ্ন, হাতে নোট বই আর কলম।
-‘আমার নাম ছাত্তার, আমি পাঠাগার আন্দোলন করি।’
-‘কোথায়?’
-‘আমার বাড়ি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের অর্জুনা গ্রামে।’
এখন গ্রামে গ্রামে এনজিও, তাই প্রায় কথা শেষ করার জন্যই বলি, ‘ও! এনজিও?’
দৃঢ় প্রতিবাদ ছাত্তারের কাছ থেকে—‘না, এনজিও নয়, একেবারে নিজেদের উদ্যোগ, গ্রামবাসীদের উদ্যোগ।’ এবার ভালো করে তাকাই ভদ্রলোকের দিকে।
-‘আপনার ফোন নম্বরটা পেতে পারি, বা একটা কার্ড?’
ফোন নম্বর দিয়ে দিই। কার্ডের কারবার কোনো দিনই ছিল না। আমি গাড়িতে উঠব, শেষ কথাটি বলল তরুণ। যোগাযোগ করব বলে তার ফোন নম্বরটা দিয়ে দিল। কিছুটা অবহেলায়ই কেন যেন ফোন নম্বরটা সেভ করে নিলাম।
তারপর মাস খানেক চলে গেছে, হঠাৎ একদিন ফোন।
‘কালকে বাসায় আছেন?’
বললাম, ‘হ্যাঁ, আছি।’ পরদিনই ঘর্মাক্ত কলেবরে বাসায় এল ছাত্তার। জানতে শুরু করলাম তার পাঠাগার আন্দোলনের কাহিনি।
প্রথমেই ঢাকায় মধ্যবিত্তের সন্দিগ্ধ প্রশ্ন। পাঠাগারের জন্য তো অর্থ প্রয়োজন। অর্থ আসে কোত্থেকে?
সাত্তারের সরল উত্তর, ‘পাঠাগারের জন্য অর্থের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন সদিচ্ছার।’
-বই কেনার জন্য টাকা লাগে না? বুকশেলফের জন্য...
-‘বই জোগাড় হয়ে যায়, আর বুকশেলফ নিজেরাই বানাই। সবার আগে একটা জায়গা। মানুষকে বুঝিয়ে বললে একটা জায়গা অনেকেই দেয়। স্কুল-কলেজে একটা লাইব্রেরি থাকেই, তবে সেখানে বই থাকে না। বিকল্প একটা জায়গা প্রথমে আমরা খুঁজি। তারপর সেখানে বুকশেলফ লাগে। গ্রামের বৃদ্ধ গাছটি হয়তো কয়েক দিন পর মরে যাবে। সেই গাছটির মালিক সাধারণত হয় সরকার। গণপ্রতিনিধি তো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার, তাই তাঁদের কাছে ধরনা দিই। তাঁরা রাজি হলেন, আমরা নিজেরাই গাছটি কেটে নিই। গাছ কাটার জন্য, তক্তা বানানো ও বুকশেলফ বানানোর জন্য যে দক্ষতাটুকু লাগে, তা আমরা আগে থেকেই রপ্ত করে নিয়েছি। লাইব্রেরিটি দাঁড়িয়ে গেলে এ সংবাদ বেশ কয়েকটি গ্রামে ছড়িয়ে যায়। তারা আমাদের কাছে আসে। ওই যে বুকশেলফ নির্মাণের ব্যাপারে আমরা এগিয়ে যাই।
যা হোক, মোদ্দা কথা হলো— ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের এবার দশ বছর পূর্তি হবে ২০ ফেব্রুয়ারি। আপনাকে এসে বইমেলাটি উদ্বোধন করতে হবে।’
পরদিন একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকায় কত কাজ! তবুও আমি রাজি হয়ে যাই। সস্ত্রীক রওনা দিই অর্জুনার পথে। পথে অবশ্য টাঙ্গাইলে মায়ের সঙ্গে দেখা করি। খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে টাঙ্গাইল থেকেও একটু দূর। গ্রামটি গাছ-গাছালি আর ছায়া সুনিবিড়। বেশ প্রাচীন সব বৃক্ষ। পৌঁছে যাই অন্বেষা পাঠাগারের সামনে। খুব বড় ধরনের কোনো আয়োজন নয়। একেবারেই গ্রামীণ আয়োজন। তবে কাজটাই তো মুখ্য। বিকেলে উদ্বোধন। মেলাস্থলে গিয়ে পরিচয় হলো বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে। জানলাম, এখন ৪১টি পাঠাগার গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জেলায়। একেক পাঠাগার একেক ইতিহাস। মেলায় গিয়ে গণপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখাও হলো। এই উদ্যোগে তাঁরাও আছেন। গণপ্রতিনিধিরা রাজনীতি করেন। তাঁদের দল আছে, দলাদলিও আছে। এই উদ্যোগে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হলে বিপদও আছে। এ জন্য পাঠাগার আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কৌশলী হতে হয়।
আজকের দিনে পাঠাগার? তা–ও আবার গ্রামে!
টাঙ্গাইল কবিদের জায়গা। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে কবিরা স্লোগান দিয়ে বললেন, ‘কবিতাই পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে।’ মনে মনে ভাবি, তাহলে এই পাঠাগার আন্দোলন কি তথাকথিত বিশ্বায়ন আর বাজার অর্থনীতির যে আক্রমণ, তা ঠেকাতে পারবে? ১০ বছরে যেখানে গ্রামে ৪১টি পাঠাগার গড়ে উঠেছে, সেখানে একটু স্বপ্নের জায়গা তো তৈরিই হয়। গ্রামপর্যায়ে আজ সাইবার ক্যাফে, বিউটি পারলার, ডিভিডির দোকানসহ নানা ধরনের দোকান গড়ে উঠেছে, সেখানে একটি পাঠাগার তো বেচারা! অবক্ষয়ী, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়া তরুণদের মধ্যে কিছু আলোকিত মানুষও তো তৈরি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
আর সবকিছুই তো বিপণন অথবা সরকারি উদ্যোগের দায়সারা কাজ; কিন্তু এখানে তো আন্দোলন। মানুষকে নিয়ে তাদের মধ্য থেকে উৎসারিত একটা আন্দোলন। বই পড়া শুধু নয়, তা নিয়ে আলোচনা। অবসরগুলোকে বই পড়ে, জ্ঞান দিয়ে ভরিয়ে তোলা।
আলোকিত মানুষ তৈরির নিরলস প্রচেষ্টা তো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ করেই যাচ্ছেন বহু দিন ধরে। সেখানেও পাঠক তৈরি হচ্ছে। এখানে ছাত্তারের মতো লোকেরা যদি গ্রাম থেকে আন্তরিকভাবে আন্দোলনটা চালিয়ে যায়, গ্রামের মানুষেরা যদি নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে এর অংশীদার হোন, তাহলে সত্যিকার অর্থেই একজন স্বশিক্ষিত মানুষ গড়ে উঠতে পারে। ছাত্তারের স্বপ্ন ছিল অর্জুনায় একটা কলেজ গড়ে তুলবে। তা–ও হয়েছে। অন্বেষা পাঠাগার তারই সহোদর।
যা হোক, সন্ধে নেমে আসে। আলো জ্বলে উঠল বইমেলার। খুব বড় ধরনের আলো নয়, গ্রামবাংলায় যতটুকু আলো পৌঁছায়। সেই আলোতে কিছু কৌতূহলী মানুষের চেহারা দেখা যায়। তাতেই উদ্বোধন হয়ে যায় বইমেলার। মনে পড়ে বিদ্যাসাগরের কথা—দুটি আলো মানুষের, একটি জীবনের আলো, অন্যটি শিক্ষার আলো।
অবহেলিত তৎকালীন পূর্ব বাংলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামটি মনে পড়ে, যেখানে রয়েছে একটি মোমের আলো। সত্যের আলো তো ছোটই হয়। সেই সত্যের আলোটাই জ্বালিয়ে চলেছে ছাত্তার আর তার সহযাত্রীরা। ঢাকার পথে চলেছে গাড়ি, গ্রামের পথে স্বল্পালোকে জ্বলে উঠেছে হেডলাইট। কিন্তু সে আলো ম্লান হয়ে ওই ছোট্ট আলোগুলোই মুখ্য হয়ে ওঠে—একটা গানের প্রথম লাইনটি বেজে ওঠে প্রাণে—হে আলোর পথযাত্রী...
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব