ট্র্যাফিক

নুরু পাগলা। বাপ-মায়ের দেওয়া নাম ছিল নুরু। পাগলা উপাধি রাস্তার মানুষজন দিয়েছে। এখন যে এলাকায় থাকে, সেখানেই তার বাড়ি কি না, তা নুরু জানে না। তার যতটুকু মনে পড়ে, একদিন রাস্তায় কার সঙ্গে জানি মারামারি লেগেছিল তার। আবছাভাবে চোখে ভাসে। নুরুর ধারণা, এর পর থেকেই সে রাস্তায়।

নুরু অবশ্য রাস্তায় ফ্রি'তে থাকে না। কিছু কাজও করে। দেশ-জাতির মঙ্গল করেই রাস্তায় থাকার অধিকার সে আদায় করে নিয়েছে।

নুরু এই এলাকার মোড়ের ট্র্যাফিক জ্যাম কমায়। অবাক লাগছে শুনে? চোখ কপালে তোলার মতো কিছু হয়নি। পাগলে কি গিট্টু বোঝে না? দড়িতে কত গিঁট আগে লাগা তো নুরু! সেটাই পরে কাজে লেগেছে। তবে আগে শুধু লাগিয়ে রাখত, খুলত না। এখন সে গিঁট খুলতেও পারে।

মোড়ের ট্র্যাফিক পুলিশের সঙ্গে ভালো খাতির হয় নুরুর। পাগলের চোখে যে চশমা থাকতে পারে, তা তারা কল্পনা করতে পারেনি। ওই বিহ্বলতা থেকেই জন্ম নিয়েছিল সংশয়। সেই সংশয় থেকে আসে অনুগ্রহ। আর অনুগ্রহ একসময় দেয় অনুমতি। নুরুর ক্ষেত্রে এটা ছিল একটা ছোট লাঠি বগলে করে চিৎকার করার অনুমতি। তা দিয়েছিল একজন সদাশয় কনস্টেবল। এর পর থেকেই ট্র্যাফিক পুলিশদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরির উত্তরাধিকার পেয়ে যায় শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় একই হাফশার্ট পরা নুরু। শার্ট একটা থাকলেও, প্যান্ট অবশ্য তার দুটো আছে।

ঝামেলাও হয়েছে এই কাজ করতে গিয়ে। প্রথম প্রথম এলাকার মানুষই মানত না। পাগল বলে হেলা করত। কিন্তু অন্য এলাকার মানুষ তো বুঝত না, না বুঝে তারা মানতে শুরু করে দিল। তাতেই বাজিমাত। একজনকে মানতে দেখলে আরেকজনও বিভ্রান্ত হয়ে যায়।

নুরুকে অবশ্য এখনো কেউ কেউ মানতে চায় না। পুলিশের মতো নির্দিষ্ট পোশাক তো তার নাই। কিন্তু পুলিশ ওকে কাজে লাগানোয় সুবিধা হয়েছে। পুলিশ দাম দিলে অন্যরাও দেয় কিছুটা। খাবার পায় ফ্রিতে। এভাবে দিন কেটে যাচ্ছিল ভালোই। তবে গত সাত দিনে শুরু হয়েছে সমস্যা। কাজ নাই নুরুর। ট্র্যাফিক পুলিশ নাই মোড়ে। কারণ গাড়িই যে নাই!

এত ফাঁকা রাস্তা নুরুর ভালো লাগে না। আবার পরিচিত পুলিশের দেখা মেলে না। নতুন পুলিশ তাকে সাধারণ পাগল ভাবছে। সে যে অসাধারণ, এটা তারা জানতে পারছে না। কারণ, জানানোর মতো চেনা পুলিশ তো রাস্তায় নাই। সমস্যা বাড়ছেই। সবাই নুরুকে রাস্তা মাপতে বলে। রাস্তা ছাড়া কি এতই সোজা? বললেই হলো?

এই রাস্তায় থাকার অধিকার এক দিনে পায়নি নুরু। তিল তিল করে অর্জন করতে হয়েছে। প্রথম দিকে সবাই দূর দূর করত। তবে আধা ন্যাংটা পাগলকে যেমনভাবে দূর দূর করে, ঠিক তেমন নয়। আসলে ওর হাফশার্ট ও ভালো প্যান্টের কারণে এবং সর্বোপরি চোখে থাকা চশমার কারণে সবাই ঠিক ঠাওর করতে পারত না। ভাবত ভাবের পাগল। কিন্তু নুরু যে সম্পূর্ণ পাগল, তা কেউ বিশ্বাস করতে চাইত না। এই বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দোলাচলেই ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছিল নুরু। আর তাতেই সে বনে গিয়েছিল ট্র্যাফিক পুলিশের হেল্পার। অবশ্য ঝামেলাও করেছে অনেক। একবার রাগের চোটে হাতের লাঠি দিয়ে একটা প্রাইভেট কারের এক পাশের ব্যাকলাইট ভেঙে ফেলেছিল। তাতে গাড়ির মালিক বের হয়ে এই মারে তো সেই মারে। পুলিশ এসেও উল্টো ওই ব্যাটার পক্ষ নিয়েছিল। অথচ ডাণ্ডা দিয়ে পুলিশই বলেছিল সব ঠান্ডা করতে। রিকশা বা প্রাইভেট কারে ভেদাভেদ করার কথা তখন বলেনি। অথচ সেই কাজ করাতেই বসের থাপ্পড় খেতে হয়েছিল নুরুকে। সে কীভাবে বুঝবে যে রিকশা গাড়ি, সিএনজি গাড়ি আর প্রাইভেট গাড়ি এক নয়? নুরু কীভাবে বুঝবে যে কোনটায় বাড়ি দিতে হবে, আর কোনটায় হাত বুলাতে হবে?

এসব প্রশ্নের জবাব পায়নি নুরু পাগলা। পাগল বলেই হয়তো কেউ উত্তর দেয়নি। ওই ঘটনায় দুই দিন তাকে কাজে নেয়নি পুলিশ। পরে অবশ্য হাতে-পায়ে ধরে ডাণ্ডা ফিরে পেয়েছিল নুরু।

অথচ এই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী নুরু এখন ফুটপাতে শুয়ে মাছি গোনে! কারণ গাড়ি নেই রাস্তায়। আর মাছিগুলোরও আক্কেল ভারি! গাড়ি নেই বলে তারাই এখন রাস্তায় মার্চ করে। কিন্তু তাদের কখনো জ্যাম হয় না। তাই নুরুর ডাকও পড়ে না।

কাজ যেমন নেই, তেমনি নুরুর খাবারও নেই। এ আরেক জ্বালা হয়েছে। আগে মোড়ের কাছে থাকা জলিলের রেস্তোরাঁয় খাবার পেত। সাত দিন হলো তা বন্ধ। ত্রাণের লাইন ঠিক করে দিয়ে অবশ্য কিছু চাল-ডাল পেয়েছিল। কিন্তু সেখানে আবার ডাণ্ডার বাড়ি দেওয়া যায় না। নুরুর হাত খালি নিশপিশ করে। শেষে আরও জোরে জোরে চিৎকার দিয়েই দুধের সাধ ঘোলে মেটায় নুরু।

এই কাজও একসময় বন্ধ হয়ে যায়।

প্রথম সাত দিন ও দ্বিতীয় সাত দিন কিছু কাজ থাকলেও তৃতীয় সাত দিন পার হওয়ার পর পুরো বেকার হয়ে পড়ে নুরু পাগলা। কাজ না থাকায় পেটে শুরু হয়ে যায় লকডাউন।

পঞ্চম সাত দিনের প্রথম ভোর

চশমা পরে ঘুমিয়ে ছিল নুরু। চোখ খোলার পর বুঝতে পারে, তা-ও ঘোলা দেখছে। একটা মাছি চোখের সামনে দিয়ে উড়ে গেলেও তাকে বাধা দিতে পারে না নুরু। হাত ওঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসা অস্ফুট চিৎকার তা থামিয়ে দিল।

দৌড়ে আসা একজন দুই হাত দূরত্বে চলে আসার পর নুরু বুঝতে পারল, ওটা মানুষ, মাছি নয়। কারণ, মাছির হাতে লাঠি থাকে না।

দূরত্ব অবশ্য আর কমল না। কারণ লাঠি অনেক লম্বা ছিল।

সকালের ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে চোখ বুজে ফেলল নুরু পাগলা। এবার তার কোয়ারেন্টিনে যাবার পালা।