কৃষ্ণকলি

অলংকরণ: স্বপন চারুশি
অলংকরণ: স্বপন চারুশি

প্রকাণ্ড আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রুবি। 
আয়নাটা ওর দাদির। রুবির দাদাজান বহু শখ করে তাঁর বউকে মানে রুবির দাদিকে এই বিশাল আয়নাটা বানিয়ে দেন। রুবির দাদি অসম্ভব রূপবতী ছিলেন; লোকমুখে বহুবার এই কথা শুনেছে ও। ওদের বাড়ির কেউই দাদির রূপ পায়নি। কিন্তু রুবির ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও জটিল। রুবি বাড়ির কারও মতোই হয়নি। দুধে-আলতা গায়ের রং ছিল রুবির দাদির। ‘অসম্ভব রূপবতী’ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন ঠিক তা-ই।
রুবির গায়ের রং শ্যামলা, শ্যামলা বলা ঠিক হবে না। সেই শ্যামলা রং এখন কালোতে পরিণত হয়েছে।
কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে রুবি। বিশাল আয়নার সামনে বেশ অসহায় লাগছে ওর।
লাল রঙের টিপটা আবারও কপালে পরল ও। ‘না, ঠিক মানাচ্ছে না’, নিজের মনেই ভাবল রুবি।
খুলে ফেলবে কি না ঠিক বুঝতে পারছে না। আশপাশেও কেউ নেই যাকে জিজ্ঞেস করা যায়। সবুজ শাড়িটাতেও নিজেকে মানাচ্ছে কি না বুঝতে পারছে না।
মাকে জিজ্ঞেস করা যায়, কিন্তু তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। আজ তিনি অনেক ব্যস্ত।
ব্যস্ত থাকাও স্বাভাবিক। আজ রুবিকে দেখতে আসছেন ছেলের বাড়ির লোকেরা। এটা অবশ্য প্রথমবার নয়, এর আগেও চারবার এসেছেন। তাঁরা রুবিকে দিয়ে বহু কিছু করিয়েছেন। কেউ হাঁটিয়েছেন, কেউ বা নানা রকমের প্রশ্ন করেছেন। তাই এ বিষয়গুলো ওর জন্য মোটেও নতুন নয়।
তবে কষ্ট যে ওর হয় না তা তো নয়, নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হয় না, তা-ও কিন্তু না।
লাল টিপটা আবার কপাল থেকে খুলে রাখল রুবি আর কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ল, পারি জমালো ওর কৈশোরে। ঠিক সেই দিনটি ওর মনের স্বচ্ছ আয়নায় বারবার ভেসে উঠতে লাগল। যে দিনটিতে রুবি বুঝতে পারল ‘ভালোবাসতে সুন্দর একটা মন নয়, সুন্দর একটা মুখ থাকতে হয়।’
মোটামুটি লম্বা আর চোখে গোল ফ্রেমের চশমা পরত ছেলেটি । চশমার রং ছিল রুপালি। নাম ছিল ছেলেটির অর্ঘ্য। ছেলেটিকে অসম্ভব ভালো লাগত রুবির। সাদা শার্টে দারুণ মানাত অর্ঘ্যকে। এখনো প্রায় সাদা শার্ট পরা অর্ঘ্যকে স্বপ্নে দেখে রুবি। এই ভালো লাগার বয়স তখন কত ছিল? কোন ক্লাসে পড়ে তখন ও? সম্ভবত নবম কি দশম শ্রেণিতে। নানাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণের আপ্রাণ চেষ্টা।
ক্লাস ছুটির পর অর্ঘ্যর অপেক্ষা। না, কোনো কিছুতেই একটি বারের জন্যও রুবির দিকে তাকায়নি সেই ছেলেটি । একদিন সাহস করে বলেই দিল রুবি ওর মনের কথা...
ছোট বোন রুবার ডাকে ঘোর ভাঙে রুবির। চোখের কোণে কিছু নোনা জলের অস্তিত্ব অনুভব করল ও । চোখের পানি আপ্রাণ লুকোবার চেষ্টা করল তবে শেষ রক্ষা হলো না।
- তুমি কি কাঁদছিলে?
- না, চোখে কাজল চলে গেছে।
- ও আচ্ছা! তুমি তৈরি তো? ওরা কিন্তু চলে এসেছে।
- হুম, তুই যা আর মাকে একটু পাঠিয়ে দে।
- মা আসতে পারবে না, তুমি চলো, তোমাকে ডাকছে।
- কেমন লাগছে?
- মন্দ না।
আয়নায় আর একবার নিজেকে দেখে নিল রুবি।
পর্দার ফাঁক দিয়ে সাদা শার্ট পরা একজনকে দেখা যাচ্ছে। রুবি মানুষটিকে দেখছে না, দেখছে সাদা শার্টটিকে।
চায়ের ট্রে হাতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে রুবি।