মানুষের ভালোবাসা যথেষ্ট পেয়েছি: আনিসুজ্জামান

ড. আনিসুজ্জামান
ড. আনিসুজ্জামান
১৪ মে,২০২০ বৃহস্পতিবার প্রয়াত হয়েছেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন সাজ্জাদ শরিফ। সেটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘আলাপে ঝালাতে’ বইটিতে। সেখান থেকে সাক্ষাত্কারটি পাঠকদের জন্য পরিবেশন করা হলো।

সাজ্জাদ শরিফ: আপনার দাদা, বাবা, আপনি-বাঙালি মুসলমান সমাজের বিবর্তনের ধারার একটি উদাহরণ হিসেবে সম্ভবত আপনাদের দেখা যেতে পারে। মুসলিম স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আপনার দাদা আবদুর রহিমের গর্ব ছিল। তিনি লেখালেখি করেছেন ইসলাম ধর্ম ও মুসলমান সমাজের গৌরবময় মুহূর্তগুলো নিয়ে। পাকিস্তান আন্দোলনে আপনার আগের প্রজন্মের উত্সাহ ও সমর্থন ছিল। পরবর্তী প্রজন্মে-আপনাদের সময়ে-আপনারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চলে গেলেন। এই পরিবর্তন দিয়ে শুরু করা যাক।

আনিসুজ্জামান: আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা যদি বলি, আমার দাদা মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবাদ নিয়ে কথা বলেছেন, বঙ্গভঙ্গের পক্ষে থেকেছেন। আমার আব্বা ছিলেন অরাজনৈতিক মানুষ, তবে তিনি পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছেন। আমরা স্কুলে পড়ার সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দিয়েছি এবং পাকিস্তান চেয়েছি। আমার মনে জিজ্ঞাসা জাগল ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে-যাকে বলা হয় ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’। আমরা তখন কলকাতায়। আমি মানুষ খুন হতে দেখলাম। আমাদের পাড়া থেকে মানুষ চলে গেল। আমাদের বাড়িতেও অন্য পাড়া থেকে এসে আত্মীয়স্বজন আশ্রয় নিল। মানুষের সে কী দুর্দশা! একগাদা দুস্থ ছেলেমেয়ে-প্রায় সবাই বাবা-মা হারানো-তারা জায়গা নিল আশ্রয়-শিবিরে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, মানুষের মৃত্যু-এসব আমার মন-মানসিকতা বদলে দেয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলো। আমরা কলকাতা থেকে খুলনায় চলে এলাম। ১৯৪৮ সালে ভাষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হলো। এস এম আমজাদ হোসেন, যিনি মোনায়েম খাঁর সময়ে শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন খুলনা মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা। তিনি আমাদের বোঝালেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করলে পাকিস্তান শেষ হয়ে যাবে। কথাটি আমার বিশ্বাস হলো। স্কুলে ধর্মঘট হলো। ধর্মঘট পালন করলাম, কিন্তু মিছিলে গেলাম না। আমি দোলাচলে পড়ে গেলাম। একদিকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি; আবার পাকিস্তান টিকে থাক, সেটাও চাচ্ছি। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় চলে এলাম। ১৯৪৯ সালে ভর্তি হলাম স্কুলে। ১৯৫০ সালে আবার সীমান্তের দুপারে দাঙ্গা। তখন আমি প্রবল দাঙ্গাবিরোধী। আমাদের স্কুলে উদ্বাস্তু শিবির হলো। আমাদের এক শিক্ষক ছুরিকাঘাতে আহত হলেন। এসব আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করল। তখন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়েই পাকিস্তানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে শুরু করে। ততদিনে আমি দশম শ্রেণীতে পড়ি। বুঝে গেছি, বাংলা কেন রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। এভাবে ধীরে ধীরে আমার মধ্যে পরিবর্তন হতে থাকে। যখন কলেজে উঠেছি, তখন আমার মনোভাব মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। মনে হয়েছে, এই আন্দোলনের জন্য আমি প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি। ১৯৫২ সালের শেষদিকে আমার ধর্মবিশ্বাস চলে যায়। এর একটা কারণ ছিল। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আমি বেশ নামাজ পড়তাম। একদিন মসজিদে খুতবার সময়ে ইমাম সাহেব মুসলমানের উন্নতি আর হিন্দু ও ইহুদিদের বিনাশ চাইলেন। এই শুনে আমি মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এই যে মানুষকে বিভক্ত করার চেষ্টা, তা আমার মনে প্রতিক্রিয়া জাগিয়েছিল। ১৯৫২ সালের পর আমি বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে আসি। বলা যায়, ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২-এই ছয় বছরে ধীরে ধীরে আমার মনোভাবে একটা বড়রকম পরিবর্তন আসে।

সাজ্জাদ: আমরা দেখেছি, যাঁরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে বা পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছেন, তাঁদের মনোভাব গঠনে ধর্ম অনেক সময়ে তীব্র ভূমিকা রেখেছে। ধর্ম অনেকের ভাবনার প্রধান এক ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ আবার ধর্ম থেকে দূরে সরে গেছেন। আপনাকে আমরা এই দ্বিতীয় দলে দেখতে পাই। আপনারা এই মন গড়ে উঠল কীভাবে?

আনিসুজ্জামান: এটা ব্যাখ্যা করা খুব মুশকিল। সাহিত্য পড়ে অনেকটা প্রেরণা পেয়েছি। পারিবারিকভাবে আমাকে স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া হয়েছে। আমার আব্বার সেই উদারতাটি ছিল। আমার স্কুলজীবনের শেষে ও কলেজজীবনের শুরুতে একটা বড় প্রভাব ছিল আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামানের। তাঁর মাধ্যমে ইংরেজি সাহিত্যের সংস্পর্শে আসি। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্য নিয়ে তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল। এটা একটা বড় কাজ করেছিল। তারপর কলেজে-শিক্ষক-বিশেষ করে অজিতকুমার গুহ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আবদুল মতিন-তাঁদের প্রত্যেকের পড়ানোর মধ্যে এমন একটি রুচি ছিল, যা আমাদের উদার হতে ও অসাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দিতে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে কাজ করেছিল।

সাজ্জাদ: পরবর্তী সময়ে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে। কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট মানুষ বা ঘটনার কথা কি মনে পড়ে, যা আপনার পরিবর্তনে বড় কোনো ভূমিকা রেখেছে?

আনিসুজ্জামান: ভাষা আন্দোলন একটি বড় প্রভাব ফেলে। এটি একটি আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে যখন গুলি চলল, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যাচ্ছি অবসন্ন হয়ে রেললাইন ধরে, তখন মনে হয়েছিল, আমরা হেরে গেছি। কিন্তু পরের দিনই মনে হলো-না, এটি তো শেষ হয়ে যায়নি, এখনো রয়ে গেছে। এটি মনের মধ্যে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এল। আমার বয়স তখন ১৫ বছর। কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি। যুবলীগ থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে আমি পুস্তিকা লিখেছি। এসবই একটা প্রেরণার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফল।

সাজ্জাদ: হাসান হাফিজুর রহমানের ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের সঙ্গেও আপনি যুক্ত হয়েছিলেন। তখনকার লেখক-শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গে আপনার সখ্য গড়ে উঠল কীভাবে?

আনিসুজ্জামান: পাকিস্তান সাহিত্য সংসদে যাওয়াটা আমার আকস্মিকভাবে হয়েছে। শিল্পী আমিনুল ইসলাম আমাদের প্রতিবেশী ছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই হাসান হাফিজুর রহমান, মুর্তজা বশীর, বিজন চৌধুরী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর-এঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তারপর সাহিত্য সংসদ হলো, সেখানে আমি যাচ্ছি। সেখানে সাহিত্যসভা করতে করতে একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠছে, সেটা উপলব্ধি করছি।

সাজ্জাদ: আপনার পরিবারে লেখালিখির পরিবেশ ছিল। আপনার দাদা লিখতেন, মা লিখতেন, বড় বোন লিখতেন। আপনার মা ও বড় বোনের সৃজনশীল সাহিত্যের দিকে ঝোঁক ছিল। সূচনায় আপনারও ছিল তা-ই। আপনি ছোটগল্প লিখতেন। পরে মননশীল রচনার দিকে চলে এলেন কী করে?

আনিসুজ্জামান: এমএ পড়া পর্যন্ত আমি গল্প লিখেছি। সেটার ব্যাপ্তি ১৯৫০ থেকে ১৯৫৭ সাল। সময়টা কম নয়। কিন্তু নিজের গল্প নিয়ে মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতানি থেকে গেল। ততদিনে সাহিত্য সংসদের জন্য আমি প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছি। পরে প্রবন্ধের দিকেই ঝুঁকলাম।

সাজ্জাদ: আপনি লেখালিখি শুরু করেছেন কিশোর বয়স থেকে। সেখানে কি এই পারিবারিক আবহ কোনো প্রভাব রেখেছে?

আনিসুজ্জামান: কিছুটা। কলকাতায় আমরা হাতে লেখা পত্রিকা বের করব সংকল্প করেছিলাম। তার জন্য বড়দের কাছে লেখা চাইতে গেলাম। তাঁরা বললেন, তোমরা কী পত্রিকা সম্পাদনা করবে? আমরা পত্রিকা বের করি, তোমরা আমাদের সঙ্গে থাকো। নতুন দিন নামে একটি পত্রিকা বের হলো। আমরা লেখা জোগাড় করলাম। আমাদের লিখতে বলা হলো। আমরাও লিখলাম। সেটাই লেখালিখির সূচনা। তারপর ১৯৪৮ সালে আমরা খুলনা চলে এলাম। সেখানে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্প অবলম্বনে একটি গল্প লিখলাম। খুলনায় হাতে লেখা কাগজে সেটা প্রকাশিত হলো। পরে ঢাকায় এসে সে গল্পটাই আবার নতুন করে লিখলাম। সেটি নওবাহার-এ ছাপা হলো ১৯৫০-এ। সেটাই আমার প্রথম মুদ্রিত রচনা। পরে ১৯৫৩-৫৪ সাল থেকে প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করলাম। এরপর ক্রমশ সেদিকেই ঝুঁকে পড়লাম।

সাজ্জাদ: আপনার কিশোরবেলায় কি আপনাদের বাসায় কোনো পত্রপত্রিকা যেত? সেই বয়সে মূলত কী পড়েছেন আপনি?

ড. আনিসুজ্জামান
ড. আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান: ঘরে পত্রপত্রিকা কেনা হতো, যেমন সওগাত ও মোহাম্মদী। দৈনিক আজাদ-এর ‘মুকুলের মহফিল’ ছিল আমার প্রিয় পাতা। বাড়িতে বইপত্র কেনা হতো। আমার দাদার বই যাঁরা প্রকাশ করতেন, তাঁরা সব সময়ে টাকাপয়সা দিতে পারতেন না। তাই আব্বা তাঁদের প্রকাশনা থেকে বই নিয়ে আসতেন। আবার বড় বোন কবিতা লিখতেন বলে দুলাভাই তাঁকে নানা রকম বই কিনে দিতেন-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-নজরুল ইসলামের বই থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের লেখকদের বই পর্যন্ত। আবার জসীমউদ্দীন ছিলেন আব্বার বন্ধু। তিনি তাঁর বই উপহার দিয়ে যেতেন। বেনজীর আহমদ, আহসান হাবীবও বই উপহার দিতেন। আবার যখন ঢাকায় এলাম, তখন-পরে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ-আবদার রশীদের বাড়িতে বড় একটি লাইব্রেরি ছিল। আশেপাশে আরও অনেক বইপড়ুয়া ছিলেন, তাঁদের সাহচর্যে অনেক বই পড়া হতো।

সাজ্জাদ: সৈয়দ শামসুল হক আমাকে বলেছেন, তাঁদের যখন কোনো বক্তৃতা-বিবৃতির প্রয়োজন পড়ত, তখন তা লেখার ভার দেওয়ার হতো আপনাকে। এসব লেখার ব্যাপারে নাকি আপনার অনায়াস-পটুত্ব ছিল। আপনার এই সহজ ও স্বাদু গদ্যের উত্স কোথায়?

আনিসুজ্জামান: স্কুলের কথা তো মনে নেই। তবে কলেজ পড়ার সময়ে শিক্ষকেরা বলতেন, সরল করে লেখো, নিজের মতো করে লেখো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে আমাদের কেজো ইংরেজি পড়াতেন জে এস টার্নার, তিনি জোর দিতেন ছোট ছোট বাক্যে লিখতে। এসব মিলিয়ে একটা প্রভাব পড়ে। ততদিনে আমি প্রমথ চৌধুরী পড়ে ফেলেছি। ম্যাট্রিক পাশ করার আগে পড়েছি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ক্লাস এইটের আগে অবশ্য নাটক-উপন্যাস পড়া হয়নি। নাইন-টেন-এই দুই বছরে অনেক বই পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পড়েছি, শরত্চন্দ্র পড়েছি। কারও না কারও প্রভাব নিশ্চয় রয়েছে।

সাজ্জাদ: সে-সময়ে বাঙালি মুসলমান যাঁরা লেখালিখি করেছেন, তাঁদের মধ্যে ঝংকারবহুল গদ্যের চল লক্ষ করা যায়। কিন্তু আপনার গদ্য প্রায় প্রথম থেকেই যেন তা সযত্নে এড়িয়ে চলেছে।

আনিসুজ্জামান: আমার লেখা বিষয়ের দিক থেকে তথ্যভিত্তিক, রীতির দিক থেকে সরল। আমার গদ্য এভাবে অনেকটা আপনাআপনিই বিকশিত হয়েছে। সব সময়ই আমি বাহুল্য বর্জন করতে চেষ্টা করেছি। বাহুল্যবর্জিত লেখার কারণে একটি সুবিধা হয়েছে। আমি অল্প পরিসরে আমার কথা বলতে পেরেছি।

সাজ্জাদ: আমরা ১৯৫২ নিয়ে কথা বলছিলাম। পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় এই একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক যাত্রাটি পাল্টে গেল। যে-বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবার এখানে দানা বাঁধতে শুরু করবে, তাঁর অন্যতম ভরকেন্দ্র হয়ে উঠবেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা রবীন্দ্রনাথকে ঠিক কোন নতুন মাত্রায় আবিষ্কার করেছি?

আনিসুজ্জামান: রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৌতূহলটা নতুন করে জেগেছে ভাষা আন্দোলনের পর। এর আগে বেতারে রবীন্দ্রনাথের গান-নাটক হচ্ছে, কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে, গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ হচ্ছে। বাধা কিন্তু ছিল না। রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতিসত্তার সঙ্গে সহজেই জড়িয়ে ছিলেন। বাঙালি পরিচয়ের কথা যখনই ভাবা হলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রনাথ চলে এলেন।
আমি যে প্রথম দিকে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে লিখেছি, সেটি অনেকটা অস্বাভাবিক। অত পেছনে কেন চলে গেলাম? আমি ভেবেছিলাম, বাংলা সাহিত্যের সবটুকু যদি আমার হয়, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র আমার নয় কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যাপারে সমাজের বিদ্যমান যে-আপত্তি, সেটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়েও আমার প্রশ্ন ছিল। ‘বঙ্কিমচন্দ্র ও আনন্দমঠ’ নামে ১৯৫৩ সালে আমি প্রবন্ধ লিখি। আমাদের পাঠ্যবই সাহিত্য পরিচিতিতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অংশটি পরিবেশিত হয়েছিল কিন্তু অখণ্ডিতভাবে। আমার কাছে মনে হয়েছিল, বাংলা সাহিত্যে যা আছে, সবই আমার। বঙ্কিমচন্দ্র যদি সাম্প্রদায়িক হয়ে থাকেন, তাহলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও জরুরি, কেন তিনি সাম্প্রদায়িক হলেন? আবার বঙ্কিমচন্দ্রের প্রেরণায় যে এত মানুষ উপনিবেশ-বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলেন, সেটাও তো লিখতে হবে। এভাবে আমার মনটা অন্যরকমভাবে গড়ে উঠেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে প্রবন্ধ লেখার পরই আমার মনে হলো, মুসলমানদের মধ্যে যারা স্বাতন্ত্র্যবাদী, তাঁদের চেতনার বিকাশের ধরন নিয়ে লিখতে হবে।

সাজ্জাদ: কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে-প্রকল্প গড়ে তুলেছিলেন, তার মধ্যে কি বাঙালি মুসলমানের প্রবেশাধিকার ছিল?

আনিসুজ্জামান: বঙ্কিমচন্দ্রের সময়টাতে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশ হয়েছে। কাজেই তাঁদের মধ্যে যে-হিন্দু জাতীয়তাবাদ স্ফূরিত হলো, তার চেয়ে মুক্তদৃষ্টি অবলম্বন করার মতো বাস্তবতা সেখানে ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র একদিকে স্বাধীনতা চাইছেন, আবার ইংরেজ শাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। ওই কৃতজ্ঞতাবোধও হিন্দু মধ্যবিত্তের বিকাশের আকাঙ্ক্ষা থেকে। তাঁর সাম্প্রদায়িক মনোভাবের পেছনেও সেই একই কারণ। কিন্তু তাঁকে যতটা সাম্প্রদায়িক বলা হয়, ততটা তিনি নন। কেননা তাঁর লেখায় অনেক উদার মুসলমান চরিত্রও আছে।

সাজ্জাদ: আমরা আবার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে আগের প্রশ্নটিতে ফিরে যাই...

আনিসুজ্জামান: বাংলা সাহিত্যকে সম্পূর্ণভাবে পেতে গেলে তো রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া হবে না। রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হবে দুভাবে। একটি নন্দনতাত্ত্বিক, অন্যটি সমাজবিষয়ক। তাঁর সমাজবিষয়ক লেখার মধ্যে ঢুকতে আমার দেরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আগে সেটা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু পরে সেগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ যে-বিষয়টাকে এভাবে দেখেছেন, আমরা তো তা সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারি। রবীন্দ্রনাথ এভাবে নতুনরূপে আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন। পশ্চিমবঙ্গের জন্য এটি জরুরি ছিল না। সামাজিক কোনো সংকট নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন, সেই সমস্যার হেতু কী-এসব বিষয় থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেন।

সাজ্জাদ: মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য বইটির সর্বশেষ ভূমিকায় আপনি লিখেছেন, এটি এখন লিখলে আপনি আরও অনেক প্রশ্ন তুলতেন। সে-সময়ে খেলাফত আন্দোলনকে আপনি ইতিবাচক বলে ভেবেছেন। এ আন্দোলনের প্রতি কংগ্রেসের সমর্থন আপনাকে বেশ উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু ধর্মকেন্দ্রিক এসব আন্দোলনের ক্ষতিকর প্রভাব তো পরবর্তী ইতিহাসে পড়েছে। উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের কারণে ওয়াহাবি বা ফারায়েজি আন্দোলনকে আমরা প্রগতিশীল বলে মহিমা দিয়েছি। সেগুলোর প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর্শ নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলিনি। সেসব আন্দোলনের মহিমা আমরা প্রশ্নহীনভাবে আত্মস্থ করেছি। পরবর্তীকালে আমাদের এখানে ধর্মীয় কট্টরপন্থার জমি তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কি তা কোনো ভূমিকা রেখেছে?

ড. আনিসুজ্জামান
ড. আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান: আমরা যাকে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন বলি, এর ইতিবাচক দিকগুলো আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। ওয়াহাবি আন্দোলনের ইতিবাচক দিক হচ্ছে এর ইংরেজ-বিরোধী চেতনা। অন্যদিকে আবার এর সংকীর্ণতার দিকটিও উপেক্ষা করার মতো নয়। ফারায়েজি আন্দোলনের ইতিবাচক দিক হচ্ছে ইংরেজ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষককে অন্তর্ভুক্ত করা। এর প্রভাবে আবার হিন্দু আর মুসলমানদের মধ্যে পার্থক্য খুব বেড়ে গেল। এমনকি এঁরা মুসলমান সমাজকেও বিভক্ত করে ফেললেন। এর চেয়ে বেশি কিছু আমি বলিনি। তবে বলা উচিত ছিল।

সাজ্জাদ: বাঙালি মুসলমানদের বুঝতে হলে আপনার গবেষণাগ্রন্থটি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। কিন্তু একটি ব্যাপার আমি বুঝতে চাই, কোনো প্রসঙ্গে সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনার জোরালো কর্তৃত্ব কি গবেষকের কল্পনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়? আপনার মনে কি সে রকম কোনো বাধা তখন অনুভব করেছেন?

আনিসুজ্জামান: সমাজ থেকে সেরকম কোনো মানসিক বাধা পেয়েছি বলে আমার মনে হয় না। যা পেয়েছি, সেটা নিজের ভেতর থেকে। যেমন কাজী আবদুল ওদুদ তাঁর বইয়ে ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতিবাচক দিকটিও দেখিয়েছেন। আমি সেই দিকটি অগ্রাহ্য করেছি। আমি বেশি গুরুত্ব দিয়েছি ইতিবাচক দিকটির ওপর। যেমন পিরবাদের বিরোধিতা আমাকে আকৃষ্ট করেছে, কিন্তু এঁদের গোঁড়ামি যে বিরক্তিকর, সেদিকে গুরুত্ব দিইনি।

সাজ্জাদ: আপনার লেখায় পড়েছি, আপনার কোনো একজন শিক্ষক আপনাকে বলেছিলেন, গবেষণা করতে গিয়ে কাউকেই কেবল ভালো বা মন্দ হিসেবে না দেখতে। একই মানুষ নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে সাড়া দিতে পারে।

আনিসুজ্জামান: শিকাগোতে আমার প্রবন্ধের আলোচনায় অধ্যাপক লয়েড রুডল্ফ্ কথাটা বলেছিলেন। আমি মন্তব্য করেছিলাম, রাধাকান্ত দেব রক্ষণশীল। তিনি বলেছিলেন, রাধাকান্ত দেবকে তুমি রক্ষণশীল লেবেল এঁটে দিচ্ছ কেন? মেয়েদের শিক্ষার জন্য তো তিনি বহু কিছু করতেন। তাঁর দুটো দিকই কি দেখা উচিত নয়? আমি সেটা স্বীকার করে নিয়েছিলাম। আমি লক্ষ করেছিলাম, প্রগতিশীল বা রক্ষণশীল—এর কোনো ভাগেই তাঁকে ফেলা যায় না। তাঁর মধ্যে দুটো দিকই আছে।

সাজ্জাদ: আপনার গবেষণায় আপনি মুসলিম বাঙালি সাহিত্যের মধ্যে সময়টা শেষ করেছেন ১৯১৮ সালে এসে। এই বিশেষ বছরটি বেছে নেওয়ার কারণ কী? প্রথম মহাযুদ্ধের সমাপ্তি, নাকি বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যের দিক থেকে বিশেষ কোনো ঘটনা?

আনিসুজ্জামান: এই বছরটি দিয়ে আমি প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান এবং সাহিত্যক্ষেত্রে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব—দুটোই বুঝিয়েছি। আমার ইচ্ছা ছিল ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আসার। কিন্তু এমন একটি জায়গাও তো আমার চাই যেখানে সাহিত্য ও সমাজের ছেদ একসঙ্গে মিলবে। নজরুলের আবির্ভাব ১৯১৯ সালে। তাঁর আবির্ভাবে তো একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গেল। সেখানে ছেদ টানাই আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

সাজ্জাদ: আপনার গবেষণার ক্ষেত্র বিচিত্র। আর তা শুধু সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আপনি বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়েছিলেন কেন?

আনিসুজ্জামান: অল্প বয়সে সিনেমা দেখে মনে হয়েছিল, আমি উকিল হব। পরে উকিল হওয়ার বাসনা হারিয়ে গেল। তখন থেকেই ভাবতাম, আমি সাহিত্য নিয়ে পড়ব, গবেষণা করব, সাহিত্যের শিক্ষক হব। সেভাবেই বাংলা সাহিত্য পড়া। বাংলা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সাহিত্যকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়া যাবে না। এই পটভূমিতেই ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে আমার সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বিষয়ে অনেকে বলেন আমি নির্ধারিত ক্ষেত্রের বাইরে চলে গেছি। আমি তা মনে করি না। যে-সমাজ থেকে সাহিত্য তৈরি হচ্ছে, সেই একই সমাজে তো ধর্মান্দোলন হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনও চালিত হচ্ছে। এগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখার ঝোঁক আমার মধ্যে সবসময়ে কাজ করেছে।

সাজ্জাদ: আপনি আমাদের সাহিত্যের পর্বভাগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলা সাহিত্যের পর্বভাগের পেছনে একটি ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচ্ছায়া টের পাওয়া যায়। ইংরেজ উপনিবেশের আগে বাংলা সাহিত্য স্থির ছিল, এমন ধারণা কি আপনার কাছে যথার্থ বলে মনে হয়?

আনিসুজ্জামান: বাংলা সাহিত্যের পর্বভাগ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পেছনের উত্সটি হলো ১৯৭৩ সালে আমার প্যারিস ভ্রমণ। আমি গিয়েছিলাম কংগ্রেস অব ওরিয়েন্টালিস্টের দুশো বছর পূর্তি উপলক্ষে। যাঁরা আয়োজক ছিলেন, যে কারণেই হোক, তাঁরা আমাকে একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব দিলেন। ওখানে গিয়ে লক্ষ করলাম, তাঁরা আধুনিকতার সূচনা ধরছেন ষোড়শ শতক থেকে, আর আমরা ধরছি ঊনবিংশ শতক থেকে। পার্থক্য হচ্ছে সময়ের, কিন্তু পর্বের নামগুলো রয়ে যাচ্ছে একই রকম। আমার তখন মনে হলো, ওরা যে-পর্বগুলো করেছে, সেটা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় আমাদের এখানে সাহিত্য ইতিহাসের ভাগগুলো ঘটেছে।

সাজ্জাদ: আপনার পুরোনো বাংলা গদ্য বইয়ে তো আপনি বাংলা গদ্যের উদ্ভব নিয়ে একাডেমিতে প্রায় স্থায়ী হয়ে যাওয়া একটি ধারণাকে মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন। অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলার মধ্যে এ ধরনের গবেষণা করার অভিজ্ঞতা কেমন?

আনিসুজ্জামান: এ-গবেষণার চিন্তাটা আস্তে আস্তে মনের মধ্যে দানা বেঁধেছে। গবেষণার বিষয়টা যেহেতু অ্যাকাডেমিক, সে কারণে অ্যাকাডেমিক শৃঙ্খলার মধ্যে না করলে আমার পক্ষে এটা উপস্থাপন করা সম্ভব হতো না।

সাজ্জাদ: আমরা এমন একটি ধারণা পেয়ে এসেছি যে, বাংলা গদ্যের জন্ম হয়েছে উপনিবেশের গর্ভে। আপনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, উপনিবেশের বহু আগে থেকেই বাংলা গদ্য ছিল এবং ইতিহাসের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সেটি ক্রমশ একটি স্পষ্ট আকার পাচ্ছিল। আপনার কি মনে হয় আমাদের গদ্য যেভাবে বিকশিত হচ্ছিল, উপনিবেশের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সেটি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারত?

ড. আনিসুজ্জামান
ড. আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান: দাঁড়াত, অবশ্যই দাঁড়াত। কেননা, ঝোঁকটা ওই দিকেই ছিল। নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তো বাংলা গদ্য ক্রমাগত বিকশিত হয়ে উঠছিল। নানা ক্ষেত্রে গদ্যের ব্যবহার বাড়ছিল। শুধু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নয়, ভাবের বাহন হিসেবেও। কাজেই এটি বিকাশ লাভ করতই। কিন্তু বাঙালির জীবনে পদ্যের অসাধারণ প্রভাব গদ্যকে আড়ষ্ট করে রেখেছিল। গদ্যে লেখা উচিত এমন বহু জিনিসও পদ্যেই লেখা হতো।

সাজ্জাদ: গ্রিসে, ইতালিতে বা ইংল্যান্ডে আমরা দেখেছি, মধ্যযুগে তাদের কবিরা যেসব ধর্মগাথা রচনা করেছেন এবং যেগুলো যুগ যুগ ধরে তাদের মনকে প্রভাবিত করেছে—যেমন হোমার, ভার্জিল বা দান্তের মহাকাব্য—তারা সেগুলোকে উচ্চ সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যেও কি এমন কিছু আছে যা তেমন মর্যাদা পেতে পারত, কিন্তু আধুনিকতার গর্বে আমরা তা দিতে পারিনি?

আনিসুজ্জামান: আমার তা মনে হয় না। হয়তো বৈষ্ণব জীবনী-সাহিত্য যে-গুরুত্ব পেতে পারত, আমরা তা দিইনি। তাছাড়া অন্য বিষয়ে আমরা কার্পণ্য করিনি। ইংরেজের সংস্পর্শে আসার আগে আমাদের সাহিত্যে অনুকরণ আর পুনরাবৃত্তিই ছিল প্রধান। তার মধ্যেও যে পালাবদল হয়নি, তা নয়। তবে তা হাতে গোনা। একেক শতাব্দীতে আমরা মাত্র একজন-দুজন করে বড় কবির নাম পাচ্ছি—চণ্ডীদাস, আলাওল, মুকুন্দরাম, ভারতচন্দ্র। এই বদল অবশ্যই বাঙালি সমাজের অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তির পরিচয়। শক্ত একটি কাঠামো বজায় থাকছে যুগের পর যুগ। আবার সে কাঠামো ভেঙে হঠাত্ করে কেউ কেউ বেরিয়েও যাচ্ছেন। এটা অনিবার্যভাবে আমাদের সামনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আবার এসব পরিবর্তনের মধ্যে কিছু কিছু বিষয় স্থিরও থেকে গেছে। যেমন নায়িকার কিন্তু ওই একই চেহারা। সব নায়িকার একই চোখ, একই নাক, একই ঠোঁট। এটা অবশ্য গ্রিক সাহিত্যেও আছে।

সাজ্জাদ: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটি নিয়ে পরবর্তীকালে বহু কথা ও রাজনীতি হয়েছে। আবার ১৯৭২-এর সংবিধানে আমরা রাষ্ট্রের মূল স্তম্ভ হিসেবে চারটি ভাবাদর্শ পেয়েছিলাম। অনেকে বলেন, এই ভাবাদর্শগুলো আকস্মিকভাবে এসেছে। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাঁদের মনে এগুলো প্রত্যক্ষভাবে ছিল না।

আনিসুজ্জামান: আমার তো মনে হয়, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগুলো ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। ১৯৪৮-৪৯ থেকে একেবারে ধাপে ধাপে জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজতন্ত্রের দিকে আমাদের ঝোঁক বেড়েছে। ১৯৫০ সালে ঢাকায় শাসনতান্ত্রিক সম্মেলনে বলা হয়, দেশের নাম হবে ইউনাইটেড স্টেটস অব পাকিস্তান। এটা ইসলামিক নয়, সেক্যুলার রাষ্ট্র হবে। এতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন থাকবে, কেন্দ্রের হাতে থাকবে অল্প বিষয়। তাই বলা যায়, এই চার স্তম্ভের ধারণা কেবল একাত্তরে নয়, তার আগেই নানা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে বিকশিত হয়েছে।

সাজ্জাদ: কোনো ঘটনা যখন ঘটে, তখন তার এক ধরনের তাত্পর্য থাকে। আবার পরবর্তী ইতিহাসের পরিবর্তিত পটভূমিতে সে তাত্পর্য অনেক পাল্টেও যায়। ১৯৫২ সালে বাঙালি বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করেছে। এখন সেটি হয়ে উঠেছে সব বিপন্ন ভাষাভাষীর অধিকারের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধকে এ সময়ে আপনি কোন তাত্পর্যে গ্রহণ করবেন?

আনিসুজ্জামান: একাত্তর থেকে আমরা মূলনীতিগুলো তো অবশ্যই নেব। এগুলো ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এর যেকোনো একটি বদলে গেলে বাংলাদেশেরও চেহারা বদলে যাবে। আমি চতুর্থ সংশোধনী মেনে নিতে পারি না, কারণ সেটি চার নীতির সঙ্গে যায় না। জিয়াউর রহমানের সংশোধন, এরশাদের সংশোধন—এগুলোর কোনোটাই মেনে নেওয়ার মতো নয়। বাংলাদেশ রাখতে হলে ওই চারটা স্তম্ভ আমাদের ধরে রাখতে হবে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, গত ৪০ বছরে নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মনে হয় মানুষের মনোভাবের পরিবর্তন হয়েছে। ধর্ম নিয়ে যে-সম্প্রীতির বোধ আমাদের মধ্যে ১৯৭০-৭১ সালে ছিল, এখন সেটা অনেক ক্ষয় হয়ে গেছে। এখন আর কেউ দাঙ্গা হচ্ছে শুনে বাড়ি থেকে দৌড়ে আক্রান্তের পাশে ছুটে যায় না। অনেক আপত্তিকর ওয়াজ, নসিহত বা ফতোয়া মানুষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। নেতাদের অনেকে বলেন, ধর্মের কথা না বললে সমর্থন চলে যাবে। ১৯৭০ সালে এটা মনে করার কোনো কারণ ছিল না। এমনকি ১৯৫০ সালেও না। ১৯৪৮-৪৯ সালে মওলানা ভাসানী অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের কথা বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী বলেছেন, ১৯৫৪-৫৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন। এঁরা পাকিস্তানের তুঙ্গ মুহূর্তে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে দেখতে পেয়েছিলেন। ধর্ম এখন একটি দেখানোরও বিষয় হয়ে উঠেছে। আমরা সবাই এখন শুধু আলহাজ হয়েই তৃপ্ত নই। আমরা নিজের নামের পাশে আলহাজ লিখতে চাই। জানাতে চাই যে, আমি হজ করে এসেছি। আমরা বিসমিল্লাহ বলে বক্তৃতা শুরু করি। আগে সেটা কখনো ছিল না। মওলানা ভাসানী কখনো বিসমিল্লাহ বলে বক্তৃতা শুরু করেননি। নামাজ পড়ার সময় হলে নামাজ পড়েছেন। নিজেদের মুসলমান প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা তখন ছিল না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা যে-রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো পেয়েছিলাম, সেগুলোর পক্ষে নেতারা আমাদের টেনেছিলেন, এখন কেন আমাদের নেতারা জনগণকে তৈরি করছেন না?

সাজ্জাদ: একাত্তরের পর গত চার দশকে তাহলে এ দেশে এমন কী ঘটল যে, আমাদের সমাজের বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এভাবে ক্ষয়ে যাওয়ার তীব্র শঙ্কা দেখা দিল?

আনিসুজ্জামান: যে-পরাজিত শক্তি বলেছিল, বাংলাদেশ হলে ইসলাম থাকবে না; বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তারা কিন্তু নিষ্ক্রিয় থাকেনি। তারা পাকিস্তানের আদর্শ প্রচার করে গেছে। তারা বোঝাতে চেয়েছে যে, মুসলমান স্বতন্ত্র, মুসলমানের পরিচয় আলাদা। এসব প্রচার অনেক কাজে দিয়েছে। আমাদের মায়েরা তো শাড়ি পরে নামাজ পড়ে মুসলমানের জীবন পার করে দিলেন। তারা বোঝাতে পেরেছে, শাড়ি পোশাক নয়। এ জন্য গ্রামের মা-বোনেরা তাদের চিরন্তন পোশাক শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ পরতে শুরু করেছে। মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে। গ্রামে অনেকেই মাদ্রাসায় ছেলেমেয়ে পাঠাতে আগ্রহ বোধ করে, কারণ শিক্ষার পাশাপাশি সেখানে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানকার কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম সাহেব জামায়াত করতেন। মসজিদকে কেন্দ্র করে তিনি নানা রাজনৈতিক কাজ করতেন। পরে তাঁকে সরানো হয়। আমরা হয়তো দু-চারটা ঘটনা জানতে পারি। এ রকম অসংখ্য ঘটনা আছে।

সাজ্জাদ: আপনার কি মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বুদ্ধিজীবীদের গণনিধনও স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য একটি ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়েছে? জাতির ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে সঞ্চার করা যদি বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম দায়িত্ব হয়, তাঁদের অনুপস্থিতির কারণে আমরা একটি শূন্যতার মধ্যে পড়েছি। আমাদের প্রত্যক্ষ অস্থির রাজনীতি তো ছিলই। বাকশাল, বঙ্গবন্ধু-হত্যা, মুহুর্মুহু অভ্যুত্থান, দীর্ঘ সামরিক শাসন। কিন্তু ওই শূন্যতা পরবর্তীকালে জাতি হিসেবে তো আমাদের কোনো সামষ্টিক মূল্যবোধ বা ইতিহাসগত জমির ওপর দাঁড়ানোরও সুযোগ দেয়নি। এ ব্যাপারে আপনার নিজের কী ধারণা?

আনিসুজ্জামান: একাত্তরে আমরা যে বুদ্ধিজীবীদের হারিয়েছি, নিশ্চয় তাঁরা দেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। আমরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। কাজেই বড় একটা ক্ষতি তো হয়েছেই। তবে সেটাও পূরণ হতে পারত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তিকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনলেন। এটা বড় একটা ক্ষতিকর পরিবর্তনের কারণ। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলো গৌণ হয়ে গেছে। অন্যদিকে নানারকম সুবিধাবাদের বিকাশ ঘটেছে। এই প্রক্রিয়া এরশাদ আমলেও চলল। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠতে পারল না। গড়ে উঠবে উঠবে করে আওয়ামী লীগ আমলেও তা গড়ে উঠল না। ফলে পুরোনো মূল্যবোধগুলো থাকল না, আবার নতুন কোনো মূল্যবোধও প্রতিষ্ঠিত হলো না। সার্বিকভাবে একধরনের সুবিধাবাদ জায়গা করে নিল। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা চিরন্তন মূল্যবোধের কথা বলেছেন, শুভ-অশুভর কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা তাকে আপেক্ষিক বলে, চরম সত্য নয় বলে সরিয়ে দিচ্ছি। আজকের যে সামাজিক অবক্ষয়, তার পেছনে এই কারণগুলো কাজ করেছে। এখনকার বুদ্ধিজীবীরা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অনেক ক্ষতি হয়েছে।

সাজ্জাদ: আপনি নিজে যে লেখালিখি করেছেন, অধ্যাপনা করেছেন, গবেষণা করেছেন। আবার একই সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকেই জাতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। আপনি বিদ্যায়তনে ছিলেন। আবার আপনার জীবন সেটা ছাপিয়ে বেরিয়েও গিয়েছে। আপনার মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিরোধ হয়নি?

ড. আনিসুজ্জামান
ড. আনিসুজ্জামান

আনিসুজ্জামান: না, বিরোধ হয়নি। কারণ, মনে হয়েছিল, নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব আমাকে পালন করতেই হবে। তবে অত্যন্ত সচেতনভাবে আমি একটার সঙ্গে আরেকটাকে জড়াইনি। শিক্ষক হিসেবে যখন আমি ক্লাসে গিয়েছি, তখন আমার কোন ছাত্রের কী রাজনৈতিক মত সেটা জানতে চাইনি, সেটা আমাকে কখনো পীড়িতও করেনি। ক্লাসে কখনো রাজনীতির কথা বলিনি। তবে ক্লাসের বাইরে নানা সভা-সমিতিতে বলেছি, এখনো বলছি। কাজেই শিক্ষক হিসেবে একটা নৈর্ব্যক্তিকতা আমার ছিল। নিশ্চয় এর একটা গুরুত্ব আছে। ছাত্ররা আমাকে ভালোবেসেছে, কিছুটা শ্রদ্ধা করেছে। কারণ তারা জেনেছে, আমার রাজনৈতিক মত থাকা সত্ত্বেও সেটাকে আমি কখনো শিক্ষকতায় প্রশ্রয় দিইনি।

সাজ্জাদ: আপনার কোনো কোনো লেখা পড়লে মনে হয় আরও বহু ক্ষেত্র আপনার মনোযোগ পেলে আমাদের অ্যাকাডেমি তার সুফল পেত। আপনার কি মনে হয় না অ্যাকাডেমিকে বা লেখালিখিকে আরেকটু বেশি সময় দিলে আপনার সময় একটু বাড়তি মূল্য পেত?

আনিসুজ্জামান: সেটা আমার প্রায়ই মনে হয়েছে। বন্ধুবান্ধব বা শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকে বলেছেন, তুমি এত কিছু না করে লেখাপড়ার জগতে থাকলে পারতে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, আপনি তো লেখাপড়া করলেন না। এটা আমার ঠিকই মনে হয়েছে। কিন্তু তখন আমার এও মনে হয়েছে যে, এক জীবনে আমার পক্ষে একটা জায়গায় স্থির থাকা সম্ভব ছিল না। কাজেই নিশ্চয় ক্ষতি অনেকটা হয়েছে। আমার জীবন যে তিনটা ভাগে বিভক্ত, তার সবগুলোরই কিছু পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে। তবে এটা অবশ্যই মানব, বেশি ক্ষতি হয়েছে লেখালিখির।

সাজ্জাদ: কিন্তু আবার এটাও তো মনে হয় সত্য যে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনি অন্য কাজের চেয়ে বেশি আনন্দ পান?

আনিসুজ্জামান: আনন্দের চেয়ে বড় ব্যাপার হলো তৃপ্তি। আনন্দ তো আমি লেখালিখিতেই বেশি পাই। কিন্তু ওসব আন্দোলনে গেলে আমার মধ্যে এই তৃপ্তি কাজ করে যে, আমি আমার কর্তব্য পালন করছি। তখন আমার মনে হয়, এতে যদি আমার লেখালিখির ক্ষতিও হয়ে থাকে, তাতে দুঃখ করার কিছু নেই।

সাজ্জাদ: শিক্ষকতা, লেখালিখি, আন্দোলন—এই তিনটির মধ্যে কোনটিতে তাহলে আপনি বেশি আনন্দ পেয়েছেন?

আনিসুজ্জামান: আমার মনে হয়, শিক্ষকতাতেই বেশি আনন্দ পেয়েছি। আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে সামাজিক কাজকর্মের জন্য তো মানুষের ভালোবাসাও যথেষ্ট পেয়েছি।

সাজ্জাদ: যে ধরনের ঘটনায় আপনার নৈতিক সমর্থন নেই, কিন্তু আপনার চোখের সামনেই তা ঘটছে—যেমন আমার একাত্তর বইটিতে যে আপনি চট্টগ্রামে অবাঙালি-হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছেন—এ রকম ঘটনায় আপনার কেমন নৈতিক পীড়ন হয়? পেছন দিকে ফিরে এসব ঘটনাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আনিসুজ্জামান: এ ধরনের ঘটনার ওপর তো আমার বা কোনো একক ব্যক্তির কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমি তো তখন সত্যিই কিছু করতে পারতাম না। ঘটনাটি ঘটেছে আমি সেখান থেকে চলে আসার পর। কিন্তু সেখানে থাকলেই বা আমি কী করতে পেতাম? কিছুই করতে পারতাম না। ঘটনাপ্রবাহ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।

সাজ্জাদ: আপনি জাহানারা ইমামের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আন্দোলন করেছিলেন। সে-সময়ে নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল, এটি একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী আন্দোলন। এ জন্য আপনার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। কিন্তু এত দিন পরে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। সে-সময়ে আপনি আপনাদের সে-আন্দোলনের ভবিষ্যত্ কী হবে বলে কল্পনা করেছিলেন?

আনিসুজ্জামান: আমরা তখন ভেবেছিলাম, বড় রকমের একটি আন্দোলন করা গেলে সরকারের ওপর চাপ তৈরি হবে। তাতে সরকার হয়তো কিছু করবে। গোলাম আযম তখনো বাংলাদেশি নাগরিক হননি। পাকিস্তানি নাগরিক হয়েও তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির হয়ে আছেন। এটা তো আমাদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক একটি ব্যাপার। আমরা চেয়েছিলাম, এমন চাপ সৃষ্টি করা যায় কিনা, যাতে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে একটি অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। সরকার যে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করে বসবে, সেটা আমরা ভাবিনি। ২৬ মার্চ সকালে যখন জানা গেল, সরকার সমাবেশের অনুমতি দেয়নি, তখনই আমরা প্রথম বুঝতে পারলাম যে, সরকার আমাদের বিরুদ্ধে। তার আগে পর্যন্ত আমাদের মনে হচ্ছিল, সরকার জনমতের প্রতি সাড়া দেবে। সরকারের আচরণের ব্যাপারটি যেমন আমরা ভাবতে পারিনি, তেমনই আমরা এটাও ভাবিনি মানুষের মধ্যে সে-আন্দোলনের এত অভাবিত সাড়া পড়বে।

সাজ্জাদ: সেই আন্দোলনের এতদিন পরে এখন যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, তখন আপনার কেমন লাগছে?

আনিসুজ্জামান: এখন আমি নিজেও বিচারের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। সাক্ষ্য দিলাম একাধিক মামলায়। এখন দেখা যাক কী হয়। রায় কার্যকরের সময় হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু আমি আশা করি, অন্তত কতগুলো মামলার রায় হয়ে যাবে। রায় হলে তাকেও আমি একটি বড় ব্যাপার বলে মনে করব। যাদের বিরুদ্ধে রায় চূড়ান্ত হবে, তারা তো সে রায়ের গ্লানি কোনোদিন মুছে ফেলতে পারবে না। সারাজীবন তাদের সেটা বহন করতে হবে। বিচার যে হলো, এটা তার একটা সার্থকতা।
সাজ্জাদ: আপনি দুবার আনন্দ পুরস্কার পেলেন।

আনিসুজ্জামান: দুবার আরও অনেকেই পেয়েছেন। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারো দেড়বার। ১৯৯৪ সালে প্রথমবার পেয়েছিলাম দুজন মিলে: আমি আর আমার ছাত্র ও সহকর্মী-এখন লোকান্তরিত নরেন বিশ্বাস। সেবার পেয়েছিলাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য। আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত নির্বাচিত রচনার কিছু অডিও রেকর্ড করে বের করেছিলাম। সেটিকে তারা পুরস্কারযোগ্য বলে বিবেচনা করেছিল। এবার আমার স্মৃতিকথার সর্বশেষ খণ্ড বিপুলা পৃথিবীকে তারা সাহিত্য হিসেবে পুরস্কারযোগ্য বিবেচনা করেছে। এটিই তফাত।

সাজ্জাদ: এত দিন আপনি ছিলেন এ পুরস্কারের অন্যতম বিচারক। এবার হয়ে গেলেন বিচারের পাত্র। কেমন লাগল?

আনিসুজ্জামান: প্রথমবার আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার এক বছর পর থেকে একটানা কুড়ি বছর এই বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তারপর ওই কাজ ছাড়ার পরপরই পুরস্কারটা পেয়ে গেলাম। একেবারে অপ্রত্যাশিত, তবে আনন্দদায়ক।

সাজ্জাদ: পুরস্কার হিসেবে কি আনন্দের কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে?

ড. আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি
ড. আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি

আনিসুজ্জামান: আনন্দ পুরস্কারের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় বসে যিনিই বাংলা সাহিত্যের চর্চা করুন না কেন, এ পুরস্কার তাঁর জন্য উন্মুক্ত। এটা বিশেষ করে কোনো ভারতীয় বা বাঙালির জন্য নয়। এ পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এডওয়ার্ড ডিমক ও ক্লিন্টন সিলি, ব্রিটেনের উইলিয়াম রাদিচে, বাংলাদেশেরও বেশ কয়েকজন। আর কোনো পুরস্কারের এ বৈশিষ্ট্য নেই।

সাজ্জাদ: লজ্জা উপন্যাসের জন্য তসলিমা নাসরিনের আগে বাংলাদেশের আর কেউ এ পুরস্কার পাননি। এমন একটা সমালোচনা আছে যে তসলিমাকে এ পুরস্কার দেওয়ার পরপর যে তীব্র বিতর্ক উঠল, সেটা থেকে বেরোনোর উপায় হিসেবে দ্রুতই তারা ভাবল যে বাংলাদেশের আর কাউকে এ পুরস্কার না দিলে নিন্দা ঘুচবে না...

আনিসুজ্জামান: সম্ভবত ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমিকে এ পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার যখন বাংলা একাডেমি নিতে চাইল না, তখন তারা তসলিমাকে দিল। তসলিমাই বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে প্রথম আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে। এরপর শামসুর রাহমান, নরেন আর আমি পেলাম। তারপর তো অনেকেই পেয়েছেন-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, বিচারপতি কামালউদ্দীন হোসেন।

সাজ্জাদ: যে বইটির জন্য আপনি পুরস্কার পেলেন, সেটি আপনার আত্মস্মৃতি। গত দুই দশকে বাংলাদেশে অনেকে আত্মস্মৃতি লিখেছেন। বাঙালি মুসলমান হঠাত্ এত আত্মসচেতন হয়ে উঠল কেন? ইতিহাসের একটা প্রেক্ষাপটে নিজেকে রেখে কেন আপনি এমন একটা লেখা লিখতে চেয়েছিলেন?

আনিসুজ্জামান: এর একটা কারণ, আমরা যে সময়টা পার করে এসেছি, সেটা যে গুরুত্বপূর্ণ-এ উপলব্ধি আমাদের মধ্যে ঘটেছে। ফলে সেই সময়টার কথা আমরা লিখে রাখতে চাই। আবুল মনসুর আহমদ বা আবুল কালাম শামসুদ্দীন যে প্রজন্মের কথা লিখেছেন, আমরা তার পরের প্রজন্মের কথা লিখেছি। এই দুই প্রজন্মই একটা পরিবর্তনের ধারার মধ্য দিয়ে গেছে। বিশের দশক, তিরিশের দশক, চল্লি¬শের দশক, পঞ্চাশের দশক এবং তারপর অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। সেই সময়ের কিছু আত্মসচেতন মানুষ হয়তো মনে করেছেন, এই পরিবতর্নগুলো লিখে রাখা উচিত। ব্যক্তি হিসেবে আমি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ নই। কিন্তু আমার কালটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে বলেই আমি লিখেছি। এই বিবেচনা থেকেই আমার আত্মকথা সবাই গ্রহণ করেছেন।

সাজ্জাদ: কাল নিরবধি, আমার একাত্তর ও বিপুলা পৃথিবী-পরপর এই তিনটি আপনার ধারাবাহিক আত্মস্মৃতি। নিছক আত্মস্মৃতি নয়, অনেকের সঙ্গে জড়িয়ে চলা একটা সময়ের আখ্যান। বাঙালি জাতির হয়ে ওঠার একটা সামাজিক রেখাচিত্র বইটিতে পাওয়া যায়। কেমন দেখলেন বাঙালির এই দীর্ঘ যাত্রাপথ?

আনিসুজ্জামান: উত্থান-পতন হিসেবেই দেখি। আমরা যদি ১৯৭১ সালকে একটি বিশেষ সময় বলে ধরি-যখন মুক্তিযুদ্ধ হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো-তখন আমরা যে আদর্শ নিয়ে দেশ প্রতিষ্ঠা করলাম, সেটি উত্থানেরই ব্যাপার। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর যা হলো, সেটি পতন। কেননা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যে জায়গাটিতে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম, সেখানে আর পৌঁছাতে পারলাম না। আজও পারিনি। মৌলিক পরিবতর্নগুলো পঁচাত্তরের পরেই হলো-সংবিধানে হলো, রাষ্ট্রীয় জীবনে হলো। আজ আমরা যে সামপ্রদায়িকতা দেখছি, ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি যে এখনো রাষ্ট্রধর্ম রয়ে গেছে-এগুলো তো সেই পতনেরই চিহ্ন। একটা প্রশ্ন স্বভাবতই জাগে যে এত কিছুর পর আমরা কি সামনের দিকে এগোচ্ছি, নাকি পিছিয়ে যাচ্ছি? যেমন ধরো, মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার চেয়েছিলাম, এত দিন পর সেটি পেয়েছি। এটা একটা ইতিবাচক দিক। তেমনি আবার রাষ্ট্র যে অনেক বিষয়ে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে বা তাদের সঙ্গে একধরনের আপস করছে-এটা একটা দুঃখজনক দিক। ধর্মের নাম করে একদিকে বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতার চর্চা চলছে, অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চের ঘটনা আমাদের দেখিয়েছে যে এ প্রজন্মের তরুণদের আমরা মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে যেমনটা উদাসীন ভেবেছিলাম, আসলে তারা তা নয়। তাদের মধ্যে সেই মূল্যবোধ আছে। পরস্পরবিরোধী কিছু লক্ষণ আমাদের মধ্যে আছে। এই ভাঙাগড়া আর উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েই আমরা যাচ্ছি। এসব মেনে নিয়েই আমরা কীভাবে সামনে এগোতে পারব, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে কীভাবে তুলে ধরছি, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্মকে যারা রাজনীতির হাতিয়ার করেছে, তারা যেভাবে মানুষের কাছে যাচ্ছে, আমরা সেভাবে পারছি না। এই যে আহমদিয়াদের ওপর আক্রমণ হলো, বাংলাদেশে এটা হবে, তা আমরা কখনো কল্পনা করিনি। বাংলাদেশে যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের উত্থান হবে, তা-ই বা কে ভেবেছিল! সহজ বুদ্ধিতে অনেকে বুঝতে পারছেন, এগুলো থেকে বেরিয়ে আসা দরকার।

সাজ্জাদ: ১৯৫০ বা ১৯৬০-এর দশকের সংস্কৃতির চর্চা ও আন্দোলনের সুফল রাজনীতির মধ্যে পাওয়া গেল। একদিক থেকে দেখলে তো সাংস্কৃতিক চর্চার ধারা এখন আরও ব্যাপক হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনীতি তাহলে পশ্চাত্মুখী হয়ে উঠল কেন? ছেদ ঘটল কোথায়, কী কারণে?

আনিসুজ্জামান: পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমাদের নেতারা বললেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চাই। পাকিস্তানি আদর্শ তখন আরও জোরালো ছিল। কিন্তু অবাক করা বিষয়, তা থেকে মানুষ সহজে বেরিয়ে এল। আমরা বাংলাদেশের আদর্শ নিয়ে অগ্রসর হলাম। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর আমাদের রাজনৈতিক নেতারা একটা ধর্মীয় চেহারা দেখাতে তত্পর হলেন। সাংস্কৃতিক মহল থেকেও আমরা একটু পিছু হটলাম। সেই সুযোগে ধর্মকে কেন্দ্র করে আদর্শটা মহিরুহের আকার ধারণ করল। ১৯৯০ সালে সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা আশা করেছিলাম, এমন পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে, যা আমাদের ১৯৭২-৭৩ সালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা সেটা আজও পারিনি। দেখা গেছে, দেশকে যারা ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে ফেলতে চায়, তারা অনেক বেশি সক্রিয়। এই অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কোন লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল-আমাদের নেতাদের তা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে হবে।

সাজ্জাদ: এ কথা কি বলা যায় যে আমাদের সংস্কৃতিচর্চার আনুভূমিক বিস্তার ঘটলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে এর যোগসূত্র গড়ে ওঠেনি?

আনিসুজ্জামান: এমন সমালোচনা করা হলে সেটা অসংগত হবে না। আমাদের যে সংস্কৃতিচর্চা, সেটা মূলত নগর ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক। বৃহত্তর সাধারণ মানুষের কাছে আমরা একে নিয়ে যেতে পারিনি। আমরা যে গান গাইছি, তার কথা বা আমরা যে নাটক করছি তার ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো মুশকিল। ধর্ম নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা সেটা পেরেছে নানা রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। সংস্কৃতির এই জনবিচ্ছিন্নতা কীভাবে দূর করা যাবে, সেটা বলা মুশকিল। সে অর্থে বলা যায়, লোকসংস্কৃতির সঙ্গে নগরসংস্কৃতির যে ব্যবধান, আমরা তার ফাঁদে পড়ে গেছি।

সাজ্জাদ: কিন্তু শিল্প, সাহিত্য বা সংস্কৃতির কাছেই তো এই যোগ আমরা প্রত্যাশা করি। আপনার কি মনে হয়, আমাদের সাহিত্য বা সংস্কৃতির পক্ষে এখনো সেই যোগসূত্র গড়ে তোলা সম্ভব?

ড. আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি
ড. আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি

আনিসুজ্জামান: নিশ্চয়ই। আমার তো মনে হয়, সেটা কিছুটা হচ্ছেও। আমি আবার সেই নাগরিক মধ্যবিত্তের কথা বলি। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তাদের কাছে যে বাণী পৌঁছাচ্ছে, সেটা মূলত প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক মূল্যবোধসম্প¬ন্ন। কিন্তু পৌঁছানোর একটা সীমা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে সেটা পৌঁছাতে পারছে না। এই সাহিত্যের পক্ষে সেটা কঠিন। এটা এক জটিল সমস্যা। শুধু বাংলাদেশের আদর্শের ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণভাবে বাঙালি সংস্কৃতির জন্যই এটা একটা বড় সমস্যা। তবে নগরের মানুষ এখন হয়তো আগের চেয়ে বেশি লোকসংগীত শুনছে, আবার টেলিভিশনের মাধ্যমে পল্লি¬র মানুষও নাগরিক সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। এটা ব্যবধান মেটাতে একধরনের কাজ করছে। ইদানীং মাদ্রাসার ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ ডিগ্রি পেতে চাইছে। কারণ, তারা মনে করছে, যে ডিগ্রি তারা পাচ্ছে, সেটি দিয়ে বতর্মান দুনিয়ায় কিছু অজর্ন করা সহজ নয়। সুতরাং একটা সেতুবন্ধন তো হচ্ছে।

সাজ্জাদ: বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে টানাপোড়েনের সম্প¬র্ক, সাহিত্য বা সংস্কৃতি সেখানে কী ভূমিকা রাখতে পারে?

আনিসুজ্জামান: মানুষের মধ্যে যে ভয় ও সন্দেহ, তা অচেনা ও অজানাকে নিয়ে। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে আমরা যখন সেই অজানা-অচেনাকে চিনতে পারি, তখন সন্দেহ ও ভয় অনেকটাই কেটে যায়। এ জন্য আমি মনে করি, ভারতের যে অংশে বাংলাভাষী মানুষ বাস করে, সেই অংশের মানুষের সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুই অঞ্চলের সাহিত্যই ভূমিকা রাখতে পারে। তা খানিকটা রাখছে বলেও আমি মনে করি।

সাজ্জাদ: এত দিনের আদান-প্রদানে জানা-বোঝার দূরত্ব যতটা কমা দরকার ছিল, ততটা কমেছে বলে কি আপনার মনে হয়?

আনিসুজ্জামান: আমার মনে হয় না, জানা-বোঝা ততটা কমছে। কিছু বদ্ধমূল সংস্কার এই জানা-বোঝার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে আছে। তবে ধীরে ধীরে এটা দূর হবে বলে মনে করি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্প¬র্ক একটা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি, যে সমস্যাগুলোর সমাধান হওয়া উচিত ছিল, সেগুলো তো ঝুলে আছেই; বরং নতুন কিছু সমস্যার উদ্ভব হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা যত বেশি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই বিরোধগুলো মেটাতে পারব, তত ভালো।

সাজ্জাদ: সাহিত্য-সংস্কৃতি যে কাজটা করে-মানে মানুষে মানুষে যোগ-সেটা কি এখানে অর্থবহ ভূমিকা রাখতে পারে?

আনিসুজ্জামান: নিঃসন্দেহে। প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব রেখেই তো চলতে হবে। এই সদ্ভাবের জন্য দুই পক্ষকেই বলব, পরস্পরকে জানুন এবং যত দ্রুত সম্ভব সমস্যাগুলোর সমাধানে চেষ্টা করুন।

সাজ্জাদ: বাঙালি এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। আবার অন্তর্জালের কল্যাণে তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। এই পরিস্থিতি কি বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য নিয়ে এল? বিশ্ববাঙালির সাহিত্যচর্চার এই নতুন পটভূমিতে বাংলাদেশের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি
জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। ফাইল ছবি

আনিসুজ্জামান: একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার ফলেই কিন্তু বাংলাভাষী মানুষের পক্ষে সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হয়েছে। আগে এটা ছিল না। এর একটা ভালো দিক আছে। অন্য দেশ সম্পর্কে আমরা জানছি। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের ফলে আমাদের প্রগতির কিছু অন্তরায়ও দেখা দিয়েছে। যেমন মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বড়সংখ্যক নাগরিক চাকরিবাকরি করছে। দেশে ফেরার সময় তারা ওই দেশের সংস্কৃতিটা সঙ্গে নিয়ে আসছে। বাংলাদেশে যে এখন হিজাব ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যপ্রবাসী বাঙালিদের মাধ্যমে। সৌদি আরবে বা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে তারা ওখানকার সংস্কৃতিকে ইসলামি সংস্কৃতি বলে মনে করছে। তারপর দেশে ফিরে এসে ওই সংস্কৃতির চর্চা করছে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের তাঁতিরা বলেছেন, বাঙালি মেয়েরা শাড়ি কম পরছে। এটা যে ঘটছে, তার কারণ ওই যোগাযোগ। আবার দেশের মানুষ বিদেশমুখী হওয়ায় আমরা অনেক মেধা হারাচ্ছি। অনেক মেধাবী দেশের সঙ্গে সব চুকিয়ে দিয়ে বিদেশে গিয়ে বসবাস করছেন। এটা হয়তো তাঁরা বাধ্য হয়েই করছেন। আবার ওখানে যারা জন্মাচ্ছে, দেশের প্রতি তাদের পূর্বপুরুষের মতো টান না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এখন পর্যন্ত প্রবাসী বাঙালিরা দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে আমরা নানাভাবে তার প্রমাণ পাই।

সাহিত্যের ব্যাপারে বলতে হয়, বিষয়ের ক্ষেত্রে আমাদেও বৈচিত্র্য অনেক বেড়েছে। এখন আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালির জীবনযাপন প্রণালি জানতে পারছি। সোভিয়েত ইউনিয়নে যাঁরা পড়তে গিয়েছিলেন, সাহিত্যে তাঁরা নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখছেন। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বাড়ছে। এসব তো আগে ছিল না। এভাবে পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের লেনদেনের একটা প্রক্রিয়া চলছে। এটা ইতিবাচক।

সাজ্জাদ: আপনি তো বাঙালির ভালো-মন্দ মেশানো রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা উত্থান-পতন দীর্ঘ সময় ধরে দেখে এলেন। বাঙালির ভবিষ্যৎ কী?

আনিসুজ্জামান: আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাঙালিত্বকে প্রতিষ্ঠা করা এবং বিশ শতকে যেসব উন্নয়ন ঘটেছে-এই শতক তো সবেমাত্র শুরু হলো-তার ফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটা করা খুব সহজ নয়, কিন্তু এটা আমাদের করতে হবে। পশ্চাত্পদ যেসব ভাবনাচিন্তা সমাজে আছে, তার সঙ্গে আরও কিছুদিন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।