'নভেরা মিথ হয়ে গেছেন'

মগ্ন নভেরা
মগ্ন নভেরা

(শেষ পর্ব)

শিবু: এবার শহীদ মিনার প্রসঙ্গে যাই। শহীদ মিনারের মূল শিল্পী কে, এ নিয়ে তো বিশাল এক জটিলতা তৈরি হয়েছে, যার মীমাংসা আজও আমরা করতে পারিনি। সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ তৈরি হয়েছে এটা সত্য। তার কারণ, হামিদুর রহমান প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব কথাবার্তা বলেছেন আরকি, শহীদ মিনার নিয়ে এবং নভেরাসহ কাজ করা, পরবর্তীকালে তিনি আবার একটু অদলবদল করেছেন তাঁর বক্তব্য। তাতে মনে হয় পুরো কাজটাই তিনি করেছেন। নভেরা তাঁকে সাহায্য করেছেন মাত্র। এই সমস্যার কিংবা রহস্যের জবাব দেওয়া যেত, যদি শহীদ মিনার ধ্বংস না হতো। কেননা, শহীদ মিনারের বেসমেন্টে যে কাজগুলো ছিল...।

শিবু: পরে যেগুলো ভেঙে ফেলা হলো...
জাহাঙ্গীর: যুদ্ধের সময় গুঁড়িয়ে দেওয়া হল বেসমেন্টের কাজগুলো। আর এই কাজগুলো ছিল বেসমেন্টে এবং সেই বেসমেন্টের কাজ তো তারপরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেগুলো মুছে ফেলা হয়েছে। যে জন্যে আমি বললাম, প্রথম দিকে যে কথাবার্তা বলেছিলেন, হামিদই বলেছেন। নভেরা তো কোনো কথাবার্তা বলেননি।
শিবু: এর কারণ কী? তখন নভেরা কোথায় ছিলেন? তাঁরা তো একে অপরকে ভালবাসতেন?
জাহাঙ্গীর: নভেরা তখন কিছুদিনের জন্য ঢাকায় এসে আবার চলে গিয়েছিলেন। হামিদ খুব ডমিনেট করত আরকি, খুব ডমিনেটিং পার্সোনালিটি ছিল। আর দুই নম্বর হচ্ছে যখন এই কাজগুলো করা হয় তার পরপরই হামিদ ও নভেরার মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। নভেরা বিদেশে চলে যান, হামিদও বিদেশে চলে যান এবং দুজন দুজায়গায়। হামিদ প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে, পরে কানাডায় আর নভেরা প্যারিসে। পরবর্তীকালে হামিদ তাঁর মৃত্যুর আগে যখন ঢাকায় কিছুদিন আগে ফিরে আসেন, তখন তাঁর বক্তব্য ছিল যে শহীদ মিনারের প্রাথমিক ডিজাইনটা তাঁর করা এবং নভেরা তাঁকে সাহায্য করেছে মাত্র।
শিবু: সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার কারণেই কি হামিদুর রহমান আবেগের বসে এ কথাগুলো বলেছিলেন?
জাহাঙ্গীর: এগুলো বলা মুশকিল। যেহেতু স্পষ্টভাবে হামিদ কোনো কিছু বলেননি এবং নভেরা তো কোনো কথাই বলেননি। তো আমি যেটা উল্লেখ করেছি সেটা হচ্ছে, প্রাথমিক পর্যায়ে এবং পরবর্তী পর্যায়ে হামিদের স্টেটমেন্ট। তারও আগে যদি আমরা যাই, সে হচ্ছে জয়নুল আবেদিনও একপর্যায়ে বলেছিলেন যে, 'শহীদ মিনারের মূল ডিজাইনটা আমি করে দিয়েছিলাম এবং হামিদ আমার কথামতো এগুলো বড় করেছে।' সুতরাং এই সত্য-মিথ্যার মধ্যে, এ তর্কের মধ্যে না যাওয়াটাই ভাল।
শিবু: কিন্তু যে মিনার আমাদের আত্মপরিচয়, তাঁর নির্মাতা সম্পর্কে আমরা যদি একটা সিদ্ধান্তে আসতে না পারি...। তা ছাড়া যার যা প্রাপ্য, সেটুকু কেন আমরা তাঁকে দেব না?
জাহাঙ্গীর: না, এইখানে কিন্তু প্রাপ্য অস্বীকার করার কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। প্রশ্ন যেটা উঠেছে, এই শহীদ মিনারের শৈল্পিক চিন্তাটা কার? এবং সেই চিন্তার রূপায়নটা কীভাবে হয়েছিল? এই চিন্তাটা হামিদ করেছেন, নভেরা করেছেন; এটা নিয়ে কোনো তর্ক নেই। কিন্তু যেখানে তর্কটা উঠছে, সেটা হচ্ছে হামিদের পরবর্তী স্টেটমেন্ট। যেখানে হামিদ বলেছেন যে 'হ্যাঁ, এই কাজটা, এই চিন্তাটা এই ড্রইংগুলো আমারই করা। নভেরা আমাকে সাহায্য করেছে মাত্র।' নভেরা ঢাকায় নেই এবং কাজেই তাঁর এই স্টেটমেন্ট নিয়ে বাদানুবাদ করবে কে?
শিবু: সৈয়দ শামসুল হক তাঁর 'হৃৎকলমের টানে' বইয়ের এক লেখায় এ প্রসঙ্গে এক প্রকারের আই-উইটনেস কিন্তু দিয়েছেন।
জাহাঙ্গীর: না আমি তো আগেই বলেছি, এই শহীদ মিনার সম্বন্ধে হামিদের প্রথম স্টেটমেন্ট আর পরবর্তী স্টেটমেন্টের মধ্যে কিন্তু একটু পার্থক্য রয়েছে। প্রথম স্টেটমেন্টটা ছিল 'আমি এবং নভেরা দুজন মিলে এই চিন্তাটা করেছি।'
শিবু: এটা ঠিক কত সনের কথা?
জাহাঙ্গীর: আমি সন-তারিখটা বলতে পারব না। আমার মনে নেই।
সম্পর্কটা ছিন্ন হওয়ার আগের যে স্টেটমেন্টটা, আর পরবর্তীকালে হামিদ যখন একা দেশে ফিরে আসেন তখন ওই স্টেটমেন্টটা দিয়েছিলেন যে 'এটা পুরোটাই আমার চিন্তার ফসল, নভেরা সাহায্য করেছে মাত্র।'...এখন যে কথাটা আমি আগেই বলেছি, যখন এই শহীদ মিনারের কাজগুলো শুরু হয় তখন হামিদ এবং নভেরা একসঙ্গেই কাজগুলো করেছিলেন। এবং ম্যুরালগুলো ছিল বেসমেন্টে অসমাপ্ত অবস্থায় ছিল। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান আর্মি পুরোটাই ধ্বংস করে দেয়। যা-ই হোক, এ নিয়ে যদি কোনো তর্ক তোলা যায়, সে তর্ক কিন্তু অসমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত থাকবে।
শিবুকোনো দলিল নেই?
জাহাঙ্গীর: না কোনো দলিল নেই।
শিবু: রাষ্ট্রীয় কোনো চুক্তিপত্র নেই?
জাহাঙ্গীর: না কোনো কিছু নেই।
শিবু: শুনেছি কন্ট্রাক্ট হামিদুর রহমানের নামে হয়েছে, অফিশিয়ালি হামিদুর রহমানের নামটাই রয়ে গেছে। কিন্তু আই-উইটনেস বলছে, এটা দুজনে মিলে করেছেন। এখন আপনি কোনটাকে সঠিক বলবেন?
জাহাঙ্গীর: আমি যা বলছি সেটা হামিদের প্রথম স্টেটমেন্ট এবং দ্বিতীয় স্টেটমেন্ট। এখন কন্ট্রাক্টে সই হয়েছে না হয়নি, সেটা অবান্তর। এই অর্থে অবান্তর, প্রাথমিক পর্যায়ে যখন কাজটা শুরু হয় শহীদ মিনারের এবং হামিদ কন্ট্রাক্টে তাঁর নাম সই করে নেন। কথাটা মনে রাখতে হবে, হামিদ খুব বেশি স্পষ্টবাক ছিলেন। কথাবার্তায় খুব চোস্ত ছিলেন। নভেরা কিন্তু সেটা ছিলেন না। এটা কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে। আর আমার মনে হয় না নভেরার মাথার মধ্যেও কখনো এটা ঢুকেছে যে হামিদ পুরো জিনিসটাই তাঁর নামে নিয়ে নেবেন। এটা নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তাও কখনো হয়নি। হামিদের সঙ্গে নভেরার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল, ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। নভেরাকে বহু ক্ষেত্রে হামিদ প্রমোট করেছেন, এর সবই সত্য। কিন্তু অপর দিকটা হচ্ছে নভেরা আর হামিদ কিন্তু পরস্পর ভালোবেসেছিলেন। একসঙ্গে ঢাকাতে বহুদিন ধরে জীবন যাপনও করেছেন। তাঁদের বিয়ে হয়েছে কি হয়নি, এটা অবান্তর। একসঙ্গে তাঁরা জীবন যাপন করেছেন। তারপর যখন তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, তখনই হামিদ চলে যান কানাডায় আর নভেরা চলে যান ফ্রান্সে। হামিদ যখন কানাডায় চলে যান, মনে রাখতে হবে হামিদ তখন বিয়ে করেছেন ঢাকারই এক মেয়েকে। তবে যে প্রশ্নটা উঠেছে, সৈয়দ শামসুল হক যে প্রশ্নটা তুলেছেন, সে প্রশ্নটা সংগত কিন্তু এর তো কোনো মীমাংসা নেই।

ভাস্কর্যের সঙ্গে নভেরা
ভাস্কর্যের সঙ্গে নভেরা

শিবু: কেন মীমাংসা নেই?
জাহাঙ্গীর: এই জন্যে মীমাংসা নেই যে নভেরা তো চলেই গেলেন।
শিবু:তাই বলে তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পাবেন না?
জাহাঙ্গীর: স্বীকৃতির প্রশ্ন উঠছে না, নভেরার কাজ তো অধিকাংশ মানুষ দেখেওনি। যেমন ধরুন আমরা নভেরা নিয়ে কথা বলছি, আমরা কতজন তাঁর কাজ দেখেছি? মূল প্রশ্ন তো ওখানে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। তো ওই জন্যে তাঁর স্বীকৃতি দেওয়া বা না দেওয়ার প্রশ্নটা উঠছে না। নভেরাকে সবাই মেনে নিচ্ছে কিন্তু নভেরার কাজ সম্বন্ধে কেউ তো স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলতে পারছে না। এখন তারপরেও শেষ পর্যন্ত... সেটা নিয়ে একটা আর্কাইভ হতে পারে, এত দীর্ঘ সময় পরে ১৯৯৮ সালে একটা এক্সিবিশন হয়েছে নভেরাকে নিয়ে। এই যে এত দিন বিষয়টা পড়ে থাকা এই বিষয়গুলো নিয়ে...এই বিষয়টা নিয়ে কিন্তু আলোকপাত করা যায়...। নভেরার কাজগুলো বহুদিন ধরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির পাবলিক লাইব্রেরির প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। তখন একটা পর্যায়ে দাবি উঠেছিল, আমরাই দাবি করেছিলাম, এগুলোকে তুলে নিয়ে আসা হোক এবং নভেরার কাজের একটা প্রদর্শনী হোক। অপর দিকটা হচ্ছে হামিদের পরিবার হামিদের কাজকে প্রমোট করেছে। নভেরার পরিবার তো এ ব্যাপারে উদাসীনই ছিল সব সময়। কেউ কিছু বলেননি।
শিবু: এটি কেন হয়েছে? নভেরার পরিবারও তো সম্ভ্রান্ত পরিবার।
জাহাঙ্গীর: সবই সত্য। এবং তাঁরা ক্ষমতাশালীও বটে, এই ব্যাপারে আমি তো বলেছি, স্পষ্ট কোনো কথা বলা মুশকিল যে তাঁরা কেন কোনো কথা বলেননি। অনেক রকম জবাব আমরা দিতে পারি, কিন্তু সমস্ত জবাবটা এক অর্থে কাল্পনিক হয়ে যাবে। যে কারণে আপনারা যাঁরা হাসনাত আবদুল হাইয়ের বইটা ('নভেরা') পড়েছেন, শেষের দিকে ওর বড় বোনের বেশ বড় একটা প্রবন্ধ আছে, তাঁর নাম কুমুম হক। তাতে কিন্তু তিনি একেবারে কোন চ্যাপ্টারে কী আছে না আছে, ভুল ইত্যাদি কথা তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন। এখন একটা হতে পারে, নভেরাকে নিয়ে তাঁর পরিবারে একটা রাগ-অভিমান, ভুল-বোঝাবুঝি ছিল। অপরটা হতে পারে, নভেরা যখন বিদেশে চলেই গেলেন, সেটেল করেই গেলেন, তারপর তো তাঁর পরিবারের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগই ছিল না। অনেকগুলো ব্যাপার আমরা বলতে পারি আরকি। এখন কোনটা সত্য, এর তো জবাব কেউ দিতে পারবে না। দিতে পারতেন একজন, তিনি হচ্ছেন হামিদুর রহমান, কিন্তু হামিদুর রহমান তো মারা গেছেন এবং হামিদুর রহমান তো সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেই চলে গেছেন। এগুলো হচ্ছে মিসিং পয়েন্ট আরকি। যদি কখনো এই মিসিং পয়েন্টগুলো আমরা উদ্ধার করতে পারি, তাহলে হয়তো এর জবাব দেওয়া যাবে, তার আগে তো কোনো জবাব দেয়া যাবে না।
শিবু: নভেরাকে নিয়ে হাসনাত আবদুল হাইয়ের উপন্যাস, একে ঘিরেও নানা বিতর্ক আছে পক্ষে-বিপক্ষে। আপনি এই উপন্যাস সম্পর্কে কিছু বলবেন?
জাহাঙ্গীর: হাসনাত আবদুল হাই নভেরাকে অবলম্বন করে একটা ভালো উপন্যাস লিখেছেন। তার কারণ, নভেরার জীবনে উপন্যাসের বহু উপাদান এবং উপকরণ আছে। যেকোনো ব্যক্তি নভেরার জীবনকাহিনি (আমি কাহিনি শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি) জানলে এবং শুনলে অভিভূত হতে বাধ্য। সেদিক দিয়ে অবশ্যই হাসনাত আবদুল হাই একটা ভালো কাজ করেছেন। বড় কাজ করেছেন। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে যেটা সমস্যা, যদি আমরা ভ্যান গঘের লাইফ, 'লাস্ট ফর লাইফ' পাশাপাশি মিলিয়ে পড়ি, তাহলে দেখতে পাই, 'লাস্ট ফর লাইফ'-এ ভ্যান গঘের জীবন এবং তাঁর চিত্রকলা পরস্পর প্রবিষ্ট হয়ে আছে। লেখক ভ্যান গঘের জীবনের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বিশেষ বিশেষ চিত্রকলার কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর যে ধরনের স্ট্রাগলগুলো হয়েছিল এক্সপেরিমেন্টেশনের ক্ষেত্রে, সেগুলো উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যাটা হচ্ছে, আমার মনে হয় হাসনাত আবদুল হাই যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেটা হচ্ছে নভেরার অত কাজ তো আমাদের কাছে নেই। এবং তিনি তাঁর কাজ, বহু কাজ যদি বিদেশে করেও থাকেন, সেগুলো দেখেছেন তারও কিন্তু প্রমাণ কোথাও নেই। এখানেই সমস্যা, সে জন্য নভেরার জীবন যত বেশি আমাদের আকর্ষণ করে, কাজের দিক থেকে যদি বুঝতে চাই, তখন আমরা একটু থতমত খেয়ে যাই যে হ্যাঁ, এ কাজগুলোর রেফারেন্স তো কোথাও নেই। অন্য কোনো কিছু নয়।

নভেরা
নভেরা

শিবু: নভেরার জীবনযাপনের মধ্যে, এরকম অভিযোগ আছে যে তিনি পুরুষদের এক্সপ্লয়েট করতেন।
জাহাঙ্গীর: না, যেটা হয়েছে তাঁর জীবনযাপন, পঞ্চাশের দশকে অবশ্যই আনকনভেনশনাল ছিল। এটা মানতেই হবে এবং এই সমাজ এটা খুব ভালো চোখে দেখেনি। নভেরাকে খুব ভালোভাবে কেউ গ্রহণও করেনি। নভেরা পুরুষদেরকে এক্সপ্লয়েট করেছেন কি না, এটা একটা মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। হয়তো করতে পারেন কিংবা হয়তো না-ও করতে পারেন। যত দিন পর্যন্ত হামিদের সঙ্গে ছিলেন, তত দিন পর্যন্ত হামিদই তাঁর জীবন-জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যত দিন পর্যন্ত এস এম আলীর সঙ্গে ছিলেন, তত দিন পর্যন্ত এস এম আলী তাঁর জীবন-জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কিন্তু যখন হামিদের সঙ্গে ছিলেন, তখন এ কথা বলা যাবে না যে আরও অনেক পুরুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। ব্যাংককে বহু পুরুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল এস এম আলী বাদে, এটাও বোধ হয় বলা যাবে না। সে জন্যে ওই প্রশ্নটা আমি মনে করি অনাবশ্যক। আমি অন্তত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাব না এবং পৌঁছাতেও চাই না, নভেরা পুরুষদেরকে এক্সপ্লয়েট করেছেন এবং তাহলে নভেরাকে ছোট করে দেখা হয়। বরং আমি বলব, নভেরা তাঁর কাজের বাইরে জীবন থেকে খুব বেশি কিছু চেয়েছেন, তার প্রমাণ কিন্তু খুব একটা নেই। তাঁকে অনেকেই অপছন্দ করতেন এবং অপছন্দের কারণগুলো তো আমি ব্যাখ্যাই করেছি। তাঁর জীবনযাপনের জন্যে, তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদের জন্যে, আনকনভেনশনাল লাইফ লিড করবার জন্যে। কিন্তু এগুলো দিয়ে আমরা খুব বেশি দূর এগোতে পারি না।
শিবু: নভেরার কাজে 'পরিবার, মাতৃত্ববোধ বা যূথবদ্ধতা' বিষয় হিসেবে এসেছে। এ ছাড়া তার কাজের ফর্মে 'শূন্যস্থান' রিপিটেডলি এসেছে। তাঁর কাজের দার্শনিক জায়গাটা নিয়ে কিছু বলবেন?
জাহাঙ্গীর: যদি ওই গ্রুপ ফিগারের কথা বলেন, শূন্যস্থানের কথা বলেন, এগুলো তো হেনরি মুরের কাজের মধ্যেই খুব স্পষ্ট। বহু গ্রুপ ফিগার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন এবং শূন্যস্থান তাঁর কাজের মধ্যে বহু জায়গায়ই রয়েছে, এটা দিয়ে আমরা কী প্রমাণ করব?
শিবু:

১৯৯৯ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। সেখানে নভেরার সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়েছিল। একুশে পদক প্রত্যাখ্যান বিষয়ে তাঁদের মধ্যে কথাও হয়েছিল, সেই ঘটনাটা সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
জাহাঙ্গীর: একটা কথা হচ্ছে যখন নভেরা চলেই গেলেন এবং প্যারিসে সেটল করলেন, তিনি কখনো এই দাবি করেননি যে 'আমি বাংলাদেশের মেয়ে। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক আছে।' আমরাই বরং তার ওপরে চাপাবার চেষ্টা করেছি যে হ্যাঁ, তুমি বাংলাদেশের মেয়ে, তোমাকে একুশে পদক নিতে হবে, তোমাকে এটা নিতে হবে, ওটা নিতে হবে। তিনি তো কখনো কোনো দাবি করেননি। তিনি কি কখনো কারও কাছে বলেছেন যে 'আমি বাঙালি?' এই দাবিতো তিনি করেননি। আমরাই বরং এগুলো প্রচার করবার চেষ্টা করেছি। তো সেই জন্যে শেখ হাসিনা প্যারিসে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করেছিলেন। তিনি কোনো সাড়াই দেননি। এগুলো আমরা শোনা কথার ভিত্তিতে কতগুলো মিথ তৈরি করবার চেষ্টা করেছি। এখানটায় হচ্ছে গিয়ে সমস্যা। তার কারণ, নভেরার মধ্যে আমরা যদি বলি দেশপ্রেম বলে কোনো কিছুই নেই...
শিবু: নেতিবাচক অর্থে বলছেন?
জাহাঙ্গীর: নেতিবাচকও নয়, ইতিবাচকও নয়। কিছু কিছু মানুষ ওভাবেই থাকে। কেননা, যে জন্যে আমি আগেই বলেছি, নভেরা তো কখনো দাবি করেননি যে 'আমি বাঙালি।' নভেরা কি কোথাও দাবি করেছেন? যদি দাবি করতেন, তাহলে প্যারিসে তো অনেক বাঙালি আছে, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ তিনি রাখতেন। এবং কারও সঙ্গে কিন্তু যোগাযোগ নেই। প্যারিসের বাঙালিদের কাছে নভেরা মৃত এক ব্যক্তি। তিনি কোথায় থাকেন, কেউ বলতে পারে না। এবং এ ব্যাপারে নভেরার কোনো মান-অভিমান কিছুই নেই।
শিবু: হামিদুর রহমান ও নভেরা আহমেদের কাজকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? এবং দুজনের কাজের মধ্যে একে অপরের প্রভাব ছিল কি?
জাহাঙ্গীর: হামিদ প্রধানত রিয়েলিস্টিক কাজ করেছেন, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এবং রিয়েলিস্টিক কাজগুলোকে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাঙচুর করেছেন। হামিদের মধ্যে একটা জিনিস ছিল, অত্যন্ত ডায়নামিক, ভালো কথা বলতে পারতেন, ইম্প্রেসিভ। কিন্তু যদি এক্সপেরিমেন্টের দিক দিয়ে আমরা চিন্তা করি, তাহলে ওই সময়ে তাঁর বন্ধু আমিনুল ইসলাম অনেক বেশি এক্সপেরিমেন্টাল কাজ করেছেন। নভেরার কাজে, এটা আমার ব্যক্তিগত মত, আমিনুলের প্রথম দিককার কাজের প্রভাব খুব স্পষ্ট। আমিনুলের সেই মোটা ব্রাশের কাজ, রিয়্যালিস্টিক কাজ, বিশাল বিশাল ফিগার, এগুলো যেন ঘুরে-ফিরে নভেরার কাজের মধ্যে এসেছে। হামিদ চেষ্টা করতেন নভেরাকে তাঁর প্রভাব-বলয়ের মধ্যে রেখে দিতে। কিন্তু নভেরা যেকোনো কারণেই হোক এই প্রভাব-বলয়কে ভেঙেছেন আমিনুলের প্রভাবে। আমিনুলের প্রভাবটা পড়েছে ঢাকায় এবং ইতালিতে থাকার সময়। এ কথা বলতেই হবে হামিদ এবং নভেরা যখন ইতালিতে ছিলেন, তখন তাঁরা খুব বেশি কাজ করেননি। তাঁরা ঘোরাফেরা করেছেন, কাজ করেননি। কিন্তু কাজগুলো করেছেন পরে, সেই কাজগুলোকে যদি আমরা বিচার করি, তাহলে কিন্তু আমি যে কথাগুলো বললাম ,সে সত্যে আমরা উপনীত হই।

প্যারিসের নভেরা
প্যারিসের নভেরা

শিবু: ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে জাতীয় জাদুঘরের এক্সিবিশন সম্পর্কে কিছু বলবেন?
জাহাঙ্গীর: ১৯৯৮ সালে তাঁর কাজ প্রদর্শনী আকারে উপস্থাপিত করার ব্যাপারে আমরা অনেকেই এর পেছনে কাজ করেছিলাম। তার কারণ আমরাই দাবি করেছিলাম যে কাজগুলো ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির প্রাঙ্গণে পড়ে আছে, সেগুলোকে তুলে নিয়ে আসা হোক মিউজিয়ামে এবং একটা সাময়িক এক্সিবিশনের ব্যবস্থা করা হোক। আমাদেরই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ এক্সিবিশনটা করেছিলেন, যে কাজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির প্রাঙ্গণে ছড়ানো-ছিটানো ছিল। একটা-দুটো কাজ ছিল এয়ারপোর্ট রোডে। আরেকটা কাজ ছিল বোধ হয় হামিদের বাসায়, তেঁজগাওয়ের বাসার প্রাঙ্গণে। এগুলোকে একত্র করে এই প্রদর্শনীটা করা হয়েছিল।
শিবু:

নভেরা-পরবর্তী সময়ে এ দেশের ভাস্কর্যের চর্চায় নভেরার প্রভাব কতটুকু দেখতে পান?
জাহাঙ্গীর: ঢাকাতে যে নতুন ভাস্কর্যের প্রয়াস শুরু হয়েছিল, সেখানে কিন্তু নভেরার প্রভাব ক্ষীণ। তার কারণ, যাঁরা তখন কাজ শুরু করেছিলেন, তাঁরা নভেরার কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেননি। তাঁরা পাঠ গ্রহণ করেছিলেন সরাসরি পশ্চিম থেকে। পশ্চিমে গিয়ে কিংবা রিপ্রোডাকশন দেখে। এবং তাঁদের কাছে গুরু ছিলেন, ওই সময়ের কথা আমি বলছি, অবশ্যই হেনরি মুর, ব্রিটিশ স্কাল্পটর বলে নয়, একজন বিশ্বনন্দিত স্কাল্পটর বলে এবং তিনি যে প্রক্রিয়ায় কাজ করেছেন, সবাই মনে করতেন এই প্রক্রিয়াটাই হচ্ছে স্কাল্পচারের ভবিষ্যৎ। এ পথ দিয়ে এগোনো যেতে পারে। হ্যাঁ ওই এক্সিবিশনটা যখন করা হয় এবং দর্শকরা যখন দেখেন, তখন তাঁরা উল্লসিত হয়েছিলেন অন্য কারণে। এই যে নভেরা, যাঁর সম্বন্ধে এত কথা শোনা যাচ্ছে, তাঁর কাজগুলো হচ্ছে এই। কাজগুলো আমরা জানতাম না। তার কারণ, এই কাজগুলোই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির প্রাঙ্গণে ছড়ানো-ছিটানো ছিল, তখন কেউ দেখেও দেখেননি। কিন্তু যখন এগুলোকে তুলে নিয়ে আসা হলো, মিউজিয়ামের রাখা হলো, তখন সবাই ভাবলেন যে হ্যাঁ, এই কাজগুলোর মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা আছে। এখান থেকে অন্য কোথাও পৌঁছানো যেতে পারে। সেখানেও আমরা যারা দর্শক ছিলাম, আমাদের মধ্যে একটা আক্ষেপ কাজ করেছে। আক্ষেপটা এই যে অন্য কোথাও পৌঁছানোর যে তাগিদ, এটা কে করবেন? এটা তো নভেরা করবেন। আমি দর্শক তো এটা করতে পারিনি। কিন্তু নভেরা কোথায়? মনে রাখতে হবে, সে সময় নভেরা কিন্তু ঢাকাতে নেই। এগুলো হচ্ছে নিষ্ঠুর সত্য।
শিবু: নভেরার সব কাজ একত্রিত করে একটা আর্কাইভ করা যায় কি না?
জাহাঙ্গীর: আর্কাইভ করা যায়। কিন্তু কথা হচ্ছে এই কাজগুলো আপনি কোথায় পাবেন? নভেরা কি কাজ দেবেন? এই প্রশ্নের জবাব কিন্তু কারও কাছে নেই। কিংবা নভেরার কাজগুলো, ভিন্নতর কাজগুলো যদি কেউ দেখেও থাকেন, সে রিপ্রোডাকশনগুলো পাওয়ার কি কোনো সম্ভাবনা আছে? তার জবাব কিন্তু নেগেটিভ। ওই কারণেই আর্কাইভ করাটা, কী করে করবেন, এই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। নভেরার জীবন যত বেশি আকর্ষণীয়, তাঁর কাজ কতটুকু আকর্ষণীয় এটা আমাদের মনে একটা বড় প্রশ্ন। যেহেতু আমরা তাঁর কাজ দেখিনি।
শিবু: দেখিনি বলতে...
জাহাঙ্গীর: তাঁর কাজ দেখিনি মানে প্রথম দিকের কাজ আমরা দেখেছি, যেগুলো এখানে আছে। তার পরের কাজ তো আমরা দেখিইনি। ভার্চ্যুয়ালিই আমরা দেখিনি। সে জন্যে আমাদের ইভ্যালুয়েশনটা হচ্ছে মিথিক্যাল, শোনা কথার ওপর অর্থাৎ নভেরা কাজ থেকে এখানে পৌঁছাতে পারতেন। এই ভাবনা দিয়ে তো খুব বেশি দূর এগুনো যায় না। এবং এটাও মনে রাখতে হবে, যেখানে এখন বসবাস করছেন, সেই অঞ্চলে, সেই শহরে বা ফ্রেঞ্চ আর্টিস্টিক ট্রেডিশনের ভেতরে নভেরার অবস্থান কী? প্রশ্নটার জবাব কিন্তু খুব নির্মম। তবে প্রশ্নটা তো উপস্থাপন করতেই হবে।
শিবু: অবশ্য প্যাট্রনাইজেশন একটা বড় ইস্যু কি...
জাহাঙ্গীর: প্যাট্রন না পেলেও আপনি ভালো শিল্পী হতে পারেন, যেমন জ্যাকোমেত্তি (Alberto Giacometti) হয়েছেন। এগুলো বড় কথা নয়। প্যাট্রন পেতেই হবে, এটা কোনো কথা নয়। কিন্তু যে প্রশ্নটা আমি করেছি, বর্তমান ফ্রান্সের যে আর্টিস্টিক ট্রেডিশন, বা ভাস্কর্যের যে ট্রেডিশন ফ্রান্সে তৈরি হয়েছে তার ওপর কতটুকু প্রভাব তিনি বিস্তার করতে পেরেছেন? এটার কিন্তু খুব বেশি স্পষ্ট জবাব কোথাও নেই। ওই কারণে তিনি কত বড় শিল্পী, এ ব্যাপারে আমরা কল্পনা করতে পারি। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো নজির আমরা কোথাও দিতে পারছি না।
শিবু: শিল্পী নভেরার জীবন থেকে যা আমাদের কিছু শেখার আছে—
জাহাঙ্গীর: নভেরার জীবন থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। সেটা হচ্ছে, যদি শিল্পকাজ করতেই হয়, লেগে থাকতে হবে। নভেরা লেগে ছিলেন, কাজ করবার চেষ্টা করেছেন। এবং কাজ করবার চেষ্টা করতে গিয়ে তাঁর বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। ভালো-মন্দ যা-ই আমরা বলি না কেন। সেগুলো তিনি ব্যবহার করেছেন কি করেননি, সেটা তর্কসাপেক্ষ।
শিবু: মেলামেশা তো তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার ব্যাপার—
জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ, কিন্তু তিনি কাজ করেছেন। সমস্যাটা হল তাঁর কাজ তিনি কখনো প্রদর্শন করেননি। কেউ জানে না এবং যে পরিবেশ থেকে তিনি বেরিয়ে গেছেন অর্থাৎ বাংলাদেশের পরিসর, তার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই নেই। বাংলাদেশ তাঁকে দাবি করতে পারে যে হ্যাঁ, তিনি আমাদের দেশের শিল্পী। কিন্তু নভেরা তো কখনোই দাবি করেননি আমার জানামতে যে 'বাংলাদেশের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক আছে।' আমরা গায়ে পড়ে তাঁর ওপরে আমাদের মূল্যায়নগুলো করবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি এই ব্যাপারে হ্যাঁ-ও বলেননি, না-ও বলেননি।
শিবু: বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর কি তাঁকে আমরা বলতে পারি?
জাহাঙ্গীর: অবশ্যই বলতে পারি, কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার পরে আমরা বলতে পারি না। পারি না এই জন্য যে তাঁর কাজ আমাদের হাতে নেই। অন্তত আমি দেখিনি। ভলিউম যদি না-ও থাকত বা আমরা কোথাও গিয়ে যদি তাঁর কাজ দেখতে পারতাম, বিভিন্নভাবেই এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যেতে পারে, তাহলে আমাদের মনে একটা বোধ তৈরি হতো, নভেরা এইভাবে কাজ করেছেন, এই দিকে যেতে চেয়েছেন। কিন্তু ও সম্বন্ধে তো আমরা কোনো কথাই বলতে পারব না। বলা সম্ভবও না। নভেরা যদি ধারাবাহিকভাবে ঢাকাতে কাজ করতেন, বাংলাদেশে কাজ করতেন, তাহলে এখন সেরা ভাস্কর তিনি হতেন। কিন্তু যখন তিনি এখান থেকে চলেই যান, তাঁর পরের কাজের নমুনা আমার অন্তত জানা নেই। সে ক্ষেত্রে বিচার করাটা বড় ডিফিকাল্ট। অপরটা হচ্ছে যতটুকু কাজের নমুনা আমরা দেখেছি, তাতে মনে হয় তিনি একটা স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু নিয়তির পরিহাস, হয়নি।
শিবু: আপনার কাছে কোন নভেরা বেশি আকর্ষণীয়—ব্যক্তি নভেরা, না শিল্পী নভেরা?
জাহাঙ্গীর: আমার কাছে দুইই পরস্পর প্রবিষ্ট। অর্থাৎ যখন আমি তাঁকে দেখেছি ব্যক্তিগতভাবে...
শিবু: কোথায় দেখেছেন?
জাহাঙ্গীর: ঢাকার কথাই বলছি।
শিবু: ঢাকার কোথায়?
জাহাঙ্গীর: ঢাকায় যখন হামিদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করতেন, হামিদের বাসায় যেতেন, একসঙ্গে থাকতেন, ওই সময়ের কথা আমি বলছি আরকি।
শিবু: তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল আপনার?
জাহাঙ্গীর: হ্যাঁ, তবে কোনো অন্তরঙ্গতা ছিল না।
শিবু: কী কথা হয়েছে?
জাহাঙ্গীর: এমনি, কেমন আছেন? আপনার কাজ কেমন হচ্ছে? সাঈদের সেতার বাজনা পছন্দ করতেন ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু হামিদ অত্যন্ত ডমিনেটিং ক্যারেক্টার ছিলেন। হামিদ খুব একটা পছন্দ করতেন না হামিদ বাদে অন্য কারও সঙ্গে খুব বেশি কথাবার্তা নভেরা বলুক।
শিবু: নভেরা কত দিন দেশে ছিলেন?
জাহাঙ্গীর: খুব বেশি দিন নয়। কারণ ঢাকাতে যখন ওঁরা শুরু করে, পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে, তার কিছুদিন পরেই ওঁরা আবার বাইরে চলে যান। তো সে জন্যে এই পরিচয় কখনোই ধারাবাহিকতা লাভ করতে পারেনি।
শিবু: নভেরাকে প্রথম কোথায় দেখলেন?
জাহাঙ্গীর: আমি তো বলেছি হামিদের বাসায়।
শিবু: সেই ঘটনাটা কি একটু বিস্তারিত বলবেন?
জাহাঙ্গীর: অত দূর আমি বলতে পারব না, কারণ, হামিদদের বাসায় বা ওই লায়ন সিনেমার গলি যেটা আমরা বলি, তার একদিকে থাকতেন শামসুর রাহমান, তাঁর বাসায় আমরা প্রায়ই যেতাম। আরেক প্রান্তে হচ্ছে হামিদ-সাঈদদের বাসা। তো ওই জন্যে আমরা প্রায়ই আড্ডা দিতে যেতাম। আর আমি তো বলেছি, হামিদ খুব ভালো কথা বলতে জানতেন, ইম্প্রেসিভ। সে-ও একটা সূত্র ছিল আরকি। তো ওই পর্যায়ে আমাদের প্রথম কথাবার্তাই ছিল সাহিত্য নিয়ে। শিল্প নিয়ে নয়। পরে শিল্পটা এসে যায়।
শিবু: নভেরার সঙ্গে সর্বশেষ কখন দেখা হয়েছিল?
জাহাঙ্গীর: ঢাকাতে যখন আবার ফিরে আসেন।
শিবু: ১৯৬০?
জাহাঙ্গীর: তখন দেখা হয়েছিল। তখন হামিদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হতে যাচ্ছে আরকি। এই পর্যায়...
শিবু: তখন নভেরার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেছেন?
জাহাঙ্গীর: একটা পরিবর্তন তো হয়েইছিল, নভেরা খুব উদ্‌ভ্রান্ত ছিলেন। মানে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, হামিদ তাঁর ভরণ-পোষণ করতেন সত্যিকার অর্থে। এখন কোথায় যাবেন? যদিও অত্যন্ত ধনী পরিবার, পরিবারের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্কই ছিল না। এগুলো সমস্যা ছিল আরকি। একটা ইনসিকিউরিটি তো ছিল, একেবারে বাস্তবিক অর্থে। ওখান থেকে বিদেশে চলে যান তিনি।
শিবু: এস এম আলী ('ডেইলি স্টার' পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক) সাহেবের সঙ্গে কি তার পরে যোগাযোগ হয়?
জাহাঙ্গীর: পরে যোগাযোগ হয়।
শিবু: কার মাধ্যমে জানা আছে?
জাহাঙ্গীর: বোধ হয় ব্যাংককে থাকাকালীন অবস্থায় তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কটা তৈরি হয়।
শিবু: নভেরাকে নিয়ে আপনার চূড়ান্ত কথা...
জাহাঙ্গীর: কোনো শিল্পী সম্পর্কে শেষ কথা বলা যায় না এবং বলা উচিতও নয়। আমরা কি বলতে পারি জয়নুল আবেদিন বেঁচে থাকলে আরো কত বড় শিল্পী হতেন? আমরা বলতে পারি না। কিন্তু বড় শিল্পী হওয়ার সমস্ত গুণ নভেরার মধ্যে ছিল। এই পর্যন্ত আমরা বলতে পারি। নভেরার শিল্পীজীবন এক অর্থে খুব ট্র্যাজিক এবং যেকোনো শিল্পী যেকোনো সংবেদশীল মন নভেরার জীবনকাহিনি পড়লে বা জানলে অভিভূত হবেন। হওয়াটা স্বাভাবিক। যেমন কিনা আমরা ভ্যান গঘের, পল গগ্যাঁর জীবনকাহিনি জানলে বা পড়লে অভিভূত হই। সেই একই অর্থে। একজন মানুষ তো আরেকজন মানুষের এই স্ট্রাগল, বিভিন্ন ধরনের লড়াই, শিল্পী হওয়ার জন্যে লড়াইগুলো জানলে অভিভূত হবেনই। সেটা স্বাভাবিক, আমিও হই।

আপনাকে ধন্যবাদ।