আমার বাবা গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের কাছে চিঠি

>

এমন কোনো দিন যায় না, যেদিন আমার সামনে তোমার উপন্যাস 'লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা'-এর একটা কোনো কিছু আসে না। তুমি এই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখতে, সেটা নিয়ে জল্পনা না করে থাকা অসম্ভবের মতো। 

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস


৬ মে ২০২০

গাবো,
১৭ এপ্রিল ছিল তোমার ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী, ইতিমধ্যে, পৃথিবী চলছে মোটামুটি তার চিরাচরিত নিয়মেই, সঙ্গে বজায় রয়েছে মানুষের অত্যাশ্চর্য ও সৃজনশীল নিষ্ঠুরতা, মহিমান্বিত বদান্যতা ও ত্যাগ, এবং এর সঙ্গে আরও যা যা রয়েছে।

একটি নতুন জিনিস: হাজির হয়েছে, এক মহামারি। আমাদের জানামতে, এই ভাইরাসের জন্ম একটি খাবার-দাবারের মার্কেট থেকে, যেখানে ভাইরাসটি একটি প্রাণীর শরীর থেকে লাফিয়ে এসে মানুষের ওপর ভর করেছে। একটি ভাইরাসের জন্য সেটি ছিল ছোট একটি পদক্ষেপ, কিন্তু ওই প্রজাতিটির জন্য সেটা ছিল অনেক বড় উত্তরণ। এটি এমন একটি প্রাণী, যেটি অপরিমাপযোগ্য সময়ের মধ্যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে একটি ছোটখাটো ক্ষুধার্ত রাক্ষসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এটিকে এভাবে বর্ণনা করাটা অসমীচীন, এবং যদি সে আমার কথায় ক্ষুব্ধ হয়, তাহলে আমি অনুশোচনা প্রকাশ করব। সে নিতে থাকে এবং নিতেই থাকে, কারণ তার সে সক্ষমতা রয়েছে। এ ধরনের ব্যবহারের সঙ্গে আমরা অবশ্যই নিজেদের মেলাতে পারি। এখানে ব্যক্তিগত কিছুই নেই।

এমন একটা দিনও যায় না যেদিন আমার সামনে তোমার লেখা উপন্যাস 'লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা' অথবা সেটার শিরোনাম, কিংবা 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড'-এ অনিদ্রার মহামারিকে রেফার করে লেখা কিছু আসে না। তুমি এই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখতে, সেটা নিয়ে জল্পনা না করে থাকা অসম্ভবের মতো। মহামারি তোমাকে সর্বদাই মুগ্ধ করত, তা সে সত্যই হোক কিংবা সাহিত্যের প্রয়োজনে তৈরি কাল্পনিকই হোক, এবং সঙ্গে সঙ্গে যেসব বস্তু এবং মানুষেরা এ দুর্যোগ থেকে ফিরে আসতে পারত, তাদের ব্যাপারেও তুমি যুগপৎ আগ্রহী থাকতে।

যখন স্প্যানিশ ফ্লু মহামারি পুরো গ্রহকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলছিল, তখনো তোমার জন্ম হয়নি, কিন্তু তুমি এমন একটি পরিবারে বড় হয়েছ, যেখানে গল্প শোনানোর রেওয়াজ ছিল, আর সেখানে ভূতপ্রেত এবং বিবিধ আফসোসের মত প্লেগও গল্পের জন্য অনবদ্য উপাদান ছিল। তুমি বলেছিলে ওরা অনেক আগে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দিত, যেগুলো ঘটেছিল ধূমকেতুর সময়ে। খুব সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হ্যালির ধুমকেতু পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ের কথা বলত তারা।

এই ব্যাপারটি তোমাকে মোহাবিষ্ট করেছিল, একটি রহস্যময় ঘড়ি প্রতি ৭৬ বছর পরপর একবার করে নীরবে ঘণ্টার কাটায় আঘাত হানছে; এই চক্রটি যেন মানব জাতির জন্য বরাদ্দ থাকা সময়ের নিখুঁত একটি প্রতিচ্ছবি।

এটি কি একটি কাকতালীয় ঘটনা? হয়তোবা এটি আরেকটি আলেয়ার পেছনে ছোটা। একজন নাস্তিক হওয়া স্বত্ত্বেও তুমি ভাবতে যে কোনো মাস্টার প্ল্যান ছাড়া এত কিছু চলতে পারে না, মনে আছে সেটা? এই গল্প শোনানোর মতো কেউ নেই। সম্ভবত এই প্রসঙ্গে এখন তুমি আমার চেয়ে বেশি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন।

একটি মহামারি ফিরে এসেছে। বিজ্ঞানের এত অগ্রগামিতা এবং মানব জাতির এত উদ্ভাবনী দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত আমরা একমাত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বের করতে পেরেছি শুধুই নিজ নিজ গৃহে অন্তরীণ থাকার ব্যাপারটা, যা হিংস্র প্রাণীদের থেকে নিজেকে বাঁচাতে গুহায় লুকিয়ে থাকার কৌশলের সমতুল্য। যাদের ন্যূনতম মানবতাবোধ রয়েছে, তাদের জন্য এটি বিনয় শেখার সময়। অন্যদের জন্য এটি একটি বিরক্তিকর ও ধ্বংসযোগ্য জিনিস। তোমার প্রিয় দুটি দেশ, স্পেন ও ইতালি, এই মহামারিতে সবচেয়ে কঠিনভাবে আক্রান্ত হয়েছে। তোমার সবচেয়ে পুরোনো কিছু বন্ধু এ সময়ের সদ্ব্যবহার করছে বার্সেলোনা, মাদ্রিদ ও মিলানের সেই ফ্ল্যাটগুলোতে অন্তরীণ থেকে, যেখানে তুমি আর মেরসেদিস গত কয়েক দশকে অসংখ্যবার বেড়াতে গিয়েছ। ওই প্রজন্মের বেশ কিছু মানুষের কাছে শুনছি যে তারা বেঁচে থাকতে দৃঢ়সঙ্কল্প। দশকের পর দশক ক্যানসার, অত্যাচারী স্বৈরশাসক, বিবিধ চাকরি, দায়-দায়িত্ব ও বৈবাহিক সম্পর্ককে জয় করে আসার পর সামান্য ফ্লু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার কোনো ইচ্ছাই তাদের নেই।

স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে মার্কেস
স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে মার্কেস

শুধু মৃত্যু নয়, বরং এই মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হওয়া সার্বিক পরিস্থিতিকে আমরা বেশি ভয় পাচ্ছি এখন। ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাজে সেজে থাকা কিছু অচেনা মানুষের হাত ধরে বিদায়হীন চিরপ্রস্থান, সঙ্গে হৃদয়হীন মেশিনের বিপ বিপ শব্দ, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা একই পরিস্থিতির শিকার আরও অনেকেও থাকবে; কিন্তু থাকবে না আমাদের কোনো নিকটজন। এটি হচ্ছে একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় ভীতি, একাকীত্বের প্রকৃত রূপ।

তুমি প্রায়ই ড্যানিয়েল ডেফোর লেখা 'আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার'-কে তোমার ওপর সর্বাধিক পরিমাণে প্রভাব বিস্তার করা গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করতে, কিন্তু গতকাল পর্যন্ত আমার মনেই ছিল না তোমার প্রিয় বইসমূহের মধ্যে প্রিয়তম 'ইডিপাস রেক্স'-এর কথা, যে বইয়ের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে এক রাজাকে নিয়ে, যে একটি প্লেগের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল। বইটির পুরোটা জুড়েই ছিল রাজার বিয়োগান্তক এবং মর্মান্তিক পরিণতির কথা, যেটার কথা প্রথমেই আমার মনে পড়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্লেগই সেই দুর্ভাগ্যজনক কাহিনির পেছনের নিয়ামক ছিল। তুমি একবার বলেছিলে যে মহামারির সবচেয়ে আতঙ্কজনক ব্যাপারটি হচ্ছে যে সেটা আমাদেরকে আমাদের নিজ নিজ শেষ পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেয়। যাবতীয় পূর্বপ্রস্তুতি, চিকিৎসাসেবা, কম বয়স ও প্রাচুর্য্য থাকা সত্ত্বেও যে কেউ, যেকোনো সময় মহামারির মরণ ছোবলের শিকার হতে পারে। ভাগ্য এবং মৃত্যু—একজন লেখকের অন্যতম প্রিয় বিষয়সমূহ।

আমার ধারণা, তুমি যদি জীবিত থাকতে, তাহলে সব সময়ের মতো এখনো মানব চরিত্র তোমাকে মুগ্ধ করত। 'মানুষ', শব্দটা এখন আর ওভাবে ব্যবহৃত হয় না, কিন্তু আমি পিতৃতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেখানোর জন্য এই ব্যতিক্রমটি করছি না, তুমি পিতৃতন্ত্র একদম পছন্দ করতে না। বরং আমার উদ্দেশ্য সেই তুমি, সেই উদীয়মান তরুণ লেখকটির কানের কাছে প্রতিধ্বনি তোলা, যে ছিল অনেক বেশি সংবেদনশীল আর যার মাথাভরা এত বেশি চিন্তা খেলা করত যে সে কী করবে, বুঝে উঠতে পারত না। তুমিই সেই তরুণ লেখক, যার প্রবল ধারণা ছিল যে: সবার ভাগ্যে কী আছে তা আগেই লেখা থাকে, এমনকি সৃষ্টিকর্তার হাতে তৈরি একটি প্রাণীর প্রতিরূপেরও, যে মুক্তচিন্তার ক্ষমতা দ্বারা অভিশাপগ্রস্থ।

তুমি আমাদের ভঙ্গুরতাকে করুণা করতে; তুমি আমাদের আন্তসম্পর্ক দেখে চমৎকৃত হতে, দুঃখিত হতে আমাদের দুর্ভোগ দেখে, রাগান্বিত হতে কিছু নেতাদের উদাসীনতা দেখে আর ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা দেখে উদ্বেলিত হতে। আর তুমি অধীর আগ্রহে জানতে চাইতে কীভাবে প্রেমিক-প্রেমিকারা সব ধরনের বাধাবিপত্তি ও মৃত্যুভয়কে জয় করে কাছাকাছি থাকছে। সর্বোপরি, তুমি মানবজাতিকে ভালোবেসে যেতে, সব সময়ের মতো।

রোদ্রিগো গার্সিয়া ও বাবা মার্কেস
রোদ্রিগো গার্সিয়া ও বাবা মার্কেস

কয়েক সপ্তাহ আগে, বাসায় অন্তরীণ থাকার প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই আমার মস্তিষ্ক প্রবল চাপের মুখোমুখি হয়েছিল নিজের কাছে ব্যাখা দিতে যে এসবের মানে কী, আর এ থেকে কীই-বা বের হয়ে আসবে। আমি ব্যর্থ হয়েছি ব্যাখা দিতে। কুয়াশা বেশি ঘন ছিল। এ ব্যাপারগুলো এখন প্রাত্যহিক হয়ে গিয়েছে, যেমনটা হয়ে থাকে সবচেয়ে ভীতিকর যুদ্ধ-বিগ্রহের ক্ষেত্রেও। কিন্তু তারপরও আমি সন্তোষজনক উপায়ে পুরো ব্যাপারটিকে বিন্যস্ত করতে পারছি না।

অনেকেই নিশ্চিত যে জীবন আর কখনোই আগের মতো থাকবে না। আমাদের কিছু মানুষ বিরাট কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলবে, আর আমরা বড়সংখ্যক মানুষও কিছু পরিবর্তন ঘটাব, কিন্তু আমার সন্দেহ, বেশির ভাগ মানুষই অভ্যস্ত জীবনে ফিরে যাবে। তোমার কি মনে হয় না যে মানুষ একটি ভালো যুক্তি খুঁজে পেয়েছে যে মহামারি প্রমাণ করে দিয়েছে, যেকোনো মুহূর্তে জীবনের অবসান ঘটতে পারে, এবং তা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে; এবং এ কারণেই কি আমাদের উচিত নয় প্রতিটি মুহূর্তকে উপভোগ করা এবং জাঁকজমকের সঙ্গে জীবন যাপন করা? তোমার নাতি-নাতনিদের মাঝেই একজন অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছে।

যাতায়াতের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ কোনো কোনো স্থানে কিছুটা শিথিল করা হচ্ছে, আর একটু একটু করে পৃথিবী চেষ্টা করছে স্বাভাবিক অবস্থার দিকে ফিরে যেতে। আসন্ন স্বাধীনতার ব্যাপারে দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতে অনেকেই ভুলতে বসেছে সম্প্রতি তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আমাদের গভীর, ব্যক্তিগত সত্তা এবং জনগোষ্ঠীর উপর এই মহামারির কী প্রভাব, সেটা বিশ্লেষণ করার যে তাড়না, সেটাও ফিকে হয়ে আসছে। এমনকি যারা জানতে আগ্রহী ছিল যে প্রকৃতপক্ষে কী হয়েছে, তারাও এখন তাদের নিজ নিজ ইচ্ছামতো ঘটনাটির ব্যাখা দাঁড়া করতে প্রলুব্ধ হচ্ছে। এর মধ্যেই আমাদের প্রিয় নেশা কেনাকাটা করা, তা সগৌরব প্রত্যাবর্তনের হুমকি দিচ্ছে। আমি এখনো ধোঁয়াশার মাঝে রয়েছি। আপাতত মনে হচ্ছে যে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রভুদের মুখাপেক্ষী হয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া অনুভূতিগুলোকে পরিপাক করার জন্য। আমি সেই দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। একটি গান, একটি কবিতা, একটি সিনেমা কিংবা একটি উপন্যাস আমাকে সেই চিন্তাধারার দিকে ধাবিত করবে, যেখানে তলিয়ে আছে এই সম্পূর্ণ ঘটনাটি নিয়ে আমার নিজস্ব চিন্তা ও অনুভূতিগুলো। আমি নিশ্চিত যে সেখানে পৌঁছাতে পারলে আমার নিজেরও কিছুটা খোঁড়াখুঁড়ি করা লাগবে। এর মাঝে, আমাদের গ্রহ ঘুরতে থাকবে তার নিজস্ব গতিতে আর জীবনের রহস্যগুলোও টিকে থাকবে শক্তিশালী ও বিস্ময়করভাবে। অথবা অত্যধিক বিশেষণের বদলে কাব্যের মাধ্যমে, তোমার ভাষায় বলতে গেলে, জীবনকে কেউ কিছু শেখাতে পারে না।
রোদ্রিগো
[রোদ্রিগো গার্সিয়া, একজন চিত্রনির্মাতা।
শিগগিরই মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকা ছবি 'ফোর গুড ডেইজ'-এর সহপরিচালক রোদ্রিগো গার্সিয়া। তাঁর সঙ্গে আছেন গ্লেন ক্লোজ এবং মিলা কুনিস।]