রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ - ত্রিরত্নের মিল-অমিল

একজন বিশ্বকবি—'মানুষের হৃদয়ের প্রীতির মতন বিভা', বিশ্ব মানবতার কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ; আরেকজন তুখোড় জাতীয়তাবাদী, বিপ্লবী, বিদ্রোহী, আবার একই সঙ্গে দারুণ প্রেমিক—'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণ-তূর্য'; শেষের জন ওই অর্থে ঠিক জাতীয়তাবাদী নন, কিন্তু হৃদয়জুড়ে বাংলার রূপরসপ্রকৃতি, বাংলায় এতটাই মগ্ন যে এর রূপ দেখেছেন বলে আর পৃথিবীর রূপ খোঁজার প্রয়োজন বোধ করেন না। এমনকি মৃত্যুর পরও ফিরে আসতে চান এই বাংলায়। এই তিনজনই বেঁচে ছিলেন অভিন্ন সময়ে। প্রথম জন বয়ঃজ্যেষ্ঠ। অভিভাবক। পরের দুজন সমবয়সী।

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ও জীবনানন্দের মধ্যে মিল-অমিলের জায়গাগুলো বড় অদ্ভুত। নজরুল ও জীবনানন্দের জন্ম একই বছরে, ১৮৯৯ সালে। নজরুলের (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) চেয়ে জীবনানন্দ (৬ ফাল্গুন ১৩০৫ বঙ্গাব্দ) প্রায় তিন মাসের বড়। নজরুলের জন্ম ওপার বাংলায়, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায়, অথচ পরবর্তীকালে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং এই বাংলার মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত। পক্ষান্তরে জীবনানন্দের জন্ম এপার বাংলায়, তৎকালীন পূর্ব বাংলার বরিশাল শহরে, অথচ জীবনের শেষ ৮ বছর পাকাপাকিভাবে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বাসিন্দা এবং সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ। সেখানের কেওড়াতলা শ্মশানে ভস্ম হয় তাঁর মৃতদেহ। নিদেনপক্ষে একটি সমাধিফলকও সেখানে নেই।

রবীন্দ্রনাথের (জন্ম ১৮৬১) সঙ্গে অন্য দুজনের বয়সের ব্যবধান ৩৮ বছর। আর যে বছর (১৯৪১) রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তার পরের বছরই নজরুল চিরদিনের মতো অসুস্থ/বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন—যে অসুস্থতা তাঁকে বইতে হয়েছে আরও ৩৪ বছর। অর্থাৎ জীবনের শেষ ৩৪ বছরে তাঁর কোনো সৃষ্টি নেই। এই সময়টুকু লেখালেখি করতে পারলে তিনি বাংলা সাহিত্য ও সংগীতকে যে আরও সমৃদ্ধ করতেন, তাতে সন্দেহ নেই। আর রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু এবং নজরুলের এই অসুস্থ হওয়ার সময়ে জীবনানন্দ বাংলার সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে এক নিস্তরঙ্গ অধ্যাপনায় নিযুক্ত নিজের শহরে, বরিশালে।

রবীন্দ্রনাথ বেঁচেছিলেন ৮০ বছর। অর্থাৎ জীবনের পূর্ণতা তিনি লাভ করেছেন। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত লিখেছেন। কিন্তু নজরুল ৭৭ বছর বেঁচে থাকলেও জীবনের শেষ ৩৪ বছর নিষ্প্রাণ। ফলে এই দীর্ঘায়ু তাঁর জীবনকে পূর্ণ করেনি। বরং যন্ত্রণা প্রলম্বিত করেছে। এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে কম আয়ু জীবনানন্দের। মারা গেছেন ৫৫ বছর বয়সে। তিনিও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লিখেছেন। ওই অর্থে খুব বেশি আয়ু না পেলেও ৫৫ বছরের জীবনে তাঁর যে সৃষ্টিসম্ভার, তা বিশাল। বস্তুত এর বড় অংশই আবিষ্কৃত এবং প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর।

রবীন্দ্রনাথ জমিদার পরিবারের সন্তানহেতু জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। মৃত্যু-অবধি কোনো দিন অর্থকষ্টে ভোগেননি। কিন্তু বাকি দুজন সারা জীবনই দারিদ্র্যের সাথে লড়েছেন। এর মধ্যে নজরুল দারিদ্র্যকে 'মহান' হওয়ার উপায় বলে আত্মতুষ্টি খোঁজার চেষ্টা করলেও জীবনানন্দের কাছে তা ছিল খেদের কারণ—'মানুষের হাতে তবু মানুষ হতেছে নাজেহাল;/ পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।' বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে অধ্যাপনার ১১ বছর এবং জীবনের শেষ দেড় বছর কলকাতার হাওড়া গার্লস কলেজের সময়টুকু বাদ দিলে জীবনের বাকি সময়টুকু অর্থকষ্টে কাটিয়েছেন এই 'বাকলা চন্দ্রদ্বীপপুত্র'। পেশায় অধ্যাপক। কিন্তু বারবারই চাকরিচ্যুত। ফলে দুটি চাকরির মাঝখানে জীবন-জীবিকার অসহনীয় টানাপড়েন।

নজরুল যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন, তারও মূলে ছিল দারিদ্র্য। ১৯৩৯ সালে তাঁর স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হন। স্ত্রীর চিকিৎসা, নিজের আর্থিক টানাপড়েন, দেনায় জর্জরিত—সব মিলিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এ অবস্থায় পয়সা রোজগারের জন্য দিনরাত লেখালেখি। ধারণা করা হয়, মস্তিষ্ক এত চাপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়। এখানে জীবনানন্দের সঙ্গে নজরুলের একটা অদ্ভুত মিল এই যে জীবনানন্দকেও জীবনের শেষ বছরগুলো নিজের ভগ্ন স্বাস্থ্যের পাশাপাশি স্ত্রীর অসুস্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হয়েছে। কলকাতা থেকে বেশ দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর কলেজে যখন (০২ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১) পড়াচ্ছিলেন, তখন স্ত্রী লাবণ্যের হাঁপানির অসুখ বেড়ে যায় এবং ছুটিতে কলকাতায় এসে একদিকে নিজের অসুস্থতা, অন্যদিকে অসুস্থ স্ত্রীর পাশে থাকা—সব মিলিয়ে আর খড়্গপুরে ফেরা হয়নি। অবশেষে চাকরিটা চলে যায়। নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা যেমন পক্ষাঘাতে ভুগে ভুগেই ১৯৬২ সালে মৃত্যুবরণ করেন, তেমনি ১৯৭৪ সালে হাঁপানিতেই মৃত্যু হয় লাবণ্যের। প্রমীলার যখন মৃত্যু হয়, নজরুল তখন জীবিত, কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ, বাকরুদ্ধ। হয়তো বুঝতেই পারেননি, প্রিয়তমা স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে গেছেন। আর লাবণ্যের মৃত্যু হয় জীবনানন্দের মৃত্যুর ২০ বছর পরে।

যদিও এই তিনজনের বিবাহ বা সংসারজীবন ছিল একেবারেই আলাদা ধরনের। নজরুল প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন—তা-ও ভিন্ন ধর্মে। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ বিয়ে করেন পারিবারিক পছন্দে। স্ত্রীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল। এখানে ব্যতিক্রম জীবনানন্দ। তাঁদের সংসারজীবন যে ওই অর্থে সুখের ছিল না, তা জীবনানন্দের গল্প-উপন্যাসের পরতে পরতে টের পাওয়া যায়। তাঁর বন্ধু ও সুহৃদরাও এ কথা জানতেন। যদিও অসুস্থ স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব পালনে তিনি কোনো কার্পণ্য করেননি।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু ছাত্রজীবন এবং কর্মজীবনের একটা বড় সময় কলকাতায় বসবাসের পরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জীবনানন্দের দেখা হয়নি। বস্তুত জীবনানন্দই দেখা করেননি। এর কারণ হিসেবে তিনি ১৯৩৭ সালের ৫ মার্চ রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠিতে লিখেছেন: 'অনেকবার দেখেছি আপনাকে। তারপর ভিড়ের ভিতরে হারিয়ে গেছি। আমার নিজের জীবনের তুচ্ছতা ও আপনার বিরাট প্রদীপ্তি সব সময়ই মাঝখানে কেমন একটা ব্যবধান রেখে গেছে—আমি তা লঙ্ঘন করতে পারিনি।' রবীন্দ্রনাথের এই 'বিরাট প্রদীপ্তি'র কারণে তাঁকে 'অহেতুক উৎপাত' না করার কথা নজরুলও স্বীকার করেছেন। ১৯৩৫ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখছেন: 'আপনার তপস্যায় আমি কখনো উৎপাত করেছি বলে মনে পড়ে না, তাই অবকাশ সত্ত্বেও আমি আপনার দূরে দূরেই থেকেছি। তবু জানি আমার শ্রদ্ধার শতদল আপনার চরণস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি।'

দেখা যাচ্ছে, সমসাময়িক অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুল ও জীবনানন্দ—উভয়েরই ছিল নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তি। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সংবাদে নজরুল শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। শারীরিক অসুস্থতা নিয়েই তিনি পরপর তিনটি কবিতা লেখেন। একটিতে বলেন, 'দুপুরের রবি ঢলে পড়েছে অস্তপারের কোলে।' আরকেটিতে বলেন, 'ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত কবিরে জাগায়ো না জাগায়ো না/ সারা জীবন যে আলো দিল ডেকে তার ঘুম ভাঙায়ো না।' আর 'রবীন্দ্রনাথ' শিরোনামেই জীবনানন্দ কবিতা লিখেছিলেন ৬টি, যার মধ্যে পাঁচটিই প্রকাশিত হয়। একটি ছিল খসড়া পর্যায়ে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি একাধিক প্রবন্ধ লেখেন এবং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে শোকমিছিল বের করেছিলেন, জীবনানন্দ সেই মিছিলেও অংশ নেন।

বড় পরিসরে জীবনানন্দের কাব্যপ্রতিভার প্রথম স্বীকৃতি আসে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ঝরাপালক' পড়ার পর রবীন্দ্রনাথ যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, সেটি কিছুটা রূঢ় হলেও দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় 'তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে' বলে মন্তব্য করেন, যে মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে অনেকে জীবনানন্দের কবিতাকে 'চিত্ররূপময়' বলে উল্লেখ করেন। নজরুলের স্বীকৃতিও কবিগুরুর কাছ থেকে। নজরুলকে তিনি তাঁর 'বসন্ত' নামের গীতিনাট্যটি উৎসর্গ করেন।

সংগীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের। বাংলা গানকে এ দুজনই অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। জীবনানন্দও কিছু গান লিখেছিলেন। কিন্তু সেগুলো তাঁর জীবদ্দশায় এমনকি এখন পর্যন্ত সুরারোপিত হয়ে গীত হয়নি। বরং কয়েকটা কবিতায় সুরারোপ করে গাওয়া হয়েছে, যেমন 'আবার আসিব ফিরে', 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি', 'হায় চিল' ইত্যাদি। আবার রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি বিশেষ মুগ্ধতা ছিল নজরুল-জীবনানন্দ উভয়েরই।

নজরুলের সঙ্গে জীবনানন্দের দেখা হলেও তাঁদের মধ্যে সেভাবে যোগাযোগ ছিল না। 'কালি-কলম'-এর অফিসে নজরুলকে দেখার কথা জানিয়েছেন জীবনানন্দ। ট্র্যাজেডি হলো, এই নজরুলের কবিতার সমালোচনা করেই 'স্বরাজ' পত্রিকার চাকরিটা হারান জীবনানন্দ। সেটা দেশভাগের বছর, ১৯৪৭ সালে। কিন্তু নজরুল যেহেতু তখন অসুস্থ, বাক্রুদ্ধ, ফলে জীবনানন্দের এই ট্র্যাজেডি তাঁর অজ্ঞাতই থাকে। নজরুলের কবিতা সম্পর্কে জীবনানন্দ একাধিক প্রবন্ধ লিখলেও জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে নজরুলের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন। মৃত্যুর পরও তাঁদের দাফন ও শেষকৃত্যে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়েছে। সেখানে জীবনানন্দ জীবদ্দশায় সেভাবে খ্যাতি পাননি। যখন তাঁর কাব্যের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু হচ্ছিল, তখনই তাঁর মৃত্যু হয়। সেই মৃত্যুটিও ছিল তাঁর নিজের জীবনের মতোই নিস্তরঙ্গ। হাজার হাজার মানুষ নয়, বড়জোর শ-দেড়েক মানুষ কলকাতা শহরের রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটতে হাঁটতে কেওড়াতলা শ্মশানে গিয়ে তাঁকে দাহ করেন। সেখানে জীবনানন্দকে খুঁজেও পাওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সমাধি এখনো তাঁদের ভক্তদের দেখার বিষয়। কিন্তু শ্মশানে জীবনানন্দের কোনো সমাধিফলকও নেই। তাঁর শরীরের ছাইভস্ম বিলীন হয়ে গেছে বাংলার রূপরসপ্রকৃতিতে। হয়তো 'শঙ্খচিল-শালিখের বেশে' তিনি এখনো ফিরে আসেন এই বাংলায়; কার্তিকের নবান্নের দেশে।