এক শিল্পীর নায়কোচিত রূপান্তর

রশীদ করীম, তাঁর স্ত্রী সালিমা মুরশেদ, কন্যা নাবিলা এবং নাবিলা-কন্যা তিশনা
রশীদ করীম, তাঁর স্ত্রী সালিমা মুরশেদ, কন্যা নাবিলা এবং নাবিলা-কন্যা তিশনা

বাংলাদেশের প্রধানতম ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের জন্য ১৯৯৩ সালের ২০ নভেম্বরের রাত ছিল নানা মাত্রায় কাফকাময় এক রাত। তার আকস্মিক এই রূপান্তরকে শুধু এক শব্দে স্পষ্টভাবে বুঝতে চাইলে বলতে হবে ভৌতিক। মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণজনিত রোগ স্ট্রোকের দরুন তিনি দ্রুত অসুস্থ হয়ে খাঁচাবন্দী পাখির জীবনের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, অতঃপর আটকা পড়ে গেলেন আংশিক সক্ষমতার মতো দুঃস্বপ্নের নিয়তিতে। প্রথমদিকে সে জীবন ছিল ভীতি, ব্যথা ও তীব্র বিরক্তিতে ভরা মারাত্মক শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয়ের এক জীবন। সে যেন আসন্ন মৃত্যুর কাছে সমর্পণ, যেন গ্রহণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আগেই মৃত্যু বরণ করে নেওয়ার অভিপ্রায়ে বিদীর্ণ চিৎকারে ক্রন্দন করতে থাকা। এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি তাঁর প্রাণোচ্ছলতা বজায় রেখেছিলেন। সাহসের সঙ্গে তিনি জীবনের শেষ অব্দি গিয়েছিলেন এবং এটাই তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অকৃত্রিম নায়ক হিসেবে প্রতিভাত করেছিল।

এই স্ট্রোক করীমের জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি নির্দয়ভাবে কেড়ে নিয়েছিল। শব্দের ওপর তাঁর দখল ও স্পর্শানুভূতির মতো দারুণ ক্ষমতা নিংড়ে ধ্বংস করে দিয়েছিল, স্তব্ধ করে দিয়েছিল তাঁর ভাষাপ্রীতি। তাঁকে বয়ে বেড়াতে হয়েছিল প্রিয়, আপন ও অন্তস্তলের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশের অক্ষমতার তীব্র যন্ত্রণা। এক হস্তবিশিষ্ট মানুষে পরিণত হয়েছিলেন তিনি, আংশিক অন্ধত্ব ও কাল্পনিক একটা পায়ের যন্ত্রণা বরণ করেছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীল হাতখানির নির্জীব হয়ে যাওয়া দেখাটা রীতিমতো কঠিন ছিল, অনেকটা কোনো বৃক্ষ তার মৃত অঙ্গসমেত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো। তাঁর আঙুলগুলো সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল, উপলব্ধিহীন হয়ে পড়েছিল, এমনকি কলমও ধরতে পারতেন না। তাঁর চিন্তাগুলো হয়ে পড়েছিল খণ্ডিত খণ্ডিত ও অসংলগ্ন। তাঁর চোখ ব্যথা করত, যখন তিনি কিছু পড়তে চাইতেন। কোনো লাইনের অর্ধেক দেখতে পেতেন শুধু। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তিনি লিখেছিলেন তাঁর আত্মজীবনী, কিছু কবিতা ও প্রতিক্রিয়া এবং দিয়েছিলেন কিছু সাক্ষাৎকার। যদিও তিনি শিল্পীসুলভ সৃষ্টির একগুঁয়ে তাড়না তখনো হারিয়ে ফেলেননি, তা-ও শ্রুতিলেখক দ্বারা তিনটি আইডিয়াভিত্তিক উপন্যাস লেখাতে রাজি হননি। তাঁর স্ত্রী এ ব্যাপারে বলেছিলেন যে কলম ধরে নিজ হাতে লেখার মধ্যে একটা বিশেষ অনুভূতি কাজ করে।

প্রিয় দুই বন্ধু শামসুর রাহমান, রশীদ করীম এবং পরিবারের সদস্যরা
প্রিয় দুই বন্ধু শামসুর রাহমান, রশীদ করীম এবং পরিবারের সদস্যরা

এমন বিধ্বংসী পরিস্থিতির পর তাঁর পরিবার যেন অপেক্ষা করছিল স্যামুয়েল বেকেটের গডোর জন্য, যার আবির্ভাব হবে অন্তিম ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য। করীম পূর্বের মতো চেনাজানা জীবনে আবার ফিরে আসবেন—এই ভ্রম আশার মধ্যেই বসবাস শুরু করেছিল তাঁর পরিবার। শারীরিক যেসব থেরাপি ছিল, তা মেনে চলতে তারা করীমকে অনুপ্রাণিত করতেন, বারবার বলতেন এবং বাধ্যও করতেন, যাতে করে তিনি পুনরায় নিজেকে তাঁর লেখার জগতে নিমগ্ন করতে পারেন, যেন সাহিত্যের ডেরায় আসা-যাওয়া করতে পারেন, আগের মত সংগীত সংগ্রহ করতে পারেন এবং বন্ধু-পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। তিনি খুব স্নেহের সঙ্গে, খানিক বিরক্তির সঙ্গে ও নিঃসঙ্গচিত্তে তাঁর পরিবারকে এই বলে সান্ত্বনা দিতেন, ‘আমি তো চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছু হচ্ছে না।’ মাঝেমধ্যে তিনি অবিচলিত নয়নে জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোমরা কি চাও আমি বেঁচে থাকি?’ এই বলে তিনি ধন্যবাদের সুরে বেশ একটা যাচাই করার ভঙ্গিতে বলতেন, ‘ঠিক আছে, আমাকে চেষ্টা করতে দাও।’

অনেক প্রত্যাশা ও প্রত্যয় নিয়ে করীম তাঁর অপরিবর্তনীয় বিপর্যস্ত জীবন পুনর্নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। নিজেকে কঠোর শৃঙ্খলিত রুটিনে অভ্যস্ত করে নিলেন—অনেক আগে শুয়ে পড়ে উঠতেন দেরিতে, সময়মতো খাবার খেতেন, ইনসুলিন বাহকের জন্য অপেক্ষা করতেন দিনে তিনবার, দিনে একবার তাঁর মেয়ের ফোনের অপেক্ষা করতেন এবং দিন শেষে তাঁর স্ত্রীর অবসরের অপেক্ষায় থাকতেন। যখন তাঁর মেয়ে ফোন করত, তখন কিছু প্রশ্ন তিনি প্রস্তুত করে রাখতেন, সঙ্গে যোগ করতেন রসিকতা, ‘আজকে সকালে কী খাচ্ছ নাস্তায়? আমার জন্য কিছু পাঠিয়ে দাও!’ গোসল আর দাড়ি কামানোকে দিনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ গণ্য করে সেসব নিয়ে আনন্দভরে কথা বলতেন তিনি।

দুই ভাই; বাংলা কথাসাহিত্যের দুই দিকপাল- আবু রুশদ এবং রশীদ করীম
দুই ভাই; বাংলা কথাসাহিত্যের দুই দিকপাল- আবু রুশদ এবং রশীদ করীম

বয়স ও ক্রমাগত আরও অসুস্থতা পূর্ণ জীবনের বৃত্তের বাইরে ছিটকে ফেলছিল তাঁকে। নিজেকে বন্দী করে নিয়েছিলেন ভাড়া করা দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে। জেগে থাকার অধিকাংশ সময় কাটাতেন শয়নকক্ষে, ডেস্কে বসে, তাকিয়ে থাকতেন বই ও সংবাদপত্রের ক্লিপিংয়ে ও পারিবারিক ছবির দিকে। কখনো কখনো বন্ধুকে ফোন করতেন সকালে। তাঁরা ফোনের ওপাশে কোকিলের ডাক শুনতে পেতেন, তখন তিনি আয়েশ করে গরম চায়ের সঙ্গে ডালপুরিতে মজে থাকতেন। দুপুরের খাবারের পর গুনে গুনে ত্রিশ কদম হাঁটতেন বৈঠকি রুমে অথবা সোফায় সটান বসে ছোট একটা ঘুম দিতেন অথবা স্ত্রীকে ভাল একটা রবীন্দ্রসংগীত খুঁজে দিতে বলতেন। বিকেলের পর থেকে তাঁর ক্লান্তি ভর করত। সন্ধ্যায় রাতের খাবারের জন্য ডেস্কে গিয়ে বসতেন। এরপর দীর্ঘক্ষণের নিত্য-আচারে ফিরে যেতেন; সবাইকে শুভ রাত্রি জানিয়ে বিছানায় সারা শরীরে তোশক জুড়ে দিয়ে তাতে কোকুনের মত আঁকাআঁকি করতেন। নিয়ন্ত্রিত এই জীবনের অগোচরে নিজের সঙ্গে নিজের নিঃসঙ্গ সংলাপ, অস্তিত্ববিষয়ক চিন্তাসমূহ ও কৃতজ্ঞতার পরশ তাঁকে ছুঁয়ে যেত। ‘এলেবেলে চিন্তা’ কবিতায় করীম সঙ্গলাভের আকুতি বর্ণনা করেছেন। বলেছেন প্রিয় মানুষের শূন্যতা নিয়ে; রাস্তায় ম্রিয়মাণ সংলাপ, কল্পিত পথিকের হঠাৎ চাহনি যেন একাকী হৃদয় তৃপ্ত করার নিমিত্তে ঢের ভাল কিছু। এরপর তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যখন প্রত্যাশিত কেউ আসে, ‘একাকী মানুষের মন ও শরীর হতবিহ্বল হয়ে যায়/ এরপরে কুকুরের ঘেউ-ঘেউ/ মৃত রাতের আঁধারে/ প্রিয়তম হতে থাকে/ কোনো অজানা কারণে।’ কিন্তু চলন্ত গাড়ির কর্কশ ধ্বনি বিরক্তি রচনা করেই যায় এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের অনুপস্থিতিতে অদূরে ক্রমাগত ভেসে ওঠে আবিষ্কারের নেশা।

সম্পন্ন পারিবারিক প্রতিমা; রশীদ করীম, তাঁর স্ত্রী সালিমা মুরশেদ এবং ছোট্ট নাবিলা
সম্পন্ন পারিবারিক প্রতিমা; রশীদ করীম, তাঁর স্ত্রী সালিমা মুরশেদ এবং ছোট্ট নাবিলা

শ্রেষ্ঠ আইরিশ লেখক জেমস জয়েস ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসে করীমের জীবনকে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরতে পারতেন, যেভাবে তিনি এঁকেছেন ‘নিত্য জীবনের মহিমা’ ও উদ্‌যাপন করেছেন ‘যা সকল রূঢ় ও সত্য’কে। ২৬ নভেম্বর ২০১১ সালে করীমের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যদি জয়েস প্রশস্তি উচ্চারণ করতেন, তবে তা নিঃসন্দেহে এমন হতে পারত, ‘শাবাস! তুমি জীবনের উঁচু-নিচু সকল স্তর নিজের মতো করে পার করে গেছ। তুমি স্ট্রোকের মতো কঠিন ব্যাধির বিপর্যস্ততা সামলেছ বীরত্বের সঙ্গে। তুমি ভালবাসা ও ঘৃণা দুই-ই করেছ মনে-প্রাণে, প্রচণ্ডভাবে। তুমি দিয়েছ অনুপ্রেরণা ও করেছ ক্ষমা, স্বপ্ন দেখেছ, কান্না করেছ, হেসেছ, সরে এসেছ। তুমি সৃষ্টি করেছ। রক্ষা করেছ। তুমি হয়েছ দেশান্তরী। করেছ ভ্রমণ। শিখেছ ভাষা। তুমি খেয়েছ স্টেক ও বিরানি, চা, হুইস্কি, জিন, বিয়ার—সব পান করেছ, প্রাতঃকর্ম সেরেছ, গান গেয়েছ, কথা বলেছ, নিজের জন্য এবং অন্যের জন্য দুঃখ বোধ করেছ, মানুষের দিকে তাকিয়েছ, মানুষের জন্য অপেক্ষা করেছ, সদাই করেছ, সতর্ক দৃষ্টি দিয়েছ স্টাইলের প্রতি...এসব কিন্তু ছোটখাটো ব্যাপার নয়, বরং “সুন্দর, গুরুতর, গভীর, চিত্তাকর্ষক” ও সাহসী। তুমি তোমার এই নশ্বর ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনকে নিয়ে সমীহ করতে পারো। নিজেকে নায়কোচিত আসনে বসাতে পারো, যে সকল প্রতিকূলতাকে সামলেছে মর্যাদার সঙ্গে এবং জীবনের স্পৃহাকে বিলিয়ে দিয়ে নয়।’

লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন: ইলিয়াছ কামাল রিসাত