এলিয়েনের অগ্নিপরীক্ষা: সেলার্সের সঙ্গে প্যারিস ও হলিউডে

সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায়
কিংবদন্তি বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের অসমাপ্ত চলচ্চিত্র 'দ্য এলিয়েন'।বিজ্ঞান কল্পকাহিনিনির্ভর এই ছবিটি হলিউডে নির্মাণের সম্ভবনা তৈরি হয়েছিল। বিখ্যাত অভিনেতা পিটার সেলার্স এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন। এরপর জল অনেক দূর গড়ালেও ছবিটি শেষ অব্দি আর হয়নি। কেন হয়নি? এ লেখায় নিজের কলমে সে কথা লিখেছেন সত্যজিৎ রায়

'সেলার্স প্যারিসে আছেন,' ফোনটা রেখে মাইক উইলসন বলেন। 'ওরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে তিনি আগ্রহী কি না জেনে নেবে।'

'ওরা' পিটার সেলার্সের লন্ডন এজেন্ট। 'দ্য এলিয়েন' নামে আমার পরিকল্পিত কল্পবৈজ্ঞানিক ছবিটাতে এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য আমি ওই ব্রিটিশ অভিনেতাকে প্রস্তাব দেওয়ার কথা ভাবছিলাম জানার মিনিট কয়েকের মধ্যে মাইক তাদেরকে আমার কলকাতার লেক টেম্পল রোডের বাড়ি থেকে ফোন করে। হলিউডি মানে যদিও এটা কোনোভাবেই ব্লকবাস্টার নয়, তবু ছবিটার শুধু স্পেশাল ইফেক্টগুলোর বাজেটই ভারতীয় মানে বিশাল। টাকাটা হলিউড থেকে আসতে হলে তারকা-তালিকায় একটি কি দুটি বড় নাম থাকলে ভালো, আর সেলার্স নিঃসন্দেহে সেই কাতারে পড়েন। অধিকন্তু, তিনি বিচিত্রবিহারী সু-অভিনেতা, এবং ইতিমধ্যে হলিউডের ছবি 'দ্য মিলিয়নিয়ারেস'-এ এক ভারতীয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। তাঁর যদি শুধু একধরনের ভারতীয় উচ্চারণ—অস্পষ্ট দক্ষিণ ভারতীয়—জানা থাকত, তাহলে আমি নিশ্চিত 'দ্য এলিয়েন'-এ অভিনয় করতে রাজি হলে ভাঁড়ারে নতুন ও চোস্ত আরেকটা উচ্চারণ যোগ করার উদ্যোগ নিতে তিনি দ্বিধা করতেন না। তাঁর যে দুটো দীর্ঘবাদন আমার কাছে ছিল, তাতে কণ্ঠ ও জিব দিয়ে তিনি যে এমন সব জিনিস করতে পারতেন, যা প্রায় অলৌকিকের কাছাকাছি, এর প্রমাণ ছিল।

সম্ভাবনাময়
বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার ক্লার্কের প্রত্যয়ন নিয়ে আসে মাইক উইলসন। এর আগের বছর লন্ডনে ক্লার্কের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল এবং আমার মাথায় সাই-ফাই ছবির যে-ভাবনাবীজটা ছিল, তাঁর কাছে তা ব্যাখ্যা করেছিলাম। সেটাকে সম্ভাবনাময় বলে মনে হয়েছিল ক্লার্কের। কলম্বোর বাড়িতে ফিরে এ ব্যাপারে তিনি মাইক উইলসনের সঙ্গে কথা বলেন। সিংহলি খ্রিষ্টান এক নজরকাড়া সুন্দরীকে বিয়ে করে মাইকও আবাস গড়েছিল কলম্বোতে। কনুইয়ের গুঁতোয় সে জায়গা করে নিয়েছিল চলচ্চিত্র ব্যবসাতেও; ফ্লেমিং সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টকে সানন্দে শ্রীলঙ্কার রুপালি পর্দায় পুঁতে রচনা, প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছিল জেইমস বান্ডা এবং ছবিটিতে টুকরো-টাকরা খল চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সে জড়ো করেছিল কলম্বোবাসী ইউরোপীয় সমাজের সবাইকে। সর্বোপরি, মাইক ছিল সুদক্ষ পেশাদার ডুবুরি, যে শ্রীলঙ্কার উপকূলে ১৭ শতকী এক মোগল যুদ্ধজাহাজের গায়ে হোঁচট খেয়ে ওই ধ্বংসস্তূপ থেকে একবাক্স রৌপ্যমুদ্রা উদ্ধার করে কিংবদন্তি বনে গিয়েছিল। এ রকম একজন মানুষ যখন চিঠি লিখে জানায় যে আপনার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার চুক্তিতে যেতে দক্ষিণহস্ত প্রসারণে সে প্রস্তুত, তখন স্বভাবতই তার কথার ওপর আপনি আস্থা রাখতে চাইবেন।

কিন্তু উইলসন মশাইয়ের কাছে চিঠি লিখে জানাতে হলো যে কয়েকটা আঁকিবুকি ছাড়া আমার খাতায় কিছুই ছিল না। বিন্দুমাত্র না দমে সে কলকাতায় উড়ে এল, সদর স্ট্রিটের এক হোটেলে উঠল এবং ঘোষণা করল যে আমি কিছু একটা দাঁড় না করানো পর্যন্ত সে আমার সঙ্গে সেঁটে থাকবে। ভাবলাম, লেখার কাজটা আমার কাছে অত্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে চিত্রনাট্য নিয়ে কাজ করার সময় আমি যে মনুষ্যসঙ্গকে নিরুৎসাহিত করি, তা তাঁকে জানিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। সে-কথা আমলে নিল না মাইক, 'আমি আপনার পাশে বসে থাকব আর যখনই দরকার হবে আপনাকে কফি বানিয়ে দেব, ওস্তাদজি।'

মাইক কফি বানায়নি, কিন্তু পাশে বসে থাকার কাজটা করেছিল এবং আর্থার সি ক্লার্কের বন্ধু হওয়ার সুবাদে ক্রমাগত উপদেশ ছুড়ে দিতে থাকে, যেগুলো আমার খাতার পাতা ঘেঁষে পিছলে পড়ে যায়। পক্ষকালান্তে আমার লেখা শেষ হয়।

এর মধ্যে খবর এল, সেলার্স আগ্রহী।

মাইক ও আমি প্যারিসে গেলাম ১৯৬৭ সালের এপ্রিলে, সেলার্সের সঙ্গে তাঁর হোটেলে দেখা করলাম। মাইক মুখ খুলতেই সেলার্স জিজ্ঞেস করলেন, 'নিউজিল্যান্ড?' মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিল মাইক। যথার্থই চমৎকৃত হলাম আমি। হোটেলের বিশাল খাওয়ার ঘরে বসে আমরা কথাবার্তা সারলাম। সেলার্স ফরাসি জানতেন না কিন্তু 'ফ্র্যাংলে' বলতেন, যা শুনে বেয়ারারা হেসে কুটিপাটি। ওরা আধডজন আমাদের টেবিল ঘিরে ছিল, কারও কারও হাতে অটোগ্রাফের খাতা। প্যারিসে খুব নাম করেছেন ইনস্পেক্টর ক্লুজো। এক ফাঁকে, সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'আমার কাজ সম্পর্কে কি আপনার কোনো ধারণা আছে?' সেলার্স বললেন, 'না, তবে জোনাথন মিলার তো আপনার নামে কসম খান, আর তাঁর মুখের কথাই আমার জন্য যথেষ্ট।' কিন্তু সেটা আমার জন্য যথেষ্ট নয়। সেলার্সের জন্য প্যারিসে আমার কোনো একটা ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখতে অনুরোধ করি মাইককে। সেলার্সের ঘর থেকে মাইক লন্ডনে ফোন করে, আর পরের দিন সকালে লন্ডন পরিবেশকের কাছ থেকে চারুলতার একটা কপি এসে পৌঁছায়। ছোট্ট একটা থিয়েটারে সেদিনই ওটা দেখাই আমরা। ছবি শেষ হয়ে বাতি জ্বলে উঠতেই সেলার্স রাঙা চোখে আমার দিকে তাকালেন আর বললেন, 'আমাকে কেন দরকার আপনার? জানেন তো, আপনার কুশীলবদের চাইতে আমি কোনো অংশে ভালো নই!' সেলার্স নিশ্চয়ই জানতেন, কেন তাঁকে দরকার আমাদের। তিনি নিছক সৌজন্য করছিলেন। যা-ই হোক, তিনি গল্পটা শুনলেন, বললেন ভূমিকাটা তাঁর পছন্দ হয়েছে, এবং মাইককে বললেন তাঁর এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। কিছুদিনের মধ্যেই মাইক আর আমার বিচ্ছেদ ঘটে। 'দ্য এলিয়েন' আর আমাকে বাড়িতে বসে তাঁর কাছ থেকে খবর আসার অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য করে জেইমস বান্ডার পরিণতি দেখার জন্য মাইককে শ্রীলঙ্কায় পাড়ি জমাতে হল।

হাস্যোদ্দীপক
মাইকের দিক থেকে পরবর্তী যোগাযোগটা ছিল এক মাস পরে হলিউড হতে। সেটা ছিল একটা উচ্ছ্বসিত ঝঙ্কারময় তারবার্তা: কলাম্বিয়া 'দ্য এলিয়েন'-এর খরচ জোগাবে; আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে; মার্কিন প্রকৌশলীর ভূমিকায় অভিনয় করতে ব্র্যান্ডো আর স্টিভ ম্যাক্কুইন দুজনই একপায়ে খাড়া; স্পেশাল ইফেক্টের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর যাবতীয় দায়দায়িত্ব সৌল ব্যাস নেবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সেলার্সও তখন হলিউডে, একটা কমেডি ছবিতে এক ভারতীয়ের ভূমিকায় অভিনয় করছেন, এবং আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার বসার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে আছেন।

উইলসন মশাইয়ের কাছে চিঠি লিখে জানাতে হলো যে কয়েকটা আঁকিবুকি ছাড়া আমার খাতায় কিছুই ছিল না। বিন্দুমাত্র না দমে সে কলকাতায় উড়ে এল, সদর স্ট্রিটের এক হোটেলে উঠল এবং ঘোষণা করল যে আমি কিছু একটা দাঁড় না করানো পর্যন্ত সে আমার সঙ্গে সেঁটে থাকবে।

যন্ত্রের গুঞ্জন কানে নিয়ে জুনের ১ তারিখে আমি হলিউডে পৌঁছালাম। ভাড়া করা একটা লিঙ্কন কনভার্টিবলে চড়িয়ে বিমানবন্দর থেকে আমাকে শহরে নিয়ে গেল মাইক এবং হোটেল মার্মন্টের সামনে সারবাঁধা কটেজগুলোর অন্যতম সর্বসুবিধাসংবলিত অভিজাত স্বয়ংসম্পূর্ণ দ্বিতল কটেজ শাতো মার্মন্টে নিজেকে দেখতে পাই, যে হোটেলে একদা মরিস শেভালিয়েরের একটি স্থায়ী স্যুইট ছিল বলে পরে জানতে পারি। আমি যে দুশ্চিন্তাটা গোপন করতে চেয়েও পারছিলাম না, সেটা ধরতে পেরে মাইক বলল, 'ও নিয়ে ভাববেন না, ওস্তাদজি। খরচপাতি যা হবে, তার কিছুটা কলাম্বিয়া অগ্রিম দিয়ে দিয়েছে। সর্বোৎকৃষ্টটি ছাড়া আর কিছু মানায় না আপনাকে; অপু ট্রিলজি আপনিই না বানিয়েছেন!'

সেলার্সের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতটা হল রবিশঙ্করের বাসায়। নতুন ওই কমেডি ছবির ভারতীয়ের ভূমিকার জন্য সেতারবাদনের ভঙ্গি অনুকরণ আবশ্যক হয়েছিল তাঁর, আর হাতের মুদ্রাগুলো ঠিকঠাকমতো করার ব্যাপারে সেলার্স অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন। রাতের আহারপর্বের পর বাজাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন রবি।

রবিশঙ্করের মহাপ্রতিভাধর সহশিল্পী আল্লারাখার উত্তর ভারতীয় সংগীতের কল্যাণে সাদামাটা বাঙালি খাবারগুলোই হয়ে উঠেছিল অসাধারণ নৈশভোজ। আহারোত্তর চমৎকার বাদনপর্বে সেলার্স কার্পেটের ওপর পা মুড়ে বসেন, আর শুনে শুনে রপ্ত করা ওয়াহ-ওয়াহ ধ্বনিতে সুবিবেচক সমঝদারি প্রকাশ করেন। ফেরার পথে জিজ্ঞেস করি, নতুন ছবিটাতে তিনি কী ধরনের ভারতীয়ের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন। 'ছবিটা নর্থ-ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ারের একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করার জন্য হলিউডে আসা এক লোককে নিয়ে, যে ভুলক্রমে একটা হলিউড পার্টিতে দাওয়াত পেয়ে যায়। ছবিটার নাম “দ্য পার্টি”।'

'ভারতীয় লোকটার নাম কী?' জানতাম ব্যানার্জি নামের প্রতি সেলার্সের পক্ষপাত ছিল।

'বকশি,' বলে নাকডাকা জলহস্তির মতো একটা শব্দ করলেন সেলার্স।
'ওইটা কী?'
'নামের প্রথম অংশ,' সেলার্স বললেন, 'এইচ-আর-ইউ-এন-ডি-আই, হ্রুন্ডি ভি. বকশি। আপনার অবশ্যই একবার শুটিংয়ে আসা উচিত। হাস্যরসাত্মক কাণ্ডকারখানা ঘটানোতে ব্লেইক একটা প্রতিভা বটে। সেদিন আমরা মজার একটা দৃশ্য করছিলাম, যেখানে বকশি বেচারা টয়লেট পেপারের স্তূপে আগামাথা জড়িয়ে যায়।'

আমি যথাসাধ্য ভাবলেশহীন থেকে তাঁকে জানালাম, অন্যান্য ছবিতে যেমনটা ছিল, 'দ্য এলিয়েন'-এ তাঁর ভূমিকা তেমনটা হবে না; এ ছবিতে তারকা-মর্যাদাটার ভাগ নেবে আরও তিন জন: বাঙালি সাংবাদিক নায়ক, মার্কিন প্রকৌশলী আর বহির্জগত থেকে আসা নির্বাক প্রাণীটা।

পিটার সেলার্স
পিটার সেলার্স

মজাদার
সেলার্স বললেন, কোনো অসুবিধে নেই। 'আর, একটা কথা বলি আপনাকে, ভারতীয় এক জ্যোতিষী লন্ডনে আমাকে বলেছিলেন যে শিগগির একজন ভারতীয় পরিচালকের সঙ্গে আমার কাজ পড়বে। ফলে এটা যতটা না আমার ইচ্ছা, তার চেয়ে বেশি কপাললিখন।' যে একটিমাত্র পিঙ্ক প্যানথার ছবি আমি দেখেছি, সেটার শক্তিমত্তার বিবেচনায় ব্লেইক অ্যাডওয়ার্ডসকে খুব বেশি রম্যরসজ্ঞ পরিচালক বলে আমার মনে হয়নি। সাত পর্বে ডি সিকার 'ওম্যান টাইমস সেভেন' ছবির দারুণ হাসির প্রথম পর্বের তুলনায় ইনস্পেক্টর ক্লুজোর ভূমিকায় সেলার্সকে আমার অনেক কম মজাদার বলে মনে হয়েছে। এই ছবিতে তাঁর অভিনয় আমার কতখানি ভালো লেগেছিল, তা বললাম তাঁকে।

'সত্যি?'
সেলার্সকে সন্দিহান মনে হলো। আমার মতকে নাকচ করে দিয়ে মাথা ঝাঁকালেন তিনি। 'ওই ডি সিকা বেটা,' গজগজিয়ে বললেন, 'সবকিছু নিজেই করে দেখাতে চায়। এরপর স্রেফ তাকে নকল করতে বলে। চরম বেজার হয়েছিলাম আমি।'

ব্লেইক এডওয়ার্ডসের অধীনে কাজ করে সেলার্স স্পষ্টতই খুব খুশি ছিলেন। যেদিন আমরা গেলাম, সেদিন তাঁরা ধারণ করছিলেন মুখ্য দৃশ্যটা—পার্টির দৃশ্য। দৃশ্যধারণের ফাঁকে ফাঁকে সেলার্স তাঁর সদ্য বিবাহিতা দ্বিতীয় স্ত্রী সুইডিশ-ব্রিটিশ অ্যাকলুন্ডকে সোহাগ করছিলেন। মাসকয়েক আগে সেলার্স হৃদাক্রমণের শিকার হয়েছিলেন, তাই তিনি যেন অতিরিক্ত খাটাখাটনি না করেন সেদিকে খেয়াল রাখছিলেন অ্যাকলুন্ড। ডজনখানেক হলিউডি চরিত্র একটা টেবিল ঘিরে বসে খাবার খেলেন। তাঁদের মধ্যে এক গৌরি অ্যামাজন আর হোলস্টারে পিস্তল নিয়ে এক কাউবয় ছিলেন। নিতান্ত বেমানান সেলার্স গৌরিটির পাশে এত খাটো একটা টুলে বসেছিলেন যে তাঁর থুতনি টেবিলক্লথে ঘষা খাচ্ছিল। দৃশ্যধারণের সময় আমি এত কাছে দাঁড়িয়েছিলাম যে 'বিগত ফেব্রুয়ারি মাসে উর্লিতে আমার যে বন্ধু ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা...' সংলাপ উচ্চারণরত হ্রুন্ডিকে গৌরিটির স্তনখাদের দিকে তাকানো অবস্থায় হাতেনাতে ধরতে পারি। পাউরুটির বদলে মাখনটা সে মাখাচ্ছিল এক ইঞ্চি দূরের নিজের আঙুলের ওপর।

আমি জানি পরিচালক, লেখক ও সাগরেদরা হাসিয়ালদেরকে দিয়ে মজার মজার জিনিস করাতে ও বলাতে চান বলেই তাদের বেশির ভাগকে পর্দায় মজারু দেখায়। এমনকি গ্রুচোও কখনো নিজের কোনো কথা বলেননি। কিন্তু কথাকে নিজস্ব শৈলীযোগে উপস্থাপন করার দক্ষতা তাঁর ছিল; আর পেরেলমানের মতো তাঁর সেরা লেখকেরা জানতেন কীভাবে তাঁর ভেতর থেকে সর্বোৎকৃষ্টটা বের করে আনতে হয়। কমেডি ছবির এটাই সর্বজনগ্রাহ্য রীতি আর এতে করে সত্যিকারের প্রতিভাবান অভিনেতার অর্জন খর্বিত হয় না। সংগীতশিল্পীর মতো কৌতুকাভিনেতার দক্ষতাও সৃষ্টিশীল আর সে দক্ষতার মাপকাঠিতেই লোকে তার যোগ্যতার বিচার করে। কিন্তু সেলার্সের মাপের একজন হাসিয়ালের এমন এক পরিচালকের খেয়ালখুশির কাছে আত্মসমর্পণ করা কোনোভাবেই ঠিক নয়, যিনি উদরহাস্য ছাড়া আর কিছুর কথা ভাবতেই পারেন না, যেগুলোর অধিকাংশই কিনা আবার পর্দায় আসবে না। সেলার্স কি খুব একটা তোয়াক্কা করেন না এসবের? নাকি তাঁর বিবেচনাবোধই ঊন? কয়েক বছর আগে কুবরিকের ডক্টর স্ট্রেইঞ্জলাভ ছবিতে তিন চরিত্রের সব কটিতেই অত্যন্ত চমৎকার অভিনয় করেছিলেন তিনি।

আমার হলিউডে থাকার সময়টাতে 'দ্য এলিয়েন'-এর জন্য সেলার্সের উৎসাহে অন্তত বাহ্যত কোনো ভাটা পড়েনি, যদিও প্রকল্পটি আর পাখা মেলতে পারেনি। কলাম্বিয়ার আগ্রহ ছিল নিখাদ, কিন্তু এই বিশেষ 'সম্পত্তি'টার দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণটি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, মাইক উইলসন কেন দরকার ছিল আমার? কে সে? ওর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলামই কীভাবে? নিজেকে বারবার একই প্রশ্নগুলোই করছিলাম। যে কটেজে সে থাকত আমি হলিউডে এসে সেখানে 'দপ্তর' লেখা ঘরটার টেবিলের ওপর আমার চিত্রনাট্যের অনুলিপির স্তূপ দেখতে পেয়েছিলাম। ওগুলোতে উৎকীর্ণ ছিল এই বিস্ময়কর টিপ্পনি: 'স্বত্ব: মাইক উইলসন ও সত্যজিৎ রায়'। মাইককে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, আমার স্বার্থরক্ষা দ্বিগুণ সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই এ ব্যবস্থা। 'এক মাথার চাইতে দুই মাথাই উত্তম, ওস্তাদজি।' মার্কিনিটার সংলাপে 'চিক'-এর বদলে 'ব্রড' ব্যবহার করতে পরামর্শ দেওয়া ছাড়া চিত্রনাট্যটিতে মাইকের আর কোনো অবদানের কথা আমি ভাবতে পারি না।

দ্য পার্টি
যেহেতু লস অ্যাঞ্জেলেসে কেউ হাঁটে না (হাঁটলে ভবঘুরেপনার দায়ে আটক হতে পারেন), তাই কটেজে বসে বসে এইসব অঘটনঘটন কোন দিকে যাচ্ছে, তা নিয়ে ভাববার মতো প্রচুর ফুরসত ছিল আমার। জেনিফার জোন্সের বিশালাকার বাসভবনে, যেখানে একদা গ্রেটা গার্বো আর জন গিলবার্ট থাকতেন, এক পার্টিতে গিয়ে পথ হারিয়ে ক্যারোলিয়ান ওয়ান্ডারল্যান্ডে সেঁধিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটাই তীব্রতর হয়। ওখানে চল্লিশের দশকের তারকা ও অভিনেতা ওলিভিয়া ডি হাভিলান্ড, রিতা হেওয়ার্থ, উইলিয়াম উয়াইলার, কিং ভিদর প্রমুখের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাঁদেরকে রক্তমাংসের মানুষ বলে কেউ বিশ্বাসই করতে চাইবে না। এত সবের ভেতরে মাইক হঠাৎ চোখের আড়াল হয়, পরমুহূর্তে পার্টিঘরের দূরতম প্রান্তের একটা দরজা গলে আবির্ভূত হয় এবং 'ওস্তাদ, জনের ঘরে জনের শিল্প দেখবেন, চলুন' ফিসফিসিয়ে এই বলে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। অতঃপর আমার দেখা সবচেয়ে বিশাল ও অভিজাত সেই স্নানঘরের দেয়ালে অগাস্টাস জনের কমপক্ষে ছয়টি চিত্রকর্ম নিশ্চিতই চোখে পড়ে আমার।

বছরাধিক কালের মধ্যে 'দ্য এলিয়েন'-এর ব্যাপারে কেউ কোনো যোগাযোগ করে না এবং আমার মনে হয় যে প্রকল্পটি অলভ্যের রাজ্যে অপসৃত হয়ে গেছে। এরপর অপ্রত্যাশিতভাবে ছোট্ট একটা খবর এল আর্থার ক্লার্কের কাছ থেকে। মাথা মুড়ে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলে ধ্যান করতে গেছে মাইক।

'দ্য এলিয়েন' যে মাঠে মারা গেছে, সে-ব্যাপারে সুনিশ্চিত হয়ে হলিউড ছাড়লাম আমি। সত্যি বলতে কি, তার প্রাণবায়ু বেরোতে যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি সময় লেগেছিল। কলকাতায় ফেরার অল্প কিছুদিন পরই সেলার্সের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। কবিতায় লেখা। হলিউডে সেলার্স জানতে চেয়েছিলেন আমি উইলিয়াম ম্যাকগঙ্গালের কবিতা সম্পর্কে জানি কি না। স্বীকার করতে হয়েছিল যে আমি জানতাম না। 'বলেন কী? সর্বকালের সেরা মন্দকাব্য রচয়িতাকে চেনেন না আপনি?' মনে হয়, গুন শো-র সময়টাতে ম্যাকগঙ্গালের কবিতা আবৃত্তি করে দর্শকশ্রোতাদের মনোরঞ্জন করেছিলেন সেলার্স। জন্মসূত্রে স্কটিশ এই 'কবি ও ট্রাজিডিয়ান'—এ বলেই নিজের পরিচয় দিতেন তিনি—১৯ শতকের শেষ পাদে খ্যাতি লাভ করেন, কাহিনিকাব্য লেখেন, এগুলোর প্রকাশক পান এবং তাঁর একটি অনুসারী গোষ্ঠীও গড়ে ওঠে। অনেক খুঁজে-পেতে এ কবির দু-দুটো বই জোগাড় করে নিজের পছন্দের পদগুলো দাগিয়ে আমাকে উপহার দেন সেলার্স। যারা ম্যাকগঙ্গালভক্ত নয়, তাদেরকে তিনি কী ধরনের কবিতা লিখতেন, সে-ব্যাপারে ধারণা দেওয়ার জন্য একটি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট হবে। 'টে সেতু দুর্বিপাক' (দ্য টে ব্রিজ ডিজাস্টার) কবিতাটার শেষাংশ এমন:
রুপালি টে-র পোড়াকপালি সেতু, হায়!

শেষিতে হইবে মোর কবিতাখানি এথায়

নিঃসঙ্কোচে শঙ্কা বিনে এ কথা কহিয়া দুনিয়ায়
তোর ওই বুকের পাঁজর পড়িত না ভাঙিয়া ও-বেলায়
জ্ঞানী-গুণীজনে দ্যাখ বলিয়া যায়
থাকিলে প্রতি পাশে শক্ত খিলানের ঠেস
জ্ঞানী-গুণীজনে তো বলিয়াছে বেশ
বাড়িখানি মোরা গড়িব মজবুত যত
ভাঙিয়া মরিবার ডর রহিবেগো কম তত।
সেলার্স সবেমাত্র 'পথের পাঁচালী' দেখেছেন। তিনি লিখলেন:
সালটা তখন ১৯৬৭ ঈসায়ী আর মাসটা ছিল ডিসেম্বর
হরিষে ভরা মাসখানি যেমতি আসে শেষে প্রতিবছর
নহে গো এ যে মোটেও মতো নভেম্বর
রাখিব স্মরণে এ মাসখানি জীবনভর।
পেয়ে গেনু এক প্রভাতে
সত্যজিৎ রায়ের হাতে
জরুরি সন্দেশখানি নহে একরত্তি দেরিতে
যেনবা পারি বন্ধুগণে সেই বিকেলেই কহিতে
ভুবনবিখ্যাত ত্রিলজি
যে ছবি দেখিবে আজই
নাম তার “পথের পাঁচালী”
যেইখানে কাশবনে শিশু দুই মিলি
দেখিতেছে রেলগাড়ি গেল চলে ধেয়ে
নীল সে আসমানের নিচে পথ বেয়ে
এমনি সুন্দর তুমি মৃত্যুরে ডাকিবে চেয়ে।
অনতিকাল পরেই 'দ্য এলিয়েন' আমাকে নিয়ে গেল আরেকটি সফরে, এবার লন্ডনে। প্রকল্পটিকে কলাম্বিয়া ইউএসএ থেকে কলাম্বিয়া ইউকেতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, জানি না এর মানে কী, এবং লন্ডনের কর্তাব্যক্তিরা আমার সঙ্গে বৈঠক করার জন্য উদ্‌গ্রীব ছিলেন। মাইক আমার এক সপ্তাহ আগে গিয়ে পৌঁছায় এবং হিল্টনস হোটেলে আমার জন্য একটা স্যুইট ভাড়া করে। কলাম্বিয়ার দেওয়া অগ্রিমের অবশিষ্টাংশে তখনো এমন বিলাসিতা সম্ভব ছিল। মাইক যথারীতি খোশমেজাজে, আমাকে ওস্তাদ বলে ডাকে, আর গঞ্জিকায় চুর থাকলে পা ছুঁয়ে সালাম করে। ওর নেশা করাটা আগেই কলকাতায় খেয়াল করেছিলাম, আর বলতেই হচ্ছে যে এতে আমি বিস্মিতও হয়েছিলাম। লম্বা চুলো, আলুথালু বেশভূষা দূরের কথা, মাইক আমার দেখা সবচেয়ে পরিপাটি আর সবচেয়ে ধোপদুরস্ত লোকদের একজন। কিন্তু দেখতে সাদামাটা হওয়ার কারণে হলিউডের সানসেট স্ট্রিপের ফ্লাওয়ার পিপলদের কাছে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা হতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি, যে লোকগুলো সাঁতো মার্মন্টে তার বৈঠকখানায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঘরটাকে একটা হিপ্পি ডেরা করে তোলার জন্য আসত।

সন-এ-ল্যুমিয়ের

সত্যজিতের কল্পনায় ভিনগ্রহবাসীর চিত্র
সত্যজিতের কল্পনায় ভিনগ্রহবাসীর চিত্র

লন্ডনে হিল্টন হোটেলে সাধারণত ঘরেই কাটাতাম, তবে এক বিকেলে মাইকের সঙ্গে দেখা করতে দুইতলা নিচে ওর স্যুইটে যেতে হল। সেখানে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ভেদ করে যে দৃশ্যটা আমার চোখে পড়ল, তা পেট্রোনিয়াসের রঙ্গমঞ্চের কোনো দৃশ্য হতে পারত। অনেকগুলো নারী ও পুরুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কার্পেটের ওপর, মুভি প্রজেক্টরের ঘরঘরানি আর বাংলা ভাষার সংলাপধ্বনি ছাপিয়ে গান করছেন শুভলক্ষ্মী, যে সংলাপগুলো ঘরের একপাশের খালি দেয়ালের ওপর ছলকে ছলকে পড়া আমারই 'দেবী' ছবির একটা ১৬ মিমি প্রিন্ট থেকে উৎসারিত হচ্ছিল—জগতের সকল সন-এ-ল্যুমিয়ের প্রদর্শনীকে খতম করে দেওয়া এক সন-এ-ল্যুমিয়ের যেন।
কিন্তু বোমভোলানাথ মাইকের চেয়ে আমার বেশি দুশ্চিন্তার কারণ ছিল ভদ্রবেশী মাইক, কেননা ভদ্রাবস্থাতেই তার চরিত্রের ভয়ংকর কিছু দিক বেরিয়ে আসে। আগে কখনোই সে ফোনে আড়ি পাতেনি কিন্তু সেবার পেতেছিল, আমাদের প্রকল্পসম্পর্কিত যাবতীয় ফোনালাপেই। ব্রিফকেসে সারাক্ষণ একটা ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে ঘুরতে শুরু করেছিল সে, লুকিয়ে কলাম্বিয়ার অফিসের প্রতিটা কথোপকথন ধারণ করত। 'ওরা খুবই বাজে,' কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করলে উত্তরে আমাকে সে বলেছিল, 'আমি চাইছি ওরা ওদের আগের কথায় ফিরে যাক।' কলাম্বিয়ার সঙ্গে আমার একটামাত্র বৈঠকে মাইক উপস্থিত ছিল না। তাঁরা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'চিত্রনাট্যটার জন্য ১০ হাজার ডলারের যে অগ্রিমটা উইলসন সাহেব গ্রহণ করেছিলেন, সেটা কি আপনি হাতে পেয়েছেন?' বললাম, এ ধরনের কোনো অগ্রিমের কথাই আমি জানতাম না। ততক্ষণে নিজেকে পুরোদস্তুর কাফকার কোনো নায়ক বলে মনে হতে থাকে আমার। সহযোগী প্রযোজক হওয়ার কথা মাইকের, কিন্তু আমাদের মধ্যে তখনো কোনো চুক্তি হয়নি। এ ফাঁকটা পূরণ করতে উদ্‌গ্রীব ছিল সে। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে—সে যাত্রায় সুরা-আলমারি গাঁথা একখানা রোলস রয়েস ভাড়া করেছিল মাইক—আমার হাঁটুর ওপরে একতাড়া কাগজ ফেলে মাইক বলে, 'এখানে যদি একটা সই করতেন, ওস্তাদ।'
বললাম, 'দুঃখিত, যাতে সই করব, তা তো পড়তেই পারছি না।'
একটা পকেট টর্চ বের করে তোড়াটার ওপরের পাতায় ধরল মাইক।
'আমি আর আপনি যে পার্টনার, শুধু এটা বলার জন্যই।'
'গাড়িতে বসে কোনো কিছুতে সই করতে পারব না,' আমি বললাম, 'এমনকি রোলস রয়েসেও না। ওগুলো আমার কলকাতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও।'

'সীতাকে রেখে দাও'
আমি অপেক্ষা করেছিলাম, কিন্তু কাগজগুলো এল না। মাস কয়েক পর যুক্তরাজ্য থেকে কলাম্বিয়ার প্রযোজনা দলের একজন কলকাতায় এলেন। তিনি বললেন, মাইককে সরে দাঁড়াতে রাজি করানো গেলে কলাম্বিয়া ছবিটার পৃষ্ঠপোষকতা করবে। 'আপনি একাই তো ছবিটা করতে পারেন,' বলেন নিক ম্যাকডোনাল্ড, 'তার কাছে লিখুন। কে জানে, আপনার কথার পেছনের যুক্তি দেখতে হয়তো সে এখনো সম্মত হতে পারে।' আমি মাইকের কাছে লিখলাম সে যেন তার স্বত্ব তুলে নেয়, যাতে করে আমি একাই এগোতে পারি। আমাকে চোর আর মানহানিকারী ডেকে ঝাঁজালো উত্তর দিল মাইক। স্বভাবতই স্বত্ব ছাড়ার আর কোনো প্রশ্ন থাকল না। এর পরে লিখল পিটার। এবার গদ্যে। 'আপনাকে সোজাসাপ্টাভাবেই বলি,' তিনি বলেন, 'চরিত্রটা আপনার কাছে কমবেশি সম্পূর্ণ বলে হয়তো মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তা মনে হয়নি এবং যেভাবে আছে ওভাবে সেটা কী উপায়ে করতে পারব, বুঝতে পারছি না।' পিটারকে আমি আগেই বলেছিলাম যে ওটা প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি ছিল আর সেটা ঠিকঠাক করা হবে—যদিও খুব বেশি নয়। এ পর্যায়ে তাঁর করণীয় শুধু নীতিগতভাবে সম্মত হওয়া—যা তিনি হয়েছিলেন।
উত্তরে লিখলাম:
'প্রিয় পিটার, বড় আরও ভূমিকা যদিবা চাহিতেন
এখন কেন লো, গোড়াতেই কথাখানা কহিতেন,
অসময়ে কথাটি জানাইয়া
দিলেনই তো হুল ফুটাইয়া
“দ্য এলিয়েন”-এর বেলুনখানিতে
দেখিতেছি শিগগির পড়িবে উহা মাটিতে
দিয়া দাগা খুব এক্ষণে
সত্যজিৎ রায়ের মনে।'
পিটারের কাছ থেকে কোনো উত্তর আসেনি। এর মধ্যে আমি 'দ্য পার্টি' দেখি, আর ছবিটার শেষ দিকে 'পথের পাঁচালী'র প্রতি ভক্তি (নাকি ভর্ৎসনা?) খেয়াল করি। যে মেয়েটা ওর প্রেমে পড়ে আর নিজের ঘরে তাকে আমন্ত্রণ জানায়, বকশি তাকে বলে, 'দুঃখিত। আমি দুঃখিত, আমাকে আমার বানরটার কাছে ফিরে যেতে হবে।' 'বানর!' 'হ্যাঁ, আমার পোষা বানর, অপু।' বছরাধিক কালের মধ্যে 'দ্য এলিয়েন'-এর ব্যাপারে কেউ কোনো যোগাযোগ করে না এবং আমার মনে হয় যে প্রকল্পটি অলভ্যের রাজ্যে অপসৃত হয়ে গেছে। এরপর অপ্রত্যাশিতভাবে ছোট্ট একটা খবর এল আর্থার ক্লার্কের কাছ থেকে। মাথা মুড়ে দক্ষিণ ভারতের জঙ্গলে ধ্যান করতে গেছে মাইক।
পরের চিঠিটা আসে স্বয়ং সেই মুণ্ডিতমস্তক ভিক্ষুর কাছ থেকে। চিত্রনাট্যটার অধিকার প্রত্যাহরণ করতে চাইছিলেন তিনি, কিন্তু সন্তত্বলাভের অত কাছাকাছি পৌঁছে লৌকিক আটপৌরে ভাষায় সেটা জানানো তো তাঁকে আর মানায় না। কথাটা তাই তিনি এভাবে বলেছিলেন:
'প্রিয় রাবণ:
সীতাকে তুমি রেখে দিতে পারো। সে তোমারই। ওকে রাখো এবং জগৎসুদ্ধ তাকে সুখী করো।'

অনুবাদ: এহসানুল কবির

সূত্র: সত্যজিৎ রায়ের ‘ট্রাভ্যেলস উইথ দ্য এলিয়েন: দ্য ফিল্ম দ্যাট ওয়াজ নেভার মেইড অ্যান্ড আদার অ্যাডভেঞ্চার্স উইথ সায়েন্স ফিকশন’, সম্পাদনা: সন্দীপ রায়। 

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]