দ্য স্টোরি অব মুহাম্মদ দীন

ইংরেজ লেখক জোসেফ রুডইয়ার্ড কিপলিংয়ের জন্ম ভারতের মুম্বাইয়ে, ১৮৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ১৮৮৮ সালে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপের সময় কিপলিং এই গল্পটি লেখেন। এই করোনাকালে গল্পটি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হবে।

পুরোনো, ছেঁড়া, ট্যাপ খাওয়া পোলো খেলার বলটা ম্যান্টেলপিসের ওপর ধূমপানের পাইপের সাথে রাখা ছিল। সে জায়গাটা আমার খিদমতগার ইমাম দীন পরিষ্কার করছিল।

'হুজুরের কি এই বলটার প্রয়োজন আছে?' বিনয়ের সাথে ইমাম দীন জিজ্ঞাসা করল।
আমার বলটার খুব একটা প্রয়োজন ছিল এমন না, কিন্তু একজন খিদমতগারের এই বল দিয়ে কী কাজ?
'আপনাদের দয়ায় আমার একটা ছোট ছেলে আছে। সে এই বলটা দেখেছে এবং এটা নিয়ে খেলতে খুবই আগ্রহী। আমি আমার নিজের জন্য চাইছি না।'
ইমাম দীন নিজে খেলার জন্য বলটা চাইছে—এ কথা অবশ্য ভুলেও কেউ চিন্তা করবে না। বলটা দেওয়ার পর সে ওটা নিয়ে বারান্দার দিকে গেল; পরক্ষণেই বারান্দাটা ভরে গেল ছোট বাচ্চার হাসি, ছোট ছোট পায়ের শব্দ, আর মাটিতে বলটা ফেলার থপ থপ জে। তার মানে বাচ্চাটা দরজার বাইরেই তার সম্পত্তি সুরক্ষিত করার জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু বলটা যে এখানে আছে, সেটা সে জানল কীভাবে?
পরদিন অফিস থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে আধা ঘণ্টা আগেই চলে এলাম। আসার পর খেয়াল করলাম, ডাইনিং রুমের ভেতর ছোট নাদুসনুদুস একটা বাচ্চা। পরনের জামাটা দরকারের চেয়ে হাস্যকর রকমের ছোট, পেটের ওপরে এসেই শেষ হয়ে গেছে। বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে গুনগুন করতে করতে সে ঘরে রাখা ছবিগুলো দেখছে। বুঝতে পারলাম, এটাই সেই 'ছোট ছেলে।'
আমার ঘরে তার কোনো ধরনের কাজ নেই; কিন্তু নতুন জিনিস আবিষ্কারে সে এতই মগ্ন ছিল যে দরজায় দাঁড়ানো আমাকে খেয়ালই করেনি। আমি ঘরে ঢোকার পর আওয়াজ পেয়ে ভয়ে কেঁপে উঠল সে; এবং সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ানো থেকে মেঝেতে বসে গেল। তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল, সেই সঙ্গে মুখ খুলে চিৎকার দেবার উপক্রম। এরপর কী হবে বুঝতে পেরে আমি দ্রুত সেই ঘর থেকে পালালাম, সঙ্গে সঙ্গেই শুনতে পেলাম বিকট লম্বা চিৎকারের আওয়াজ! সে আওয়াজ সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে যত দ্রুত পৌঁছাল, আমার বাজখাঁই গলার কোনো হুকুমও সেখানে এত দ্রুত কখনো পৌঁছায়নি। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ইমাম দীন ডাইনিং রুমে হাজির। এরপরই সেখান থেকে কান্নার আওয়াজ আসতে লাগল। আমি গিয়ে দেখি ইমাম দীন বাচ্চাটাকে বকছে আর ছেলেটা তার ছোট জামা দিয়ে নিজের চোখের পানি মুছছে।
'এই ছেলেটা', ইমাম দীন রেগে বলে যাচ্ছে, 'একটা বদমাশ, একটা আস্ত বদমাশ। এসব করলে সে অবশ্যই একসময় জেলখানায় যাবে।' এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলের হয়ে আমার কাছে ইমাম দীন মাফ চাইতে লাগল।
'বাচ্চাটাকে বলো', আমি বললাম, 'সাহেব রাগ করেনি। আর ওকে নিয়ে যাও।' ইমাম দীন আমার কথা বাচ্চাটাকে শোনাল, চিৎকার থামিয়ে তখন সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তারা দুজন দরজার দিকে এগিয়ে গেল। 'ওর নাম মুহাম্মদ দীন'—ওর বাবা এমনভাবে বলল যেন তার নামটাও অপরাধের একটা অংশ, 'আর ও একটা বদমাশ।' এ কথা শুনে বাবার কোল থেকে মুহাম্মদ দীন আমার দিকে ফিরল। এরপর গভীর অভিমান নিয়ে বলল, 'আমার নাম মুহাম্মদ দীন এটা ঠিক, থাহেব। কিন্তু আমি বদমাশ না, আমি মানুষ।'
সেদিন থেকে মুহাম্মদ দীনের সঙ্গে আমার পরিচয়। সে আর কখনো আমার ডাইনিং রুমে আসেনি, কিন্তু বাড়ির উঠানে প্রায়ই আমার সঙ্গে তার দেখা হতো। যদিও আমাদের কথাবার্তা ছিল খুবই সীমিত। দেখা হলে সে আমাকে বলত, 'থালাম, থাহেব'; আর আমি জবাব দিতাম,'সালাম মুহাম্মদ দীন।' প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পর আমাকে দেখে তার ছোট শরীরটা বাগানের ঝোপঝাড়ের পেছন থেকে বের হতো। আমিও সেখানে ঘোড়া থামিয়ে তার সম্ভাষণের জবাব দিতাম, যাতে সে বুঝতে পারে আমি তার জন্যই দাঁড়িয়েছি।

'ওর নাম মুহাম্মদ দীন'—ওর বাবা এমনভাবে বলল যেন তার নামটাও অপরাধের একটা অংশ, 'আর ও একটা বদমাশ।' এ কথা শুনে বাবার কোল থেকে মুহাম্মদ দীন আমার দিকে ফিরল। এরপর গভীর অভিমান নিয়ে বলল, 'আমার নাম মুহাম্মদ দীন এটা ঠিক, থাহেব। কিন্তু আমি বদমাশ না, আমি মানুষ।'


মুহাম্মদ দীনের কোনো সঙ্গী ছিল না। সে উঠানে নিজের মতো ঘুরে বেড়াত, আপনমনে এক ঝোপ থেকে আরেক ঝোপে। একদিন হাঁটার সময় বাগানের দূরপ্রান্তে আমি তার শিল্পকর্ম আবিষ্কার করলাম। সে মাটিতে পোলো বলটা অর্ধেক পুঁতে রেখে তার চারপাশ বৃত্তাকারে সাজিয়েছে ছয়টা শুকনো ম্যারিগোল্ড ফুল দিয়ে। সেই বৃত্তের বাইরে ইটের টুকরা আর ভাঙা চিনামাটি দিয়ে চারকোনা নকশা, তার বাইরে মাটি দিয়ে আরেকটা সীমানা। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেটা ছোট একটা বাচ্চার কাজ এবং এর ফলে আমার বাগানের কোনো রকম সৌন্দর্যহানি হয়নি।
বিধাতা জানেন, আমার কখনোই বাচ্চাটার খেলার জায়গা নষ্ট করার কোনো রকম ইচ্ছাই ছিল না; কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় আনমনে হাঁটতে গিয়ে আমি সেটার ওপরই হোঁচট খেলাম। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ম্যারিগোল্ড, ইট, চিনামাটি আর মাটির একটা দলায় পরিণত হয়ে গেল সেটা। পরদিন সকালে দেখলাম, মুহাম্মদ দীন আমার বানানো সেই ধ্বংসস্তূপের সামনে বসে কাঁদছে। কে যেন তাকে নিষ্ঠুরভাবে বলেছে বাগান নষ্ট করার জন্য সাহেব তার ওপর অনেক রাগ করেছেন এবং গালাগাল দিতে দিতে লাথি মেরে সেটা ভেঙে দিয়েছেন। মুহাম্মদ দীন প্রায় এক ঘণ্টা লাগিয়ে ফুল, ইট, মাটিসহ সবকিছু পরিষ্কার করে সরিয়ে ফেলল; আর সেদিন বাড়িতে ফেরার পর সে অত্যন্ত ক্ষমার সুরে আমাকে 'থালাম, থাহেব' জানাল। তাড়াতাড়ি একটা তদন্তের পর ফলাফল হিসেবে ইমাম দীন গিয়ে মুহাম্মদ দীনকে জানাল, সাহেব বাগানের ভেতর যেখানে খুশি সেখানে তাকে খেলার অনুমতি দিয়েছেন। বাচ্চাটা সঙ্গে সঙ্গেই তার ফেলে দেওয়া প্রাসাদটা বানানোর জন্য দৌড়ে গেল।
এরপর কয়েক মাস সে ঝোপঝাড়ের মধ্যে নিজের মতো করে প্রাসাদ বানাতে থাকল; কখনো কুলিদের ফেলে দেওয়া বাসি ফুল দিয়ে, কখনো মসৃণ নুড়িপাথর দিয়ে, কখনো ভাঙা কাচ আর পালক দিয়ে। আমি মাঝেমধ্যেই তাকে খেয়াল করতাম, একা একা গুনগুন করতে করতে খেলছে।
একদিন তার বানানো এক দালানের পাশেই ধূসর রঙের একটা ঝিনুকের খোল পাওয়া গেল। আমি বুঝলাম, এটা দিয়ে মুহাম্মদ দীন অন্য রকম কিছু একটা বানাবে। আমাকে মোটেই হতাশ না করে সে ঘণ্টাখানেক গভীর ধ্যানমগ্ন থাকল, তারপর তার গুনগুন আওয়াজের বদলে উৎসবমুখর গানের ধ্বনি ভেসে আসতে লাগল। সে মাটি দিয়ে বাইরের সীমানাটা বানিয়ে ফেলল। এটা অবশ্যই চমৎকার একটা কিছু হবে, বুঝতে পারলাম আমি। কারণ, এই নকশাটা লম্বায় দুই গজ আর চওড়ায় এক গজের মতো। কিন্তু এই প্রাসাদের কাজ আর শেষ হলো না।
পরদিন বাগানের মাথায় মুহাম্মদ দীনকে দেখা গেল না। সেই সাথে কোনো রকম 'থালাম থাহেব'-ও শুনতে পেলাম না। বাসায় ঢুকেই এই কথাগুলো শোনা তত দিনে আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে, তাই সেটার অনুপস্থিতি আমার কাছে মোটেও ভালো লাগল না। তার পরের দিন ইমাম দীন আমাকে জানাল, বাচ্চাটার জ্বর এসেছে এবং তার কুইনিন দরকার। তাকে ওষুধের সঙ্গে একজন ব্রিটিশ ডাক্তারও দেওয়া হলো।
'এগুলোর জীবনীশক্তি বলতে একদম কিচ্ছু নেই', বলতে বলতে ইমাম দীনের ঘর থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।
এক সপ্তাহ পর, আমার নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাস্তায় ইমাম দীনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। একজন সঙ্গী নিয়ে সে গোরস্থানের দিকে যাচ্ছে। তার কোলে সাদা কাফনে মোড়ানো ছোট মুহাম্মদ দীন।

অনুবাদ: আরিফিন ইউসুফ

*অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]