আসিফ ফাররুখি: নিভে গেল উর্দু সাহিত্যের একটি দীপ

আসিফ ফাররুখি
আসিফ ফাররুখি
>গতকাল মারা গেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরা উর্দু লেখক আসিফ ফাররুখি

১ জুন সন্ধ্যায় উর্দু সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল বাতি চিরদিনের জন্য নিভে গেল। দেশে কিংবা বিদেশে উর্দু সাহিত্যকে তুলে ধরার পেছনে যাঁর রয়েছে অনন্য অবদান, সেই মানুষটি গতকাল সন্ধ্যায় মামুলি অসুখে চলে গেলেন। গল্পকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক ও সংগঠক আসিফ ফাররুখির সঙ্গে আমার পরিচয় ইনতেজার হুসেইনের মাধ্যমে। ইনতেজার হুসেইনের বিখ্যাত উপন্যাস 'বাস্তি'র ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা লিখেছেন আসিফ। অবশ্য অনুবাদটির প্রথম সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন পাকিস্তানের আরেক বুদ্ধিজীবী ড. উমর মেমন।

সেই ভূমিকা দিয়েই আসিফ ফাররুখিকে চেনা। তারপর পড়তে পড়তে জানতে পারি, ইনতেজার হুসেইনের মতো এই গল্পকারও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন একাধিক ছোটগল্প। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা তাঁর বিখ্যাত গল্প 'নিকাল দিয়া' পড়ে চমকে যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নিয়াজ জামান ও আসিফ ফাররুখির যৌথ সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে উর্দু ও বাংলাভাষায় লেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ইংরেজি অনুবাদ-সংকলন—'ফল্ট লাইনস: স্টোরিস অব নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান'।

করাচি থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভের পর ১৯৮৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনস্বাস্থ্যে স্নাতক করেন আসিফ ফাররুখি। কর্মজীবনের শুরুতে চিকিৎসা পেশায় থাকলেও পারিবারিক ধারাবাহিকতায় লালন করা সাহিত্যের ঝোঁক তাঁকে সাহিত্যের অধ্যাপনায় নিয়ে যায়। ২০১৪ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি পাকিস্তানের বিখ্যাত হাবিব বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৫৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর করাচিতে আসিফের জন্ম। তাঁর বাবা ডক্টর আসলাম ফাররুখি ছিলেন উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত কবি ও শিক্ষাবিদ। মা ছিলেন আরেক বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ডেপুটি নাজির আহমদের নাতির কন্যা এবং সম্পাদক ও সংগীতজ্ঞ শাহিদ আহমদ দেহলভির ভাতিজি। সন্দেহ নেই, পারিবারিক এই সাহিত্য-আবহ তাঁকে লেখক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

নিয়াজ জামান ও আসিফ ফাররুখি সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ইংরেজি অনুবাদ-সংকলন, ফল্ট লাইনস: স্টোরিস অব নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান,।
নিয়াজ জামান ও আসিফ ফাররুখি সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ইংরেজি অনুবাদ-সংকলন, ফল্ট লাইনস: স্টোরিস অব নাইনটিন সেভেনটি ওয়ান,।

হার্ভার্ডের জীবন থেকেই ফাররুখি উর্দু সাহিত্যের অনুবাদ শুরু করেন। সমকালীন উর্দু কবিদের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ 'অ্যান ইভিনিং অব কেজড বিস্টস' নামে প্রকাশ করেন। তারপর কয়েক বছর উর্দু থেকে ইংরেজিতে দুর্দান্ত সব অনুবাদ করেন। 'দ্য ডিসট্যান্স অব আ শাউট' নামে কিশওয়ার নাহিদের কবিতার অনুবাদ করে হইচই ফেলে দেন। আতিয়্যা দাউদের অনুবাদ প্রকাশ করেন 'রেজিং টু বি ফ্রি' নামে। পাকিস্তানের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ইনতেজার হুসেইন ও আসাদুদ্দিনের সঙ্গে 'শর্ট স্টোরিস ফ্রম পাকিস্তান: ফিফটি ইয়ারস অব পাকিস্তানি শর্ট স্টোরিস' নামে উর্দু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ সংকলন প্রকাশ করেন।

অনুবাদের মাধ্যমে উর্দু সাহিত্যকে যেভাবে বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন আসিফ, ঠিক সেভাবে বিশ্বসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখাজোকা অনুবাদ করে উর্দু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। জার্মান লেখক হেরমান হেসের 'সিদ্ধার্থ' উর্দুতে অনুবাদ করেছেন। 'ইয়াদুঁ কি বাজগশত' ও 'খাবনামা' নামে নোবেলজয়ী মিসরীয় লেখক নাগিব মাহফুজের অনুবাদ করেছেন। আরেক আরব লেখক রফিক শামির হাফনাত মিন আল নুজুমকে 'মুঠিভরা তারা' শিরোনামে এবং লাতিন আমেরিকার লেখক উমর রাভাবেলার উপন্যাস উর্দুতে অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ করেছেন বাঙালি লেখক সত্যজিতের লেখাও।

অনুবাদের বাইরে লিখেছেন সাতটি গল্পগ্রন্থ। 'আতিশ ফেশাঁ পর খেলতে গোলাব', 'এক আদমি কি কমি', 'শেহের বেতি', 'শেহের মাজরা', 'ম্যায় শাখ ছে কিঁউ টুটা', 'মেরে দিন গুজর রহে হ্যায়' তাঁর প্রকাশিত গল্পসংলন। 'সমন্দর কি চোরি' নামে তাঁর নির্বাচিত একটি গল্পের সংকলন রয়েছে। 'জেন্ডার, পলিটিকস অ্যান্ড পারফরম্যান্স ইন সাউথ এশিয়া' নামে রয়েছে একটি প্রবন্ধের বই।

অনুবাদ, গল্প, প্রবন্ধ এবং দৈনিক ও সাহিত্য পত্রিকায় কলাম লেখার বাইরে উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যপত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন আসিফ ফাররুখি। 'দুনইয়াজাদ' নামে কয়েক শ পাতার একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন। পত্রিকাটির এ পর্যন্ত তেতাল্লিশটি সংখ্যা বেরিয়েছে। জ্যেষ্ঠ লেখকদের পাশাপাশি নতুন অথচ প্রতিভাবান মেধাবী তরুণদের লেখার সুযোগ দিতেন। ফলে উর্দু ভাষার সব বয়সের লেখকের সঙ্গে আসিফ ফাররুখির ছিল গভীর যোগাযোগ। তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শেহেরজাদ থেকে ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে শতাধিক গুরুত্বপূর্ণ বই।

সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৫ সালে পেয়েছেন প্রাইম মিনিস্টার অ্যাওয়ার্ড। ২০০৫ সালে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন সম্মানজনক তমঘায়ে ইমতিয়াজ (মেডেল অব এক্সিলেন্স) পদক।

আসিফ ফাররুখি সাহিত্যকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে প্রতিষ্ঠা করেছেন করাচি লিট ফেস্টের। এ আয়োজনটিকে ঘিরে পাকিস্তানে বসে সবচেয়ে বড় সাহিত্য মজমা। বলা দরকার, করাচি লিট ফেস্টের পর সারা দেশে এমন আরও বহু উৎসবের আয়োজন করা হয় এখন। দেশ-বিদেশের সাহিত্যিকদের মিলন ঘটে। আরও একজন সহপ্রতিষ্ঠাতাকে নিয়ে গত বছর থেকে শুরু করেছিলেন আদব ফেস্টিভাল পাকিস্তান।

বিশ্বসাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে উর্দু পাঠকদের দুয়ারে হাজির করা, আবার উর্দু সাহিত্যকে অনুবাদের মাধ্যমে বিশ্বসাহিত্য দরবারে তুলে ধরা, মৌলিক লেখালেখি, সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা, প্রকাশনা সংস্থা পরিচালনা এবং সাহিত্য উৎসবের মাধ্যমে লেখক-পাঠকদের মধ্যে সফলভাবে নিবিড় যোগাযোগ তৈরি করতে সক্ষম হন যে সাহিত্য স্রষ্টা, তাঁকে নিশ্চয় উর্দু সাহিত্যের পাঠকেরা ভুলতে পারবেন না কোনোদিন।

যে দীপ গতকাল সন্ধ্যায় বাহ্যত নিভে গেল, তাঁর জ্বালানো আলোয় উদ্ভাসিত হোক সাহিত্যধারা।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]