মির্জা গালিবের গজল নিয়ে

মির্জা গালিব
মির্জা গালিব

'দেখনা তকরির কি লযযত কে জো উসনে কাহাঁ

ম্যায় নেয়ে জানা কে গোয়া য়ে ভি মেরা দিল মে হ্যায়'
(দেখো তার কথার জাদু, সে যা-ই বলে
আমার মনে হয়, এ-ও তো আমার মনেই ছিল)
আজ এত দিন পরে একগাল লম্বা, সাদা দাড়িওয়ালা এক বুড়োর ঝাপসা ঝাপসা ছবি দেখে কে বুঝবে, ১৮১৬ সালে ১৯ বছর বয়সের মধ্যেই তুর্কি বংশোদ্ভূত সুদর্শন, শক্তিশালী অথচ মিষ্টি স্বভাবের ভারি মজাদার এক তরুণ শেষ করে ফেলেছিলেন সেই সব লেখার বেশির ভাগটুকুই, দুই শ বছর পার করেও বিশ্বের নানা প্রান্তের কবিতাপিপাসু মানুষ যার নিত্যনতুন ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন নিজের মতো করে প্রতিনিয়ত। যদিও তাঁর মনে হতো এসব দেশোয়ালি ভাষা (উর্দু) লেখার উপযুক্ত নয়, সাহিত্যের উপযুক্ত ভাষা হলো ফারসি এবং জীবনের পরের প্রায় তিরিশ বছর লিখে গেছেন তিনি ফারসিতে, উর্দুর প্রায় দশ গুণ। কিন্তু ইতিহাসের মজা হলো, এই পাক-ভারত উপমহাদেশে তাঁকে কিংবদন্তি করে রেখেছে অনাদরের সেই উর্দু। উর্দু ভাষার অনেক মহৎ কবির ভিড়েও তাঁর জনপ্রিয়তায় একবিন্দু ভাটা পড়েনি। নাম মির্জা আসাদুল্লাহ খান বেগ গালিব, উর্দুভাষীদের কাছে তিনি শুধুই 'চাচা গালিব'।

গালিবের অনুবাদক জাভেদ হুসেন
গালিবের অনুবাদক জাভেদ হুসেন

দুই.
'গালিব বুরা না মান জো বায়িয বুরা কহে
আয়সা ভি কোয়ি হ্যায় কে সব আচ্ছা কহে জিসে'
(গালিব, যদি ধর্মগুরু মন্দ বলেন মন খারাপ কোরো না
এমন কি কেউ আছে, যাকে সবাই ভালো বলে)

জাভেদ হুসেনের অনূদিত 'মির্জা গালিবের গজল থেকে'বইয়ের ওপরে লিখতে গিয়ে গালিব ও তাঁর সময়কে নিয়ে বেশি কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু গালিবের গজল বোঝার জন্যই ইতিহাসকে 'নোকতা'হিসেবে সামনে না রাখলে বিভ্রান্ত হবেন পাঠক। কারণ, আধুনিক নাগরিক জীবনের চাপ আর জীবনযুদ্ধের প্রতিদিনের ক্ষত ইতিহাসকে আমাদের কাছে দূরতর দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। মনে রাখতে হবে, গালিবের জীবন ও মৃত্যু এমন এক শহরে এমন এক বিশেষ সময়ে কেটেছে, যেখানে মোগল সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিল আর জেঁকে বসেছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন। যে গালিব নিজেকে অভিজাত হিসেবে চিহ্নিত করতে গর্ববোধ করতেন, তিনিও মোগল সম্রাটের কাছে বিশ্বস্ততার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন; কারণ ব্রিটিশদের প্রতি বিশ্বস্ততার অভাব ঘটলে তার পারিবারিক বৃত্তি পাবার ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

>

মির্জা গালিবের গজল
উর্দু ও ফারসি থেকে ভাষান্তর: জাভেদ হুসেন
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।
দাম: ৩০০ টাকা।


গালিব ইতিহাসের পালাবদলের রাস্তায় একমাত্র মহাকবি (কারণ, জওখ ও মোমিন আগেই মারা গিয়েছিলেন), ১৮৫৭ সালের উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের সাক্ষী। সুলতানি আমলের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ শাসন, ঐতিহ্য ও স্মৃতির দিল্লি হতে রক্তাক্ত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দিল্লি, গৌরবের আকবরাবাদ থেকে নতুন নির্মিত আগ্রা, সব হয়েছে গালিবের চোখের সামনে। তিনি ছিলেন ইতিহাসের উত্থানের মাঝে দাঁড়িয়ে, দেখলেন ভাষা ও সাহিত্যের জগতেও অচেনা অজানা অভ্যাসের উত্থান। এত দিন ধরে নগণ্য হিসেবে গণ্য ভাষা উর্দু, নিজস্ব ভঙ্গিমায় নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে ব্যাকুল। ভাষার সেই ব্যাকুলতা আর গালিবের ভালোবাসার 'পুরোনো দিল্লি' আটকে থাকল মির্জা সাহেবের কলমের কালিতে। আমরা গালিবের লেখালেখির দিকে তাকালে দেখতে পাব পুরোনো দিল্লির বহুমাত্রিকতা, এর সমস্যা, ক্ষুদ্রতা, হতাশা, উচ্ছ্বাস, আভিজাত্য আর সাফল্য—এ সবই গালিবের জীবনযাপন, ভাবনা ও লেখাপত্রের মধ্য দিয়ে এক অসচরাচর ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে।

তিন.
যত দিন গেছে, গালিবের প্রতি পাঠকদের আকর্ষণ ভাষার প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বৈশ্বিক কাব্যভাষার মূলধারায় চলে এসেছে। গালিবের কবিতা বিভিন্ন ভাষার কাব্যপ্রেমীদের স্মৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। কবি হিসেবে গালিব 'জটিল', শুধু আবেগ ও কল্পনার গভীরতা প্রকাশের দিক থেকে নয়; শব্দের সৌন্দর্য আর পৃথিবীর মোহময়তার গভীর অনুভূতির কারণে গালিবের গজলের মূল শক্তি শব্দের নিবিড়তা আর বর্ণনাভঙ্গির সাবলীলতা, তার আধুনিক মনের কল্পনা, সৃজনশীল প্রশ্ন, মনস্তাত্ত্বিক প্রমাণের অনুসন্ধান, ক্ষণস্থায়ী রহস্যময়তা,উদ্ভাবনী যুক্তি এবং গতানুগতিক ভাষাকে লঙ্ঘন অবজ্ঞা করার সামর্থ্য—যে কারণে সেই সব গজল হয়েছে কালোত্তীর্ণ।

গালিবের মতো একজন কালোত্তীর্ণ কবির কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে অনুবাদককে জড়িয়ে পড়তে হয় দুটি সংঘাতে। প্রথমত, ইতিহাসের গণ্ডি পেরিয়ে সময়কে ছোঁয়া, অনুবাদকে একই সঙ্গে সমকালীন ও চিরকালীন করার দায়, আর সেটা যদি হয় গালিবের মতো জটিল কবির অনুবাদ। বলা যায় জাভেদ হুসেন দক্ষ নাবিকের মতো সময়ের ঝড় সামলেছেন দৃঢ়তার সঙ্গে।

'রাত-দিন গর্দিশ মে হ্যায় সাত আসমা,
হো রহেগা কুছ না কুছ ঘাবড়ায়ে কেয়া'
(রাত-দিন আবর্তনে আছে সাত আসমান
কিছু না কিছু তো হবেই, ঘাবড়ে কী লাভ)

দ্বিতীয়ত, মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব একজন কবি ভাষাহীন ভাষায় গতির যে স্ফূরণ রাখেন কাব্যে, তাকে অন্য ভাষায় আনতে গেলে অনুবাদকে পাড়ি দিয়ে বের হয়ে আসতে হয় শব্দের অর্থহীনতার ওপারের এক জগতে। জাভেদ হুসেন সেখানেও সফল। এই জগৎ যে গতিতে চলতে অভ্যস্ত, সেই অভ্যস্ততা জ্বরের ঘোরের প্রলাপের মতো অর্থহীন। কবিতায় গন্তব্য কাছে না এসে বরং দূরত্বকে বোঝায়। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার উদগ্র চাওয়া যে তীব্র গতির সঞ্চার করে, কাব্য অনুবাদে তাতে তাল রাখা খুব মুশকিল।

'হর কদম দুরিয়ে মনযিল হ্যায় নুমায়া মুঝ সে
মেরি রাফতার সে ভাগে হ্যায় বিয়াবা মুঝ সে'
(প্রতি পদক্ষেপে গন্তব্যের দূরত্ব আমার কাছে স্পষ্ট হয়
আমার গতি দেখে বিরান মরু আমার কাছ থেকে ছুটে পালায়)

জাভেদ হুসেনের অনুবাদের নিপুণতা হলো তিনি উর্দু বা ফারসির কাব্য ঐতিহ্যের অনবদ্য বৈশিষ্ট্য 'রহস্যময়তাকে' বাংলায় এনেছেন, কিন্তু আক্ষরিক অনুবাদও তিনি করেননি। কবিতার ভাব ও প্রাণকে সজীব রেখেই এর অসমাপ্ত রহস্যের চাবি নিয়ে অন্য ভাষার হাজির হওয়া—উভয় ভাষায় অনুবাদকের সৃজনশীল মেধা ও মজবুত কবজির স্বাক্ষর বহন করে। সম্ভবত বাংলা ভাষায় সরাসরি ফারসি হতে গালিবকে প্রথম অনুবাদের কারণে অনুবাদক আলাদা করে অভিনন্দন পেতেই পারেন বাংলাভাষীদের কাছে।

মির্জা গালিবের গজল
মির্জা গালিবের গজল

চার.
'সুখন কেয়া কেহ নেহি সাকতে কে জোয়া হু জওয়াহির কে
জিগর কেয়া হাম নেহি রাখতে কে খোদে জাকে মাদাআন কো?'
(আমি কি কবিতা লিখতে পারি না যে রত্ন খুঁজে বেড়াব?
আমার কি হৃদয় নেই যে খনির খনন করব?)

উপনিবেশিক আমলে সংস্কৃতির জগতে ছিন্নমূল জারজের মতো বেড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক নানা স্রোত কেবল আধুনিকতার মোহে। বৈশ্বিক মহামারির এই কালে সে আরোপিত উদ্দেশ্যমূলক সাংস্কৃতিক স্রোত অনেকটাই শুকিয়ে গেছে। মির্জা গালিবের অনুবাদের এই বইটি কেবল একজন মহান কবির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নয় বা ভিন্ন একটি ভাষার পাঠকের কাছে তাঁকে পৌঁছে দেওয়া নয়, একই সঙ্গে এই অনুবাদ হতে যাচাই করে নেওয়া যায় আমাদের ব্যক্তি অবস্থানটিকেও; ঐতিহ্য হতে মুক্ত হতে চাওয়ার অজ্ঞানতার অন্ধকারে তার অবস্থান কোথায়—তীর্থযাত্রার মতো ফেলে আসা সময়ের উঠানে ঘুরে ঘুরে জীবনের অসংগতি আর বাস্তবতাকে নিষ্ঠুর উপহাসের প্রচ্ছদে ঢেকে ইতিহাস পরিক্রমণের যাত্রাবর্ণনা হয়ে থাকবে এই বই।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]