গ্রেট ইনফ্লুয়েঞ্জা ও করোনা

স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার পর, ১৯১৮ ও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর, ২০২০
স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার পর, ১৯১৮ ও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর, ২০২০

তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। চারদিকে ধ্বংস আর হিংসার প্রমত্ততা। মাঝখানে চুপিসারে এক অদ্ভুত রোগের আবির্ভাব। মানুষের শরীরে জ্বর, দিন তিনেক ভুগে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মৃত্যু। আমেরিকার শহরগুলোতে সংক্রামক ব্যাধি ছড়িয়ে যেতে লাগল, ছড়াল ইউরোপেও। কিন্তু সংক্রমণের নাম কেন হলো ‘স্প্যানিশ ফ্লু’? যাতে করে যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্রগুলো বোঝাতে পারে এ ফ্লু এসেছিল স্পেন থেকে। মহামারি নিয়ে মিথ্যাচারের সংস্কৃতি অনেক পুরোনো। যেমন করোনাকালের সূচনায় দাঁড়িয়ে উচ্চারিত হয়েছিল—সামান্য জ্বরজারি হবে, তারপর দুদিনেই সেরে যাবে, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, প্রয়োজন নেই কোনো প্রস্তুতিরও।

 প্রকৃতপক্ষে, ১৯১৮ সালে যুদ্ধে লিপ্ত রাষ্ট্রগুলো কিছুতেই চায়নি ওই অসময়ে ফ্লু ছড়িয়ে যাওয়ার মতো ভয়ানক খবর প্রচারিত হোক, যাতে যুদ্ধের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি বাধাগ্রস্ত হয়। মানুষের জীবন আর বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে সতর্কতা সেই সময়েও যেমন সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আজও ঠিক তেমনই। তবে তখন স্পেন ছিল একমাত্র দেশ, যে যুদ্ধের ডামাডোলের বাইরে ছিল বলে স্বাভাবিকভাবে খবর প্রচার করতে পারছিল। আর সে কারণেই স্পেনের সংবাদমাধ্যমে ইনফ্লুয়েঞ্জার দ্রুত সংক্রমণের খবর প্রথম প্রচারিত হয়ে বিশ্ববাসীর কাছে সংক্রমণটি হয়ে দাঁড়ায় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’।

সত্যি বলতে কী, সেদিনকার যুদ্ধের আবহ আর আজকের স্থিতিশীল অবস্থা, কেনো পরিস্থিতিতেই রাষ্ট্র তার সংবাদমাধ্যমের ওপরে নিয়মকানুন না চাপিয়ে থাকতে পারে না। লেখক ও ইতিহাসবিদ জন এম বেরি দ্য গ্রেট ইনফ্লুয়েঞ্জা: দ্য এপিক স্টোরি অব দ্য গ্রেটেস্ট প্লেগ ইন হিস্টোরি বইয়ের দীর্ঘ বর্ণনায় মূলত এটাই বলেছেন যে মহামারির সময়ে সবচেয়ে জরুরি হলো রাষ্ট্রের তথা সংবাদমাধ্যমের সত্যবাদিতা। স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাস ও কার্যকারণ নিয়ে রচিত বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৪ সালে। বইয়ের বর্ণনায় দেখা যায় তখনকার রাজনৈতিক এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখে উচ্চারিত হয়েছে, ‘এটা সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ করোনাভাইরাসের আগমনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়াও ছিল একই রকমের। ওদিকে, শুধু ইতিহাসভিত্তিক বই কেন, মহামারি নিয়ে রচিত বিখ্যাত উপন্যাসগুলোতেও নিয়ন্ত্রণ ও মিথ্যাচারের বিষয়টি ঘুরেফিরে এসেছে। রবিনসন ক্রুসো-খ্যাত লেখক ড্যানিয়েল ডেফো রচিত আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার উপন্যাসে দেখা যায় মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো হচ্ছে কিংবা মৃত্যুর কারণের ক্ষেত্রে সংক্রমণের কথা এড়িয়ে অন্য কিছু উল্লেখ করা হচ্ছে। ডেফোর বইটি অবশ্য কল্পকাহিনি নাকি বাস্তবের দিনলিপি, তা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অন্যদিকে, আলবেয়ার কামুর দ্য প্লেগ উপন্যাসের কোনো দৃশ্যে রাষ্ট্রের কথা সরাসরি উল্লেখ না থাকলেও কাহিনির বাঁকে রাষ্ট্রের তদারকির প্রমাণ স্পষ্ট। সেখানে রাষ্ট্রের নজরদারি ক্রমেই বেড়ে চলে আর গণমাধ্যমে কোন সংবাদটি যাবে, কোনটি যাবে না, তা নিয়ন্ত্রণের আভাস পাওয়া যায়।

জন এম বেরি দ্য গ্রেট ইনফ্লুয়েঞ্জা: দ্য এপিক স্টোরি অব দ্য গ্রেটেস্ট প্লেগ ইন হিস্টোরি বইয়ের প্রচ্ছদ
জন এম বেরি দ্য গ্রেট ইনফ্লুয়েঞ্জা: দ্য এপিক স্টোরি অব দ্য গ্রেটেস্ট প্লেগ ইন হিস্টোরি বইয়ের প্রচ্ছদ

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে—করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে চীনের একজন চিকিৎসক উহানে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয় রোষানলের শিকার হন। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অবহেলা ও লুকোছাপার সুযোগে দুর্যোগটি ভয়াবহ আকার নেয়। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র ঘটমান প্রতিটি পরিস্থিতিতে প্রশংসার দাবিদার হতে চায়। এই দাবি এতটাই মারাত্মক যে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যবস্থাপনা তছনছ হয়ে যাওয়াকেও নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া বলে মনে করে। ফলে দুর্যোগ এলে রাষ্ট্রের অপ্রতুলতা আর অক্ষমতা জনগণের সামনে উলঙ্গ হয়ে পড়ে। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত মানুষ যে তাই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক হওয়ার অভিনয় করে, তা চিরন্তন সাহিত্যের চোখ এড়ায় না। যেমন আলসান্দ্রো মানজোনির দ্য বিট্রোথেড উপন্যাসে দেখা যায়, প্লেগ ধেয়ে আসছে জেনেও রাজপুত্রের জন্মদিনের অনুষ্ঠান বাতিল করা হয় না। তাই ১৬৩০ সালে মিলানে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এ রকম ঘটনা যে বাস্তবে ঘটেনি, তা নয়। যেমন স্প্যানিশ ফ্লু ছড়িয়ে পড়ছে জেনেও ১৯১৮ সালে ফিলাডেলফিয়ায় যুদ্ধোত্তর প্যারেডের আয়োজন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় বন্ড উদ্বোধন উপলক্ষে প্যারেডে অন্তত দুই লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে। তারপর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়, ভেঙে পড়ে শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। তখনকার জনসংখ্যার ২০০ কোটির মধ্যে মারা গিয়েছিল ৫ কোটি, যা আজকের পৃথিবীর জনসংখ্যার অনুপাতে ১৫ কোটি।

তখনকার দিনে সরকারিভাবে লকডাউনের নিয়ম না থাকলেও প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষ কাজে অনুপস্থিত থাকত। সুবিধা ছিল, ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ছিল মাত্র ৩ দিন। অবশ্য সংক্রমণ হয়েছিল কয়েকটি ধাপে। কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে সমস্যা এর ইনকিউবেশনে চলে যায় ১৫ দিন। প্রক্রিয়াটি ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে পড়ে। গত মাসে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে লেখক জন এম বেরি বলেন, ‘মানুষ একটা সময়ে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফেরত নিশ্চয় যাবে কিন্তু তার আগে টেস্টের ব্যাপক সুবিধা এবং চিকিৎসাব্যবস্থা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।’ তাঁর কথা মাথায় রেখে দেখা যায়, প্রায় অনেক দেশেই বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে লকডাউন তুলে নেওয়ার কথা জানানো হচ্ছে কিন্তু বিশেষজ্ঞের সংজ্ঞা বা নামধাম জানানো থেকে রাষ্ট্র বিরত থাকছে। বেরির বইটি থেকে জানা যায়, যুদ্ধ-পরবর্তী বাণিজ্য চালাতে ও অর্থনীতি সচল রাখতে স্প্যানিশ ফ্লুর ভয়াবহতা সম্পর্কে মানুষকে অন্ধকারে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সোজা কথায়, বর্তমানের অবস্থা অভিন্ন। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে যেহেতু দেশের সার্বিক উন্নতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ভিত্তিতে ওঠানামা করে, তাই দেশি বাণিজ্যের উন্নতিকল্পে সংক্রমণ বাড়ানোর ফল পরবর্তী সময়ে ভোগ করবে আমদানি-রপ্তানি শিল্প। দেশ যদি কালো তালিকাভুক্ত হয়, তবে তার প্রভাব সরাসরি পড়বে শিল্পের ওপর।

 এই প্রসঙ্গে বলা যায়, বাণিজ্যের কর্ণধার বিল গেটস নিজের ব্লগে বেরির বইটি নিয়ে ছোট আলোচনা লিখেছেন। প্রথমত তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক নেতা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষেরা তথ্য গোপন করেন এবং তথ্যের বিকৃতিও ঘটান, যা করোনার মহামারির সময় কুফল ডেকে আনবে। অন্যদিকে উল্লেখ করেছেন বিজ্ঞানের উন্নতির কথা। তাঁর ভাষায়, বিজ্ঞানের উন্নতি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার। যেমন স্প্যানিশ ফ্লু ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয়নি, হয়েছিল ভাইরাসের সংক্রমণে—এটুকু নিশ্চিত হতেই বিজ্ঞানীদের ১৫ বছর লেগেছিল। এখন বিজ্ঞানের উন্নতি অনেক দ্রুততর কিন্তু তবু তা বিশ্বব্যাপী মহামারির চেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন নয়। তাই বিল গেটস শেষে জন এম বেরির কথায় ফিরে এসে বলেছেন, পৃথিবীব্যাপী মহামারি মোকাবিলা করতে কেবল বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করলে চলে না, প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক সদিচ্ছারও।