মারি নিয়ে ঘর করি

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
>

করোনা মহামারির কালে দেশের জ্যেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক লিখেছেন তাঁর দেখা মহামারির গল্প, জীবনে ফেরার গল্প।

আমরা জানি, মাঝেমধ্যে জলোচ্ছ্বাস ওঠে সমুদ্রে এবং মাঝেমধ্যেই তা সমুদ্রতীরে আঘাত হানে। একইভাবে এই পৃথিবীতে মানুষ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে—রোগ-তাপের বিরুদ্ধে, জীবনের পক্ষে এই যুদ্ধ। এখন যেমন আমরা লড়ছি এক অদৃশ্য ভাইরাস করোনার বিরুদ্ধে। বর্তমানে এক অদ্ভুত সময় পাড়ি দিচ্ছে বিশ্ববাসী। আমাদের দেশে আপাতত লকডাউন শেষ হলেও সবার মধ্যে ভয়, কখন কী হয়ে যায়! জীবনসায়াহ্নে এসে এ দৃশ্য দেখতে হবে, একদমই ভাবিনি। মারি, অনাহার আমি আগেও দেখেছি। তবে এ ধারার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। করোনা মহামারির কালে আজকাল কেন জানি না নিজের জীবনে দেখা মহামারির স্মৃতি, রোগশোকের কথা মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। এক মহামারি আরেক মহামারির স্মৃতি উসকে দেয় হয়তো। এই উসকে দেওয়ার মধ্যে কোথাও নিশ্চয় জীবনের ঘ্রাণ আছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক বছরের মাথায় আমার জন্ম। শুনেছি রোগবালাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল মায়ের পেট থেকে মাটিতে পড়ার পরই। জন্মের পরই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছিলাম না। এটা দেখে আমার বাবার এত কষ্ট হয়েছিল যে মাকে বলেছিলেন, এ আর বাঁচবে না, ফেলে দাও, একে ফেলে দাও। আদতে তখনো তো নিউমোনিয়ার কার্যকর কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। আর যেখানে জন্মেছিলাম, বর্ধমানের যবগ্রামে, ওই গণ্ডগ্রামে ত্বরিত ডাক্তার-বদ্যিই-বা কোথায় পাওয়া যাবে। তো, রোগ-জরার সঙ্গে লড়াই করেই জন্ম আমার।

জন্মের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখেছি নিরন্ন মানুষের হাহাকার। এরপর বেড়ে উঠতে উঠতে পরিচয় ঘটেছে কলেরা ও বসন্তের সঙ্গে। সেকালে কলেরা-বসন্ত মহামারিই ছিল। জলবসন্তকে মানুষ এত তোয়াক্কা না করলেও গুটিবসন্ত ছিল ভয়ংকর। কেউ গুটিবসন্তে আক্রান্ত হলে তাকে বাড়িতে রাখা হতো না, বাইরে রেখে দেওয়া হতো। গুটিবসন্তে আক্রান্ত মানুষের গলিত দেহ, সে কি দেখা যায়! এ জীবনে তা-ও দেখেছি। দেখেছি কলেরার বীভৎস কাল। এমনকি কলেরা আমাদের গ্রামেও হয়েছে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল বলরাম পাল। সে ছিল স্কুলের ফার্স্ট বয় আর আমি সেকেন্ড বয়। একসঙ্গে পড়লেও বলরাম আমার চেয়ে খানিকটা বড় ছিল। আমরা তাকে বলা নামে ডাকতাম। একদিন হঠাৎ শুনলাম তার কলেরা হয়েছে। এটা শুনে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বলাকে আমি দেখতে গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। গিয়ে দেখলাম, বলা ঘরের মধ্যে শুয়ে আছে। আর ক্ষীণ কণ্ঠে আমাকে বলছে, আজিজুল, কেন এসেছিস? আমি তো মরে যাব ক ঘণ্টা বাদে। তুই পালা।

আমার প্রতি এই ছিল বলার শেষ কথা। সে কথা শোনার পর তার কাছ থেকে পালিয়েওছিলাম বটে। এরপর ওই দিনই বলা মারা যায়। কলেরা মহামারিতে ওই প্রথম আমার কোনো বন্ধুর মৃত্যু হলো এবং সেই শৈশবে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে অনুভব করলাম বলা যায়।

কলেরা প্রসঙ্গে আরেকটি কথাও মনে পড়ছে। ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে একবার মামাবাড়ি গিয়েছিলাম। মা ভেবেছিলেন আমাদের নিয়ে কয়েকটা দিন আয়েশ করে তাঁর বাবার বাড়িতে থাকবেন। কিন্তু বিধি বাম, হঠাৎ জানা গেল, মামাবাড়ির পাশে একজন কলেরায় আক্রান্ত। খবর পেয়ে মা তো ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। বললেন, না, এখানে আর থাকব না, আমার মানিকদের নিয়ে আমি এক্ষুনি চলে যাব।

কলেরার চোখ থেকে বাঁচতে আমরা সেবার মামাবাড়ি থেকে চলে এসেছিলাম।

কলেরা নিয়ে একটি গল্পই তখন বারবার শুনতাম। কালো রঙের এক বুড়ি হাতে একটা পুঁটলি নিয়ে বিরাট এক মাঠ পাড়ি দিচ্ছে। কোথাও কেউ নেই। সেই বুড়ি ছুটছে, ছুটছে। ওই বুড়িই হলো ওলাবিবি। কলেরার দেবী। বলা হতো, ওলাবিবি কোনো গ্রামের ওপর নজর দিলেই সেই গ্রামে কলেরার মড়ক লাগে। তাই কোনো গ্রামে কলেরা শুরু হলে মানুষ বলত, তোমরা ওলাবিবিকে দেখেছ নাকি?

আমরা কেউই ওলাবিবিকে দেখিনি। তবে বারবার শুনতে শুনতে শিশুমনে ওলাবিবির একটা কাল্পনিক ছবি গাঁথা হয়ে গিয়েছিল বৈকি।

তবে আমাদের গ্রামে কলেরা হানা দিলেও আমার বাবা পণ্ডিত দোয়া বক্স মোল্লার সাবধানতা ও সচেতনতার কারণেই বোধ হয় আমাদের মুসলমান পাড়ায় কলেরা ঢুকতে পারেনি। বাবা আধুনিক মানুষ ছিলেন। তাঁর কড়া নিষেধ ছিল, বাড়ি থেকে এক পা বেরোবি না। তাই কলেরার কালে, ছেলেবেলায়, মস্ত দুরন্ত আমাকেও বাবার আদেশে বাড়িবন্দী থাকতে হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, আজ এত বছর পর আবারও আমি স্বেচ্ছা বাড়িবন্দী।

মরণ ও মারি আমাদের নাকের পাশ দিয়ে অসংখ্যবার চলে গেছে, দেখেছি। শৈশবে আমার সখী ছিল মসবুদা। মাঠের মধ্যে তার সঙ্গে হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়াতাম। সেই মসবুদা হুট করে মরে গেল টাইফয়েডে। তা-ও দেখেছি। আমাদের ছেলেবেলায় টাইফয়েডও মোটামুটি মড়কের মতো ছিল। ১৯৫০ সালের আগে এ বালাইয়ের কোনো ওষুধ তো আবিষ্কৃত হয়নি, আর এটা যেহেতু সংক্রামক, তাই একবার লাগলে নিস্তারের উপায়ও ছিল না।

টাইফয়েডের থাবায় ছোট বয়সে আমি নিজেও মরতে বসেছিলাম। টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীর এত দুর্বল থাকত যে সারা দিন শুয়ে থাকতাম। আর রাতের বেলা ঘরের মধ্যে যখন হারিকেন জ্বালানো হতো, সেই আলোয় মানুষের ছায়াগুলো ঘরের দেয়াল ছাড়িয়ে আরও বড় দেখাত। এসব দেখে ভয়ে শিউরে উঠতাম। কলিজা কেঁপে উঠত। এসব লিখতে গিয়ে আরও মনে পড়ছে—আদতে মনে পড়ছে না, পরে মায়ের মুখে শুনেছি, একদম গ্যাঁদাকালে ডবল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর আমাকে নিয়ে মা ছুটেছিলেন গ্রাম থেকে বহু ক্রোশ দূরে কাটোয়া মহকুমায়, ডা. এস কে রায়ের কাছে। আমাকে দেখেই ডাক্তার বলেছিলেন, এ কী নিয়ে এসেছেন, কাকে নিয়ে এসেছেন, একে তো মেরে এনেছেন!

তখন মরিনি। কলেরা, গুটিবসন্তের মহামারি নির্মূল করা গিয়েছে। টাইফয়েডও আগের মতো ভয়াবহ নয়। কিন্তু করোনা? এখন সাবান-স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধুতে ধুতেই আমাদের দিন চলে যায়। মুখে মাস্ক সেঁটে বসে থাকি। সারাক্ষণ ভয়, কে যেন ছুঁয়ে দেয়! এ ছাড়া অবশ্য কোনো উপায়ও নেই। এই মহামারি ঠেকাতে হলে সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া গতি নেই। প্লেগ যেমন একসময় ইউরোপকে ধরেছিল, তেমনি চীনকে দিয়ে শুরু করে করোনা মহামারিও ইউরোপকে ধসিয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশেও এখন সে ভীষণ আগ্রাসী ভূমিকায় উপস্থিত হয়েছে। তবু, সবকিছুর পরও, আমার বিশ্বাস, কলেরা, গুটিবসন্তের মতো এর প্রতিষেধকও অচিরেই আবিষ্কৃত হবে। জীবনঘাতী এই মারিকেও আমরা পরাজিত করব। কেননা, মানুষ তো অপরাজেয়। যুগে যুগে মানুষ যে কাজটি করেছে তা হলো, মৃত্যু ও মারির বিরুদ্ধে লড়াই। আর এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই বারবার আমরা জীবনে ফিরেছি। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তো বলেইছেন, ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারি নিয়ে ঘর করি।’

শুরুতেই লিখেছিলাম, এক মহামারি আরেক মহামারির স্মৃতি উসকে দেয়। উসকে দেয় এই কারণেই যে এই সব স্মৃতির মধ্যে আছে আমাদের সম্মিলিত লড়াইয়েরও ছবি, ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সির বুড়ো লোকটির মতো যে লড়াই আমরা বারবারই করে চলেছি।