ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার শেষ দিনগুলো

স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা স্বৈরাচারী শাসকের হাতে নিহত হয়েছিলেন। কিন্তু কেমন ছিল তাঁর শেষ দিনগুলো? অন্তিম মুহূর্তটি? এ নিয়ে লিট হাব ডটকমে ২০১৯ সালের ৫ মার্চ একটি লেখা প্রকাশিত হয়। গতকাল ছিল স্পেনের কালজয়ী এ কবির জন্মদিন। এ উপলক্ষে প্রকাশিত হলো লিট হাব ডটকমে প্রকাশিত ওই লেখার অনুবাদ। ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন রেহাল হোসেন
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা
ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা

১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট সন্ধ্যার একটু আগে আগে স্পেনের গ্রানাডা শহরের বাইরের ছোট ছোট উপত্যকার কাছাকাছি ভিজনার আর অ্যালফ্যাকার শহরের সংযোগকারী মাটির রাস্তাটার কাছে একটি গাড়ি থেকে সাদা প্যান্ট আর ব্লেজার পরিহিত এক লোক বেরিয়ে এলেন। তাঁর ভ্রুজোড়া বেশ ঘন আর বাঁকা বাঁকা। কপালের ঠিক মাঝখান থেকে দুই পাশে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু পিচকালো চুলগুলোর সঙ্গে একপাশের গভীর সিঁথি তাঁর ৩৮ বছরের মুখাবয়বের সঙ্গে মানিয়ে গেছে বেশ।

অমাবস্যার রাত, আন্দালুসিয়ার কালো তাঁবুর মতো আকাশের নিচে তিনি একা নন। লোকটিসহ আরও তিন কয়েদিকে কড়া পাহারায় রেখেছেন পাঁচ সৈনিক। বাকি তিন কয়েদির মধ্যে দুজন হলেন বিদ্রোহী বুল ফাইটার আর একজন পাকা চুলের স্কুলশিক্ষক, ভদ্রলোকের এক পা আবার কাঠের তৈরি। যে গাড়িতে করে এই স্থানে তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছে, তার হেডলাইটের আলোয় তাঁদের রাস্তাটির একদিকের পার্শ্বসীমা পেরিয়ে অনতিদূরের মাঠটির দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। মাঠজুড়ে অসংখ্য জলপাইগাছ, সেই আলো-আঁধারিতে গাছগুলোকে দেখতে লাগছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো। সৈনিকদের প্রত্যেকের হাতে অ্যাস্ট্রা ৯০০ সেমি অটোমেটিক পিস্তল আর মাউজা রাইফেল। ইতিমধ্যেই বন্দী চারজন বুঝে গেছেন তাঁদের হত্যা করা হবে। তাঁদের মধ্যে সাদা প্যান্ট পরা লোকটি আর কেউ নন, কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা।

এই ঘটিনার ঠিক এক মাস আগে ফ্রান্সেসকো ফ্রাংকো আর তাঁর জেনারেলরা মিলে স্পেনের গণতন্ত্রকামী তরুণদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত নিধনযজ্ঞ শুরু করেন। স্পেন অধিকৃত মরক্কোয় নিষ্ঠুরতার জন্য কুখ্যাত স্প্যানিশ ফরেন লিজিয়ন ও ৪০ হাজার আফ্রিকান সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীকে নেতৃত্ব প্রদানকারী জেনারেল ফ্রাংকো ছিলেন অসমসাহসী। ঈর্ষণীয় ক্যারিয়ার আর বেখাপ্পা কণ্ঠস্বরের অধিকারী এই জেনারেল যুদ্ধ করতেন আভিজাত্যপূর্ণ সাজে সাজানো ধবধবে সাদা ঘোড়ায় চড়ে।

যাহোক, নিধনযজ্ঞের ডাকে সাড়া দিয়ে গোটা স্প্যানিশ উপদ্বীপে শুরু হয় সামরিক বাহিনীর সমন্বিত উত্থান আর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ডানপন্থী দালালগোষ্ঠী, ফ্যাসিবাদী মিলিশিয়া দল ও পুলিশ থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। সমন্বিত এই বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল সে বছরেরই ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসা জনপ্রিয় বামপন্থী জোট সরকারকে উৎখাত করা। বিদ্রোহীদের চোখে তাঁরা ছিলেন মূলত ১৯৩১ সালে মিলিটারি একনায়ক মিগুয়েল প্রিমো ডে রিভেরা আর তাঁর মিত্র রাজা আলফনসো ত্রয়োদশকে ক্ষমতাচ্যুত ও বিতাড়িত করে দ্বিতীয় স্প্যানিশ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারীদেরই উত্তরসূরি।

প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরের পাঁচ বছর ধরে বামপন্থী প্রশাসকেরা স্পেনের পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক উচ্চাভিলাষী সব সংস্কার সাধন করেন। এর মধ্যে নারী অধিকার বৃদ্ধি, ভূমিহীন কৃষকদের দুর্দশা লাঘবে নতুন কৃষি আইন প্রণয়ন, শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্যাথলিক চার্চের প্রভাবমুক্ত করতে নানাবিধ পরিবর্তন সাধন থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর প্রভাব হ্রাস করতে তাদের অবকাঠামোগত আমূল পরিবর্তন ইত্যাদি ছিল অন্যতম। ঐতিহ্যবাহী স্প্যানিশ সমাজকাঠামোর ওপর এই সব আঘাতের দরুন সংস্কারপন্থী তথা খোদ প্রজাতন্ত্রেরই অসংখ্য শত্রুপক্ষ তৈরি হয়, যাদের মধ্যে রাজভক্ত রাজতন্ত্রবাদী থেকে শুরু করে রক্ষণশীল ক্যাথলিক, ধনী ভূস্বামী থেকে স্প্যানিশ ফ্যাসিবাদী পার্টি, দ্য ফ্যালাঞ্জ সবাই ছিল। এই সব গোষ্ঠী ফ্রাংকো আর তাঁর জেনারেলদের অধীনে একত্র হয়ে স্পেনের ক্ষমতা দখল করে আগের সেই গৌরবময় রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। এই স্বপ্নের অংশ হিসেবেই তারা লোরকার মতো প্রগতিশীল মানসিকতার মানুষদের নিজেদের পথের কাঁটা জ্ঞান করে তাঁদের চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে।

আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ বিকেলে লোরকা যখন ভগ্নিপতির হত্যার খবর পান, তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রুইজ আলোনসো আর তাঁর ১০০ জন সশস্ত্র সৈন্যের একটা বাহিনী লুই রোজালেসের বাড়িটাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কিংবদন্তিতুল্য দস্যুকে পাকড়াও করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সে সময় বাড়ির সব পুরুষ যুদ্ধক্ষেত্রে থাকায় মিসেস রোজালেস লোরকাকে হানাদারদের হাতে সোপর্দ করার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু রুইজ আলোনসো তাতে না দমে মিসেস রোজালেসকে বলেন, ‘এই লোকটি শুধু কলম দিয়েই আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তা অস্ত্র দিয়েও করা সম্ভব নয়।’

 

লোরকার জন্ম ১৯৮৮ সালে গ্রানাডার নিকটবর্তী একটি গ্রামের বেশ অবস্থাসম্পন্ন পরিবারে। তিনি ছিলেন একাধারে একজন প্রতিভাবান সংগীতজ্ঞ, নতুন ধারার কবি, থিয়েটারের একজন শক্তিমান নাট্যকার এবং অতুলনীয় আড্ডাবাজ। তাঁর ব্যক্তিত্ব এতই শক্তিশালী আর সংক্রামক ছিল যে কলেজে থাকাকালে নিজের তরুণ বয়সে প্রখ্যাত চিত্রকর সালভাদর দালি গ্রানাডার এই তরুণের অনন্যসাধারণ প্রতিভা দেখে যারপরনাই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন এবং তাঁর প্রভাব থেকে বাঁচতে একরকম পালিয়েই যান বলতে গেলে। নিজের মধ্যত্রিশেই লোরকা হয়ে ওঠেন তৎকালীন স্প্যানিশ সাহিত্যের জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। নিজের সমসাময়িক সাহিত্যিক তথা প্রজন্ম ’২৭-এর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্প্যানিশ কবিতায় সমগ্র ইউরোপের শৈল্পিক চেতনার সঙ্গে স্পেনের পল্লিসংস্কৃতির অভূতপূর্ব এক সম্মিলন ঘটান লোরকা। বিশেষ করে নিজের জন্মস্থান আন্দালুসিয়ার পল্লিসংস্কৃতির সঙ্গে সেখানকার জিপসি প্রভাবের যে সম্মিলন তিনি ঘটিয়েছিলেন, তা ছিল যুগান্তকারী। বন্ধু লোরকার বিষয়ে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে চিলির প্রখ্যাত কবি পাবলো নেরুদা একবার লিখেছিলেন, ‘মাধুর্য, প্রতিভা, বিশুদ্ধ হৃদয় আর স্ফটিকস্বচ্ছ জলপ্রপাতের মতো মননের এমন সমাহার আমি আর কোনো মানুষের মধ্যে দেখিনি।’

যদিও লোরকার সেই স্ফটিকস্বচ্ছ জলপ্রপাতের মতো মনের আড়ালে ছিল বেশ পলকা আর অন্ধকারময় এক জগৎ। আর যে দেশের আলো-বাতাসে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সেই দেশেই ব্রাত্য হয়ে পড়লেও তা স্বদেশ বা স্বজাতির শিকড় সন্ধান থেকে তাঁকে নিরস্ত করতে পারেনি। স্পেনের অন্ধকারতম প্রবৃত্তিগুলোর অনুসন্ধান তিনি চালিয়ে গেছেন ঠিকই।

প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরের পাঁচ বছর যাবৎ বামপন্থী প্রশাসকেরা স্পেনের পুনর্গঠন ও আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক উচ্চাভিলাষী সব সংস্কার করেন

নিজের এক বিখ্যাত বক্তব্যে লোরকা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর আর সব জায়গায় মৃত্যুই শেষ কথা। মৃত্যু আসে, চিরতরে পর্দা নামে কিন্তু স্পেনের বিষয়টি ভিন্ন, এখানে বরং মৃত্যু সব পর্দা, সব আড়াল সরিয়ে দিয়ে সবকিছু দৃশ্যমান করে তোলে।’ তিনি স্পেনের ঐতিহ্যবাহী বুল ফাইটের সঙ্গে মৃত্যুর প্রতি মানুষের আত্মঘাতী আকর্ষণের যোগসূত্র খুঁজে বের করেছিলেন। লোরকা লিখেছিলেন, ‘স্পেন একমাত্র দেশ, যেখানে মৃত্যু বিষয়টি জাতীয়ভাবে সমস্ত আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। এটিই একমাত্র দেশ, যেখানে বসন্তের আগমনকালে ডঙ্কারের দীর্ঘায়ু সুরে মৃত্যুকে স্বাগত জানানো হয়।’ আর ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৯৩৬ সালের গ্রীষ্ম নাগাদ মৃত্যু বুল ফাইটের প্রাঙ্গণ তথা বিখ্যাত প্লাজা ডি টোরোস অ্যারিনা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ল স্পেনের গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র। চারদিক ভরে গেল জাতীয়তাবাদীদের হাতে নিহত মানুষের লাশে।

নাৎসি বাহিনীর সহায়তায় তাদের বিমানে চেপে জিব্রালটার প্রণালি পেরিয়ে ফ্রাংকোর বাহিনী উত্তরে মাদ্রিদ শহর অভিমুখে নিজেদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখল। এই অভিযানে তাদের সঙ্গে ছিল জার্মান ও ইতালিয়ান ট্যাংক ও বিমান। ওপরমহলের নির্দেশে এবং সেভিল থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিপো ডি লানোর উসকানিমূলক প্রচারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিদ্রোহী সামরিক জান্তা তাদের যাত্রাপথে নির্বিচারে গণহত্যা চালায়, মারা পড়ে অসংখ্য নিরীহ কৃষকশ্রেণির মানুষ, ধর্ষিত হন অগণিত নারী। কুখ্যাত স্প্যানিশ ফরেন লিজিয়নের সৈনিকেরা, যারা নিজেদের পরিচয় দিত মৃত্যুর বর হিসেবে, তারা তাদের তথাকথিত শত্রুদের হত্যার পর তাদের কান কেটে নিত নিজেদের সংগ্রহে রাখার জন্য। আফ্রিকায় থাকাকালে জেনারেল ফ্রাংকো একবার এক তরুণের কান কেটে নেন, এই কুকীর্তির সূত্র ধরেই তারা এমন করত। তাদের রণহুংকার ছিল—মৃত্যু দীর্ঘজীবী হোক।

লোরকা মাদ্রিদে থাকতেন। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি নিজের জন্মস্থান গ্রানাডায় চলে আসেন। কিন্তু বিধিবাম, দীর্ঘদিনের জমে থাকা ঘৃণা আর রেষারেষি ইতিমধ্যে সেখানেও দানা বেঁধে উঠতে শুরু করেছে। ফালাঞ্জিস্ট এসকুয়াদ্রাস নেগ্রাস, অর্থাৎ ব্ল্যাক স্কোয়াড সেখানেও শুরু করে দিয়েছে তাদের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। গ্রানাডার আপাত-শান্ত জনপদ রাতারাতি পরিণত হয় রক্তপিপাসু হায়েনার দলে। গ্রানাডার পৌরসভা সমাধিস্থলটি পরিণত হয় ফায়ারিং স্কোয়াডে। শোনা যায়, সেখানকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা লোকটি নাকি যুদ্ধের সময়কার সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সরাসরি প্রত্যক্ষ করার ফলে এতটাই তীব্র মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন যে মানসিক ভারসাম্য খুইয়ে শেষমেশ বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হন।

গ্রানাডার এই চিত্র তৎকালীন সময়ে স্পেনজুড়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ বীভৎসতারই খণ্ডচিত্র। বিদ্রোহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ব্যক্তিরা দেশের নিয়ন্ত্রণ নিতে ক্ষমতাসীন বামপন্থী সরকারের সমর্থকগোষ্ঠীর সঙ্গে যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তারই ফলে সারা স্পেনে একের পর এক উঠতে থাকে মৃত্যুর পর্দা।

আর এই যুদ্ধের কেন্দ্রে ছিল ক্ষমতাসীন স্প্যানিশ বামপন্থীদের নেওয়া ‘ফ্রি ফর অল’ নীতি। এই দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করেই জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নে সেই শতাব্দীর শুরুর দিকে স্প্যানিশরা জড়িয়ে পড়ে এই আত্মঘাতী সংঘর্ষে। এখানে বলে রাখা ভালো, ওই একই শতাব্দীতে সারা পৃথিবী দেখেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বলশেভিক বিপ্লব।

স্পেন কি তাহলে ক্যাথলিক রাজাদের হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দেবে, ফিরে যাবে মধ্যযুগীয় সামন্তবাদে, যেখানে ভূস্বামীরা ভূমিহীন হতদরিদ্র কৃষকশ্রেণিকে শাসন করে আর চার্চ হয়ে ওঠে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের সর্বময় কর্তা? তাহলে কি স্পেন স্বাধীনতা, সাম্য আর আলোকায়নের আদর্শের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত তাদের নতুন গণতান্ত্রিক রাজপথে অধুনা আরম্ভ হওয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েই যাবে? নাকি একপাশে স্তালিনের কমিউনিজম আর বিপরীতে হিটলারের নাৎসিবাদ নিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে হারিয়ে যাবে ইতিহাসের অতল গভীরে?

কারও কারও মতে, শতবর্ষ যাবৎ স্পেনে এসব টানাপোড়েন ধীরে ধীরে দানা বাঁধছিল, যেন অতীত আর ভবিষ্যৎ একজোট হয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে চাইছিল বর্তমান। যে সময়ের কথা বলছি, তার আগের প্রায় ১২০ বছরেই স্পেনে সংঘটিত হয় তিন-তিনটি গৃহযুদ্ধ, ক্ষমতায় আসেন দুজন স্বৈরশাসক, প্রণীত হয় ছয়-ছয়টি সংবিধান আর ঘটে যায় পঞ্চাশটির বেশি সেনা অভ্যুত্থান। কেবল বিদ্রোহী পক্ষই নয়, ক্ষমতাসীন জনপ্রিয় দলের অনেকেও নতুন এই সহিংসতাকে অবশ্যম্ভাবী আর দরকারি বলে মনে করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক নেতা ফ্রান্সিসকো লারগো কাবায়েরো যেমন বলেছিলেন যে এ সবকিছুর সমাধান এখন একটাই, ‘রক্তপাত’।

যাহোক, গ্রানাডাতেও যে লোরকা নিরাপদ ছিলেন না, তা অচিরেই পরিষ্কার হয়ে যায়। বিশেষ করে যখন ২০ জুলাই লোরকার গ্রানাডায় ফেরার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁর ভগ্নিপতি (তখনকার গ্রানাডার নবনির্বাচিত মেয়র) গ্রেপ্তার হন। মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার মাত্র দশ দিনের মাথায়ই গ্রেপ্তার হন তিনি। ঠিক তার পরপরই একদিন ফালাঞ্জ গুন্ডাদের একটি দল লোরকাদের পারিবারিক বাড়িতে হামলা চালায় এবং কবিকে সিঁড়ি থেকে নিচে ফেলে দেয়, বাড়ির পাহারাদারকে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেধড়ক পেটায়। পরিস্থিতি দেখে প্রচণ্ড ভড়কে যান লোরকা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চালিত নাট্যদলের নেতা হিসেবে স্পেনের নাম না জানা অসংখ্য এলাকায় কাজ করে বেড়ানো লোরকা যে প্রজাতন্ত্রের সরব সমর্থক ছিলেন, তা কারও অজানা ছিল না। এ ছাড়া তাঁর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত মহলের ইন্ধন, গ্রানাডার রক্ষণশীল বুর্জোয়া সমাজকে নিয়ে করা এত দিনের কটাক্ষ—সব মিলিয়ে এটা একরকম অবধারিতই ছিল যে হানাদাররা অচিরেই আবার ফিরে আসবে, বিশেষ করে যেখানে তার নামে কুৎসা রটনাকারীরা লোরকার সমকামিতা নিয়ে বলতে গিয়ে তাঁকে ‘বো টাই পরা সমকামী’ আখ্যা দিয়েছিল।

পরদিন লোরকা আত্মগোপন করতে ছুটে যান ২৬ বছরের তরুণ কবি লুই রোজালেসের বাসায়। লুই রোজালেসের আদর্শ ছিলেন লোরকা। কিন্তু রোজালেস নিজেও বিদ্রোহীদের দলে নাম লিখিয়েছিলেন। স্পেন যে তখন অনিশ্চয়তা আর অরাজকতার চরম ঘূর্ণিপাকে দিশেহারা, এই ঘটনা থেকে সেটাই প্রতীয়মান হয়। এটি ছিল ব্যক্তিগত-আদর্শিক, স্থানীয়-জাতীয় সংঘাতের এমন এক রূপ, যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মানুষ হয়তো আপাতদৃষ্টিতে তার শত্রুকে নিজের মিত্রদের থেকে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল, তবে বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণও ছিল বিস্তর।

আর এই ঘূর্ণিপাকই গ্রাস করে লোরকাকে। এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, লুইস রোজালেসের ভাইয়েরাই তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিল আবার কেউ কেউ বলেন, গ্রানাডায় তাঁর যাওয়ার জায়গাগুলো আসলে কারও অজানা ছিল না।

তবে যা-ই হোক না কেন, পরিণতির কোনো হেরফের তাতে হয়নি। অচিরেই গ্রানাডার এক প্রতিহিংসাপরায়ণ পাতি নেতা র‌্যামন রুইজ আলোনসোর কানে লোরকার খবর পৌঁছায়, যার আশা ছিল লোরকাকে সরিয়ে দিয়ে ফালাঞ্জ দলে নিজের পদোন্নতি নিশ্চিত করা।

কেবল বিদ্রোহী পক্ষই নয়, ক্ষমতাসীন জনপ্রিয় দলের অনেকেও নতুন এই সহিংসতাকে অবশ্যম্ভাবী আর দরকারি মনে করেছিলেন

লোরকাদের সঙ্গে থাকা ওই পাঁচজন সৈন্য পেশাদার হত্যাকারী ছিলেন না। তাঁরা বিদ্রোহের একটা পক্ষে নাম লেখানো কজন সাধারণ মানুষ ছিলেন মাত্র। আর তারই ফলে সেদিন তাঁদের কাঁধে ওই গুরুদায়িত্বের ভার দেওয়া হয়। হয়তো আর দশজনের চেয়ে একটু বেশিই প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন তাঁরা। সেই সৈন্যদেরই একজন পরে জনসমক্ষে এটাও বলেছিলেন যে তিনিই লোরকার বড়সড় কপালটিতে প্রথম বুলেটটি দাগান। হেড: ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার শেষ দিনগুলো

আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ বিকেলে লোরকা যখন ভগ্নিপতির হত্যার খবর পান, তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রুইজ আলোনসো আর তাঁর ১০০ জন সশস্ত্র সৈন্যের একটা বাহিনী লুই রোজালেসের বাড়িটাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কিংবদন্তিতুল্য দস্যুকে পাকড়াও করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। সে সময় বাড়ির সব পুরুষ যুদ্ধক্ষেত্রে থাকায় মিসেস রোজালেস লোরকাকে হানাদারদের হাতে সোপর্দ করার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু রুইজ আলোনসো তাতে না দমে মিসেস রোজালেসকে বলেন, ‘এই লোকটি শুধু কলম দিয়েই আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তা অস্ত্র দিয়েও করা সম্ভব নয়।’
অবশেষে হানাদারদের অনড় অবস্থানের মুখে ভীতসন্ত্রস্ত লোরকা বাড়িটি থেকে বেরিয়ে আসেন। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি সরকারি বাড়িতে। তারপর রাত নেমে এলে গাড়িতে করে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় ছোট ছোট পাহাড়শোভিত সিয়েরা নেভাদার পার্বত্য অঞ্চলের ছোট্ট গ্রাম ভিজনারের নির্মিত অস্থায়ী এক জেলে। ভোরের সামান্য আগে আগে লোরকা এবং তাঁর সঙ্গী তিন কয়েদিকে অ্যালফাকারের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটির সেই বাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যেখানে ব্লেজার আর সাদা প্যান্ট পরা অবস্থায় তিনি গাড়ি থেকে নেমে পা মাটিতে রাখেন। আকাশে সেদিন কোনো চাঁদ ছিল না।

ফ্রান্সেসকো ফ্রাংকো
ফ্রান্সেসকো ফ্রাংকো

‘জন্ম যেমন আমাকে আলোড়িত করে না, তেমনি মৃত্যু নিয়েও কোনো উৎসাহ আমার নেই।’ কথাটি লোরকা বলেছিলেন এই ঘটনার মাত্র মাস তিনেক আগের এক সাক্ষাৎকারে। তখন কে জানত এটিই হবে তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকার। কিন্তু লোরকা সেদিন মিথ্যা বলেছিলেন। তিনি মৃত্যুকে ভয় পেতেন; বছরের পর বছর ধরে তিনি স্রেফ মজা দিতে মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের সামনে নিজের মৃত্যুদৃশ্য অভিনয় করে দেখাতেন, কিন্তু সেদিনের সেই শেষ মুহূর্তটির জন্য কি আসলেই প্রস্তুত ছিলেন তিনি, বিশেষত এর দুঃস্বপ্নময় যুক্তি আর ক্ষমার্হ দুঃখবোধের দিকটি বিবেচনা করলে যা অসম্ভব বলে মনে হয়? মৃত্যু, লোরকা যাকে বলেছিলেন, ‘অসংখ্য প্রশ্নের প্রশ্ন’, অবশেষে তাঁর ওপরই বিছিয়ে দিয়েছিল তার সীমাহীন শূন্যতার চাদর আর কেড়ে নিয়েছিল কবির কাব্যিক রোমান্স।
রাস্তাসংলগ্ন অন্ধকার মাঠটির কোনো এক স্থানে সৈন্যরা থামার নির্দেশ দিল কয়েদিদের। লোরকাদের সঙ্গে থাকা ওই পাঁচ সৈন্য পেশাদার হত্যাকারী ছিলেন না। তাঁরা বিদ্রোহের একটা পক্ষে নাম লেখানো কজন সাধারণ মানুষ ছিলেন মাত্র। আর তারই ফলে সেদিন তাঁদের কাঁধে ওই গুরুদায়িত্বের ভার দেওয়া হয়। হয়তো আর দশজনের চেয়ে একটু বেশিই প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন তাঁরা। সেই সৈন্যদেরই একজন পরে জনসমক্ষে এটাও বলেছিলেন যে তিনিই লোরকার বড়সড় কপালটিতে প্রথম বুলেটটি দাগান।
কথিত আছে, লোরকা তাঁর এক আপন চাচাতো ভাইকে উপজীব্য করে নিজের লেখা একটি নাটকের একটি চরিত্র নির্মাণ করেছিলেন এবং হেয় করেছিলেন। সৈন্যদের আরেকজন নাকি ঘটনার পুরো সময়ই বেশ ভীত ছিলেন। একপর্যায়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে চিৎকার করে তিনি বলতে শুরু করেন, ‘আমি এই কাজ করতে পারব না! আমাকে দিয়ে এই কাজ সম্ভব নয়!’ আর সেই পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট দলটির যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তিনি ছিলেন প্রজাতন্ত্রেরই প্রথম প্রধানমন্ত্রীর শোফার, ঘটনার আগের দিনই নিজের দশ মাস বয়সী পুত্রসন্তানকে হারান তিনি।
অবশেষে সেই পাঁচজন মানুষ একসঙ্গে নিজেদের আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নেন এবং কয়েদিদের ওপর গুলি চালান।
সেই রাতের সেই গগনবিদারী গুলির প্রতিধ্বনি যারাই শুনে থাকুক না কেন, তারা কেউই জানত না যে আসলে কী ঘটছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাতরাতে থাকেন রক্তাক্ত লোরকা। অবশেষে সৈন্যদের একজন এসে চিরতরে নিভিয়ে দেন তাঁর জীবনশিখা। নিথর হয়ে যায় লোরকার দেহ। আর হঠাৎই যেন বন্ধু ইগনাসিও সানচেজ মেহিয়াসের (বিখ্যাত স্প্যানিশ বুল ফাইটার) নির্মম মৃত্যু নিয়ে লেখা তাঁর নিজের পঙ্‌ক্তিগুলো তাঁর নিজের পরিণতির সঙ্গেই সম্পূর্ণ মিলে যেতে থাকে, লোরকা লিখেছিলেন:
কিন্তু এখন সে চিরনিদ্রিত
এখন তার কঙ্কাল ফুঁড়ে জন্ম
নেবে গুল্ম ও ঘাসফুল নিশ্চিত
এখন তার রক্তধারায় শোনা যাবে
আরাধ্য সংগীত
এভাবেই মৃত্যু হয়েছিল ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ শেষ হতে তখনো অনেক দিন বাকি।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]