করোনাকালের নাট্য ইশতেহার

গাজির গানের মতো বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারাগুলো করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে নাট্যশিল্পীদের অবলম্বন হতে পারে
গাজির গানের মতো বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারাগুলো করোনা পরবর্তী বাংলাদেশে নাট্যশিল্পীদের অবলম্বন হতে পারে
কলা মাধ্যমের মধ্যে জীবন্ত শিল্প হলো মঞ্চনাটক বা থিয়েটার। কিন্তু এই করোনা বাস্তবতায় সামাজিক দুরত্ব অনুসরণের কালে কীভাবে করা যেতে পারে থিয়েটার? বাংলার ঐতিহ্যবাহী নাট্যাঙ্গিকের সূত্র ধরে সে উপায় বাতলেছেন দেশের এই খ্যাতিমান নাট্য নির্দেশক।


শত বছর আগে যেমন স্প্যানিশ ফ্লু বদলে দিয়েছিল পৃথিবী, ঠিক তেমনি কোভিড-১৯ বদলে দিল আমাদের একুশ শতকের জীবনযাপনের রীতি-সংস্কৃতি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হবে করোনা প্রতিষেধক। মানুষ আবার প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যাবে। কিন্তু যে পরিবর্তন ও অভিজ্ঞতা মানুষ এই অতিমারি থেকে অর্জন করবে, তা নিশ্চিত বদলে দেবে সংস্কৃতি। বদলে দেবে সামাজিক রীতিনীতি। ধর্ম-অর্থ-বিত্তের শক্তির বিপরীতে বিজ্ঞান ও যুক্তির সংস্কৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ তৈরি হবে। এই বদলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, বাণিজ্য বলয় থেকে মুক্ত হয়ে জ্ঞান ও সেবামুখীন হবে। মানুষে মানুষে সহমর্মিতার সম্পর্ক দৃঢ় হবে। বদলে যাবে রাষ্ট্র ও মানুষের সম্পর্ক। পৃথিবী বদলে যাবে। বদলে যেতে বাধ্য। তবে সে বদলের জন্য সংগ্রাম করতে হবে। অপেক্ষাও করতে হবে। আর এই বদলের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষও বটে।

এই অন্তর্বর্তীকালে সাংস্কৃতিক উপাদান যা মানুষ সৃষ্ট, তা তো অতীতের মতো হবে না। রহস্যময় জগতের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়ায় সৃষ্ট যে সংস্কৃতি, তা অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মে সৃষ্ট হবে।

তাহলে বদলে যাওয়া জীবন ও সংস্কৃতির চর্চার ধরনটা কী হবে! এটা বোঝার জন্য আপত্কালীন চর্চার একটা কৌশল অবশ্যই আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। অর্থাৎ কোভিড-১৯ কালে শিল্পী বা তরুণ শিল্পকর্মীরা নানাভাবে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে অনলাইনে কথামালা, আবৃত্তি, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সেমিনার ও নানা ধরনের কার্যক্রম সফলভাবে চালাচ্ছেন। এতে ফলে শিল্পসমাজে মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে একধরনের ঐক্য গড়ে উঠছে বৈকি।

আমি নিজে ১২ মে থেকে মাসুম রেজার নাটক 'পেন্ডুলাম' পাঠ শুরু করেছিলাম, যা এখনো চলছে। ঢাকা থিয়েটার ও দেশ নাটকের যৌথ প্রযোজনায় নাটকটি এ বছরের শুরুতে হয়তো জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চায়ন হতো। কিন্তু বিধিবাম। করোনা সব ওলট-পালট করে দিল। করোনার আক্রমণের প্রাথমিক কালে করোনা প্রতিরোধে অন্য অনেকের মতো সামাজিক সহযোগিতা কর্মকাণ্ডে আমিও জড়িয়ে পড়ি। অর্থাৎ গ্রাম থিয়েটার নিয়ে সামাজিক সচেতনতামূলক কর্মসূচিতে নেমে পড়ি। তারপর কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য খাদ্য সহযোগিতা কার্যক্রম শুরু করি। কিন্তু অচিরেই অনুভব করি, হয়তো এই কার্যক্রমগুলো বিশেষ জরুরি। কিন্তু আমাদের নাটকের কাজটা করাও সমান জরুরি। কিন্তু কীভাবে করা যায়। নাটক তো অনলাইনে হওয়ার শিল্প নয়। নাটক ত্রিমাত্রিক মাধ্যম। ডিজিটাল পর্দা দ্বিমাত্রিক। তাই ত্রিমাত্রিক একটি শিল্পকর্ম কারিগরি কৌশলে দ্বিমাত্রিক মাধ্যমে রূপান্তরিত করলে তা হয় আত্মঘাতী। এতে করে সৃষ্ট শিল্প তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে। হারিয়ে ফেলে তার নন্দনতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। তা ছাড়া নাটকের জন্মলগ্ন থেকে 'জীবন্ত রূপ' এর মৌল উপাদান, মূল শক্তি। তাকে ক্যানবন্দী বা ডিজিটবন্দী করলে নাটকের প্রাণবায়ু বের হয়ে যায়। তাকে যান্ত্রিকভাবে আবার জীবিত করতে হয়। কিন্তু সে তো জীবিত হওয়া নয়, ভিন্ন একটা রূপে তখন সে আবির্ভূত হয়। টেলিভিশন নাটক তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যাঁরা প্রস্তাব করছেন অনলাইন থিয়েটারের, তাঁদের সাধুবাদ জানাই। অবশ্যই বন্দিদশায় নাটকের মানুষেরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে ঘরে বসে থাকবে না। তারা একটা পরিসর তৈরি করবে। তো হতে পারে অনলাইন নাটক একটা বিকল্প। কিন্তু নিশ্চিতভাবে তা থিয়েটার নয়। টেলিভিশন নাটকের মতো আরও একটি নাট্যপ্রয়াস।

তা ছাড়া নাটকের দাবি তো রক্ত–মাংসের দর্শক বা সামাজিকগণ, মঞ্চ বা অভিনয়স্থানের চারপাশে বসে থাকা জলসিক্ত চোখ, শ্বাস নেওয়ার কম্পমান শরীরের জীবন্ত দর্শক, এক কথায় মানুষ। অভিনয়ের উত্তুঙ্গ মুহূর্তে জীবিত মানুষের উচ্ছ্বাস বা বেদনার মুহূর্তে পাথরের নীরবতা, শুধু শ্রুত হয় মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্ষীণ ধ্বনি। শত শত দর্শকের শরীরের তাপ, গন্ধ। অভিনেতার চরিত্র বিনির্মাণে দর্শকের সঙ্গে এ মিথস্ক্রিয়া অনিবার্য শক্তি হিসেবে কাজ করে। এ এক অপার্থিব প্রাপ্তি যেন। একমাত্র মঞ্চনাটকেই সম্ভব এ রসায়ন। একমাত্র মঞ্চনাটকেই তাৎক্ষণিক ঘটে দর্শকের গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যানের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া। এই পরম্পরায়ই অভিনেতা এগিয়ে যায়, নাটকও এগিয়ে যায়। মঞ্চের নাটক এভাবেই হাজার হাজার বছর তার স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে আছে।

নাটক সদা ক্রিয়াশীল এক শিল্পযাত্রা। থিয়েটার একটা মঞ্চক্রিয়া। যতক্ষণ অভিনেতা মঞ্চে, ততক্ষণই থিয়েটার। একে ক্যাসেটবন্দী বা ডিজিটবন্দী করলে ওটা আর থিয়েটার থাকে না। শুধু আঙ্গিক নয় শক্তিটাও হারিয়ে যায়। আর নাটক তো বলা যেতে পারে নাট্যগুণসংবলিত যেকোনো রচনাকে। যেমন নাট্যকার যখন রচনা করেন, তখন আমরা তাকে নাটক বলি। আর যখন রচিত নাটকটি মঞ্চে অভিনীত হয়, তখন বলি থিয়েটার বা নাট্য। অথচ টেলিভিশনের নাটককে আমরা থিয়েটার বলি না। বলি না নাট্য। কেননা, তখন ওই নাটক অভিনেতা দর্শকের অলিখিত চুক্তি ও রসায়নে বেড়ে উঠতে অক্ষম।

তবে নতুন অনলাইন নাটককে স্বাগত জানাতে আমি প্রস্তুত।

এবার আসি অনলাইন ব্যবহার করে থিয়েটারের কিছু কাজ কি আদৌ করা যায়?

উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ। যায় বৈকি!


করোনাকালে বাসায় বন্দী হয়ে অলস সময় না কাটিয়ে অথবা শুধু শুধু অনলাইন 'টক শো'তে সময় নষ্ট না করে। সময় যখন স্বাভাবিক হবে, অথবা অতিমারির কালে কীভাবে নাটক করা যায়, তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যায়। এমনকি অতিমারির কালের থিয়েটারের একটা কৌশল উদ্ভাবন করা যায়।

শুরু করা যাক এভাবে-প্রথমে নাটক পাঠ করতে পারি। তারপর বিষয় ও প্লট বিশ্লেষণ করা যায়। নাট্যকাঠামো আমলের চেষ্টা করা যায়। নাটকের প্রকরণ বা গোত্র ভাগ করা যায়। চরিত্র বিশ্লেষণ করা যায়, যেমন চরিত্রের দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক অবস্থান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহ পুঙ্খানুপুঙ্খ বোঝার চেষ্টা করা যায়। চরিত্রের আন্তসম্পর্ক নির্ণয় করা যায়। বাক্যরীতি বিশ্লেষণ করা যায়। উচ্চারণ ও প্রক্ষেপণ চর্চা করা যায়। নাটকটি সামনে রেখে নাট্য কর্মশালা করা যায়। ভরতের 'নাট্যশাস্ত্র', রূপ গোস্বামীর 'উজ্জ্বল নীলমণি', নন্দীকিশোরের 'অভিনয় দর্পণ' (সেলিম আল দীন অনূদিত), স্তানিস্লাভিস্কির তত্ত্ব, মায়ারহোল্ড, রবীন্দ্রনাথ, গ্রোটস্কি, পিটার ব্রুক, সেলিম আল দীন, যে নাট্যতাত্ত্বিককে আপনার কাজের জন্য জরুরি মনে হবে, তাঁর তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে আপনার কলাকুশলীদের সঙ্গে কর্মশালায় নেমে পড়েন।

সেট, আলো, প্রপস, সংগীত, কস্টিউম, মেকআপ ইত্যাদির প্রাথমিক পরিকল্পনা করা যেতে পারে।

ডেডিকেটেড অ্যাপ ব্যবহার করে দলের সবাইকে বা যাদের প্রয়োজন, তাদের নিয়ে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে দুঘণ্টা বা ততোধিক সময় মহড়া, আলোচনা বা ওয়ার্কশপ চালানো যেতে পারে। জুম, গুগল মিটস, ইস্টিম ইয়ার্ড বা অনলাইন-যোগাযোগের অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম এখন সহজলভ্য। এসব মাধ্যমের সুবিধা হলো এই যে ওয়েব ক্যামেরার সামনে বসে একাগ্রচিত্ত হওয়া ছাড়া অংশগ্রহণকারীদের কোনো উপায় নেই। কেননা, প্রত্যেকে সমানভাবে দৃশ্যমান। নির্দেশক সবাইকে একসঙ্গে একই রকম দেখেতে পান। সবার ইমেজ সমান। অভিব্যক্তি প্রকটভাবে দেখা যায়। মহড়াকক্ষে নির্দিষ্ট অভিনেতা ছাড়া অন্যরা পরিচালকের চোখে পুরোপুরি ফোকাসড নন। এর কারণ দূরত্ব ও প্রয়োজন। কিন্তু ওয়েব ক্যামেরায় সবার দূরত্ব সমান।

তাই সবার প্রতি পরিচালক সজাগ দৃষ্টি রাখতে পারেন। বাড়তি সুবিধা হলো প্রত্যকে প্রত্যককে সমভাবে দেখা ও যোগাযোগ করতে সক্ষম।

অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি নাটক মঞ্চায়নের প্রাথমিক প্রস্তুতি হয়তো এ প্রক্রিয়ায় অধিকতর মনোযোগের সঙ্গে সম্ভব। কিন্তু অবশ্যই চূড়ান্ত কাজ সশরীরে মহড়াকক্ষে করতে হবে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মহড়া ও প্রযোজনার অন্যান্য কাজ করা যেতে পারে।

ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত যৈবতী কন্যার মন নাটকের দৃশ্য
ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত যৈবতী কন্যার মন নাটকের দৃশ্য

যেহেতু ইতিমধ্যে আমরা নাটকের তাত্ত্বিক কাজে যথেষ্ট অগ্রগতি করেছি, তাই মহড়াকক্ষের ফ্লোরে চরিত্রের শারীরিক ভাষা, বাচিক ভাষার সমন্বয়ে গতি, স্পন্দন, তাল, লয়, ছন্দ ইত্যাদির নান্দনিক টেম্পো তৈরি করব। এ জন্য চরিত্রের লক্ষ্য ও নাটকের লক্ষ্য যদি পূর্বাহ্ণে নির্দিষ্ট করে ফেলা যায়, তবে নির্ধারিত দিনগুলোয় নির্ধারিত স্থানে বিভিন্ন চরিত্রের চলন, সরল রেখায়, কি বক্রাকারে, দ্রুত অথবা শ্লথগতিতে, নাট্যমুহূর্তের উত্তাপ বা শীতলতা, সরব অথবা নীরব, কণ্ঠের উচ্চগ্রাম অথবা নিম্নগ্রাম, এ সবকিছু নির্দেশক একটি অভীষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। উল্লেখিত নাট্য উপাদানের সমন্বয় সাধনের মধ্য দিয়ে একটি ছন্দ তৈরি করতে সক্ষম হলে মঞ্চে দৃশ্যকাব্য সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়।

নাটকের বিষয়, প্রেক্ষাপট, চরিত্র, ভাষা, সংলাপ, বর্ণনা, নৃত্য, সংগীত, সেট, প্রপস, আলো, পোশাক, রূপসজ্জা ও শরীরের ভাষার সমন্বয় সাধনে টেম্পো সৃষ্টি নির্দেশকের জন্য কঠিন ও মূল কাজ। উল্লেখিত উপাদানের সৃষ্টিশীল ব্যবহারের মধ্যেই নিহিত আছে নাটকের থিয়েটার বা নাট্য হয়ে ওঠার রহস্য। আর এ কাজ মানুষের সশরীরের উপস্থিতি ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে নাট্য বা থিয়েটার মানুষ ও জীবন ছাড়া হয় না। তাই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন মহড়া হতে পারে, কিন্তু থিয়েটার নয়।

এবারে আসি কোন ধরনের নাটক এ মহামারিকালে বা উত্তরকালে করা যায় এবং কোথায় করা যাবে।


নাটকের ধরন
পশ্চিমি কাঠামোর যে নাটকের ধারা বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, সেটি কার্যত বিভিন্ন দেশে 'থিয়েটার' হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

বেশির ভাগ এ ধরনের নাটকে সুনির্দিষ্ট গল্প, বিপরীত বিষয়ের দ্বন্দ্ব, চরিত্রের দ্বন্দ্ব, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, দ্বন্দ্বমূলক সংলাপের মধ্য দিয়ে নাট্য উৎকণ্ঠা বা ক্লাইমেক্সে আরোহণ ও পরবর্তী সময়ে অবরোহণে নাট্যক্রিয়ার নিষ্পত্তি।

এ ধরনের নাটক চরিত্রপ্রধান। তাই অভিনেতা ও কলাকুশলী প্রয়োজন হয় অধিক মাত্রায়। তা ছাড়া বিভিন্ন প্রয়োজনে স্পর্শ জরুরি, তাই সামাজিক দূরত্ব বা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা দুরূহ।

ঐতিহ্যবাহী নাটক করে সময়ের দাবি পূরণ করা সহজতর বলে আমার মনে হয়। অধিকতর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নাটক করা সম্ভব।

তবে এর ব্যত্যয়ও রয়েছে। স্বল্প চরিত্রের নাটক ও স্পর্শ এড়িয়ে নাট্যমুহূর্ত নির্মাণ সম্ভব—এ ধরনের নাটকের কথাও আমরা জানি। সচেতনভাবে এ নাটক করা সম্ভব। স্বল্প চরিত্র অপেক্ষাকৃত সরল নাটক নির্বাচন করে বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটার এ ধরনের নাটক করতে পারেন।


ঐতিহ্যবাহী নাট্যধারা
ঐতিহ্যবাহী নাটক করে সময়ের দাবি পূরণ করা সহজতর বলে আমার মনে হয়। অধিকতর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নাটক করা সম্ভব।


যদি আমরা আঙ্গিকের বিষয়টি প্রথমে বিবেচনা করি, তবে ভাবতে পারি—১) সঙযাত্রা ২) গম্ভীরা ৩) পালাগান ৪) মনসামঙ্গল ৫) হাস্তর ৬) গাজির গান ৭) লেটো ৮) যাত্রা ৯) কবির লড়াই ১০) ভাষাণযাত্রা ১১) ঝুমুরযাত্রা ১২) কচ পুরাণ ১৩) কুশানগান ১৪) মনসার ভাষাণ (শুধু নারী অভিনয়শিল্পীদের পরিবেশনা)।

বাংলার হাজার বছরের অনেক নাট্যাঙ্গিকের কথা বলা যায়, যে আঙ্গিকগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো স্বল্পসংখ্যক কলাকুশলী। যাত্রা ব্যতীত সব নাট্যের দাবি একজন অভিনেতা গায়েন ও সংগীত দল। গায়েন অভিনেতা একাধিক চরিত্র করে থাকেন। অনেক সময় দোহারদের মধ্যে একজন ঠেটা হিসেবে দ্বিতীয় অভিনেতার কাজ করেন।

আমরা করোনাকালে বা উত্তরকালের নিকটবর্তী সময়ে উল্লেখিত পালাকার অথবা অভিনেতা-গায়েনকে দিয়ে নাট্য উপস্থাপনা করতে পারি। অন্যথায় বিভিন্ন নাট্যদলের সদস্যরা এই মহান কালাকারদের কাছ থেকে স্বল্পকালীন কর্মশালার মধ্য দিয়ে শিখে নিতে পারি ঐতিহ্যবাহী নাট্যকৌশল এবং তা প্রয়োগ করতে পারি নতুন নাট্যনির্মাণে। আঙ্গিক ঠিক রেখে বিষয় ও কাঠামোর সৃষ্টিশীল পরিবর্তন করে দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ সমসাময়িক বিষয় ও গতির ব্যবহার। এসবই পরীক্ষা–নিরীক্ষার বিষয়। আর বিপদ উত্তরণের সবচেয়ে সঠিক পথ হলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা।

এক্ষণে যে বিষয়টি আলোচনা করব, সেটি হলো কোথায় নাটক করব। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার শিগগির মঞ্চ খুলতে দেবে না। কিন্তু আমাদের কথাটা খোলসা করে বলা দরকার। যখন সরকার বাজার খুলে দিয়েছে। বাস, ট্রেন, গাড়ি, বিমান, লঞ্চ, অফিস, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকান ও মসজিদ খুলে দিয়েছেন। তাহলে কোন যুক্তিতে মঞ্চ, মিলনায়তন, থিয়েটার ও সিনেমা হল বন্ধ রেখেছেন? স্বাস্থ্যবিধি আরোপ করে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মঞ্চ খুলে দিন। মানুষ আসুক নাট্যালয়ে। বসুক সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। নাট্যদলগুলো দর্শকদের বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে ও মাস্ক সরবরাহ করে স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োগ করুক ও নিরাপদ পরিসর গড়ে তুলুক। ৫০০ আসনের মিলনায়তনে ১০০ দর্শক বসুক। প্রদর্শনী খরচ সংকুলান হবে না। টিকিটের দাম বাড়বে। না। তা কেন হবে! সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা শিল্পকলা একাডেমি, জেলা প্রশাসন ভর্তুকি দেবে। অর্থাৎ নাট্যদলগুলোকে আর্থিক প্রণোদনা দেবে। তাতে টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দর্শকের ওপর চাপ বাড়াতে হবে না। টিকিট আগের মতো সাশ্রয়ী হবে।

আর যদি মিলনায়তন না–ই পাওয়া যায়, তবে ঢাকাসহ সারা দেশে শহীদ মিনার, খোলা জায়গায় অস্থায়ী খোলা মঞ্চ করে অথবা না করে মাটিতে অভিনয়স্থান নির্দিষ্ট করে নাট্য মঞ্চায়ন করা যেতে পারে। শহীদ মিনারসংলগ্ন মাঠ বা স্কুলের মাঠ বাঁশ দিয়ে ঘেরাও করে মাঝে মঞ্চ করে অথবা অভিনয়স্থল নির্দিষ্ট করে স্বল্পমূল্যে টিকিট বিক্রি করে দর্শকের সমাগম করা সম্ভব। এভাবে আগে উল্লেখিত দুধরনের নাটকই করা সম্ভব। দর্শকের আসন ছয় ফুট দূরত্বে এবং যথাযথ নিয়ম মেনে করা যেতে পারে, তা চেয়ারে হোক বা সমতলে হোক।

বিনোদিনী নাট্য প্রযোজনায় শিমূল ইউসুফ
বিনোদিনী নাট্য প্রযোজনায় শিমূল ইউসুফ

তবে ঐতিহ্যবাহী রীতির নাটক সহজে করা যেতে পারে। কেননা, এ রীতির নাটক খোলামেলা ও গীতল। অভিনেতার শারীরিক দূরত্বের নিশ্চয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি সমতলে আসনবিন্যাসের বিধি মেনে করা অধিকতর সহজ।

আচ্ছা, শুধু খাদ্য গ্রহণ করে মানুষ কি বাঁচতে পারে? তার কি মানসিক খাদ্যের প্রয়োজন নেই? খাদ্য তো প্রাণী মাত্রই গ্রহণ করে। কিন্তু মানুষ সৃষ্টিশীল প্রাণী। তাই সে রং, রেখা, ভাষা, তাল, লয়, ছন্দ দিয়ে ছবি আঁকে, কাব্য ও সংগীত রচনা করে।

মানুষের সৃষ্ট সুরে তো ভরে যায় প্রকৃতির বুক। তাই তো পৃথিবী আনন্দের জায়গা হয়ে ওঠে।

আচ্ছা, এমন একটা দেশের কথা ভাবুন তো, যেখানে গান নেই, নাটক নেই, কবিতা নেই, নৃত্য নেই, চিত্রকলা নেই; এমন কোনো দেশ যদি থাকে, ওই দেশে কি মানুষ থাকবে? না, মানুষরূপী কিছু প্রাণীর সাক্ষাৎ হয়তো পাবেন। কিন্তু আমরা তো সে রকম দেশ নই। বাংলাদেশ তো গানের দেশ, কবিতার দেশ, আখ্যানের দেশ। আমরা ভুলে যেন না যাই পূর্বপুরুষের দেওয়া শিল্পকৌশল। আসুন, এই অতিমারির কালে আমাদের চর্চা অব্যাহত রাখি। স্বল্প পরিসরে হলেও শিল্পক্রিয়া জারি রাখি। যেন স্বাভাবিক জীবন ফিরে যেদিন পাব, সেদিন শিল্পজোয়ারে ভাসিয়ে দেব চরাচর।


নাটক, সংগীত, চলচ্চিত্র, নৃত্য, চিত্রকলা ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানে জীবনেরই জয়গান হোক শ্রুত। বিষাদের কালো মেঘ সরে যাক শিল্পের অমল ধবল আলোয়। এসো হে শিল্পবন্ধুরা—'চাঁদ চাষ করো। কার্পাস তুলার চাষ। সেই কার্পাসের পোশাক হোক সকল মানুষের সৌরযাত্রার বসন। চলো মানুষ চলো।'

 

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]