দ্বিখণ্ডিত

আজ তোমার বিয়ে। তবে খুব সাদামাটা এই দুটো বর্ণের মতো খুব সরল না ব্যাপারটা। শফিক—তোমার হবু বর—সকালবেলাতেই বিয়ের তত্ত্ব পাঠিয়ে দিয়েছে। একটা বেনারসি শাড়ি, সঙ্গে একটা হিরের নাকফুল, মুক্তার মালা আর একটা হিরের আংটি। আরও কিছু টুকটাক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তোমার মায়ের ঘরের বিছানাজুড়ে।

মা খুব ব্যস্ত। ছোট খালাকে নিয়ে রান্নাঘরে রান্নার আয়োজন করছে। মেহমান সাকল্যে পাঁচ-ছয়জন হবে। তবে আইটেম অনেক, তাই গতকাল রাত থেকেই চলছে আয়োজন। এই একটা বিষয় ছাড়া আর কোনো কিছুতেই আড়ম্বর নেই। এক ফাঁকে ছোট খালা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে তোমার কপালে একটু হলুদ ছুঁইয়ে গেল। তারপর তোমার কড়া আপত্তি সত্ত্বেও তোমার কড়ে আঙুলটাতে একটু মেহেদি লাগিয়ে দিতে গেল। তুমি আঙুলটা ঝটিতে সরিয়ে নিয়ে খালার চোখের দিকে তাকালে। খালা সেই দৃষ্টিতে কী দেখতে পেল জানো না। হয়তো তোমার সব কথা ছিল ওই চাহনিতে, তাই নীরবে সরে গেল।

মায়ের বিছানায় ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা পয়নামা কেউ কেউ দেখছে। কেউ কেউ আবার দেখেও না দেখার ভান করছে। আসলে তারা হয়তো তোমার মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করছে। মাঝেমধ্যে রান্নাঘর থেকে ছোট খালার হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ছোট খালা কার সঙ্গে হাসছে? মায়ের সঙ্গে? মা হাসতে পারছে! মায়ের পক্ষে আজ হেসে হেসে গল্প করা সম্ভব হচ্ছে! ছোটবেলা থেকে দেখছ, মা তার ভাইবোন, দেবর-ননদদের কাছে খুব প্রিয়। মা যেকোনো সাধারণ গল্পও এমনভাবে বলে যে সবাই আগ্রহ নিয়ে শোনে এবং কখনো হেসে গড়িয়ে যায়; আবার কখনোবা বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়ে। তোমার মা এখন ছোট খালাকে কী বলছে যে খালা এত হাসছে? মা কত সহজে সব ভুলতে পারল। কত স্বাভাবিক আচরণ করছে মা! অথচ গত দুই বছর মা কেমন পাথরচাপা মানুষের মতো আচরণ করেছে।

তোমার কি এখন একটু স্বস্তি পাওয়া উচিত, মা স্বাভাবিক আচরণ করছে সে জন্য!

সেদিন থেকেই মা কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে গিয়েছিল, যেদিন চেন্নাইয়ের ডাক্তার তাকে বললেন, ‘মেয়েটার বয়স কম, দেখতে সুন্দরী, মেয়েটার জীবন আবার নতুন করে শুরু করতে দিন।’

কিন্তু তোমার মনে তখনো একটা ক্ষীণ আশা ছিল। তুমি মায়ের মতো হাল ছেড়ে দাওনি। তুমি মাকে কাঁদতে দেখতে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, তুমি কখনো মায়ের সামনে কাঁদোনি। এর আগে মাকে কখনো কাঁদতেও দেখোনি। মা দাপুটে মহিলা, দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা। পারিবারিক ও বন্ধুমহলে হুল্লোড়ে-অড্ডাবাজ মাকে তুমি দিন দিন হারিয়ে ফেলছিলে। বলাই বাহুল্য, তোমার জগৎটা ছিল মা-ময়। আর তার বহু পরে তোমার জীবনে এসেছিল আরেকজন। দুজনই কি তোমার জীবনে সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল না! অথচ...! যাক সে কথা।

চেন্নাই থেকে ফেরার পর চারপাশের গোটা জগৎটাই যেন তোমার প্রতি সহানুভূতির ডালা সাজিয়ে বসেছিল। যার সঙ্গে দেখা হয় সে-ই একটু আহা-উহু করে। কেউ কেউ আবার এক্সট্রা প্রিভিলেজ নিতে চায়। সহানুভূতির আড়ালে কারও কারও লোলুপ অস্তিত্বকে এড়িয়ে যাওয়া তোমার পক্ষে অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঠিকমতো অফিস করাও তোমার পক্ষে সম্ভব হতো না অনেক সময়।

এর মধ্যে ইঁদুরদৌড়ে শফিক ভাই কীভাবে যেন প্রথম হয়ে গেল।

সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে তোমার প্রতি শফিক ভাইয়ের একটা টান ছিল। শফিক ভাই মায়ের অনুজ্জ্বল বান্ধবীর উজ্জ্বল ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকত। প্রায়ই মা তাকে বাসায় ডেকে এনে ভালো-মন্দ খাওয়াত। শফিক ভাই স্মার্ট, প্রাণবন্ত। বইটই পড়ে। সমাজ, রাজনীতি সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে। এ কারণে তাকে তুমি পছন্দ করতে। কিন্তু সেই পছন্দের মধ্যে ভালোলাগা থাকলেও প্রেম ছিল না।

শফিক ভাই এখন একটা ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বেশ গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। তাই তো শফিক ভাই মায়ের কাছে প্রস্তাবটা দেওয়ার পর মা যেন আকাশের তারা হাতে পেল। অথচ মা এত সামান্যতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মানুষ নয়। তবে কি পরিস্থিতি মাকে এতটা বদলে দিয়েছে! মা কেমন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে। মা ভুলেই গেল আনানের সঙ্গে তোমার দীর্ঘ সাত বছরের প্রেম আর এক মাস সতেরো দিনের সংসারজীবন!

>কুয়াশা ক্রমে ঘন হয়ে আসতে থাকে। তুমি জানালায় উদগ্রীব চোখ রাখো। বাইরেটা ধোঁয়াশা। অস্বচ্ছ হয়ে ওঠা জানালার কাচ বেয়ে টপটপ করে নামছে জল। বৃষ্টি না, ঘনঘোর প্রহেলিকা। তোমার মনে হতে থাকে, যেন হাজার হাজার বাদুড় দল বেঁধে কালো অন্ধকারে ঢেকে ফেলছে আকাশটা। আর সেই অন্ধকার যেন ক্রমে গ্রাস করে নিচ্ছে তোমার সবকিছু—জীবনের যত হাসি, উচ্ছ্বাস, কোলাহল, প্রেম। তুমি ক্রমাগত ফোনে আনানকে পাওয়ার চেষ্টা করে যাও।

হ্যাঁ, তোমার প্রেমিক বলো, বন্ধু বলো বা বর—যা-ই বলো না কেন, সব তো ছিল আনান। বিয়েও হয়েছিল দুই পরিবারের সম্মতিতেই। কিন্তু বিয়ের এক মাস সতেরো দিনের মাথায় ঘটল ঘটনাটা। ঘটনা না দুর্ঘটনা। অথবা তোমার জীবনে তার চেয়ে আরও বেশি কিছু। ব্যাবসার কাজে আনানকে সেদিন চিটাগাং যেতে হয়েছিল। এর এক দিন পর হানিমুনে তোমাদের ইন্দোনেশিয়া যাওয়ার কথা। আনান তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে রাতেই ফিরে আসছিল। তুমি বারবার তাকে সতর্ক করেছিলে, সেদিনই ফেরার দরকার নেই। এতটা পথ ড্রাইভিং করে যাওয়া-আসায় ড্রাইভারের ওপর বাড়তি স্ট্রেস পড়তে পারে, সে চলতে চলতে ঘুমিয়েও পড়তে পারে।

কিন্তু আনানের এই স্বভাবের কথাও তুমি জানতে, সে বেপরোয়া, একগুঁয়ে। আর এই সবকিছু মিলিয়েই যে মানুষটা, তাকেই তুমি ভালোবাসতে, ভালোবাসো।

তারপরও তোমার সব আশঙ্কা যে এভাবে সত্য হয়ে যাবে! সে রাতে ভেতরে–ভেতরে এক প্রচণ্ড অস্থিরতা গ্রাস করে ফেলে তোমাকে। এমন অস্বস্তি তোমার ভেতরে তখনই হয়, যখন তুমি অশুভ কোনো কিছুর ইঙ্গিত পাও। কুয়াশা ক্রমে ঘন হয়ে আসতে থাকে। তুমি জানালায় উদগ্রীব চোখ রাখো। বাইরেটা ধোঁয়াশা। অস্বচ্ছ হয়ে ওঠা জানালার কাচ বেয়ে টপটপ করে নামছে জল। বৃষ্টি না, ঘনঘোর প্রহেলিকা। তোমার মনে হতে থাকে, যেন হাজার হাজার বাদুড় দল বেঁধে কালো অন্ধকারে ঢেকে ফেলছে আকাশটা। আর সেই অন্ধকার যেন ক্রমে গ্রাস করে নিচ্ছে তোমার সবকিছু—জীবনের যত হাসি, উচ্ছ্বাস, কোলাহল, প্রেম। তুমি ক্রমাগত ফোনে আনানকে পাওয়ার চেষ্টা করে যাও। কিন্তু নেটওয়ার্কের জটিলতা, কুয়াশাপূর্ণ রাত, বেপরোয়া যান সব সতর্কতা এক লহমায় গিলে খেয়ে ফেলে। অবশেষে তোমার জীবনে আসে সেই ভোর, যে ভোরে সূর্যের দেখা মেলে না।

চাপা কান্না, ফিসফাস, আনানের অতি প্রেম, গোঁয়র্তুমি, বিরূপ প্রকৃতি, বেপরোয়া ট্রাক, নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি—এমন অসংখ্য শব্দ জট পাকিয়ে আবর্তিত হতে থাকে তোমাকে ঘিরে।

কিন্তু এই সবকিছুর ভেতরেও তুমি গভীর বিস্ময়ে দেখো আনানকে। সে বেঁচে আছে। সে তোমাকে ছেড়ে চলে যায়নি। যেতে পরত। কোনো কিছু না বলে বিনা নোটিশে তো চলে যায় অনেকে। কিন্তু আনান ফিরে এসেছে তোমার কাছে। ও শুধু তোমার জন্যই ফিরে এসেছে।

হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে শুয়ে আছে আনান। ওর কোনো সংবিৎ নেই তখন। তা-ও তো ফিরে আসা!

যদিও দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই কোমায় চলে গিয়েছিল আনান, তারপরও প্রতি মুহূর্তে তুমি ভাবতে এই এক্ষুনি আনান উঠবে। উঠেই বলবে, ‘তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও তো, সাজগোজ করতে একদম সময় নিবা না, আমরা এক্ষুনি বের হব।’

এই ভাবনা হয়তো তোমার মধ্যেই শুধু ছিল। তাই বাকি সবাই ধীরে ধীরে যখন হাল ছেড়ে দিচ্ছিল, তোমার লড়াইটা জারি ছিল। আর তোমার লড়াইটা আনানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আরও এক বছর চৌত্রিশ দিন। আনান যেমন বেঁচে থাকার জন্য লড়েছে, তার চেয়ে বেশি লড়াই ছিল তোমার ওকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আনানকে নিয়েই বেঁচে থাকতে চেয়েছ তুমি, আনানকে নিয়েই বেঁচে আছ।

অথচ তোমার চারপাশ তোমাকে বাঁচতে দেবে না। তারা বাঁধভাঙা জলের মতো তোমার ভেতরে ঢুকে পড়তে চায় কুলকুল করে। সহানুভূতির, কামের, করুণার ডালা সাজিয়ে হাজির হতে থাকে তোমার সামনে। যেন তুমি একটা কলের পুতুল। সব থেকেও যেন কিছুই তোমার নেই।

তোমার সৌন্দর্য তোমাকে গিলে খাচ্ছিল। তোমার তারুণ্য সবার মনদাহের কারণ হয়ে উঠল। ঘরে-বাইরে কোথাও তোমার একদণ্ড স্বস্তি নেই।

আর সেই সব অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেতে বা সবাইকে মুক্তি দিতেই একদিন শফিক ভাইয়ের প্রস্তাবটাই গ্রহণ করে নিলে তুমি। কিন্তু সেই মেনে নেওয়ার মধ্যে যেন একটা কঠিন পহাড় চেপে বসেছিল। তাকে অতিক্রম করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না তোমার পক্ষে। আর তাই তো তোমার বারবার মনে হচ্ছিল, একটা ধারালো তলোয়ার দিয়ে তোমাকে কেউ দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তোমার চারধার। কিন্তু সে রক্ত দেখার মতো কেউই নেই। ঠুলি পরা চোখে ওই রক্ত দেখাও যায় না।

আর সেই দ্বিখণ্ডিত দেহের এক খণ্ডে পড়েছিল তোমার মন, অন্য খণ্ডে শরীর, যা যৌবনের জৌলুশ ছাড়া অন্য কোনো চি‎হ্ন বহন করে না।