জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ও জেরিকো ব্রাউনের একটি কবিতা

জর্জ ফ্লয়েডকে স্মরণ করে ফিলিস্তিনির গাজায় দেয়ালে ম্যুরাল আঁকছেন আইমান আল-হুসারি। ছবি: এএফপি
জর্জ ফ্লয়েডকে স্মরণ করে ফিলিস্তিনির গাজায় দেয়ালে ম্যুরাল আঁকছেন আইমান আল-হুসারি। ছবি: এএফপি

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু সম্পর্কে জেরিকো ব্রাউন

মিনিয়াপোলিসে গত ২৫ মে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ প্রকাশ্যে মেরে ফেলার পর পুলিৎজারজয়ী কবি জেরিকো ব্রাউনের ‘বুলেট পয়েন্টস’ কবিতাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে চালাচালি হয়। এখনো কবিতাটি ভাইরাল হচ্ছে। এর কারণ হলো, এই কবিতায় আফ্রিকান-আমেরিকান নাগরিকদের ওপর পুলিশের নির্যাতনের বিষয় উঠে এসেছে। ব্রাউনের ‘দ্য ট্র্যাডিশন’ কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটি কয়েক বছর আগে লেখা হলেও তা এখন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে অর্থাৎ চলতি বছরেই কাব্যগ্রন্থটি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে। ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ও ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ডের চূড়ান্ত তালিকায়ও কাব্যগ্রন্থটি স্থান পেয়েছিল।


‘বুলেট পয়েন্টস’ কবিতাটি সম্পর্কে কবি জেরিকো ব্রাউন (তিনি বর্তমানে ইমোরি ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন) গত ৫ জুন সিবিসি রেডিওকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘একের পর এক পুলিশি হেফাজতে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আত্মহত্যার কথা এই কবিতাটি লেখার সময় আমার মনে এসেছিল। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে উত্তর ক্যারোলাইনায় জেসাস হুয়ের্তা নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের গাড়িতে করে পুলিশ স্টেশনে নেওয়া হচ্ছিল। গাড়ির মধ্যেই সে যে কোনোভাবে পুলিশের পিস্তল নিয়ে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে মারা গিয়েছিল। ২০১৪ সালের আগস্টে লুইজিয়ানায় ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনায় পুলিশ ভ্যানে পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় ভিক্টর হোয়াইট থ্রি নামের ২২ বছর বয়সী এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পুলিশের ভাষ্য, পুলিশের পিস্তল নিয়ে তিনি নিজেই নিজের পিঠে গুলি করেছিলেন। এরপরের ঘটনা টেক্সাসে। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে স্যান্ড্রা ব্ল্যান্ড নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণীর সঙ্গে একজন ট্রাফিক পুলিশের বচসা হয়। স্যান্ড্রাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। তিন দিন পর পুলিশ জানায়, স্যান্ড্রা হাজতের ভেতরে একটি ট্র্যাশব্যাগের দড়ির সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। স্যান্ড্রার সঙ্গে পুলিশের বাতচিত, তাঁকে হাজতে নেওয়া ও তাঁর মৃতদেহ হাজত থেকে বের করার বেশ কিছু ভিডিও তখন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ায় অনেক বিক্ষোভ হয়েছিল।’


কবি জেরিকো ব্রাউন বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি এই কবিতাটি আসলে আমার মায়ের কথা চিন্তা করে লিখেছিলাম। কখনো যদি আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় এবং তাদের হেফাজতে যদি আমার লাশ পাওয়া যায় তাহলে কেউ যেন বিশ্বাস না করে আমি আত্মহত্যা করেছি। আমি আমার পরিবারকে এবং অন্য সবাইকে বলতে চেয়েছি, তারা যেন বুঝে নেন আমাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি এই কবিতার মধ্য দিয়ে বলতে চেয়েছি, আমি যদি পুলিশ হেফাজতে আত্মহত্যা করেও ফেলি তারা যেন আমার এই কাজে অবাক না হয়। অর্থাৎ এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আমি থাকব যেখানে এ ছাড়া আমার করার কিছুই ছিল না বলে যেন তারা ধরে নেন।


জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর বিষয়ে কবি জেরিকো ব্রাউন বলেন, ‘জর্জ ফ্লয়েডের ভিডিওটা চারপাশে ঘুরছে। আমি প্রাণপণে ভিডিওটা শেষ পর্যন্ত না দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখন দেখলাম একজন পুলিশ কর্মকর্তা দুই হাত পকেটে পুরে একেবারে আয়েশি ভঙ্গিতে জর্জের গলা হাঁটু দিয়ে চেপে বসে আছে তখন আর না দেখে পারিনি। ওটা দেখে মনে হলো, এই যুক্তরাষ্ট্র একটা পুলিশি রাষ্ট্র। এখানে আমাদের গলার ওপর পুলিশ হাঁটু চেপে বসে আছে। যিনি দৃশ্যটি ভিডিও করছিলেন, তিনি বলতে পারতেন ‘‘ওকে ছেড়ে দিন, লোকটা মারা যাচ্ছে।” কিন্তু তিনি তা বলতে পারেননি, কারণ তাঁকে বাঁচাতে গেলে তাঁর জীবনও হুমকির মুখে পড়ে যেতে পারত। ফলে সেই হত্যাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা ছাড়া কারও কিছুই করার ছিল না। আপনি ভিডিওটা খেয়াল করে দেখলে দেখবেন, অফিসারটি এমনভাবে দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটু চেপে ধরে আছে যেন তাঁর পায়ের নিচে কে মারা যাচ্ছে সেটি তাঁর কাছে কোনো ব্যাপারই না। অর্থাৎ ওই অফিসার তাঁর নিজের রক্ষাকবচ সম্পর্কে এতটাই নিশ্চিত যে কোনো ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। সবাই জর্জ ফ্লয়েডের মারা যাওয়া নিয়ে কথা বলছে। আর আমি ভাবছি, বেঁচে থাকলে হাজতে তিনি কোন মানসিক অবস্থায় থাকতেন।’

জেরিকো ব্রাউন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিনিয়ত কৃষ্ণাঙ্গদের পুলিশের ভয় নিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। আমি পুলিশকে মোটেও বিশ্বাস করি না।পুলিশের বিষয়ে আমার কোনো ভালো ধারণা নেই। আমার সঙ্গে বহুবার পুলিশ অমানবিক আচরণ করেছে। আমার নিজের আঙিনায় ঢুকে পুলিশ আমাকে ফলো করেছে। একবার আমাকে গাড়ির ওপরে ছুড়ে মেরেছে। এসবের জন্য এমন কোনো উসকানি আমার দিক থেকে ছিল না। কিন্তু আমরা যারা কৃষ্ণাঙ্গ এই দেশে বাস করছি তাঁদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত এমন আচরণ করা হয়।’

জেরিকো ব্রাউন
জেরিকো ব্রাউন


জেরিকো ব্রাউনের কবিতা
বুলেটের মুখে

নিজের মাথা তাক করে আমি চালাব না গুলি
নিজেরই পৃষ্ঠদেশে আঁকব না বুলেটের চুম্বন
ময়লার ব্যাগের সাথে ফাঁস লটকে মরব না কোনো দিন
কিরে কেটে বলছি, এসব করব না আমি।

যদি বা করেই বসি
অন্তত পুলিশের ভ্যানে হ্যান্ডকাফ পরা অবস্থায় নয়
অথবা এমন কোনো শহরের জেল–সেলে বসে নয়
বাড়ি ফেরার সময় যে শহর ডিঙাতেই হয় বলে নামটাই শুধু তার জানি।

হ্যাঁ, জানি হয়তো ঝুঁকিতে আছি খুব
তবু হলফ করেই বলি শোনো—
আমার ঘরের মেঝের নিচে যে শবখেকো কীটের আবাস,
গলা লাশ খুবলে খাওয়া যার নিয়তস্বভাব, তাকেও ঢের বেশি
বিশ্বাস করি আইনের মারপ্যাঁচজীবী সেই অফিসারের চেয়ে—
পুরোহিতের মতো আমার চোখ চিরতরে মুদিয়ে দেওয়া
কিংবা আমাকে যে ধবধবে কাপড় পরিয়ে দেন মা
সে রকম চকচকে কাফনে আমার নিঃসাড় দেহ মোড়ানোই যার কাজ।
 
বরং আত্মঘাতী হতে হলে সেই পথই বেছে নেব
যেই পথে অধিকাংশ আমেরিকান মরে যায়।
কথা দিচ্ছি সেই পথ বেছে নেব:
মরে যাব সিগারেটে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায়
নয়তো মাংসের টুকরো গলায় আটকে মরে যাব।
অথবা নিকৃষ্টতর শীতের কাঁপানো ঠান্ডায়
জমে মরে যাব।
 
হলফ করেই বলি শোনো—
যদি শোনো কোনো দিন কোনো পুলিশের আশপাশে মৃত্যু হয় আমার
নিশ্চিত জেনো, আমার ঘাতক ছিল সে-ই।
বুঝে নিয়ো আমাদের মাঝ থেকে সে আমাকে তুলে নিয়ে শবদেহ ফেলে রেখে গেছে।
 
যতই শেখানো বুলি আওড়ানো হোক
জেনে রেখ ছেলেহারা মায়ের অশ্রুরোধে  
এ শহর যে ক্ষতিপূরণ দেবে তার চেয়ে প্রাণহীন সে দেহের দাম অনেক অধিক।
যতই শেখানো বুলি আওড়ানো হোক  
জেনে রেখ—
পরত পরত মগজের গহিন থেকে বড়শির আংটায় তুলে আনা
চকচকে বুলেটের জেল্লার চেয়ে পড়ে থাকা সেই দেহ ঢের বেশি সুন্দর।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]