হাসান হাফিজুর রহমান : ধ্রুপদি বুদ্ধিজীবিতা

>বিশুদ্ধ কবিতা, শুদ্ধ নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদির প্রলোভন তাঁকে তাড়িত করেনি। বরং কবিতা, আধুনিকতা ও আত্মপরিচয়ের জটিল ও বহুমুখী সম্পর্ককে রাজনৈতিকভাবে বুঝতে চেয়েছেন। এ রাজনীতি কেমন? নিঃসন্দেহে উদার মানবিকতাবাদী, কিন্তু একই সঙ্গে বি-উপনিবেশী। সামগ্রিকভাবে উপনিবেশবাদী চিন্তার সকল পরিকাঠামোর উচ্ছেদ সাধন নয়, বরং জাতীয়তাবাদের ছক ধরে আরেকটি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা। মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার পথেই হাসান হাফিজুর রহমান এগিয়েছেন সাহিত্য ও কবিতাসমেত।

ইতিহাস কাউকে কাউকে নির্মাণ করে, কেউ কেউ নিজেই হয়ে ওঠে ইতিহাস। ব্যক্তির সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক বেশ জটিল। ইতিহাসের একরৈখিক কোনো ধারা নেই। বহু কণ্ঠে বহু স্রোতে নির্মিত হয় ইতিহাস। তবু কখনো কখনো কোনো কোনো ব্যক্তিনাম ইতিহাসে স্মারকচিহ্ন হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে এমন ব্যক্তিত্বের হদিস নিতে গেলে হাসান হাফিজুর রহমানের খোঁজ পড়বেই। প্রকৃতপক্ষে খোঁজ না নিয়ে উপায় নেই। সতচল্লিশ-উত্তর পূর্ব বাংলায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে চৈতন্য গড়ে উঠেছিল তাঁর সঙ্গে ঘোরতরভাবে যুক্ত হাসান হাফিজুর রহমান। 

জাতীয়তাবাদের বিকাশে মধ্যবিত্তের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ভূমিকা থাকে। সে ভূমিকায় নেমেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা নতুন এক জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকেছে। তাঁদের রাজনৈতিক কল্পনা পূর্বের জাতীয়তাবাদী আয়োজনকে প্রত্যাখ্যান করে নতুন শাখায় নতুন নদীর মতো এগিয়ে গিয়েছে। উনিশ শতকে বাঙালিরা যখন জাতীয় চেতনা পরিকাঠামো প্রস্তুত করছে তখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী অংশ। আবার ১৯০৫-এ তৈরি হওয়া জাতীয় চেতনাকে মুসলমানরা সন্দেহ ও প্রত্যাখ্যানের ভাষা দিয়ে এড়িয়ে চলেছে। সত্যিকার অর্থে হিন্দু ও মুসলমানের রাজনৈতিক বাসনা দুই ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় কল্পনায় আটকে পড়েছিল। ধর্ম ও রাজনীতির মর্মান্তিক সম্পর্কের পুনর্বিচার করতে পেরেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। 'আরও দুটি মৃত্যু' নামের অসামান্য গল্পে সেই স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। এ গল্পে দেখা যাচ্ছে, প্রসববেদনায় কাতর এক হিন্দু নারী গর্ভের সন্তানসহ মারা পড়েছেন ট্রেনের প্রক্ষালন কক্ষে। কেউ এগিয়ে আসেনি ভয়ে, সন্দেহে। আসলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিষময়তায়।

হাসান হাফিজুর রহমানদের প্রজন্ম গড়ে উঠেছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব মুহূর্তে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাঁদের ক্ষণিক বাসনার ছায়াপাত ঘটলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন, 'আসসালামু ওয়ালাইকুম পাকিস্তান।' আর তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটল। ধাবিত হলেন নতুন রাষ্ট্রবাসনা নিয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রকল্পনার দিকে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবি-লেখকদের অনেককেই এই পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে পুরোপুরি মিলিয়ে পড়তে হবে। নয়তো ভুল বিচার, অপ-সমালোচনার খপ্পরে পড়ে এঁরা কাটা পড়তে পারেন। অথচ সে কালে তাঁরা যথাযোগ্য মর্যাদার নায়কই ছিলেন। এক্ষেত্রে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান--এই দুজনের নাম আমি বিশেষভাবে নেব। কারণ দুজনের কবিতা সম্পর্কে অনেকেরই একটু নাক-উঁচু করা উপেক্ষা আছে।

হাসান হাফিজুর রহমান। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
হাসান হাফিজুর রহমান। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

এই উন্নত নাসিকার মর্মার্থ আর কিছুই না, কবিতাকে পরিমাপ করার একটি-মাত্র মাপকাঠিই তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, সেটি--শিল্পতাত্ত্বিক ও সৌন্দর্যতাত্ত্বিক। এ কারণে আলোচনা করার সময় তাঁরা বিবেচনা করেন কোন উক্তিটি ভাষাগতভাবে কতখানি নতুন, চিত্রকল্পের অভিনবত্বে কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ কিংবা ভাষার সামগ্রিক রূপ-অবয়ব কতখানি পূর্বসূরিবিহীন। বিষয়টি অনেকখানি উকিলের কাছে বৈদ্যের কাজ দাবি করা, বৈদ্যের কাছে উকিলের কাজ দাবি করা। অর্থাৎ যাঁর যাঁর কাব্যতাত্ত্বিক অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির যথাযথ বিবেচনা না করা।

হাসান হাফিজুর রহমানের কবিতা এবং অন্যান্য লেখালেখি নিয়ে তেমন একটি দৃষ্টিভঙ্গিই কাজ করে বলে আমার কাছে মনে হয়। বিচার-বিশ্লেষণের সময় ভুলে যাওয়া হয়, ভাষা ও শৈলির অকল্পনীয় অভিনবত্বই কবিতা বিচারের একমাত্র দাঁড়িপাল্লা নয়। নন্দনতত্ত্ব ও শিল্পতত্ত্ব মোটেও ভাষার রাজনীতি-বহির্ভূত ব্যাপার নয়। হাসান হাফিজুর রহমানদের প্রজন্মের একটি অংশ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়েছিলেন বোদলেয়ার-এলিয়টের দিকে, আরেক অংশ তাকিয়ে ছিলেন চলমান ভাষা-রাজনীতি, জাতীয়তা, জাতীয়তাবাদের দিকে; কবিতা ও সাহিত্যকে প্রায় পরিপূর্ণভাবে রাজনীতির অংশ করে তুলেছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন সাহিত্য হয়ে উঠুক ব্যক্তিক ও সামষ্টিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ। আর তাই কবিতার আধুনিকতা প্রসঙ্গেও নতুন করে ভাবতে হয়েছে। সম্ভবত হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর দশকের একমাত্র কবি যিনি আধুনিকতা ও আত্মপরিচয়কে তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিকভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে লেখা তাঁর দীর্ঘ বই 'আধুনিক কবি ও কবিতা' তার প্রমাণ।
লুই আলথুসারের ধারণা নিয়ে বলা যায়, হাসান হাফিজুর রহমানেরা ছিলেন 'ইডিওলজিক্যাল স্টেইট অ্যাপারেটাসে'র বিপরীত উচ্চারণ। আলথুসার দেখিয়েছিলেন রাষ্ট্র কী করে ভাবাদর্শ উৎপাদনের কারখানা প্রতিষ্ঠা করে, জ্ঞান, বিদ্যা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি উৎপাদনের প্রতিষ্ঠান ও সংঘগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বলেছিলেন, ভাবাদর্শ প্রচারের মাধ্যম। প্রশ্ন হলো, হাসান হাফিজুর রহমানদের সময় রাষ্ট্র কোন ধরনের ভাবাদর্শের প্রচার করত? সে কথা সবারই জানা--এক শব্দে বললে তা হয় 'পাকিস্তানবাদ'। এই গুপ্ত ও প্রকাশ্য ভাবাদর্শের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠা এবং জনগণকে ভাবদর্শিকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও শাসন করা। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত নেমে আসার কারণ নিঃসন্দেহে এখানেই নিহিত। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা রাষ্ট্র-পরিচালিত নিয়ন্ত্রণ ও ভাবাদর্শের বিপরীতে ভিন্ন বক্তব্য দাঁড় করিয়েছে এবং তার প্রচার করেছে। হাসান হাফিজুর রহমানের লেখালেখি সেই জাতীয়তাবাদী কর্তব্যের অংশ। 'দাঙ্গার পাঁচটি গল্প', 'একুশে ফেব্রুয়ারি' সংকলন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র'সহ তাঁর সমস্ত লেখালেখি এই কর্তব্যের অধীন।

হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’

বিশুদ্ধ কবিতা, শুদ্ধ নন্দনতত্ত্ব ইত্যাদির প্রলোভন তাঁকে তাড়িত করেনি। বরং কবিতা, আধুনিকতা ও আত্মপরিচয়ের জটিল ও বহুমুখী সম্পর্ককে রাজনৈতিকভাবে বুঝতে চেয়েছেন। এ রাজনীতি কেমন? নিঃসন্দেহে উদার মানবিকতাবাদী, কিন্তু একই সঙ্গে বি-উপনিবেশী। সামগ্রিকভাবে উপনিবেশবাদী চিন্তার সকল পরিকাঠামোর উচ্ছেদ সাধন নয়, বরং জাতীয়তাবাদের ছক ধরে আরেকটি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা। মূলত বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার পথেই হাসান হাফিজুর রহমান এগিয়েছেন সাহিত্য ও কবিতাসমেত।

পঞ্চাশের কবিতায় যে নৈরাশ্যের স্তবগান শোনা গিয়েছিল তা থেকে বাইরে যেতে চেয়েছিলেন তিনি; যদিও প্রথম বইয়ের নাম 'বিমুখ প্রান্তর', কিন্তু উচ্চারণ একদমই বিমুখতা-বিবর্জিত, 'মরা মাটি ফুঁড়ে ওঠে জীবনের কায়া/ হলুদ বসন্ত ওরে দেখা দিবি নাকি।' কিন্তু কী গড়তে চান সবটা মিলিয়ে? কোন বসন্তের হোলি খেলায় মত্ত হতে চান তিনি? আমি বলব, 'দেশ'। দেশ-কল্পনাই তাঁর কবিতার প্রাণভোমরা। 'আমর একুশে' কবিতায় যেমন বলছেন, 'হে আমার দেশ, বন্যার মতো/ অভিজ্ঞতার পলিমাটি গড়িয়ে এনে/ একটি চেতনাকে উর্বর করেছি...'। চেতনার উর্বর জমিনে লেখা হয়েছে বাংলাদেশের নাম। এ কারণে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কালসীমাকে বলেছেন, 'ফ্যারাউনের আয়ুর শেষ কটি বছর'। যেন বুঝে ফেলেছিলেন মুক্তি আসবেই, শেকল ভাঙবেই। এই সম্ভাবনাকে বুঝতে পারা কবিরই কর্তব্য। কেননা পুরনো আপ্তবাক্য সত্য করে দিয়ে কবি তো বরাবরে মতোই দ্রষ্টা।

হাসান হাফিজুর রহমান দেশ-দর্শনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন অ্যাক্টিভিজম বা সক্রিয়তাকে। এ কালের সাপেক্ষে তাঁকে হয়তো নন-কনফর্মিস্ট বুদ্ধিজীবী বা লেখক বলা চলে না। কিন্তু তখনকার সাপেক্ষে ভাবা যাক, জাতীয়তাবাদের ধ্রুপদি বুদ্ধিজীবিতায় তাঁর অংশগ্রহণ ও কাজগুলো বিবেচনা করা যাক, দেখা যাবে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকছেন বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। বাঙালির সংজ্ঞার্থ বদলের এই সময়ে জরুরি কর্তব্য হয়ে দেখা দিয়েছিল ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, সাংস্কৃতিকভাবে রাষ্ট্র-প্রদর্শিত নিশানার বাইরে অবস্থান করা। যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য হাসান হাফিজুর রহমান তারুণ্য ও যৌবন খরচ করেছিলেন তাঁদের উত্তরসূরি হিসেবে আমরা কী নেব তাঁর কাছ থেকে? কবিতা, রাজনীতি, স্পর্ধ, সাহস? আমি মনে করি, এই সময়ে আজ আমাদের মধ্যে সাহসের ঘাটতিই বেশি খোলামেলাভাবে ধরা পড়ছে। সাহিত্যের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে ইডিওলজিক্যাল স্টেইট অ্যাপারেটাসের বিরুদ্ধে সমালোচনার যুক্তি খুঁজতে, প্রতিরোধের নন্দনতাত্ত্বিক প্রণোদনা খুঁজতে হাসান হাফিজুর রহমানের জীবন ও কাজের কাছে ফিরে যেতে পারি আমরা।