আমি ও একজন কাজী আনোয়ার হোসেন

পাঠক তৈরিতে কাজী আনোয়ার হোসেন ও সেবা প্রকাশনীর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। ছবি: অন্য আলো
পাঠক তৈরিতে কাজী আনোয়ার হোসেন ও সেবা প্রকাশনীর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। ছবি: অন্য আলো

একসময় সেবা প্রকাশনীর অজস্র বই অনুবাদ-রূপান্তর করেছেন রওশন জামিল। মাসুদ রানা বিতর্কের প্রেক্ষাপটে কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে তিনি লিখেছেন তাঁর অনুভবের কথা।

আনিস, মানে কীর্তিমান লেখক-সাংবাদিক আনিসুল হক, সেদিন হঠাৎ করেই ইনবক্স করলেন আমার ওপর কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রভাব নিয়ে একটা লেখা যেন তাঁকে দিই। খানিক ইতস্তত করে রাজি হয়ে গেলাম; কাজীদার কাছে অনুবাদক হিসেবে আমার যে ঋণ, তা স্বীকার করার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম সুযোগ আর হয় না।

কাজীদা—বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্য ও প্রকাশনাশিল্পের প্রবাদপুরুষ কাজী আনোয়ার হোসেনর সঙ্গে আমার সম্পর্ক চল্লিশ বছরের ওপর, গত শতকের সাতের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, প্রেসক্লাবের টেবল টেনিস রুম আর ব্যাডমিন্টন কোর্টে, আমি বলের পেছনে দৌড়াই আর কাজীদা চ্যাম্পিয়ন, ‘রানা’ বেরোলেই প্রচ্ছদের ওপর নিজের নাম সই করে আমাকে এক কপি দিচ্ছেন।

শুধুই কি এই, সম্পর্কটা কি আসলেই চল্লিশ বছরের সামান্য ডানে হেলে! স্মৃতি আঁতিপাঁতি করি, পেছনে যাই, বেশ পেছনে, জুনিয়র হাইস্কুলে পড়ার দিনগুলোয়, ক্লাস সেভেন কি এইটের দিকে, সাতষট্টির শেষাশেষি বা আটষট্টির শুরুতে, যখন বড়দের বইয়ের আলমারির পেছনের কোনো কোনায় লুকানো ‘মাসুদ রানা’ পড়ছি চুরি করে: ‘ধ্বংস-পাহাড়’, ‘ভারত নাট্যম’, ‘স্বর্ণমৃগ’…।

সে কী শিহরণ, এপিফ্যানিই বলা যায় বোধ করি, অ্যারাবির বেদনার্দ্র সলজ্জ সাবালকত্ব প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা নয়, বরং সীমাহীন আনন্দের, চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে এক মায়ার জগৎ, যা স্পর্শ-অসম্ভব দূরবর্তী কল্পলোক নয়—বাস্তব, ধরাছোঁয়া যায়।

এর আগের সময়টায়, ক্লাস টু থেকে ক্লাস সিক্সের শেষ বা সেভেনের শুরুতে, আমাকে ছেঁয়ে ছিল ব্যোমকেশ বক্সী, দীপক চ্যাটার্জি, কিরীটী রায় আর দেবসাহিত্য কুটিরের শিশু-কিশোর সংস্করণে বিশ্ব ক্লাসিকস। ফাঁকে-ফোকরে ‘গল্পগুচ্ছ’, ক্লাস ফোরে পড়ার সময় জন্মদিনে পাওয়া, আর শরৎচন্দ্রের এক-আধটা উপন্যাস। কিন্তু আমার দুনিয়াকে জানার, কল্পনাতে হলেও তাকে চাখবার স্পৃহা মেটাতে পারছিল না ওগুলো, ওই বয়সেই প‍ানসে মনে হচ্ছিল অনেকটা, হয়তো পরিবেশের কারণেই, নিচতলার পড়শির উঠোনে খেলতে গিয়ে শুনছি তাদের ঘর থেকে ভেসে আসা এলভিস প্রিসলি, প্যাট বুন ক্লিফ রিচার্ড—যদিও অনেক পরে আবিষ্কার করব আমার ভেতর একধরনের গল্পকাঠামো ধারণার জন্ম কিন্তু ওরাই দিয়েছিল— যা ‘রানা’য় এসে পেলাম।

বোঝাতে পারলাম কি না জানি না, ওই বয়সে এবং পরেও বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়তে গিয়ে না জীবনের, না আখ্যানের বৈচিত্র্য, যা দুর্মরভাবে কাছে টানে, এমন কিছুই পাইনি, হতে পারে আমারই অক্ষমতা। ‘রানা’র গল্প ছকে বাঁধা কিন্তু টানটান, আপনার স্নায়ুতে ঢিলে পড়ে না। এটা শুধু গোয়েন্দা কাহিনি বলে নয়, বিদেশি অনেক সিরিয়াস গল্প-উপন্যাস, যে ধরনটাকে এ দেশে কেউ কেউ ‘সুসাহিত্য’ বলে খুব খানিক আত্মপ্রসাদ লাভ করে থাকেন, সেগুলোও স্রেফ বর্ণনভঙ্গিমার জন্যই একনিশ্বাসে পড়ে যাওয়া যায়। গার্সিয়া মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’র কথাই ধরা যাক। পড়া শুরু করার পর আপনাকে উঠতে দেয় না, এতই রুদ্ধশ্বাস।

কৈশোরে রোমান্স-রোমাঞ্চের অনুভূতি যেভাবে ডালপালা মেলে, আর কোনো বয়সেই হয়তো সেভাবে নয়।

রানা গোপন মিশনে ঘুরে বেড়ায় দেশ-দেশান্তরে, সঙ্গে আমিও চলি, আড়াল থেকে লক্ষ করি তার দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ড, আর রক্তে অনুভব করি কাঁপন। একটু একটু করে বদলায় আমার জীবনভাবনা, একটা বৈচিত্র্যহীন সমাজসংস্কারের বাঁধন থেকে বেরিয়ে যেন বিশ্বলোক দেখি ‘রানা’র ভেতর দিয়ে। সেই অমরাবতী, যা টানে কিন্তু পুরোপুরি মায়ায় জড়ায় না। শুধু কি আমিই? আরও অনেকেই নন কি? এই প্রজন্ম ’৭১-এরই অনেকে, বিশেষ করে অনলাইনে ‘এ-টিম’ নামে খ্যাত যাঁরা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের কীর্তিকাহিনি মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছেন, প্রত্যেকেই নানা সময়ে বলেছেন দেশের প্রতি তাঁদের এই যে টান, জান বাজি রেখে শত্রুর গোপন কর্মকাণ্ড আলোয় তুলে আনা এ তাঁরা শিখেছেন—‘মাসুদ রানা’র কাছে।