বাবা আমার জীবনশিক্ষক

শিক্ষানুরাগী মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পড়ালেখার সুযোগ নিশ্চিত করাই হয় মা–বাবার একমাত্র চ্যালেঞ্জ। আমি এমন একটি পরিবারের মানুষ, যে শিক্ষার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে এখনো শহুরে সংস্কৃতিতে আগন্তুক। এখানে নেই টেলিভিশনের মতো বহুল প্রচলিত বিনোদনমাধ্যম, কিন্তু আছে সুসজ্জিত বইয়ের তাকে আরেক প্রস্থ সৃজনশীল বই। এ পরিবারে স্কুল ফির অভাব হয়নি কখনো, তবে বাদ গিয়েছে অনেক ঈদের নতুন কাপড় কেনার বাহুল্য। নৌকার গতি নির্ধারণে যে ভূমিকা থাকে মাঝির, আমাদের এ পরিবারে বাবার ভূমিকাও সেটি। বাবাকে জীবনে গরু চরাতে অনেকবার নদীর চরে, খেতে, বিলে যেতে হয়েছে; কিন্তু আমাকে বাবা বই, সংস্কৃতি, মানুষ, সমাজে নিজেকে চরিয়ে নতুন কোনো জ্ঞানার্জনের কথা বলে যান অবিরাম।

মধ্যবিত্ততার ক্লিশে রেখা বাবা–সন্তানের মধ্যে যে একটু দূরত্ব তৈরি করে, তা আমাদের মধ্যে থাকলেও বোঝাপড়াটা চমৎকার। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে শিখেছি মসজিদে যাওয়ার পথ। পথে বিদ্যুচ্চমক কী বৃষ্টি অথবা রোদে বাবাকে দেখেছি পাখির ছানার মতো আগলে নিয়েছেন আমাকে নিজের পাখনাতলে।

প্রতি বৃহস্পতিবার বাবা বাড়িতে আসতেন। পৌঁছে যখন ঘরের কড়া নাড়তেন, তখন প্রায়ই রাতের এক প্রহর পেরিয়ে মধ্যরাত ঘনিয়ে আসত। তবু কেন জানি ওই সব বৃহস্পতিবারে বাবা আসা ছাড়া ঘুম আসত না। দাদি বলতেন, আমি নাকি বাবা আমার জন্য কিছু নিয়ে আসেন কি না, সেই লোভে বসে আছি।

>

আমরা ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে টিনের চালে বৃষ্টির মৃদু সিম্ফনিতে ঘুমিয়ে ছিলাম। যখন জেগেছি, তখন দেখলাম মাথার ওপরের টিনের চালের একটি টিন লাপাত্তা। তবু বাবা আছেন পাশে, আমি নিশ্চিন্ত।

কিন্তু বাবার হাতের ব্যাগের চেয়ে বরং বাবা আসছেন, তাতেই আমি বেশি খুশি। মনে পড়ে সিডরের রাতের কথা, সেদিনও ছিল বৃহস্পতিবার। বাবা ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছিলেন। আমরা ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে টিনের চালে বৃষ্টির মৃদু সিম্ফনিতে ঘুমিয়ে ছিলাম। যখন জেগেছি, তখন দেখলাম মাথার ওপরের টিনের চালের একটি টিন লাপাত্তা। তবু বাবা আছেন পাশে, আমি নিশ্চিন্ত। এভাবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে যখন মাধ্যমিকে পা রাখি, সিদ্ধান্ত হয়, আমাদের বাড়ি থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে বাবার মাদ্রাসায় আমাকে ভর্তি করা হবে। বাবার সঙ্গে আমার নিবিড় জীবনযাপনের শুরু এখানেই। ছোট একটা রুমে বাবার সঙ্গে একজনের বিছানায় দুজনে ভাগাভাগি করে ঘুমানো, বাবা–ছেলের কাঁথা টানাটানি, লজিং বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে আসা ভাত–তরকারি ভাগ করে খাওয়া। বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে এভাবেই চলে বাবা–ছেলের জীবন। আমিও শিশু থেকে কিশোরে পরিণত হই। বছর বছর ‘বাবু কোন ক্লাসে পড়ো?’—এই প্রশ্নের উত্তর বদলায়। একসময় আমি ওই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে অন্য শিক্ষায়তনে ভর্তি হই। তত দিনে বাবার থেকে শিখে গেছি আদর্শ, জ্ঞান আর জীবনযাপনের প্রক্রিয়া।

আমার বাবা শুধু আমার শ্রেণিশিক্ষক নন, তিনি আমার জীবনশিক্ষক। জীবনের প্রতিটি বাঁকে আমাকে দিয়েছেন নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ। ওপর থেকে পথ দেখিয়েছেন নক্ষত্রের মতো। মুখ থেকে বলা হয় না কখনো, বাবাকে ভালোবাসি। তবু মন যেন ক্ষণে ক্ষণে বলে, বাবা তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষক।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সদস্য, ঢাবি বন্ধুসভা।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]